![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি অতি সাধারন একজন মানুষ। প্রকৃতিগতভাবে একটু নিঃসঙ্গ ধরনের। এমন কি অনেকের মাঝেও একা। পেশায় একজন চিকিৎসক। মানুষের উপকার হয় এমন যেকোন কাজে আমি আছি। আপনারা ডাকলে ইনশাল্লাহ পাশে থাকব।
কয়েকজন পুলিশ সদস্য যখন ছেলেটাকে ইমার্জেন্সীতে নিয়ে আসে, তখন তার চাহনিতে ছিল অসীম শূন্যতা! মুখে শুধু একটাই কথা, "একটা অপমৃত্যু মামলা কি হবে না?"
"কিছু খেয়েছে কিনা বুঝতে পারছিনা ডাক্তার সাহেব, একটু দেখুন তো।"
বললাম, "কি ঘটনা খুলে বলুন দেখি।"
"ঘন্টা দুয়েক আগে থানায় এলো। বলে একটা অপমৃত্যু মামলা করতে চায়! ১৭/১৮ বছরের ছেলে, কিসের কি মামলা করতে চায়, সন্দেহ হল।
জেরা করলাম, কে মারা গিয়েছে, কে মেরেছে, কার বিরুদ্ধে মামলা করতে চায়, এসব বিষয়ে। কেমন উল্টোপাল্টা বলতে লাগল।
বাসার ঠিকানা, নাম বলল না।
অনেক জেরা করেও কিছু বের করতে না পেরে, অসুস্থ বা কিছু খেয়েছে কিনা সন্দেহে আপনার কাছে নিয়ে এলাম।
একটু দেখুন তো।
যা দিনকাল পড়েছে, এই বয়েসী ছেলেমেয়েদের ড্রাগ এডিকশনের হার তো দিন দিন বেড়েই চলেছে।"
"কি নাম তোমার বাবু?" জিজ্ঞেস করলাম।
উত্তর নেই।
চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ। দু'চোখে রাজ্যের শূন্যতা।
বেড এ শুইয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছেনা।
কোন স্পেসিফিক সাবস্টেন্স এবিউজ বলেও মনে হচ্ছে না।
কিছুক্ষন অবজার্ভেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রুম থেকে চলে আসব, এমন সময় আমার দিকে চেয়ে বলে উঠল,
"ভাইয়া, একটা অপমৃত্যু মামলাও কি হবে না?"
আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, কাধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কিসের অপমৃত্যুর মামলা, কেন?"
"একটি স্বপ্নের অপমৃত্যুর জন্য মামলা ভাইয়া!"
ভাবলাম, আবার উল্টোপাল্টা বলতে শুরু করে দিয়েছে।
বললাম, "কি স্বপ্ন, কার স্বপ্ন? খুলে বল ভাই।"
"আমার স্বপ্ন, আমার বাবার স্বপ্ন, আমার মায়ের স্বপ্নের মৃত্যুর জন্য মামলা করতে চাই। আমার মত হাজার হাজার নিরীহ ছেলেমেয়ের একমাত্র স্বপ্নের অপমৃত্যুর বিচার চেয়ে মামলা করতে চাই। প্রশ্ন ফাস করে দিয়ে আমাদের মেডিকেলে পড়ার অধিকার, চিকিৎসক হতে পারার অধিকার যারা কেড়ে নিয়েছে, তাদের বিচার চাই। এই মানুষরূপী জানোয়ারগুলোর বিরুদ্ধে একটা মাত্র অপমৃত্যু মামলা করতে চাই। একটি স্বপ্নের অপমৃত্যুর জন্য বিচার চেয়ে মামলা।"
ইতিমধ্যে কথোপকথনের সাড়াশব্দ পেয়ে কর্তব্যরত পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছেন আমার পাশে। তার দিকে চেয়ে ছেলেটা বলে চলেছে, "...পুলিশ সাহেব, আপনাদের থানায় তো হাজার হাজার মামলা আছে, লাখ খানেক এফ আই আর আছে হয়ত। আর একটা নিতে কি খুব বেশী কষ্ট হবে? কয়েক পিস সাদা কাগজই তো লাগবে, আমিই না হয় লিখে দিলাম, আপনি বলবেন কিভাবে লিখব। তবু মামলাটা নিন। আমার স্বপ্নের অপমৃত্যুর যন্ত্রনা যে আমি বইতে পারছি না!"
আমি কি বলব, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। পুলিশ সদস্যদের দিকে চেয়ে দেখি একজনের চোখের কোনে জল!
ছেলেটাকে স্বান্তনা দিতে গিয়ে বললাম, "ভাই, আল্লাহ হয়ত তোমার জন্য আরো ভাল কিছু রেখেছেন, তুমি হতাশ হয়ো না।"
বলল, "ভাই, মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাইনি বলে তো কাদছি না। কাদছি, একটা অন্যায়ের কাছে, অন্যায়ের প্রশ্রয়ের কাছে হেরে গিয়েছি বলে!"
আর কোন উত্তর দিতে পারলাম না।
একটা ঘুমের ঔষধ দিয়ে ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। ভোর হতে আর ঘন্টা দুয়েক বাকি।
পুলিশ চলে গেছে।
আমি ইমার্জেন্সীতে বসে আছি একা। চোখে অসীম শূন্যতা নিয়ে।
ছেলেটা ঘুমুচ্ছে, ঘুমোক।
সারা বাংলাদেশ ঘুমুচ্ছে, ঘুমোক।
এই শেষরাতে তারাই হয়ত জেগে থাকে রাত্রির গুহায়, যারা লক্ষ টাকার খেলায় হাজার নয়, লক্ষ নয়, ১৭ কোটি জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছে 'একদল' হায়েনার কাছে, যারা একদিন আপনার আমার চিকিৎসা করবে।
সারা বাংলাদেশ ঘুমুচ্ছে, ঘুমোক।
এই ঘুমই যে তার শেষ ঘুম হতে পারে সে ধারনাটুকুও তার নেই!
আফসোস!!
©somewhere in net ltd.