নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর চাকরি করেছি; অবসর নিয়েছি কর্নেল পদবীতে ২০০৬ সালে। এরপর এযাবৎ প্রিন্সিপাল হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে; এখন অর্কিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা-তে। ‘স্কুল সাইকোলোজি’ নিয়েও কাজ করছি।

আশরাফ আল দীন

কবি, শিক্ষাবিদ ও প্যারেন্টিং এক্সপার্ট

আশরাফ আল দীন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার জন্মদিনের কথা

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:২৬

আমার জন্মদিনের কথা।। আশরাফ আল দীন
আমি, বা আমরা, কখনো ঘটা করে জন্মদিন পালন করি না। আশৈশব এমনটা আমরা শিখিনি এবং বরাবরই জেনেছি, এটা আমাদের সংস্কৃতি নয়। এ নিয়ে আমি লেখার শেষে কিছু কথা বলবো।
আজ সকালে আমি স্কুলে আমার (অর্থাৎ প্রিন্সিপালের) অফিসে বসে কাজ করছি। হঠাৎ দেখলাম আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা দলবেঁধে আমার রুমে এলো এবং একটি ফুলের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বললো, "শুভ জন্মদিন স্যার!" তাদের সকলের মুখে হাসি। আমি ওদের ধন্যবাদ জানালাম। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কিছু আনন্দ ও আবেগ আমাকে ঘিরে থাকলো। আমার মনে পড়ে গেলো শৈশবের কিছু কথা।
আজ থেকে দীর্ঘ ৬৫ বছর আগে এমন একটি দিনে আমার জন্ম হয়েছিলো। এ কথা ভাবতে আমার মন্দ লাগে না, ভালোই লাগে। আমার জন্মের দিনক্ষণ নিয়ে আব্বার কাছে নানা গল্প শুনেছি অনেক আগ্রহ নিয়ে। যতটুকু মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, দিনটি ছিল শনিবার এবং মাসটা ছিল বৈশাখ। আব্বা একটি কাগজে যত্ন করে টুকে রেখেছিলেন আমার সব ভাইবোনদের জন্মের সময় এবং তারিখ। আমার নামের পাশে লেখা ছিলঃ দোসরা মে ১৯৫৪ সাল।
মাঝরাতের বেশ কিছু পরে আমার জন্ম হয়েছিল অর্থাৎ শনিবার এর শুরুতে, গভীর রাতে। তখন তো আর হাসপাতাল, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবা একালের মতো এতটা সহজলভ্য ছিল না, উন্নতও ছিল না!
আমার জন্ম হয়েছিল আমাদের বাড়িতে একজন ধাত্রীর হাতে এবং একজন ডাক্তার সারারাত উপস্থিত ছিলেন আমাদের বাড়িতে। আমাদের এলাকার নাম করা ডাক্তার ছিলেন সুধীর বিশ্বাস, লোকে বলতো 'সুধীর বিশ্ব'। তিনি ছিলেন আব্বার বন্ধু। আমি কৈশোরে তাঁকে দেখেছি। সুন্দর চেহারার মোটাসোটা একজন মানুষ; অধিকাংশ সময় শার্ট-প্যান্ট-কোট পরণে থাকতো তাঁর। ডাক্তার হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল পুরো তল্লাটে। তাঁর নিজের এজমার সমস্যা ছিল, তাই তিনি কোন রোগীর বাড়িতে বেশি সময় দেবেন এটা আশা করা হতো না। কিন্তু আমার জন্মের সময় তিনি আমাদের দেউরি ঘরে অপেক্ষা করেছিলেন প্রায় সারারাত। সেই রাতে আমার জন্মের সংবাদ পাওয়ার পর হাসি মুখে সুধীর বিশ্বাস বিদায় নিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি থেকে। তবে, আব্বা তাঁকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছিলেন সেই নিকষ কালো অন্ধকার রাতে, একাই হাতে একটি লাঠি ও একটি হারিকেন নিয়ে। আমাদের বাড়ির অল্প দূর পরেই ছিল হিন্দু পাড়া এবং পথের উপরেই একটি পুকুর পাড়ে ছিল হিন্দুদের শ্মশান, বা স্থানীয় ভাষায় 'চিতা খোলা'। চাঁদনী রাতেও একা শ্মশানের পাশ দিয়ে যেতে সাধারণত মানুষ ভয় পেত। অন্ধকার রাতে তো কথাই নেই! তাই আব্বা ডাক্তার সুধীর বিশ্বাসকে এগিয়ে দিয়ে এসেছিলেন সেই চিতাখোলার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। এটা ছিল বন্ধুর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা। তিনি এত সাহস পেলেন কি করে যে একা শ্মশানের পাশ দিয়ে হেঁটে আসবেন! এই প্রশ্নের জবাবে তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেনঃ 'আমার তো তখন প্রচন্ড সাহস, কারণ আমি আরেকটি পুত্র সন্তানের জনক হয়েছি! ভয়কে প্রশ্রয় দেওয়ার ফুরসৎ আমার ছিলো না।' আমি অবাক হয়ে কথাগুলো শুনেছিলাম আর বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। এই ফাঁকে বলে রাখি, আলহামদুলিল্লাহ আমরা মোট নয় ভাই-বোন। প্রথমে আমরা পরপর ছয় ভাই এবং তারপর তিন বোন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে আমি চতুর্থ। আমাদের ভাইবোনদের সবাই এখনো জীবিত আছি, আলহামদুলিল্লাহ, কেবল আমার শেজ ভাই ছাড়া, যিনি আমাদের পরিবারে একমাত্র সক্রিয় ও সমরাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আর, আব্বা-আম্মা জান্নাতের পথে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন অনেক বছর আগে।
আমার ধাত্রী মাতা ছিলেন একজন বর্মী মহিলা। আমি ছোটবেলায় তাঁকে অনেকবার দেখেছি। মাঝে মাঝে তিনি আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। অপেক্ষাকৃত খর্বাকৃতির কিন্তু অত্যন্ত ফর্সা, চেপ্টা ও মোটা শরীরের একজন বর্মী মহিলা। চট্টগ্রামের গ্রামীণ মহিলাদের পোশাক পড়তেন, থামি এবং চাদর। তিনি 'বর্মিনি' হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। আম্মা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে 'বড় মা' বলে ডাকতে, কারণ তিনি আমার ধাইমা বা ধাত্রীমাতা এবং ধাইমাকে সম্মান করতে হয় মায়ের মতো। তাঁকে দেখলেই আমার মনে এক অদ্ভুত শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠতো। তাঁকে দেখে আমার বরাবরই একজন 'শরীফ মহিলা' বলে মনে হতো। আম্মা এই সরল মানুষটিকে খুব পছন্দ করতেন। প্রায়ই আম্মার পাশে বসে পানের বাটা থেকে পান খেতেন, দেখেছি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি ছিলেন আমাদের গ্রামেরই এক সাধারণ দরিদ্র পরিবারের বয়স্ক সদস্য ও নামকরা ধাত্রী। তাঁর হাতে অসংখ্য সন্তানের জন্ম হয়েছে কিন্তু যতদূর মনে পড়ে তাঁর নিজের কোন সন্তান ছিল না। সম্ভবত একটি ছেলে ছিল, মারা গেছে অনেক আগেই। চট্টগ্রামের সাথে তখন বার্মার রেঙ্গুন এবং আরাকানের যোগাযোগ ছিল ভালোই। আমাদের এলাকার অনেক লোক বার্মা চলে যেত কাজের সন্ধানে। সাধারণত যেসব লোকগুলো ছিল অশিক্ষিত, অলস এবং আঁটকুড়ে প্রকৃতির তাদের জন্য বার্মাই ছিলো কিছুটা আশা-ভরসার স্থল।এমনও শুনেছি, যারা আমাদের গ্রামে বিয়ে করার মেয়ে পেত না অর্থাৎ কেউ তাকে মেয়ে দিতে রাজি নয় তারা গিয়ে বার্মা থাকে ফর্সা চামড়ার বর্মী মহিলা বিয়ে করে নিয়ে আসতো। এসব মহিলা কালের পরিক্রমায় আমাদের সমাজের সাথে মিশে একাকার হয়ে যেত। আমার ধাত্রীমাতা চট্টগ্রামের ভাষা এত বছরেও পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারেননি। তিনি যখন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন তখন খুব সহজেই বোঝা যেত যে এটা তাঁর মাতৃভাষা নয়। টেনে টেনে আলতো ভাবে তিনি যেভাবে কথা বলতেন তা আমার অত্যন্ত ভালো লাগতো। তিনিও ইন্তেকাল করেছেন বহু বছর আগে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতি হিসেবে কবুল করুন।
মানুষের জীবনে জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই ঘটনাগুলোর সাথে যেহেতু আবেগ মিশে আছে প্রচন্ডভাবে, সম্ভবত সে কারণেই ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে এমন কিছু আচার আচরণ মানুষের মধ্যে চালু হয়ে যায় যেটা অনেক সময় ধর্ম-বিশ্বাসের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তাই বলে ঘটনার গুরুত্ব তো অস্বীকার করা যাবে না! তাই, এই দিনগুলো এলে আমাদের সবাইকে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে যাতে আচারের ভিতরে অনাচার কিছু না হয়ে যায়। তবে, তাই বলে মানুষের অন্তরের আবেগকে অস্বীকার করা, অমর্যাদা করা এবং নিবৃত্ত করার পক্ষপাতী আমি নই। যেমন, আমি আমার জন্মদিনগুলো ঘটা করে কখনো পালন করিনি। কিন্তু একবার একটা কবি সংগঠন কবিতা পাঠের আলোচনা করল এবং সেখানে আমাকে একটি উপহার দিলো। আমি তাদের এই আবেগকে ছোট করে দেখতে চাই না এবং এটা 'বিজাতীয় কোন সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে ঢুকে গেল' এই ধরনের ভয় পাওয়ার কোন কারণ হিসেবে চিহ্নিত করিনা। এছাড়াও কোন কোন সময় আমার জন্মদিনে আমি নিজে কবিতা লিখেছি অথবা কোন গদ্য রচনা করেছি। ভাই-বোন ছেলে-মেয়ে বা বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের কেউ কেউ কখনোবা একটা উপহার এগিয়ে দিয়েছে হাসি মুখে। অনেকেই শুভ জন্মদিন বলে আমাকে জানান দিয়েছে অথবা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এসবকে আমি কখনো কঠোরভাবে পরিত্যাজ্য বা হারাম বলে মনে করি না। তবে আমি আমার নিজের শুধু নয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্মদিনও ঘটা করে পালন করার মাধ্যমে 'আমাদের বিশ্বাসের সাথে যায় না' এমন কোন অনুষ্ঠান প্রতিপালনের পক্ষপাতী নই এবং কখনো করি না। আমার মনে হয় এইটুকু সচেতনতাই আমাদের জন্য কল্যাণকর। মূলনীতি হওয়া উচিতঃ 'যে কোনো ধরনের বাড়াবাড়িই পরিত্যাজ্য।'

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৫১

রাজীব নুর বলেছেন: আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই।
যুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?
আগের আমলে হাসপাতালের চেয়ে ধাই এর হাতেই বেশি সন্তান জন্ম নিতো।

২| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:৫৭

হাবিব ইমরান বলেছেন:

জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভকামনা এবং ভালোবাসা জানবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.