নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আশরাফ মাসরুর

লিখতে পসন্দ করি। ভালবাসি পড়তেও। অন্যকে জানতে যেমন, ইচ্ছে করে নিজেকেও জানান দিতে। তাই আসা ব্লগে।

আশরাফ মাসরুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৃত্যুর প্রত্যাশায়

১৬ ই জুন, ২০০৯ রাত ১০:০৪

মৃতুযর প্রত্যাশায়



ইবরাহিম সাবতি



এখানে একশ্রেনীর লোক আছে, যারা আদতেই ফেরেশতা। যদিও আমি তাদের একজন নই।

জোসেফ কনরাড।



ধুধু মাঠ; উন্মুক্ত, কোথাও কোন বাধা না পেয়ে দৃষ্ঠি ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর। গাড়ি নিয়ে আমি এই বিরান জায়গায় আমি আটকা পড়ে গেছি। মনে হচ্ছে আশেপাশে আমি ছাড়া হিউম্যান প্রজাতির আর কেউ নেই। আর ঘন্টা কয়েকের মধ্যে যে এদিক দিয়ে কেউ অতিক্রম করবে, সে রকম কোন সম্ভাবনাও দেখছিনা। সবাই সম্ভবত অন্য কোন ট্র্য্যাক দিয়ে চলাচল করে থাকে। তারা এই ট্র্যাক থেকে ভাল কোন ট্র্য্যাকের সন্ধান জানে, ফলে এই বালুময় নির্জন প্রান্তরটি এড়িয়ে যেতে সম হয়। কিংবা এই পথ দিয়েও কেউ অতিক্রম করে গেছে; আর আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সম্ভবত.....

পাখীদের মতই সাহস হারা হলাম না। পানির শেষ বিন্দুটুকু দিয়ে মাথা ভিজিয়ে নিলাম। পানির পিপাসার কথা আপাতত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এই সময় ভাইটির কথা মাথার মধ্যে হঠাৎ অশুভ ধুয়ার রেখার মত ঘুরপাক খেতে লাগল; আচমকাই মনে হল, ভূপৃষ্ঠে যা কিছুই আছে, সবই নশ্বর। প্রতিটি বস্তুরই একদিন ফিরে যেতে হবে....

বেশ কয়েক বছরের মধ্যে এ রকম ভাবনার উদয় এই প্রথম হল। চমকে গেলাম; নিজেকে কেমন বিমূঢ় আর হতবুদ্ধ লাগছিল .... !

বোষ্টন বিমানবন্দরে জুদি ফষ্টারের গ্রেপ্তারের সংবাদ আমার মনে বিশেষ ভাবান্তর সৃষ্টি করেনি। সে আন্ডারওয়্যারের ভেতর কোকেন নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যা নিয়ে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম, সে আবার নেশার ডোজ না নিয়ে ঘুমোতে পারে না। এই অনিদ্রার রোগ থেকেই সে একদিন পাঁড় নেশাখোর হয়ে উঠে। সৃষ্টির শুরু থেকেই কত লোকের মৃত্যু হয়েছে এই পথে... !

গত কয়েক বছরের মধ্যেই কোন দৃশ্যই আমার মধ্যে কোন ছাপ ফেলত না; এক রকম নিস্পৃহ হয়েই ছিলাম...

পাথুরে ভূমি, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঝোপঝাড় আর নরম কাদামাটির স্তর; দূরের পথ বালুতে বালুতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। -যদি অন্য কোন পথের হাদিস জানা থাকত ! শালার সব বাজে রাস্তাগুলি দিয়ে যেন আমার অতিক্রম করা চাই ! ! ভয়াবহ দু:স্বপ্নের মত খর রোদ্রে সেই তখন থেকেই পাথরগুলি ঝলসে যাচ্ছে। নরম কাঁদাটে স্থান (চোরাবালি) অতিক্রম করতে করতে বীরত্ব ও সাহসের সঙ্গীত আবৃত্তি করতে থাকি। খোদাই জানে, কয়জনে এই চোরাবালি অতিক্রম করতে পেরেছে ?

কেউ নেই... কোথাও কেউ নেই ....... “এই পাথর, ঝোপ, চোরাবালি আর মরু পঙ্গপাল ও চামচিকার দুনিয়ায় একবেদ্বিতীয়তম অধিশ্বর এক আমি” Ñ প্রতি দশ মিটার পার হয়েই নিজেকে বাহবা দিতে দেই আর সেই কবিতাগুলি গাইতে থাকি, সেই শৈশবে যা সকালে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে প্রিন্সিপালের একঘেয়ে ভাষনে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রিন্সিপালের ভাষনের পরে আমাদের সেটা জোরে সমস্বরে গাইতে হত। কিন্তু কিছুদিন পরেই সেটা একটা হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় । কী নির্মম তামাশা ! সেই সময় হতেই তার বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ আমার মনে গেথে যায়, আর এখন আমি সেই শব্দগুলি আবৃত্তি করছি, ‘এই পাথর, ঝোপ, চোরাবালি আর মরু পঙ্গপাল ও চামচিকার দুনিয়ায় একবেদ্বিতীয়তম অধিশ্বর এক আমি’ !

সিংহের মত অবশেষে এমন এক জায়াগায় গিয়ে হাজির হই, যেখানে আর কোন আশাই নেই। হে প্রভু ! হে দয়াময় ! অনুগ্রহ কর। তোমার কাছে সবিনয় প্রার্থনা- এদিক দিয়ে যাচ্ছে এমন কাউকে মিলিয়ে দাও.....

উচুনিচু পাথরে হোচট খেতে খেতে এগিয়ে যেতে থাকি। একটু পরপরই কাটাতে ভর্তি ঝোপঝাড়ে জড়িয়ে যাচ্ছি। ডুবন্ত ব্যক্তির রশির মত শরীরখানা শেষ শক্তি দিয়ে টানছি। হঠাৎ থামলাম। কি আশ্চর্য ! কুয়া ! কুয়া দেখা যাচ্ছে ! এই নির্জন নি:সঙ্গ মরূভূমিতে ?

আহ ! অবশেষে এবার পানি পাবো ! তৃপ্তি ভরে পান করতে পারবো !

কিন্তু পানি পর্যন্ত যাবো কীভাবে ? সেটা তো বেশ দূরে ... হাত বাড়াই, কিন্তু ছুতে পারি না। এক বেদুঈনের গল্পের কথা মনে পড়ে যায়, সে তার আবাটি খুলে পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে পরে তার পিপাসার্ত কুকুরের মুখে নিংড়িয়েছিল। কিন্তু আমি আবা পড়িনি। গায়ে যতগুলি কাপড় আছে, তার সবগুলিকে একত্র করে গিটও দেই, তবুও পানি পর্যন্ত পোছানো অসম্ভব। সে আশা ত্যাগ করলাম। সেই বেদুইনকে যদি পেতাম, মনে এই দুরাশা জাগছিল। মনে হচ্ছে তার আবাই এই মুহুর্তে একমাত্র উপায়। পিপাসায় মরে যাওয়ার থেকে বাচার একমাত্র উপায় সেটিই। ধৈয্য যেমন সফলতার কার্যকারণ কিংবা নর্মান্ডিরা রাখদের পরাজয়ের !

রাখ ? এখানে আবার রাখ কোথা থেকে আসল ! আমি পিপাসায় মরছি ! একটি উট হয়ে যাবার আশা মনে জাগছে। মরূভূমি আর উচুনিচু প্রান্তর পাড়ি দিবো পিপাসা চেপে রেখে। জীবনেও শুনিনি, কোন উট মারা গিয়েছে তৃষ্নায়। যদি উট হতাম কিংবা পাখী, ময়ূরপঙ্খী পাখা দিয়ে পাড়ি দিতাম জমিন আর চলে উড়ে যেতাম আকাঙ্খিত বস্তুর পানে .... সূরভিত স্থানে....

আর পানির কাছে .....

এমন এক জায়গায় গিয়ে হাজির হয়েছি, পানির চিন্থমাত্রটিও কোথাও নেই। আমি অস্তিত্বমান একটি স্বত্তায় পরিণত হচ্ছি, জলীয় নয়। মঙ্গলগ্রহের মত; সেখানে মানুষ পানির খোঁজে অবশেষে হতাশ হয়ে পড়েছে। ইচ্ছে, ইচ্ছে হচ্ছে.... যাই ইচ্ছে হোক না কেন, আমি পিপাসার্ত ! ধ্বংসশীল ! মাথা ঘুরছে ! কান্ত ও নির্জীব হয়ে পড়ছি ! খোদা ! পিপাসার মরণ থেকে রে কর !

ঠিক পথটি চিনিয়ে দাও !

খোদা ! যদি অনুতপ্ত হওয়াই তাওবা হয়ে থাকে, তবে আমি চুরান্ত অনুতপ্ত এই যাত্রায় বেরিয়েছি বলে। একটি বারের মত সুযোগ দাও। হতাশ করো না !

বিপদগ্রস্থের প্রার্থনা গ্রহণীয়। যদিও তা ঘটে কিছুন পরে ! আমাকে তৃপ্তমনে ঘরে পৌছতে দাও। পিপাসায় কাতর হয়ে নয়। ভাইটির শেষ মুহুর্তের বাক্যগুলি আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

-“আমি মারা যাচ্ছি .... মারা যাচ্ছি..

আমার চোখের সামনে ভাইটি মারা গেল। তার চোখদুটি আেেপর অশ্র“তে টলমল করছিল। ও আমার উপর পরম নির্ভর করেছিল; আমি ওকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করবো !

ঘটনাটি আমার জন্য কেমন ছিল ? মৃত্যু তার স্পর্শ দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, আমি কিচ্ছু করতে সক্ষম নই। আমার চোখ বেয়ে অশ্র“ নিরবে ঝরে পড়তে থাকে। কিছু করতেই আমি সম নই। ও মারা যায় একটি অপরিচিত ও দূর এলাকায়। আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না। প্রায় শেষ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। কোন নার্স কিংবা ওয়ার্ড ডাক্তার- কাউকেও চোখে পড়ল না। সবাই এসে হাজির হল- যখন ডেথ সার্টিফিকেট ঘোষনার সময় হল, তখন। কর্তব্যরত ডাক্তারের নিকট কাকুতি-মিনতি করি। কিন্তু সে তখন একটি কম বয়েসী মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আমাকে সে সম্পুর্ণ উপো করে। আমার কারণে মেয়েটিকে ছেড়ে আসতে পারেনি। আমার ভাইটির শেষ মুহুর্তগুলিতে সে ঠিক কোন রকম সহায়তা করেনি। পেশাদারী নির্লিপ্ততায় সে আমাকে ফিরিয়ে দেয়।

-‘কিছু করার নেই ! তোমার ভাই মৃত ! কোন সুযোগই নেই !’

সে ওকে ঠিকমত না দেখেই এগুলি বলে দেয়।

আমার বিশ্বাস ছিল ওর শ্বাস আমি ফিরিয়ে আনতে পারবো...... যেই মুহুর্তটিতে ভাই আমার মরে গেল, তার উপর আমি লুটিয়ে পড়ি। ওরা তাকে সরিয়ে ফেলে একটি তালাবদ্ধ দরজার পেছনে। আমাকে বের করে আনে রাস্তায়। ওরা আমার ভাইটির শরীরকে মর্গঘরে রেখে দেয় সেই সকাল পর্যন্ত।

তিন মাস পরে প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছায় আমি হাসপাতালটিতে গেলাম। সেই কেবিনে প্রবেশ করলাম, যেখানে ও মারা যায়। চুপচাপ বসে থাকি সেই খাটটির সামনে, আমার ভাইয়ের শেষ শ্বাসগুলির/মুহুর্তগুলির যে ছিল স্বাী। অর্থহীন আক্রোশ ক্রমশ আমাকে আচ্ছন্ন করতে থাকে। আমি অবহেলাকারী ডাক্তারের কথা মনে করলাম। সে তখন কর্তব্যরত ডাক্তারদের রূমে বসে। তার কাছে গেলাম। এক লোক তার সামনে বসে, অনুনয়-বিনয় করে কাঁদছে। বুঝতে পারলাম- এই সুযোগ। কিন্তু থেমে গেলাম। আমাকে চিন্তায় পেয়ে বসল। আসলে আমি প্রতিশোধের চিন্তায় বুঁদ হয়েছিলাম। আমাকে প্রতিশোধ নিতে হলে আরো কৌশলী হতে হবে; আমার পরিচয় ও সম্পৃত্ততার বিষয়টি যাতে প্রকাশ না পায়...

কিছুটা দূরে গিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে চিন্তা করছিলাম। ঘটনাটি কীভাবে ঘটানো যায়। ঝাঁ করে একটি চিন্তা আমার মাথায় ভেসে আসল। একটি ফিল্মে দেখেছিলাম- হতাশ প্রেমিক যখন তার স্বৈরিনী প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যায়, সুযোগ বুঝে তার মুখে এ্যসিড ছুড়ে মারে। ঝলসে যায় মুখ। চিন্তাটি মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, ডাক্তারের মুখ এ্যসিড দিয়ে ঝলসে দেবো। এটিই নিরাপদ উপায়। তার মুখ পুড়িয়ে দেবো। এটা হচ্ছে তাই- আমি যা চাচ্ছিলাম। দ্রুত বেরিয়ে আসলাম; এ্যসিড খোঁজ করতে হবে।

লোকে বলে ‘তিযাব’; বিশেষজ্ঞদের নিকট পরিচিত সালফারিক এ্যসিড নামে। বেরোলাম তার খোঁজে- রাস্তার দুপাশে সারসার ঠাসাঠাসি করে বাড়িগুলি দাঁিড়য়ে। রাস্তা ধরে হেটে চলছি আমি। বিশেষ কোন কষ্ট করতে হলনা, রাস্তার ধারের একটি বাড়িতেই উদ্দিষ্ট বস্তু পেয়ে গেলাম। ছোট্র একটি বোতলে আমার প্রয়োজনমত ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মৃত্যু পানি পকেটে পুরলাম। হাসপাতালের দিকে দ্রুতপায়ে এগুচ্ছি।

ঐ শালার ডাক্তার ! তার মুখটা আমি পুড়িয়ে দিবো ! একেবারে ঝলসে দিবো ! একটি রচনা লিখবো- সেখানে তার মৃত্যুকালীন যন্ত্রনা-কষ্টের একটি চমৎকার বিবরণ থাকবে। ওর জীবন একেবারে নাশ করে দিবো !

জায়গামত পৌঁছে গেলাম। কিন্তু সে নেই ! খানিকপূর্বেই যে কেবিনদুটিতে ঢুকেছিলাম, আবার ঢু মেরে দেখলাম। নেই ! কীনারকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল,

-“ বেরিয়ে গেছেন। তার ডিউটি শেষ হয়ে গেছে।”

সন্দেহ জাগতে পারে এই ভয়ে কীনারকে বিশেষ আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। ঘরে ফিরে আসলাম। আগামি কালের অপো। মনে সাহস যোগালাম। ছোট্রবেলায় মুখস্থ করা বীরত্বের প্রায় সকল গানগুলি আবৃত্তি করতে থাকলাম। মনে হচ্ছিল- যেন বিপুল শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বেরিয়েছি। ভাবতে বসলাম- একজন লোকের সাহায্য দরকার পড়বে। আমাকে যে হাসপাতালে ডাক্তারের রুমটি দেখিয়ে দিবে আর বেরোবার নিরাপদ রাস্তাটি চিনিয়ে দিবে। ডাক্তারের রুমেই কাজটি শেষ করতে হবে। কেউ যাতে না দেখে; আর কোন আওয়াজও হওয়া চলবে না। কাজ সারতে হবে নি:শব্দে। চেচামেচি আমার মোটেও ধাতে সয়না। হট্রগোল কোনকালেই আমার পসন্দের ছিল না। টেলিভিশনের চ্যানেলগুলি পাল্টাতে থাকলাম।

.....আশা করছি, কাজটা দ্রুতই সারতে পারবো। .... আমি তাকে ঝলসে দিবো। বিশ্বাসীদের উচিত খারাপ লোকদের এভাবেই হত্যা করা। তারপর আমি আমার শহরে ফিরে যাবো। আমাকে কামানের ২১টি গোলা ছুড়ে অভিবাদন জানানো হবে।...

ভোরে ভোরে উঠে পড়লাম। লম্বা বারান্দা হয়ে তার রুমের দিকে এগুতে থাকলাম। বেশ কয়েক মিনিট পরেই ল্য করলাম দুটি সুন্দরী মেয়ের মাঝখানে সে দাড়িয়ে আছে; তাদের পোষাক-টোশাকে মনে হল ইন্টার্নি ডাক্তার-টাক্তার গোছের কিছু একটা হবে। ....

বারান্দার মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে; ডান হাত পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছি। শক্ত করে এ্যসিডের শিশিটা ধরে আছি। ... আচমকাই সে ঘুরে গিয়ে দ্রুত চলতে লাগল, যেন কোন কিছুর কথা হঠাৎ মনে পড়েছে। মেয়ে দুটি অন্যদিকে ওকে ছাড়াই চলে গেল।

ঝাড়া এক ঘন্টা ! ঠায় দাঁিড়য়ে আছি বারান্দার মাঝখানে। বারান্দা দিয়ে আসা-যাওয়া করছে মানুষ। সবার সন্দেহভরা দৃষ্টি আমার উপর দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে।

অবশেষে আপনভাগ্যকে দুষতে দুষতে বের হয়ে এলাম। শালার ভাগ্য ! এমন ভাগ্য জন্মেও আর দেখিনি ! আমার ভাগ্য হচ্ছে আটার মত; ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, ঝড়ের দিনে সেগুলিকে এক করতে হবে।

একদিনের কথা মনে পড়ছে; সেদিন আমাদের অফিসার আমাদের উদ্দেশ্য করে বক্তৃতা ঝারছিল। সাহস যুগিয়ে যাচ্ছিল পরমোৎসাহে।

“ তোমরা হচ্ছ বীরের জাতি ! তোমরা পাহারাদারীর কর্ম ঈমানদারীর সাথে করতে থাক। পূর্ণ শক্তির সাথে প্রতিরোধ করতে থাক।”

কিন্তু যতই দিন গড়ায়, আমাদের সংখ্যা কমে আসতে থাকে। কেউ হয়ত পালিয়ে যায়; আবার কেউ আহত কিংবা নিহত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। প্রদাহ রোগ ছড়িয়ে পড়ার এক হপ্তা পর এর রকম পাইকারী মৃত্যুর কথা যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। লাশে লাশে ভরে আছে চর্তুদিক। অফিসারের সাথে একমাত্র যেই লোকটিকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচানোর জন্য পাথরের সেলে বন্দি করা হয়- সে হচ্ছে এই বান্দা !! টানা চল্লিশ দিন আমাকে আটকে রাখে; যাতে আমি বন্দীর জীবন বাচতে পারি !

এ্যসিডের শিশিটি খাটের সাথে রাখি। কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য এই কাজটি করি। কাজটি আমি শুরুই করতে পারিনি। মনকে সান্তনা দিয়ে বলি; সময় এখনো ফুড়িয়ে যায়নি।.....



ওহ ! এসব কী ভাবছি ! দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চলে এসেছি; পেছনে আমার গাড়ি পড়ে আছে বিন্দু শস্যকণার মত। এই নির্জন মরূভূমিতে পিপাসায় কন্ঠ ওষ্ঠাগত, কান্ত আমি টলতে টলতে এগুচ্ছি। হায়রে কপাল ! এই ঊষর মরূভূমি পাড়ি দিতে পারবো- এ দুরাশাও দেখি মনে জাগছে। এই খর রোদ্রে ! এই ভয়াবহ মরুভূমি ! ...

দূরে জমিনে কিছু একটা নড়ছে। পরিষ্কার ধরতে পারছি না কি হতে পারে। সম্ভবত কোন গাছ-টাছ হবে। এই বিরান নির্জন মৃত্যু উপত্যকায় নি:সঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়ে সেখানে যাবার ইচ্ছা চেপে বসছে আমার উপর। কিন্তু শক্তি ! এক বিন্দু শক্তি আর অবশিষ্ট নেই আমার শরীরে ! দৌঁড়াতে পারছি না। কল্পনা করছি, পঙ্গপালের এক এক পাল আসছে; দ্রুত পাড়ি দিচ্ছে জমি। আর আমি তাদের ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছি।

স্পষ্টই বুঝতে পারছি, চোখদুটি ক্রমশ লাল হয়ে আসছে। আর সারা শরীরে ভরে গেছে ফোস্কায়। ইচ্ছে করছে চুলকাই। কিন্তু পাচঁড়া হয়ে যাবার ভয়ে তাও করতে পারছিনা। হায় খোদা !

আমি পিপাসার্ত ! শরীর ভেঙ্গে আসছে। আর এখানে বালু, আকাশ ও ম্নান সূর্য ছাড়া আর কিছুই নেই। আঙ্গুরের ঝোপ ও বিছানো বালুতে শুয়ে আছি শুয়ে আছি বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ জেগে উঠি। নিজেকে আবিষ্কার করি কান্ত ও নির্জিব অবস্থায়। সাহায্যের আশায় বিভৎস গলায় চিৎকার করে উঠি। শোনার কেউ নেই। হায় খোদা ! সেই আমার ভাইটির মতই আমিও অপরিচিত ও নির্জনে মারা যাচ্ছি।.... শৈশবের কথা মনে পড়ছে।

কি রকম হত.... প্রিন্সিপালের ভাষন প্রতিদিন সকালেই মাথায় গুনগুন করত। বৃদ্ধ লোকটি; প্রতিদিন একই ড্রেস পড়ে আসতেন। তার মত আশ্চর্যলোক আর দেখিনি। দশ বছর পূর্বের কথা। একদিন তাকে দেখতে পাই বসে আছেন জীর্ণ পুরাতন কাপড় গায়ে; বোতামের লেশমাত্র নেই সেখানে। কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। উত্তর দিলেননা। ফের দিলাম। কিন্তু তবুও উত্তর নেই। আমাকে তার মনে নেই- স্পষ্টতই বুঝতে পারলাম। বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। বয়স হয়ত তার স্মৃতি কেড়ে নিয়েছে। তার সামনেই একটি ছেলে বসা। আমাকে বলল,“ তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। দূরে সরে যান। না হয় আপনাকে কিছু ছুড়ে মারতে পারতে পারে। আপনার হয়ত তা ভাল লাগবে না। আপনাকে পাথর ছুড়ে মারবে; দুনিয়ার শেষ প্রান্তটিতেও যাননা কেন !

চোখদুটি অশ্র“তে ভরে গেল। কি নিদারুন ক্ষয় ! আমার শৈশবের বছরগুলি যেন ব্যর্থ। আমি বৃদ্ধটিকে দেখছি তার ঘরের সামনে বসে; নি:সঙ্গ, বিষন্ন। এক সময় লোকেরা তাকে দেখে ভয় পেত....



আহ ! অবশেষে সেই জায়গায় গিয়ে হাজির হই, দূর থেকে যা ল্য করেছিলাম। একটি শুকিয়ে যাওয়া মরা গাছ; তার মধ্যে যেমন, আশেপাশেও প্রাণের কোন চিন্থটুকুও নেই। ডালগুলি লম্বা হয়ে আছে নরমভাবে; ঝরঝরে হয়ে আছে। কান্ডটি নরম আর কোকড়ানো অবস্থায় টিকে আছে; আমি তার মধ্যেই ঠেস দিয়ে বসলাম। উপরের দিকে চেয়ে কষ্টের হাত থেকে রেহাই পাবার প্রার্থনা করতে থাকলাম। নিজেকে আল্লাহর হাতে সমর্পণ করে দিয়েছি। এই মুহুর্তে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিনে অবস্থান করছি। জানতেও পারছিনা কোথায় মারা যাচ্ছি ! নির্জন ও অপরিচিত স্থানে মারা যাচ্ছি; লাশ থেকে যাবে শকুন ও হায়েনার ঠুকরে খাবার অপোয়। কেউ আমাকে কবরে শুইয়ে দিবে না। আমি মাটির উপর রয়ে যাবো; যতন না পর্যন্ত একেবারে নি:শেষ হয়ে যাবো; পূর্ণতই। সম্ভবত কিছু হাড্ডি ইতস্তত: বিপ্তি হয়ে পড়ে থাকবে। হায় খোদা ! তুমি নাকি সুযোগ দাও ! হতাশ কর না ! প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল কর ! চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ করে ফেললাম। মনে হয় যেন বিদ্যুতের আওয়াজ শুনলাম। শব্দটি আমাকে কাঁপিয়ে দিল। আমি নিস্পন্দ হয়ে পড়ে রইলাম। কল্পনা করছি একেবারে মৃত্যুর মুহুর্তটিতে উপস্থিত হয়েছি। মরে যাচ্ছি কিছুনের মধ্যেই ! চোখের সামনে কাঁপছে দূরের রেখা !

প্রখ্যাত অভিনেতা তার আন্ডারওয়্যারে কোকেন লুকিয়ে রেখছে। আমার সামনে ভাইটি মারা যাচ্ছে আর আমি অম তাকে সাহায্য করতে। আমার মানসিক ভারসাম্যহীন প্রিন্সিপাল অন্তরকে ভেঙ্গে দিয়েছেন একেবারেই। একা আমাকেই বাচাতে বন্দি করা হচ্ছে ! হায় খোদা ! হচ্ছেটা কি আমাকে নিয়ে ! এ সব কি ঘটছে আমার জীবনে !

একটি ঘোড়া পেলেই হত; পাড়ি দিতাম মরুভূমি আর বালুময় মরুভূমি পাড়ি দেবার রেকর্ড সৃষ্টি করে ফেলতাম। হায় ! কাকে আমি কষ্ট দিয়েছিলাম ? আমি সবসময় চাইতাম, আমার মৃত্যু হবে পরিজনের মাঝে। আমার বীর অফিসার আমাদের বলতেন,

“ তোমরা মারা যাও আর আমাকে রেখে যাও একাকী...

একটি আওয়াজ আমার কানে বাড়ি মারছে। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। মনে হচ্ছে আকাশভরে বৃষ্টি নামবে। প্রবল বর্ষণ হবে। আর আমাকে, আমার শুষ্ক শরীর বেয়ে গড়িয়ে যাবে....

আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম।

“ তুমি !

হালকা পায়ে হেটে আসার নরম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চোখ খূললাম। এক লোক আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালাম। যেভাবে সমুদ্রের ঢালু তীরে পানি ঢেউ আছড়ে পড়ে। ঋজু হয়ে দাড়িয়ে আছে সে। ....

ডুবন্ত ব্যক্তি যেভাবে বাচতে চায়, ঠিক তেমনি তাকে আকড়ে ধরলাম। কৌতুক ভরা স্বরে ভরাট কন্ঠে বলছে,

“ খোদার শোকর কর ! যে তোমাকে আমি দেখতে পেয়েছি !

বিরক্তি পেয়ে বসছিল আমাকে। কি যে হল হঠাৎ মরুভূমি পাড়ি দিতে শুরু করলাম। আর সেই অবস্থায় কিনা ভাবতে বসলাম ভাইটির কথা- যে মারা গেছে দূর নির্জনে। আর সেই শিশিটির কথা- খাটের মাথায় যা রেখেছিলাম। অথচ ভাবতে পারতাম তার কথা, যে শিশিটি নিয়ে যায় এবং আমার নিকট যে আমার ভাইকে যে উপেক্ষা করেছে, তার সংবাদ নিয়ে আসে। তবেই আমার শহর ২১বার তোপধ্বণি করে বরণ করে নিত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.