নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আসসালামু আলাইকুম। আমার ব্লগ পেজে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।

আতোভাইলু

হিসাব-নিকাশ জানি না, ওজনে কম দিলে টের পাই

আতোভাইলু › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি দূর্ঘটনা | সারাজীবনের কান্না

০৮ ই মার্চ, ২০১৬ ভোর ৫:৩৪




ভূমিকাঃ

কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের সম্পর্কে লেখাটা অনেক কঠিন । কেননা, সেই মানুষটা এতো কাছের এবং এতো আপন হন যে ভেবেই পাওয়া যায় না কোনটা দিয়ে শুরু করি। অথবা ব্যাপারটা এমনও হতে পারে যে, তাঁর সম্পর্কে যা কিছু বলার তা হয়তো কেবল অনুভূতি দিয়েই বুঝতে হয়। হয়তো আমার আঙ্গুলের মৃদু আঘাতে বসে যাওয়া কি-বোর্ডের বোতামগুলো থেকে প্রবাহিত বৈদ্যুতিক সংকেত এর মাধ্যমে সৃষ্ট যে বর্ণমালা আমার কম্পিউটারের পর্দায় একের পর এর ভেসে উঠছে সেই বর্ণ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের হোয়াইট প্লেইন শহর এর একটি নামী নার্সিং হোম এ সয্যাশায়ী, স্বরধ্বনিহীন, বাহুবলবিহীন মানুষটার দিকে তাকালে সন্তান হিসেবে তাকে নিয়ে দুটি কথা না বলে থাকা যায় না।
২০১৪ সালের নভেম্বর মাস। নিউ ইয়র্কের বাতাসে শীতের তীব্রতা অনেক। প্রকৃতি যেন নতুন উদ্যোমে কনকনে—হাড় কাঁপানো শীত নিয়ে হাজির। প্রচণ্ড শীতের কারণে গাছগাছালিরা সেই কবে তাদের পাতাগুলো রাগে-কষ্টে নিজেদের শরীর থেকে আলাদা করেছে। আশেপাশের যেদিকেই নজর যায়, কেবল পাতাবিহীন উলঙ্গ গাছগুলো লজ্জায় অবনত দেখায়। দিনের বেলায় সূর্যের উপস্থিতি ক্ষীণ প্রায়। ভারী কনকনে বাতাস সূর্যের উপস্থিতির কোন তোয়াক্কা করে না। বাতাসের অদৃশ্য চাদর যেন সূর্য্যের আলো এবং তাপকে অতি নগণ্য করে দেয়। আর প্রকৃতির ডাকে সারা দিয়ে মানুষ নামের প্রাণীগুলো বাইরে অতি প্রয়োজন ব্যতীত বের হয় না। যদিও বা বাইরে আসে, কিন্তু তাদের রক্তগরম দেহকে রীতিমত বাস্তা জড়ানোর মত করে ভারি কাপড় জড়িয়ে আসে।

প্রথম ফোন কলঃ

প্রতিদিনের মত আব্বুও কাজের জন্য বের হচ্ছিলেন। কেমন যেন এক আনন্দের পসরা আব্বুর মনকে ছুঁয়ে গেল। বাংলাদেশী এবং বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ হয়েও প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এই ভীন দেশে এসে দীর্ঘ ৫ বছর বসবাসের পর অবশেষে তিনি আমেরিকার নাগরিক হতে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, আজ আব্বুর শপথ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের দিন। আইনত যদিও আব্বু নাগরিক হয়ে গেছেন, কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় কোর্টে হাজির হয়ে আব্বুর মত প্রায় ৫/৬ শত মানুষের অংশ গ্রহণে শপথ পাঠ করার মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাবার নিয়মকানুন সম্পন্ন হয়।

ভিজিটিং নার্স, তাই কাজের পোশাকের প্রতি আব্বুকে সব সময় অনেক যত্নবান হতে হত । ইউনিফর্ম ছাড়া অফিসে যাওয়া যায় না। কিন্তু আজ আব্বুকে একটু অন্যরকম করেই সাজতে দেখলাম। কয়েক সপ্তাহ আগে সহধর্মীনির নিকট হতে উপহারস্বরূপ প্রাপ্ত স্যুট-প্যান্ট পরে আব্বুকে যে কেমন লাগছিল, তা আমার মায়ের মুখের দিকে তাকালেই বলে দেয়া যাচ্ছিল। আব্বুর সরল চেহারা থেকে তাঁর অভ্যন্তরীণ আনন্দের পূর্ন ছাপ দেখা যাচ্ছিল। ভার্সিটির নানা ব্যস্ততায় আমি পারি নি আব্বুর সাথে যেতে। পারি নি আব্বুর সাথে সেই আনন্দের মুহুর্তটি ভাগাগাগি করে নিয়ে।

মায়ের কাছ থেকে জানতে পারি আনুমানিক সাড়ে ১২ টার দিকে আব্বু বাসায় ফোন করেন। শপথ অনুষ্ঠান সমাপ্ত করেই মা এর কাছে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন আব্বু। এবং সেখান থেকে কাজে চলে যান। তারপর আব্বুর সাথে মার সর্বশেষ কথা হয় বেলা ১ টার দিকে। এরপর আমাদের কারো সাথে আব্বুর আর কোন কথা হয় নি।

দ্বিতীয় ফোন কলঃ

জুম্মার দিন, নামাজ পড়ে বাসায় ছিলাম, তখন আনুমানিক সাড়ে পাঁচটা বাজে। বাসায় মা আছে, ভাই কেবল কাজ থেকে বাড়ি আসল। আমরা সবাই বাসায় ছিলাম তখন। হঠাৎ করে আমাদের বাসার ফোন বেজে উঠল। আমরা যখন বাসায় থাকি তখন মা বাসার ফোনে ফোন আসলে রিসিভ করে না। আমরা দুই ভাইয়ের কেউ রিসিভ করি। কিন্তু সেদিন কেন জানি মা ফোন রিসিভ করলো।
ফোনের অপর প্রান্তে আব্বু যে রোগীর দেখাশোনা করেন তিনি রয়েছেন। তিনি আমার মা এর কাছে জানালেন যে আব্বু এক্সিডেন্ট করেছে গাড়ির সাথে, রাস্তা পার হবার সময়, এখন তিনি ব্রুকডেল হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে আছে, তোমরা আসো সবাই। তারপর আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, সব কিছু স্থগিত করে আব্বুর কাছে ছুটে গেলাম।

জ্বালাময়ী ২ ঘণ্টাঃ

আব্বুর এক্সিডেন্ট এর খবর শোনার পর আমাদের ধারনা ছিল যে হয়ত বা আব্বু মোড় নেয়া কোন গাড়ির ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে গেছেন, খুব বেশি কিছু হবে না । হলেও হয়ত হাত পা ভেঙ্গে যেতে পারে। এমনটাই আমরা সবাই ভাবছিলাম যখন আমরা ট্যাক্সির ভেতরে ছিলাম। আমাদের বাসা থেকে হাসপাতাল একটু নিকটে হবার কারণে গাড়িতে হাসপাতালে পৌঁছতে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। হাসপাতালের সামনে নেমেই আমরা চলে গেলাম সোজা ইমার্জেন্সিতে । আমাদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও নিরাপত্তাকর্মী আমাদেরকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন না। এমন অবস্থায় ইমার্জেন্সী কর্মীদের শিফট পরিবর্তনের সময় হবার কারণে আমাদেরকে সহ আর যারা ছিলেন তাদের সবাইকে আরও ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হল। স্বাভাবিকভাবেই এমনিতেই মন মানুসিকতাঁর অবস্থা অনেক নাজুক, আব্বুকে এক পলক দেখার জন্য মনটা কেঁদে যাচ্ছিল। তারপর আবার পাক্কা ২ ঘণ্টা অপেক্ষার যন্ত্রণা । ঠিক তখন আমি আমার কর্মক্ষেত্রে কল করে আগামী বেশ কিছুদিন কাজে যোগদান করতে পারব না বলে জানিয়ে দিলাম। ভাইও একই কাজ করলো।
এদিকে আমরা যতক্ষণে অপেক্ষা করছি, ভাই আমাকে আব্বুর সেই রোগীকে ফোন করে কিভাবে এক্সিডেন্ট হল সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে পরামর্শ দিল।

এক্সিডেন্টের বিবরণঃ

আব্বুর যে রোগী আমাদের ফোন করে আব্বুর এক্সিডেন্টের কথা জানিয়েছিলেন, তাঁকে আব্বু বিগত ৪ বছর যাবত দেখাশোনা করেন। সন্তানের সমতুল্য এই রোগীর নাম ক্যাশ। তিনি আব্বুর খুব আদরের কারণ আব্বু যে সমস্ত রোরীদের দেখাশোনা করেছেন তাদের মধ্যে সব থেকে কম বয়সের ক্যাশ। সেই জন্য আব্বু ক্যাশের প্রতি একটা আলাদা ভালোলাগা ভালবাসা ছিল। আব্বুর সব কিছু দেখাশোনার পর কাজ থেকে বিদায় নেবার আগে একটা কাজ করেন প্রতিদিন। তা হল, ক্যাশের জন্য রাতের খাড়ার বাইরে থেকে কিনে এনে দিয়ে তারপর আব্বু চলে আসেন। ঠিক এই রকম করেই আব্বু বিগত চার বছর কাটিয়েছেন।

এক্সিডেন্টের কথা বলতে গিয়ে ক্যাশ বলেন, আমি তাঁকে আমার ঘরের চাবি দিয়ে বলে দিলাম আমার জন্য খাবার কিনে এনে, চাবিটা আমার কাছে দিয়ে তুমি চলে যাও। এই রকম প্রতিদিন করা হয়, কিন্তু আজ কেন জানি তাঁর একটু দেরি হচ্ছে, আমি এদিকে অপেক্ষা করছি কখন মুহাম্মদ ( আমেরিকাতে সবাই কখনও নামের প্রথম অংশ কখনঅ নামের শেষের অংশ ধরে ডাকে। সেই জন্য আব্বুকে সে মুহাম্মদ বলে ডাকে) আসবে। কিছুক্ষণ পর আমার এক প্রতিবেশী আমাকে ডেকে বলল যে জানো আমাদের বাড়ির অপর পাশে রাস্তায় একটা লোক এক্সিডেন্ট করেছে। সেই কথা শোনার পর পরই আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হল। আমি তখন ধীরে ধীরে আমার বাড়ির পেছনের রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলাম। আমি যতক্ষণে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই, ততক্ষণে পুলিশ এবং মেডিকেল ইমার্জেন্সির কর্মীরা এসে গেছেন। দেখলাম একটা মানুষকে ঘিরে তাঁরা রয়েছেন। আমি কাছে এগিয়ে গিয়ে সেই মানুষটাকে দেখতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পুলিশ এবং ইমার্জেন্সির কর্মীরা আমাকে বাধা দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার মনে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর হয়ে গেছে। কারণ তাদের সাথে কথার ফাঁকে আমি মুহাম্মাদের মলিন এবং ফ্যাকাসে মুখটা দেখতে পেলাম। তাঁকে এমন অবস্থায় দেখে আমার মনটা অনেক বেশি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আমি তাদেরকে মুহাম্মাদ আমার নার্স এ কথা বলার পর তাঁরা আমাকে তাঁকে দেখতে দেয়। পরে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে আমি জানতে পারি যে, মুহাম্মাদ আমার বাড়ি থেকে বাইরে এসে আমার জন্য খাবার কিনে নেবার পর আমার বাড়িতে ফেরার পথে রাস্তা অতিক্রম করার সময় দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।

আমি আরও জানতে পারি যে, মুহাম্মদ যে রাস্তা পার হচ্ছিল তা ছিল টু—ওয়ে রাস্তা। এবং প্রত্যেকটা ওয়েতে ছিল আবার ২ টা করে লেন। রাস্তাটা ছিল ৪ লেনের। প্রথমে এক দিক থেকে ২ টা গাড়ি মুহাম্মাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। গাড়ি দুটির অবস্থান ছিল একজনের পেছনে অপরজন। তবে মুহাম্মাদ রাস্তা অতিক্রমের সময় রাস্তার সিগনাল লাইট সবুজ ছিল কি লাল ছিল সেটা নির্নয় করার উপায় নেই। এরপর প্রথম গাড়িটা মুহাম্মাদ এর খুব কাছ থেকে চলে যায়, কিন্তু দ্বিতীয় গাড়িটা মুহাম্মাদকে দেখতে না পাওয়ায় সরাসরি মুহাম্মাদকে ধাক্কা দেয়। এতে সে মাটিতে প্রচণ্ড আঘাতে লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয় কেউ একজন নাইন-ওয়ান-ওয়ান এ কল করলে সেখানে পুলিশ এবং ইমার্জেন্সি মেডিকেল কর্মীরা এসে উপস্থিত হয়। তখন আমি কাল বিলম্ব না করে বাসায় ফিরে আসি, এবং মুহাম্মাদের ব্যাগ থেকে তাঁর বাসার নম্বর নিয়ে আমি কল করে তাদের জানিয়ে দেই । যে লোকটি মুহাম্মাদকে আঘাত করেছে, যে গাড়িচালক, আমি তাঁকে পুলিশদের সাথে কথা বলতে দেখেছি। ক্যাশ এর বেশি কিছু বলতে পারেন না বলে তিনি জানান।

অপ্রত্যাশিত সত্যঃ

দীর্ঘ ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করে অবশেষে আব্বুকে দেখতে যাবার সময় হল। তখনো আমাদের তিন জনের মনের ভেতর শুধু একটা ব্যাপার ঘোরাফেরা করছে যে আমরা হয়ত আব্বুকে দেখতে পাবো কোন বেডে শুয়ে আছেন, আমরা গেলে এবং আমাদের ডাক শুনে তিনি চোখ মেলাবেন এবং আমাদের সাথে কিভাবে কি হল সেগুলো নিজেই বর্ণনা করতে পারবেন।

ওয়েটিং রুম থেকে ইমার্জেন্সী রুম খুব বেশি দূরে না। কিন্তু সেই মুহুর্তে আমার কাছে অনেক দূর মনে হচ্ছিল। মাত্র কয়েকটি অফিস রুম পার হলেই ডানহাতের দিকের সরু গলি পার করে সামনেই ইমার্জেন্সী রুম। স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভিড় । রিসিপশন এর নার্সদের কাছে জিজ্ঞাসা করতেই তারা আমাকে সামনের ডানদিকের একটা ঘর দেখিয়ে সেদিকে যেতে বলল। আমার সাথে আমার মা আর ভাই রয়েছে। তিনজনের ছয়টি চোখ তখন যেন কাকচক্ষুর ন্যায় সেই সোনার মানুষটার জন্য সন্ধিৎসু। আমরা সেই ঘরের ভেতর প্রবেশের চেষ্টা করলে ২ জন কর্তব্যরত ডাক্তার আমাদের ভেতরে যেতে নিষেধ করলেন এবং আমাদের জানালেন যে রোগীর গত ২ ঘণ্টা অবধি প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে । রোগীর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে দুর্ঘটনার সময়।

উক্ত দু’ জন ডাক্তারের মধ্যে একজন হলেন পাকিস্তান বংশদ্ভুত। তিনি আমাদেরকে দেখে একটু বেশি আগ্রহী হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি আব্বুর প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না বলে আমাদেরকে জানান। তবে আব্বুকে হাসপাতালে নিয়ে আসার সময় তিনি “ফার্স্ট রেস্পন্ডার” হিসেবে কাজ করেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, তোমাদের আব্বুকে যখন এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে এখানে আনা হচ্ছিল তখন তিনি “আল্লাহ! আল্লাহ!” এবং “পানি পানি” বলে কাতর কণ্ঠে বার বার বলছিল। তাঁর সাথে কথা বলার সেই মুহুর্তেও ডাক্তারেরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন আব্বুর দেহের রক্তক্ষরণ রোধ করার জন্য। কিন্তু তখনো আমরা জানি না, এই দূর্ঘটনায় আব্বুর দেহের কোথায় কি ক্ষতি হয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পর, পরিশেষে একজন ডাক্তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলেন। তিনি আমাদের তিনজনকে নিয়ে ইমার্জেন্সী রুমের বাইরের একটি ছোট কনফারেন্স রুমে নিয়ে গেলেন। তখন আমরা তিনটি প্রাণী যেন নিজের জানটা হাতের ভেতর ধরে রেখেছি। নিজের অজান্তেই মনের ভেতর এক ধরণের ভয় আগে থেকেই জমা হতে শুরু করেছিল। যেমনটা কল্পনা করেছিলাম ইমার্জেন্সী রুমে ঢকার আগে, পরিস্থিতি এর থেকেও অনেক গুরুতর বলে মনে হচ্ছে। অন্ততপক্ষেঃ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাদের সেই রকম মনে হচ্ছিল। কিন্তু অপর দিকে আবার মনে হচ্ছিল, না, তা কেন? আব্বুর তেমন কিছুই হয়নি। হয়ত কিছুদিন হাসপাতালে থাকা লাগবে, এরপর আমরা আমরা আব্বুকে বাসায় নিয়ে যাবো। সেবা-সশ্রুষাঢ় মাধ্যমে তিনি ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠবেন।
রুমের ভেতর ঢুকেই তিনি বেশ কিছু কাগজ আমাদের সামনে দিয়ে সেখানে আমাদের সই করতে বলেন। তখন বুঝিনি সেই কাগজটা আসলে বন্ড সই বা কনসেন্ট পেপার ছিল। কয়েক মুহুর্ত তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। তখন আমরা তিনজনই বুঝতে পারলাম আবারো যে অবস্থা অনেক বেশি ভয়াবহ। তিনি বলতে শুরু করেন এক এক করে আব্বুর কোথায় কি সমস্যা হয়েছে। তিনি বলেন, “ রোগীর ডানহাত এবং ঘাড়ের সংযোগস্থল থেকে খুলে গেছে, সেখান থেকে অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রোগীর হার্টে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে এবং সেখান থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তাঁর লিভারে সমস্যা হচ্ছে, সঠিকভাবে কাজ করছে না। তাঁর লাঞ্চ এর কার্যক্রম এখন পর্যন্ত অনেক সীমিত। তাঁর ডানপায়ের হাঁটুর চিচের হাড় পুরোটাই ভেঙ্গে দুই ভাগ হয়ে গেছে। মাথার পেছনের অংশটি আঘাতপ্রাপ্ত । এমন অবস্থায় কি হবে কিছু বলা যাচ্ছে না।”

এই কথা শোনার পর ক্ষণিকের জন্য আমাদের তিনজনের কাছেই মনে হয়েছিল আমরা যেনও এই দুনিয়াতে নেই। এতোগুলো ব্যাপার আমরা কিভাবে হজম করবো সেটা আমাদের জানা ছিল না। তখন আমরা কি করবো তা বুঝতে পারলাম না। ডাক্তার আমাদের উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করার কথা বলে আবার ইমার্জেন্সী রুমে ফিরে গেলেন। আমরা ডাক্তারের পেছন পেছন আবার সেই রুমের কাছে গেলাম যেখানে তখনো পর্যন্ত আব্বুর প্রাথমিক চিকিৎসা চলছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর হঠাত করেই আব্বুকে একটি বেড এ করে নিয়ে যাওয়া হল। সেই সময় আব্বুকে এক পলক দেখার সুযোগ হল। কিন্তু মনের ভেতর যে যন্ত্রণা কাজ করছিল তা আব্বুকে দেখার পর কিছুতেই কমছিল না, বরং আব্বুকে এমন মুমূর্ষ অবস্থায় দেখে তা যেন বহুগুণে বেড়ে গেল। পাকিস্তানী ডাক্তারের কাছে থেকে জানতে পারলাম আব্বুকে তখন কোমা তে রয়েছেন। তখন পর্যন্ত জানতাম না মানুষ কখন কোমাতে থাকে। আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হল আব্বুকে ছয় তলায় আইসিইউ তে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানেই তিনি থাকবেন। কিন্তু সাথে সাথে দেখা করা যাবে না। কয়েক ঘণ্টা পরে আব্বুর সাথে আমরা দেখা করতে পারব বলে জানতে পারলাম আমরা।

নিজেদের কিছুটা সামলে নিয়ে তখন আমরা ইমার্জেন্সী রুমের বাইরে ওয়েটিং এরিয়াতে বসে পড়লাম। তখন এগারো টা বেজে গেছে। পরের দিন শনিবার আমাদের তিনজনেরই কাজ ছিল। আমি আর ভাই কাজের ওখান থেকে ছুটি নিলাম। মা হেলথ কেয়ার এ কাজ করেন তাই তিনি আর ছুটি নিতে পারলেন না। সেই দিনের মত আমি বাসায় ফিরে আসি শত অনিশ্চয়তায় ভরা মন নিয়ে। ভাই আর মা সেখানে ছিলেন ভোরবেলা পর্যন্ত। এরপর প্রতিদিন আমি আর ভাই মিলে আব্বুর কাছে থেকেছি ২৪ ঘণ্টা। ঘুমিয়েছি হাসপাতালের চেয়ারে। খাবার খেয়েছি কখনো হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে। কখনো খেতে ইচ্ছা করেনি।
আইসিইউ এর দিনগুলোঃ

এইভাবে আমি আর ভাই মিলে প্রতিদিন আব্বুর পাশে থাকতে শুরু করলাম। আর বাদ বাকি সময় মা আমাদের সাথে থাকতেন, তবে মায়ের অসুস্থতার কারণে তাঁর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা রাতের বেলা তাঁকে হাসপাতালে থাকতে দিতাম না। এর মধ্যে আমাদের যত আত্মীয়স্বজনেরা আছেন এখানে, সবার কাছে আব্বুর এক্সিডেন্ট এর খবর পৌঁছে গেল এতদিনে। সবাই এসে দেখে গেছেন আব্বুকে। আইসিইউ এ থাকাকালীন সময়ে প্রথম কিছু দিনের মধ্যে আব্বুর দেহটা প্রচণ্ড আকারে ফুলে গেল। আব্বুর আকৃতি যেমন তাঁর থেকে তিন গুণ বেশি ফুলে গেল আব্বুর দেহ। ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাদের জানান যে আব্বুর দেহে তখন বিভিন্ন ধরণের এন্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। সুতরাং এর কারণে শরীর ফুলে গেছে। এমন অবস্থায় আব্বুকে ফিডিং টিউব এর মাধ্যমে পাকস্থলীতে খাবার দেয়া হচ্ছিল, এছাড়া আব্বু নিজে নিজে শ্বাস নিতে পারছিলেন না তাই তাঁর মুখের ভেতর দিয়ে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিল। আব্বুর শরীরে যেহেতু একই সাথে অনেকগুলো স্থানে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাই স্বাভাবিকভাবেই, সারা দেহে অনেক ব্যথা ছিল। এতো বেশি ব্যথা ছিল যা আব্বুর চেতনা থাকলে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাঁকে কয়েক রকম ড্রাগ দেয়া হচ্ছিল শুধুমাত্র ব্যথা কমাবার জন্য। তিনি তখন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। কেউ জানতো না কি হবে আব্বুর এখন। আমরা সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে আব্বুকে ফিরিয়ে দেবার কাকুতি- মিনতি করেছি।

লাইফ সাপোর্টে থাকাকালীন সময়ে আব্বুর অবস্থা এতোবেশি নাজুক ছিল যে এক সময় ডাক্তার বলেছিলেন যে এমন অবস্থায় কিছুই বলা যায় না। তাঁর বেঁচে থাকার ফিফটি-ফিফটি চানচ আছে। ২ সপ্তাহ কাটানোর পর হঠাত করে এমন অবস্থা হল যে আব্বুর দেহে ইনফেকশনের পরিমাণ এতো বেড়ে গেল যে আর কোন রকম এন্টিবায়োটিক কাজ করছে না। আইসিইউ তে থাকা রোগীরা সব থেকে বেশি সুবিধা পান কারণ হাসপাতালের সব রোগীর মধ্যে তাঁরা সব থেকে বেশি অসুস্থ । সুতরাং তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা একটু আলাদা হয়ে থাকে। আব্বুর জন্য হাসপাতালে একদল ডাক্তারকে নিযুক্ত করা হয়। এ সময় যেহেতু রোগী অনেক বেশি সংক্রমিত থাকেন, তাদের জন্য এন্টিবায়োটিক তৈরি করতে হয় । এ সময় ডাক্তারেরা শুধু বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে পরীক্ষা করেন কোনটি রোগীর উপকারে আসছে। আর প্রার্থনা করেন যেন কোনও একটি এন্টিবায়োটিক কাজে আসে। আমি দেখেছি ডাক্তারদের আইসিইউ এবং ল্যাব এ বার বার আসা -যাওয়া করতে, কারণ সে সময় আব্বু খুবই মুমুর্ষ ছিলেন এবং নাজুক অবস্থায় আইসিইউ এর বিছানায় নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাঝে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন।

তিন সপ্তাহ একটানা আব্বু ছিলেন অচেতন হয়ে লাইফ সাপোর্ট এ। এ সময়টা আমাদের জীবনের সব থেকে কঠিন মুহুর্ত ছিল। কি করবো, কোথায় যাব কোন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অন্যদিকে আব্বুর কর্মক্ষেত্রের কর্মকর্তাদের সাথে, আইনজীবীদের সাথে, এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হচ্ছিল। একদিকে আব্বুর ডাক্তারদের সাথে কথা বলা, অন্যদিকে বাইরের ব্যাপারগুলো মেইন্টেইন করা আমার জন্য ছিল অনেক বেশি কষ্টের। আর এই কষ্টটা আরও একটু বাড়িয়ে দিল পর পর ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার মাধ্যমে। আইসিইউ এর ভেতর আব্বু যে রুমে থাকতেন সেখান থেকে মাত্র ২ সপ্তাহের ব্যবধানে ৪ জন মানুষ মারা গেছেন। এমনকি আব্বুর ডানপাশের এবং বামপাশের বেড এ যে দুজন ছিলেন, তাঁরাও মারা যান। একজন ছিলেন আব্বুর সন্তানের বয়সী, আর একজন ছিলেন বয়স্ক। সেখানে দিনের পর দিন জীবন-মৃত্যুর লড়াই দেখতে দেখতে আমার মার মানুষিক অবস্থা অনেক বেশি নাজুক হয়ে পড়ে। তিনি মনে মনে ধরে নেন হয়তো আব্বুর ভাগ্যেও একই লেখা আছে। মা বাসায় গিয়ে প্রতিনিয়ত এই সব ভাবতেন এবং সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতেন।

২২ দিন পরে অবশেষে আব্বু চোখ খুলেন। প্রতিদিনের মত সেদিনও আব্বুর পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলাম। কিন্তু সেই দিনের কান্নাটা ছিল ভীষণ অন্যরকম। আমার জীবনে ঐ রকম খুশির দিন আসবে কি না তার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

শেষ কথাঃ

আব্বু এখন আছেন হোয়াইট প্লেইন শহরের শুনোমাকার নামক একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে । সেখানে তাঁর সব রকম সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিনি কথা বলতে পারেন না। তাঁর অঙ্গভঙ্গি দেখে অনুমান করা যায় যে তিনি পরিবারের সদস্যদের দেখে চিনতে পারেন। দুঃখের কোনকিছু তাঁর সাথে বললে, তিনি কান্নাকাটি শুরু করেন, ডাক দিলে দিক ফিরে তাকান একদম সুস্থ মানুষের মত। অল্প স্বল্প হাত এবং পা নাড়াতে পারেন। এখনো পাকস্থলীর সাথে সংযুক্ত আছে আব্বুর খাবার। তিনি নিজে নিজে খেতে পারেন না। গলার নিচে ছিদ্র করে সেখান দিয়ে আব্বুর উপযুক্ত অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। এখন আব্বুর আগের মত যখন তখন জীবন নাশের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আব্বুর মস্তিষ্কের ইনজুরি এতো বেশি যে কোন ডাক্তারের পক্ষে পরবর্তি পর্যায়ে কি হবে তা বলা সম্ভব না।
আজীবন পরিশ্রমী এই মানুষটাকে আজ অসময়ে বিশ্রামে দেখে বড্ডো খারাপ লাগে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৭:০১

অন্তঃপুরবাসিনী বলেছেন: ভাষা হারিয়ে ফেললাম।

আল্লাহ আপনার পিতার উপর রহমত করুন!!

২| ০৮ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:১৭

বিজন রয় বলেছেন: অবশ্যই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.