![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১
এক মাসও হয় নাই নীলা সল্ট লেকে আসছে । কোথায় বাবা-মা ভাই বোনকে মিস করে সময় কাটার কথা, তা না এটা ওটা গোছাতে গোছাতে মাস পার হয়ে গেল । এই এক মাসে অন্তত একশো বার ভাবছে, কি দরকার ছিল এখানে পিএইচডি করতে আসার ? আন্ডারগ্র্যাড শেষ করে চুপচাপ কারো ঘরের বউ হয়ে গেলে কি ক্ষতি ছিল ? মাত্র এক মাসে এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, সেও পায় নাই ।
নতুন দেশ, নতুন শহর, নতুন বাসা । থিতু হতে সময় লাগবে । নতুন বাসা ৪ তলা, সে দোতলায় থাকে । বাসাটা নিরিবিলি, চুপচাপ । পুরা শহরটাই এমন । এমনটাই চাইছিল সে । হৈচৈ এর ঢাকা শহর ছেড়ে তাই অত খারাপ লাগছে না । সমস্যা হল, রুমমেট মেয়েটা কোরিয়ান । নাম রুক্সি অ্যান । বাংলায় কথা বলা যায় না, কি যন্ত্রণা ! সারাদিন বাংলা বলতে না পারলে কেমন জানি ছটফট লাগে ।
আসার পর থেকে একবারও লন্ড্রি করা হয় নাই । অথচ মা বলে দিছিল “প্রতি সপ্তাহে দুইবার করে কাপড় ধুবি । খবরদার ময়লা কাপড় পরে ঘোরাঘুরি করবি না” । দেশে বুয়াকে কাপড় দিলেই কেঁচে দিত । এখানে আর বুয়া কই ? নিজে লন্ড্রি করতে হয় । লন্ড্রি করা এমন কিছু জটিল কাজ না । ওয়াশিং মেসিনে কাপড় ভরে দাও, ঘণ্টা খানেক বাদে ড্রায়ারে ভর, আরও ঘণ্টা খানেক বাদে তুলে নিএ যাও । ঝামেলা হচ্ছে, এই মেশিন আর ড্রায়ারের জন্য গ্রোসারির দোকান থেকে মনে করে কোয়ার্টার নিএ আসতে হয় ।
গতকাল শনিবার গেল । সারা সপ্তাহের পেইন শেষে এই দিনটাতে এত ঝিমানি লাগে যে আর কিছুই করা হয় না । আজকে তাই লন্ড্রি করা মাস্ট । রাতে রান্না করতে করতেই ১২টা /১টা বেজে গেল । মোটামুটি সারা সপ্তাহের রান্না, তাই সময় লাগে । খেয়ে দেয়ে দেড়টা বেজে গেল । কাপড় গোছাতে গোছাতে পৌনে ২ টা । আসলে খাবার আগে কাপড় মেশিনে দিয়ে আসলে হত । নেক্সট বার থেকে এমন করতে হবে ।
দরজা খুলে দেখে করিডোর শুনশান, কেউ নাই । দিনের বেলায়ই লোকের দেখা নাই, আর এখন তো রাত, তাও রবিবারের রাত । একবার ভাবল, অ্যানকে ডাকে । কিন্তু ওর দরজার নিচে অন্ধকার, ঘুমায়ে গেছে । পরে ভাবল এটুকুর জন্য মেয়েটাকে ডাকলে, যতদিন একসাথে থাকবে, ভীতু বলে পচানি খেয়েই যাবে । তাছাড়া করিডোরে আলো আছে, সিঁড়িতে আলো আছে, এত ভয়টা কিসের ?
২
জানুয়ারির ২৫ তারিখ, বেশ ঠাণ্ডা বাইরে ।
কাপড়ের বাস্কেট আর ডিটারজেন্ট এর প্যাকেটটা হাতে নিয়ে, দরজাটা বন্ধ করে দিল । করিডোরের শেষ মাথায় সিঁড়িটা । হাঁটতে হাঁটতে ১৭বি এর সামনে এসে উৎকট গন্ধ লাগে তার । নিশ্চয়ই নাইজেরিয়ান বুড়োটা গাঁজায় দম দিচ্ছে । কমপ্লেইন করে দেওয়া উচিৎ এটার নামে । দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে সে । নীচে নামতেই বিল্ডিং এর ব্যাক ডোরটা ধড়াস করে করে খুলে গেল । লালমুখো এক আমেরিকান টলতে টলতে ঢুকল । পিছনে পারকিং এ কোনও আলো নাই । সিঁড়ির আবছা আলো, দরজার বাইরে অন্ধকার, দরজায় মাতাল আমেরিকান, তার মত নিরীহ বাঙালি মেয়েকে ক্যাটাটনিক স্টেজে পৌঁছানোর জন্য মোর দ্যান এনাফ ।
মাতালটা সোজা তার দিকে আগায় আসল । পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখল । মনে হল শুকে দেখল । তারপর হলুদ দাঁত বের করে হাসি দিল ।
- লন্ড্রি নাইট, হাহ হানি ? ইউ মিসড মি ?
ভদকার গন্ধে বমি আসতে থাকে নীলার । কোনও কথা বলতে পারে না সে । ভয়ের চোটে কাঁদতেও পারতেছে না । মাতালটা পাশে দিয়ে ওপরে যেতে থাকে,
- কাম ব্যাক সুন ডার্লিং । আই’ল ওয়েট ফর ইউ । উই হ্যাভ এ লং নাইট এহেড । লং লং নাইট .........
পা দুটো অসাড় লাগে নীলার । সিঁড়ির গোঁড়ায় বসে পরে । এতক্ষণে কাঁদতে পারে সে । ভাবল ওপরে চলে যাই । দরকার নাই আজকে আর লন্ড্রির । পরক্ষনেই ভাবে মাতালটা যদি সত্যিই ওপরে দরজার গোঁড়ায় ওয়েট করতে থাকে ওর জন্য । বাকিটা সে আর ভাবতে চাইল না ।
চুপচাপ লন্ড্রি রুমে ঢুকে বাতি জ্বালায়ে দেয় । সামনের ড্রায়ারের ওপর বাস্কেট আর তার ওপর ডিটারজেন্ট এর প্যাকেট রেখে, জোরে জোরে শ্বাস নেয় । ৩০ সেকেন্ড আগে কি হয়ে গেল ভোলার চেষ্টা করতে হবে । মনে মনে জপতে থাকে, “কিছু হয় নাই, কিছু হবে না, আমি এখনও সেফ আছি” ।
হাতের ডানে একটা না দুইটা ভেন্ডিং মেশিন । একটা স্ন্যাক্সের, অন্যটা সফট ড্রিংকস । মেশিন দুইটা নতুন মনে হয় । যাই হোক, তার কাজ ওয়াশিং মেশিনে, ভেন্ডিং মেশিনে না । ৪ টা মেশিন পাশাপাশি । একটার ওপরে লেখা ব্রোকেন (মানে আউট অফ অর্ডার, জলজ্যান্ত দাঁড়ায়ে আছে মেশিন, ব্রোকেন মানে কি আবার ?)। দুই নাম্বার এর সামনে দাঁড়ায়ে মেশিনের দরজা টেনে ধরল ।
অমনি কি এক শব্দে ঘরের আলো নিভে গেল । ঝট করে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বুঝতে সময় লাগে তার । আলো নিভে গেল কেন ? শব্দই বা হল কিসের ? দরজার সেমি ট্রান্সপারেন্ট গ্লাসের ভেতর দিয়ে সামান্য ঘোলা আলো আসতে থাকে । তাতে প্রায় কিছুই দেখা যায় না । আবছা আলোয় একটা ভেন্ডিং মেশিন বোঝা যায় । স্বাভাবিক ইন্সটিঙ্কটে নীলার মাথায় আসে ভেন্ডিং মেশিনের সাথেই দরজা, দরজা খুললেই বাইরে আলো । এক পা এগোতেই দড়াম করে আওয়াজ হল । ওয়াশিং মেশিনের যে দরজাটা সে খুলেছিল, সেটার শব্দ । মেশিনের গায়ে বাড়ি খেয়ে সেটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করতে থাকে ।
৩
অন্ধকারে এবার ভয় লাগতে থাকে নীলার । ভয়াবহ নিক্টোফোবিয়া (আঁধারের ভয়) তার । ঘরেও বাতি জ্বালায়ে ঘুমায় সে । দরজা পর্যন্ত সাত পা দূরত্ব এখন তার সাত সমুদ্রের মতন মনে হতে থাকে । এক-আধ পা করে কোনও মতে দরজা পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা । এর মধ্যে দরজার কাচে কারো ছায়া পরে । কেউ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, কিন্তু খুলতে পারছে না । ইংরেজিতে গাল দিল কেউ । মনে হল মাতালটা ফিরে আসছে, সে জানত নীলা লন্ড্রি রুমেই গেছে । আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে আসে নীলার । ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে থাকে, কোনও ভাবেই যেন দরজাটা না খুলে ।
দরজা না খোলার কোনও কারণ নাই । কিন্তু কোনও অদ্ভুত কারণে ঈশ্বর এই আতঙ্কিত মেয়েটির কথা শুনলেন । দরজা খোলা গেল না, আরও কয়েকটা গাল দিয়ে বাইরের লোকটা সরে গেল । ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনও ওয়াশিং মেশিনের পাশে বসে পড়ল নীলা । শীতের মধ্যেও শরীর ঘেমে একাকার, দুর্বল লাগতে থাকে তার । কখন চোখটা বুজে আসল, সে টেরও পেল না ।
ঘুম ভাঙল গানের শব্দে । কেউ টেনে টেনে গান গাইতেছে । ঘুম পাড়ানি গান ।
“হাশ এ বাই ইউ সুইট লিটল বেবি
অ্যান্ড ডোন্ট ইউ ক্রাই এনি মোর
ড্যাডি ইজ ডাউন অ্যাট হিজ স্টকব্রোকারস অফিস
কিপিং দ্য উলফ ফ্রম দ্য ডোর”
ধড়মড় করে উঠে বসে নীলা । অন্ধকারে ভয়টা আবার জাঁকিয়ে বসে । কে গান গায় ? কে ? কাছেই কেউ উত্তর দেয়
- হায়, আই অ্যাম মিলিন্ডা রাইট
- আ আ ... কে ?
- আমি মিলিন্ডা, আমার মেয়ে জেন-কে ঘুম পারাচ্ছিলাম, তোমাকে বিরক্ত করলাম না তো ?
নীলার মনে হল তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে । যা হচ্ছে সব তার মাথার ভেতর হচ্ছে । এছাড়া এসবের আর কোনও ব্যাখ্যা হইতে পারে না । অনেক কষ্টে সে শান্ত থাকার চেষ্টা করে । কত রাত এখন ? পাশের গলাটা উত্তর দেয়
- রাত তিনটা বিশ এখন
- কে আপনি ? আমার কাছে কি চান ? এখানে কি করছেন ?
- কিছু চাই না তো । আমার মেয়েটা ঘুমাচ্ছিল না, ভাবলাম বাইরে হাঁটাহাঁটি করলে যদি ঘুম আসে আর কি
- কে আপনার মেয়ে ?
- এই যে জেন । আমার মেয়ে
৪
আঁধারে মহিলা কোন জেনকে কোন জায়গায় দেখাল কে জানে । সেটা কথা না । আজগুবি এই মহিলার সাথে কথা বলে নীলার মন একটু হালকা হয় । ভয় কম লাগছে এখন । কথা তো তাহলে চালানোই যায় ।
- আপনি কোন ফ্ল্যাটের ?
- ১৯সি
- ১৯সি তে তো জানতাম কোনও ইন্ডিয়ান থাকে ?
- আমরাই থাকতাম, তারপর একদিন লিহাইতে ফ্রুটল্যান্ড ভ্যাকেশন হোমে গেলাম । আর সব ওলট পালট হয়ে গেল
- কেন ? ওলট পালট হল কেন ?
- গর্ডনের মাথা খারাপ হয়ে গেল
- গর্ডনটা কে ?
- মাই বয়ফ্রেন্ড
- ও, তা কি হল ওনার ?
- রাতে ড্রিঙ্ক করে আসছিল । ঘরে ফিরে যা তা বলতে লাগল । হি সেইড, আই চিটেড হিম । জেন ইজ নট হিজ ডটার । আই কুডন্ট বিলিভ হি সেড দ্যাট, আফটার অল দিজ ইয়ার্স উই হ্যাভ বিন টুগেদার ।
- তারপর ?
- হি সেইড, হি ওয়ান্টেড আস টু গেট রিড অফ দ্য বেবি । অ্যান্ড ফর দ্যাট, হি উড ইভেন কিল মি ইফ নেসাসারি
- গেট রিড অফ দ্য বেবি - মানে কি ?
মহিলা উত্তর দিল না, বলে যেতে থাকল
- সো আই হ্যাড টু ডিফেন্ড মাইসেলফ অ্যান্ড জেন । কাবারডের ওপর থেকে শট গানটা নিলাম । গর্ডনই চালাতে শিখিয়েছিল । কাঁধের ওপর বাটটা চেপে ধরে ওর বুক বরাবর শুট করে দিলাম । জেন সাথে থাকায় ঠিকমত লাগাতে পারলাম না । গর্ডনের পেটে লাগল । ও “ইউ বিচ” বলে কোনও একদিকে সরে গেল
- কি সাংঘাতিক ! আপনি আর আপনার মেয়ে ঠিক ছিলেন তো ?
- তখন ভেবেছিলাম গর্ডন মরে গেছে । বোকা মেয়ে ছিলাম, জানতাম না যে, পেটে গুলি লাগলে মানুষ সাথে সাথে মরে না, ধীরে ধীরে মরে
- ও বেঁচেছিল তখনও ?
- হুম, নিজের রিভলবরটা খুঁজে নিয়ে আমাকে গুলি করে বসল
- বলেন কি ?
- ওর নিশানা সবসময়ই ভাল । বুলেটটা মাথার বাঁ পাশে লাগল । আর সব অন্ধকার
- হোয়াট ?!?!?
নীলা আর নিতে পারল না, মেন্টাল ব্রেকডাউন হয়ে গেল । হিস্টিরিয়ার ঠেলায় সে কোনও মতে নিজেকে টেনে নিয়ে গেল দরজা পর্যন্ত । কিন্তু দরজা খুলল না । দরজার হাতলে কেউ পাউডার দিয়ে রাখছে । বার বার হাত পিছলে যাচ্ছে । ঈশ্বরকে ডাকতে থাকে সে । (আয়রনি আর কারে বলে, ঘণ্টাখানেক আগেই সে দরজাটা না খোলার জন্য ঈশ্বরকে ডাকছিল, এখন আবার উলটাটা )। এবার আর ঈশ্বর তার ডাকে সাড়া দিলেন না, সবার সব ডাকে সব সময় সাড়া দেওয়া যায় নাকি !
সফট ড্রিংকসের ভেন্ডিং মেশিনটার বাতি জ্বলল । ওই আলোয় দেখা গেল, ৩৬ বছর বয়স্ক প্রেগন্যান্ট মিলিন্ডা রাইট পেটে হাত বোলাতে বোলাতে ভেন্ডিং মেশিনের দিকে আগায়ে যাচ্ছেন ।
- জেন, ইউ নো ড্যাডি লাভস ডক্টর পিপার । উই উইল বায় হিম ওয়ান অ্যান্ড সে উই লাভ হিম নো ম্যাটার হোয়াটসোএভার
খট করে একটা শব্দ হল । মেশিনের ওপেন কম্পারটমেন্টে পিপারের ক্যান পরার শব্দ । মিলিন্ডা নিচু হয়ে তুলতে গেলেন । ভেন্ডিং মেশিনের আলোয় করোটির চূর্ণ বিচূর্ণ বাম পাশটা দেখা গেল । মহিলা আবার তার অনাগত শিশুর জন্য গান ধরছেন
“হাশ এ বাই ইউ সুইট লিটল বেবি
অ্যান্ড ক্লোজ দোজ প্রিটি ব্লু আইস
মাদার হ্যাজ গন টু হার উইকলি ব্রিজ পার্টি
টু গেট হার উইই বেবি দ্য প্রাইজ”
চার নম্বর ড্রায়ারের সামনে নীলা এবার মূর্ছা গেল ।
৫
সকালে নীলার ঘুম ভাঙে অ্যানের ডাকাডাকিতে ।
- এই নিতা, নিতা গেত আপ (হেই নীলা, নীলা গেট আপ)
চোখ খুলে একগাদা লোক দেখে নীলার মত ইন্ট্রোভারট মেয়ে ভড়কে যাবে সেটাই স্বাভাবিক । সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার চেয়েও ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া লোকগুলার দিকে তাকায় । এদের কেউই বুঝতে পারছিল না এই মেয়ে লন্ড্রি রুমে শীতের মাঝে সারা রাত তার লন্ড্রি বাস্কেট দিয়ে ঠেস দিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছিল কেন । নীলাও এদের কৌতূহল ঠিকঠাক মেটাতে পারল না । একেক জন একেক থিওরি দিয়ে ও নিয়ে চলে গেল । সোমবারের সকাল বেলা, এত তামাশা দেখার সময় কার আছে ?
অ্যানের কাছ থেকে শুনল, সকালে কোনও মহিলা লন্ড্রি করতে এসে দেখে দরজা স্টাক হয়ে আছে । কেয়ারটেকারকে ডাকলে সে ধস্তাধস্তি করে লন্ড্রি বাস্কেটটা ভেঙ্গে দরজা খুলে নীলাকে পায় । মেঝেতে ছড়ানো কাপড় আর ডিটারজেন্ট, কিছুটা ডিটারজেন্ট ডোর নবে । ডিটারজেন্ট সহ বাস্কেটটা পরে যাবার সময় লাইটের সুইচটা অফ হয় । হঠাৎ আলো নিভে যাওয়া, রাতের বেলার আগন্তুকের দরজা খুলতে না পারা আর ডোর নবে হাত পিছলে যাওয়া কিছুই আর অলৌকিক মনে হয় না । পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর রকমের নাটকীয় মনে হয় । অযথাই লজ্জা পেতে থাকে সে । ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দেওয়া দরকার । প্রফেসরের মেইল আসে । বিরক্তিতে কুচকে যায় মুখটা ।
“বুড়ো, তুমি মারা খাও” !!!
৬
বিকালে ল্যাবে অলস বসেছিল । কাজ ঠিকই আছে, কিন্তু আজকে আর না, কালকে হবে । প্রকাস্টিনেশন জিনিসটা মনে হয় বাঙালির মজ্জাগত । রাতের কথা ভাবে, কি রাত গেল একটা ! কারো সাথে শেয়ারও করা যাচ্ছে না এটা । ল্যাবের কেউ বাংলাদেশী না । কারো সাথে সখ্যতা হয় নাই, কেমন জানি ফর্মাল ফর্মাল । ভিনদেশী ভিনভাষী এদের সাথে চট করে মেশা যায় না । ভাষা একটা বিশাল ব্যারিয়ার ।
পুরো ব্যাপারটা ভাবতে থাকে সে । এমন সাংঘাতিক একটা ঘটনা সে শুনল, বেশ কিছুটা দেখলও । অথচ গোটাটাই অবাস্তব । কেমনে হয় ?
মিলিন্ডা রাইট লিখে গুগল করল সে । হাবিজাবি অনেক কিছু চলে আসল । ফেসবুক, টুইটার এমনকি লিঙ্কডইন প্রোফাইল সহ । মিলিন্ডা রাইটের পাশে সল্ট লেক সিটি লিখে এন্টার চাপল । এবারও তেমন কিছু পাওয়া গেল না । মনে মনে খুশি লাগতে থাকে নীলার । পুরো বিষয়টাই অমূলক মনে হতে থাকে । অথচও সে মহিলার গাওয়া গানটাও শুনতে পাচ্ছিল । কি যেন গানটা – “হাশ বাই বেবি” অর সামথিং । আশেপাশের ফ্ল্যাটে কেউ নিজের পিচ্চিকে ঘুম পারাইতে পারে না – নিজেই সমাধান বের করে সে ।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে উঠতে যাবে, এমন সময় কিছু একটা মনে পড়ল । মিলিন্ডা রাইট এর সাথে গর্ডন রাইটও লিখল এবার । সল্ট লেকের বদলে লিখল লিহাই । ২৭ হাজার ৬০০ রেজাল্টের প্রথমটাতে ঢুকল সে । টাইটেল “কাপল ফাউন্ড ডেড ইন লিহাই-অ্যাপারেন্ট মার্ডার সুইসাইড” । ডেসক্রিপশন – “কাউন্টি শেরিফ’স অফিস ডিসক্লোজড পসিবল মার্ডার সুইসাইড অফ লিহাই কাপল...........অন ২৫ জানুয়ারি ২০১৫...............বডিস ফাউন্ড দ্য পাস্ট উইকেন্ড ইন ফ্রুটল্যান্ড ভ্যাকেশন হোম............কাপল হ্যাড বিন রিপোর্টেড মিসিং বাই ফ্যামিলি মেম্বারস............শেরিফস অফিস স্টেটস, ইট অ্যাপিয়ারস মিলিন্ডা রাইট, (থার্টি সিক্স) শট হিজ বয়ফ্রেন্ড, গর্ডন রাইট, (ফোরটি টু) অ্যান্ড দেন শট ইন হার হেড অ্যান্ড কিল্ড হারসেলফ...........ওয়াজ ৬ মান্থস প্রেগন্যান্ট.............ডেথস স্টিল রিমেইন্ড আন্ডার ইনভেস্টিগেশন......আফটার পোস্ট মরটেম দে হ্যাভ বিন বারিড ইন মাউন্ট অলিভেট সিমেটারি .........”।
শিরদাঁড়া বেয়ে কিছু একটা উঠে গেল নীলার । থরথর করে কাঁপতে থাকে সে । অনলি শি নোস ইন দ্য হোল ওয়ার্ল্ড, দেয়ার ওয়াজ’ন্ট এনি সুইসাইড । পুলিশকে ইনফরম করা উচিৎ কি ? করে লাভই বা কি ? দে আর ডেড এনিওয়ে । তাছাড়া মিলিন্ডা রাইটের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা কে বিশ্বাস করবে ?
৭
ট্র্যাক্সে করে গেলে স্টেডিয়ামের পাশেই মাউন্ট অলিভেট সিমেটারি । কি মনে করে নেমে গেল নীলা । এতশত কবরের মাঝে মিলিন্ডাকে খুঁজে পেতে তো ভালই ঝামেলা । মুস্কিল আসান করে দিল বুড়ো জর্জ । ৫০ বছর ধরে এই সিমেটারির কেয়ারটেকার । নিজের বয়স ৮০ এর বেশি হবে । মাথায় জটা জটা চুল, মুখ ভর্তি ঝাউ গাছের মত দাড়ি । দেখলেই ভয় লাগে । কিন্তু লোক ভীষণ আমুদে । নীলা একা একা হাঁটছিল । দূর থেকে দেখতে পেয়ে বুড়োই আগায়ে এসে, “হেই ইয়ং লেডি, লুকিং ফর সামথিং ?” বলে গপ্প জুড়ে দিল । শত শত গল্প তার ভাণ্ডারে, কবরের গল্প, এপিটাফের গল্প, মৃত্যুর গল্প । দুলে দুলে হেসে হেসে গল্প করছিল সে । মৃত্যুর মত এমন কঠিন বিষয় নিয়ে এত সহজ হালকা ধাঁচে কেউ গল্প করতে পারে একে না দেখলে বিশ্বাস করা মুস্কিল । চোখের সামনে এত এত মৃতদেহ দেখে বুড়োর আর মৃত্যুকে মৃত্যু মনে হয় না, ড্রামা মনে হয় । মনে মনে বিড়বিড় করে সে
“ইটস এ ভেরি সিম্পল ইস্যু, ইউ আর হেয়ার ফর অ্যান ইন্টারভাল । হোয়েন ইটস ওভার, ইটস ওভার । ইউ গায়জ মেক ইট আননেসাসারিলি ডিফিকাল্ট অ্যান্ড কমপ্লিকেটেড । ” – কত সহজ জীবনদর্শন ।
বুড়োর গল্প আর ফিলোসফির চক্করে আসল ব্যাপারটাই ভুলতে বসে নীলা । বুড়োকে বলতেই,
- ও গর্ডন রাইট, দ্যাট পুওর ফেলা !
- পুওর ফেলা ?!?!
- ইয়াহ, ওয়াজ শট বাই হিজ গার্লফ্রেন্ড, শি দেন সুইসাইডেড
কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিল নীলা । কাউকে বলা যাচ্ছে না যখন, একে বলে কি লাভ ? সিমেটারির পশ্চিম দিকে দুজনের কবর পাওয়া গেল পাশাপাশি । সাদামাটা এপিটাফ দুজনেরই । বিশেষ কিছু লেখা নাই । ওই ঘটনা নিয়ে তো কিছু নাই অবশ্যই । এপিটাফ দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে । নিজেকে একটু বেকুবের মত লাগতে থাকে । কেন আসল সে এখানে, সম্মান দেখাতে ? নিশ্চয়ই না ।
“সানস অফ বিচেস, মাদার***স”
চিৎকার করে ওঠে জর্জ । কি হল ?
- দিজ গড ড্যাম জাঙ্কিস আর শিটিং দিস প্লেস । দে অলওএস লেফট দেয়ার শিটস হেয়ার ।
বুড়ো রাগে গজগজ করতে থাকে । হাতে তার একটা ডক্টর পিপারের ক্যান । প্রতি সপ্তাহেই সে এই জায়গাটাতে পিপারের ক্যান পায় । সিমেটারির এই জায়গাটা অন্ধকার বলে হোমলেস জাঙ্কি গুলা এইখানে মাল খায়, ড্রাগ নেয় বলে তার বিশ্বাস । রামের সাথে পিপার ব্যাপক ফেভারিট ড্রিংক এদের কাছে । রামের দাম বেশি, তাই পিপার এর সাথে মিশায়ে খায় । ড্রিংক করতে করতে গান গায় এরা, ঘুম পাড়ানির গান, যতসব আকাইম্মার দল । এখানে লাইট আর ক্যামেরা লাগানোর কথা অফিসে সে অনেকবার বলছে । বারবার অফিস থেকে জানায় পয়সা নাই ফান্ডে ।
নীলা কয়েক মুহূর্ত খালি ক্যানটার দিকে তাকায়ে থাকে । আশ্চর্য স্বভাববিরুদ্ধ শান্ত তার দৃষ্টি । জর্জের দিকে চোখ ফিরিয়ে শান্ত গলায় জানায়
- জাঙ্কিস ডিড’ন্ট লিভ ইট হেয়ার, নাইদার দে স্যাং লুলাবিস
- দেন হু ডিড ?
- মিলিন্ডা
- হোয়াট মিলিন্ডা ?
- মিলিন্ডা রাইট, হু ওয়াজ কিল্ড বাই হার বয়ফ্রেন্ড হোয়াইল শি ওয়াজ সিক্স মান্থস প্রেগন্যান্ট
স্তম্ভিত জর্জকে পেছনে রেখে ফিরতি পথ ধরে নীলা । শীতের সময়, আলো পড়ে গেছে । বেশ ঠাণ্ডা বাতাস । অন্ধকারে সিমেটারির গেটের রাস্তা দেখা যাচ্ছে না । আজীবন নিক্টোফবিক নীলা কেন যেন আর এসব ভয় পায় না । এক প্রেগন্যান্ট মহিলা যদি রাত দুটায় তার অনাগত সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য সাড়া শহর ঘুরে ঘুরে গান গাইতে পারে, সে এই সামান্য অন্ধকার রাস্তাটা একা পার হইতে পারবে না ?
সিমেটারির গেট থেকে রাস্তায় আসল নীলা, অন্য এক নীলা ।
শি হ্যাজ বিন চেঞ্জড,
মিলিন্ডা রাইট চেঞ্জড হার ফরেভার,
দ্যাট লন্ড্রিরুম চেঞ্জড হার ফরেভার ।
(কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা আর কিছু আজগুবি ও কিছু গাঁজাখুরি ঘটনা অবলম্বনে !!!)
মে ২১, ২০১৬
©somewhere in net ltd.