নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর চাকরি করেছি; অবসর নিয়েছি কর্নেল পদবীতে ২০০৬ সালে। এরপর এযাবৎ প্রিন্সিপাল হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে; এখন অর্কিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা-তে। ‘স্কুল সাইকোলোজি’ নিয়েও কাজ করছি।

আশরাফ আল দীন

কবি, শিক্ষাবিদ ও প্যারেন্টিং এক্সপার্ট

আশরাফ আল দীন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মূল্যবোধের কড়চা

৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫১

মূল্যবোধের কড়চা
আশরাফ আল দীন
বৃষ্টির দিন। ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে হাতে ছাতা নিয়ে বের হলাম। খুব বেশি বৃষ্টি নেই। দুই এক ফোঁটা পড়ছে মাত্র। তবুও ছাতাটা খুলে ধরলাম। একটা মোটর সাইকেল আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। চালক একজন যুবক আর পেছনে হেলমেট মাথায় একজন যুবতী। মেয়েটি খুব স্মার্টলি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "আঙ্কেল, দুই নম্বর রোডটা কোন দিকে?" আমি দেখিয়ে দিলাম। মোটর সাইকেল চলে গেল। ছেলেটি কোন কথা বলে নি, কথা বলেছে মেয়েটি। তা’ছাড়া, দেখে আমার মনে হয়নি তারা খুব ঘণিষ্ঠ হয়ে বসেছে। কেন জানি আমার মনে হলো, এটা "পাঠাও"এর মোটর সাইকেল হবে নিশ্চয়ই। যুবকটি চালক এবং মেয়েটি তাকে ভাড়ায় নিয়ে এসেছে। এরকম নাকি হচ্ছে আজকাল আমাদের ঢাকা শহরে বা আমাদের দেশে। আগে আমার চোখে কখনো পড়েনি। মনে হয় আজকেই প্রথম দেখলাম।

আমাদের কৃষ্টি ও বিশ্বাস অনুযায়ী আমার কাছে ব্যাপারটা যথাযথ মনে হয়নি অর্থাৎ ভালো লাগেনি। আমার মত পুরনো ধাঁচের অনেকেই হয়তো এদেশে এখনো আছেন। আবার অনেকেই আছেন যাঁরা বলবেন, “সমস্যা কোথায়!” সেই সংখ্যা যদিও খুবই কম। আমি সেই বিতর্কে যাচ্ছিনা। তবু, আপনি হয়তো আগবাড়িয়ে বলবেনঃ “মেয়েরা তো আজকাল আর ঘরে বসে নেই! ওদেরও অনেক কাজ আছে ঘরের বাইরে। অনেক রকম জরুরত বা প্রয়োজন আছে। ওদেরও তো চলাচল করতে হবে!” প্রয়োজন হয়তো আছে, কিন্তু সে প্রয়োজন অন্যভাবে কি সমাধা করা যায় না? যেভাবে আগে করা হতো? যেমন ধরুনঃ এই ঢাকা শহরেও রাস্তার পাশেই নানা পদের নতুন নতুন খাবার তৈরী হয় এবং বিক্রীও হয়। অনেকেই তা ভক্ষণ করেন নিরুপায় হয়েই। কেথাও কোথাও অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে রুচিহীনভাবে তৈরী অনেক খাবার ইদার্নিং পাওয়া যাচ্ছে। তাই বলে কি সব খাবারই আমাকে মুখে তুলে নিতে হবে? মান এবং রুচির বিচার বলে কোন কথা নেই? আমার প্রণপ্রিয় মেয়েটাকে কেন আমি ‘জীবনের মান ও রুচি’ শিক্ষা দিতে পারবো না! আমার কথা অত্যন্ত স্পষ্টঃ যে বিশ্বাসে এবং যে মূল্যবোধ নিয়ে আমি বড় হয়েছি সেখানে এই ধরনের অপরিচিত যুবকের সাথে একজন যুবতী যানবাহনে চড়ে গায়ের সাথে গা ঘেঁষে বসে চলাচল করবে, এটা সঠিক বলে মনে করা হয় না। বিশেষতঃ যেখানে কড়া ব্রেক করলে একের উপর অন্যের হুমরি খেয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি সেখানে এধরনের স্বাধীনতাকে গ্রহণ করতে আমার মন চায় না। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার মা-বোনদের সম্মান দেখানোর জন্যে এধরণের সীমারেখা অন্তরে ধারণ করে। আমার ব্যক্তিগত কথা যদি বলি, তবে বলবোঃ আমার তিনটি মেয়ে। আমার বিশ্বাস, ওরা কেউ এইভাবে চলাচল করবে না। কারণ, তেমন মর্যাদায় আমরা তাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

মসজিদের পথে দেখা হলো আমার এক ষাটোর্ধ্ব বন্ধুর সাথে। কথাটা তুলতেই তিনি বললেন, "হ্যাঁ, এমনটা হচ্ছে তো হরহামেশাই! 'পাঠাও' প্রথমে মেয়ে চালক দিয়ে কাজ শুরু করেছিল; এখন মেয়েরা ছেলেদের পেছনে বসে লিফট নিচ্ছে স্বেচ্ছায় এবং গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে অচেনা পুরুষের সাথে। দেখুন তো আজকাল কী অবস্থা হয়েছে সমাজের!" তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করায় আমি বললাম,
: মেয়েদের দোষারোপ করে লাভ নেই। এটা মা-বাবার এবং ব্যাপক অর্থে সমাজের ব্যর্থতা। যে মূল্যবোধে আমরা বিশ্বাস করি তা তাদেরকে আমরা শেখাতে পারি নি।
: মেয়েরা কি এখন আর মা-বাবার কথা শোনে?' তিনি বললেন।
: ছেলে-মেয়েদের কেউই অবাধ্য হয়ে জন্ম নেয় না। আমরা হ্যান্ডলিং করতে জানি না বলেই ওদের কেউ কেউ অবাধ্য হয়ে যায়।' আমি বললাম। আমি জানি আমার বন্ধুর ছেলে মেয়ে দু’জনেই পড়াশোনা ও বিয়েশাদী করে সার্থকভাবে চাকরি ও সংসার করছে এবং অত্যন্ত বাধ্যগত সন্তান তারা, মাশাআল্লাহ।।
: তা ঠিক।' সম্মতি দিলেন তিনি।
: মোট কথা মা-বাবাদের কেউই এর দায় ও দায়িত্ব কোনটাই এড়াতে পারবে না।' আমি বললাম।

এরপর মসজিদে প্রবেশ করলাম, তাই কথা আর বাড়ানো হলো না। পরে আমি এই নিয়ে ভাবছিলাম নামাজের পর একা একা হাঁটতে হাঁটতে। আসলেই কি আমাদের সন্তানরা অবাধ্য হয়ে জন্ম নেয়? যদি তা না হয় তাহলে তাদেরকে 'বাধ্য সন্তান' হিসেবে তৈরি করতে আমরা, বা আমাদের অনেকেই, পারছি না কেন? আমিতো চাইবো আমার সন্তানকে আমার মত এবং আমার চিন্তাধারায় গড়ে তুলতে! এখোন প্রশ্ন হচ্ছে, আমার কাছে ‘আমার চিন্তাধারা’ই যদি স্পষ্ট না হয় তাহলে তার কাছে আমি আমার চিন্তাধারাকে কীভাবে তুলে ধরবো? যদি আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের একটা ‘নিজস্ব মূল্যবোধ’ আছে, লালিত ‘আত্ম-পরিচয়’ আছে তাহলে সে ব্যাপারে তো আমাকেই সর্বপ্রথম সচেতন হতে হবে! এরপর সেটা নিজেকে অনুশীলন বা প্র্যাকটিস করতে হবে এবং সন্তানদের মধ্যে সংক্রমিত করার সার্বক্ষণিক ও আন্তরিক চেষ্টা করতে হবে।এটা তো হীনমন্যতার কিছু নয়! এটা বরং আত্মপরিচয়ের ও গর্বের ব্যাপার। এ নিয়ে অবশ্য অনেক সময়ই, মূল্যবোধের পার্থক্য ও তারতম্যের জন্য, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও মন কষাকষি হয়, ভুল বোঝাবুঝি হয়, জানি। সেখানেও সমঝোতার এবং সঠিক মোটিভেশনের বিশেষ প্রয়োজন আছে। আমি বলছি না, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ! এই সিদ্ধান্ত ব্যক্তিকেই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কোন ভাবেই স্ববিরোধিতার মধ্যে থাকা যাবেনা, এবং স্ববিরোধিতার মধ্যে জীবন যাপনের ফল কখনো সুখপ্রদ হবে না। আমি নিজের জন্য যে চিন্তা ও মূল্যবোধকে গ্রহণ করতে চাই সেটাকেই সযত্নে শেয়ার করতে হবে এবং লালন করতে হবে আমার পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্মের সাথে। পারিপার্শ্বিক বিপরীত পরিবেশকে কবুল করে নিয়ে আমাদেরকেই ব্যক্তিগতভাবে ও পারিবারিকভাবে সেই মূল্যবোধকে ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং মগজে ঢুকিয়ে নিতে হবে। তা নইলে ফলশ্রুতিতে যা কিছু আমার অপছন্দের তা'ও আমাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হবে! তখোন আক্ষেপ করে কোন ফায়দা হবে না বরং নিজেরাই অপাংক্তেয় হয়ে দূরে ছিটকে পড়বো, পরিত্যক্ত হবো।

আমাদের সমাজে বর্তমানে অনেক মাতাপিতাই অসহায় হয়ে পড়েছেন নিজেদের সন্তানকে বা সন্তানদের নিয়ে। অনেকের কাছেই তাদের এককালের প্রাণপ্রিয় সন্তান এখোন বোঝা হয়ে গেছে। তাদেরকে না তারা ছেড়ে দিতে পারেন, না তারা হজম করতে পারেন! সমস্যাটা কোথায়? যদিও এই সমস্যার নানাবিধ মাত্রা ও দিক আছে, তবু আমি এক কথায় বলবোঃ সমস্যাটা হচ্ছে প্যারেন্টিংএর। 'প্যারেন্টিং' আমাদের দেশে খুব পরিচিত শব্দ নয়। মাত্র অল্প দিন হলো আমরা শব্দটাকে ব্যবহার করছি এবং সত্যিকার অর্থে প্যারেন্টিং শব্দটার বাংলা ভাষায় সঠিক কোনো অনুবাদও নেই। সে যাই হোক, আমাদেরকে সঠিক এবং সফল প্যারেন্টিংএর যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এবং এব্যাপারে শিক্ষিত/প্রশিক্ষিত হতে হবে। এ ব্যাপারে সর্ব প্রথম নিজেকে মোটিভেটেড হতে হবে, তারপর তা আমরা আমাদের সন্তানদের মধ্যে বিতরণ করতে পারবো। জেনারেশনগুলোর মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। কেবলমাত্র সমন্বয়হীনতার জন্য, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার কোন মানে হয় না। আমাদের এই দেশ, আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবার এবং আমাদের নিজেদেরই জীবনকে আমরা সুন্দর এবং সুগঠিত করতে চাইলে আমাদের মূল্যবোধ ও আদর্শকে আমাদের নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে হবে এবং তা আমাদের সন্তানদের কাছে তুলে ধরতে হবে, কোন রকম ভণিতা না করে। সন্তানদের মাধ্যমে সেটা পরিচিতি পাবে এবং সমাজে সংক্রমিত হবে। সেটা যা'ই হোক না কেন! কেউ যদি খুব খোলামেলা চলতে চায় সেটাই তার আদর্শ। সেভাবেই মোটিভেট করার চেষ্টা করবে তার সন্তানদেরকে। অযথা উষ্মা প্রকাশ করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। বাস্তবিকই কিছু পার্থক্য সৃষ্টি হলে সেটা নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার কোন মানে হয় না।

আবার অনেকে আছেন যারা একমসয় বেপরোয়া জীবন-যাপন করেছেন এবং পরিণত বয়সে এসে লইফ-স্টাইল পরিবর্তন করেছেন; কেউ কেউ হয়তোবা পাগড়ি-জুব্বাও গ্রহণ করেছেন এবং সুযোগ পেলেই “সমাজ গেলো”, “সমাজ গেলো” বলে চিৎকার করছেন! অথচ তাদের (অধিকাংশের) সাথে বর্তমান প্রজন্মের উদ্দীপনা-ভরা তারুণ্য-সমৃদ্ধ মানুষগুলোর কোনই যোগাযোগ নেই! মওকা পেলেই (এমনকি মওকা ছাড়াও) আমরা যদি আমাদের নতুন প্রজন্মকে গালাগাল করি, অবজ্ঞা করি বা পরিত্যাগ করি, তাহলে তারাও তো আমাদের প্রতি একই আচরণ করবে! তাই বর্তমান অবস্থায়, আমাদের মত যাঁরা বয়স্ক আছেন, তাঁরা যদি তাঁদের অতীত জীবনে নিজেরা (নিজের ও সন্তানদের জন্য) এই কাজ করতে ব্যর্থও হয়ে থাকেন, এখন তাঁদেরকে ভবিষ্যত প্রজন্মের দিকে নজর দিতে হবে অর্থাৎ নিজেদের নাতিপুতি যারা আসছে তাদেরকে যত্ন করার চেষ্টা করতে হবে। কাঠখোট্টাভাবে হুকুমদারী চালিয়ে নয়, বরং গ্রহণযোগ্য আলোচনা ও নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতার (তিক্ত বা মধুর)মাধ্যমে ওদের আগ্রহ সৃষ্টি করে নিজেদের আদর্শকে তাদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করতে হবে। ‘নিজের আদর্শ’ বলতে আমি আমাদের, এই ভাটির দেশের মানুষগুলোর, কৃষ্টি-বিশ্বাস-ধর্মীয় মূল্যবোধকে বুঝাচ্ছি।

এটা আমাদেরই দেশ আমাদেরই সমাজ। আমরা যখন চলে যাবো তখনও এটা রয়ে যাবে 'আমাদেরই দেশ আর আমাদেরই রেখে যাওয়া সমাজ' হিসেবে। আমরা এর কল্যাণ কামনা করা ছাড়া, এর কল্যাণে কিছু কাজ করে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

মিরপুর।।২৬.০৯.২০১৯

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫৯

রাজীব নুর বলেছেন: এই সমাজ পচে গলে নষ্ট হয়ে গেছে।
এখন যারা নতুন বিয়ে করবে তাদের বলল বাচ্চা নেওয়ার দরকার নাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.