নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্ত্যজ বাঙালী, আতরাফ মুসলমান ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান।রবীন্দ্রনাথ

ইমন জুবায়ের

জীবন মানে শুধুই যদি প্রাণ রসায়ন/ জোছনা রাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন। [email protected]

ইমন জুবায়ের › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: সন্ধ্যায়, মাটিরাঙ্গার আধো-অন্ধকার টিলায় ...

০৫ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৩:৫৯

মধ্য অক্টোবরের শীত মাখানো রোদে ঝলমল করছিল টিলাটা । বাতাসে ভাসছিল শিশির ভেজা গাছের ছাল ও বুনো লতাপাতার ঘন গন্ধ । ডাকবাংলোর মেন গেটের কাছে একটি লিচু গাছ। সে গাছেই ভোর থেকেই ঝাঁক ঝাঁক টিয়ে বসেছিল । ওদের ডাকাডাকিতে মূখর হয়েছিল ডাকবাংলোর বাগান। সকাল এগারোটার দিকে মাটিরাঙ্গা ডাকবাংলোর বারান্দায় বেতের সোফার ওপর গা এলিয়ে বসে ছিল আবিদ । বারান্দা ভর্তি ঝলমলে রোদ। বেশ ঘোর লেগেছিল আবিদের। কদিন ধরে ভিতরের কাঠ কাঠ ভাবটা মরে আবার জেগে উঠছিল সে-সেরে উঠছিল।

এ জন্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে আসা।

মাটিরাঙ্গা উপজেলাটি খাগড়াছড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমে।

হঠাৎই মেন গেটের ওপাশে গাড়ির হর্নের শব্দে ঘোর কাটল ।

এই রে সরকারি কর্তাব্যাক্তিরা বুঝি এসে গেল। আবিদের সঙ্গে মাটিরাঙ্গার এই সরকারি ডাকবাংলোটিতে থাকার অনুমতিপত্র নেই-কাজেই ক্ষীন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে সে । এসব ক্ষেত্রে কর্তাব্যাক্তি ভালো হলে নরম সুরে চলে যেতে বলেন, কিংবা মন্দ হলে গালাগাল না করলেও থানায় ফোন করার হুমকি দেন। বেতের টেবিলের ওপর আয়েস করে পা তুলে বসেছিল আবিদ। পাটা এখন নামিয়ে বসল। সিগারেট ধরিয়েছিল। চটজলদি ওটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে রাখল।

ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার বুড়োটি মেন গেট খুলে দিতে দৌড়েছিল। একটু পর সাদা একটি মাইক্রোবাস এসে থামল ডাকবাংলোর চত্তরে। মাইক্রোর গায়ে লাল রঙের সড়ক ও জনপদ বিভাগের ছিলছাপ্পড় দেখে যা বোঝার বুঝল আবিদ । মাইক্রোবাস থেকে প্রথমে নামলেন বেঁটে কালো আর থলথলে একটি লোক। লোকটার পরনে কালো রঙের বাহারি আর দামি সাফারি স্যুট হলেও লোকটার চেহারা কী রকম গেঁয়ো । ভদ্রলোকের পর মাইক্রোবাস থেকে যিনি নামলেন তাকে দেখে আবিদ মুগ্ধ বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কালো ব্লাউজ আর নীল পার শাদা শাড়ি পরা মধ্যবয়েসী শ্যামলা আঁটোসাঁটো শরীরের এক মহিলা । মিষ্টি চোখমুখ। নাকে সরু নথ। কী দারুন অভিজাত দেখতে। এত সুন্দরী মহিলা ঐ রকম বেঢপ একটা লোকের বউ! আবিদ ভিতরে ভিতরে দারুন হতাশ হয়ে পড়ে–। কালো রঙের সাফারি স্যুটপরা থলথলে লোকটি ততক্ষণে বারান্দায় উঠে আসার জন্য কাঠের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন। আবিদ প্রবল অস্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বারান্দায় উঠেই আবিদকে দেখে থমকে গেলেন ভদ্রলোক। আবিদের ঈষৎ কোঁকড়া বাদামি রঙের চুল, ফরসা মুখে কদিনের না-কাটা দাড়ি আর নীল জিন্সের ওপর নীল সোয়েটারের ফাক গলে সাদা শার্টের কলারের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর আবিদকে প্রায় অবাক করে দিয়ে হেসে হাত বাড়িয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন। রোডস অ্যান্ড হাইওয়েতে আছি।

ভদ্রলোকের থলথলে হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে জড়োসরো ভঙ্গিতে নীচু স্বরে আবিদ বলল, আমি আবিদ সারওয়ার । স্টুডেন্ট।

বসেন। বসেন। কবে আইছেন মাটিরাঙ্গায়? বলেই বেশ শব্দ করেই উলটো দিকের সোফায় বসলেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন । আবিদও জড়োসরো হয়ে বসে বলল, গতকাল। তার চোখ- নীল পার সাদা শাড়ি পরা মহিলার দিকে। বারান্দায় না-বসে বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে ভিতরে চলে গেলেন ভদ্রমহিলা। মনে হল আগেও এখানে এসেছেন।

ডাকবাংলোর গেট লাগিয়ে কেয়ারটেকার বুড়োটি এসে দাঁড়িয়েছিল। মাইক্রো থেকে ততক্ষনে দুটো স্যুাটকেস ছাড়াও দুটো বাঁশের খাঁচায় খরগোশ আর কবুতর নামিয়ে রেখেছে ড্রাইভার। সেগুলি বুড়োকে বুঝিয়ে দিতে লাগল। মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে চাকমা মনে হল আবিদের।

ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন বললেন, মাটিরাঙ্গা থেকে মহালছড়ি পরজন্ত রাস্তার মেরামত চলতে আছে। প্রজেক্টটা হইল আমারই আন্ডারে। কাজে কাজেই মাঝেমইধ্যে মাটিরাঙ্গা আসতে হয়।

ও। আবিদ জানে মাটিরাঙ্গার দক্ষিণপুবে মহালছড়ি উপজেলা । খাগড়াছড়ির দক্ষিণে।

আইজকাল চিটাগাং হিল ট্র্র্যাক্টস্ এ পর্যটক এত বাড়ছে। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন বললেন। নতুন রাস্তা না করলে বাঁচনের কায়দা নাই -বলে কী মনে করে ভদ্রলোক বললেন- গুইমারার কাছে লাস্ট নাইটে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হইয়া গেছে।

অ্যাক্সিডেন্ট! আবিদ মৃদু ঝাঁকুনি খেল। ওর সৌম্যদের কথা মনে পড়ল। সৌম্যরা তো মানিকছড়ি। মানিকছড়ি এখান থেকে অনেকই দূর। অনেক দক্ষিণে।

ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন বললেন, হ্যাঁ। গুইমারার ওসি সাহেব আইজ সকালে ফোন করছিলেন। জিপের ড্রাইভার নাকি আমার রেফান্সে দিসে। খাওয়াদাওয়ার পর একবার গুইমারার দিকে যাইতে হইবে। তখন সব শুইনা আইসা বলব নে।

কথা বলতে বলতে আবিদের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুনের একটা সর্ম্পক বেরিয়ে আসে। রোডস অ্যান্ড হাইওয়েতে ছিলেন আবিদের বাবার এক বন্ধু- মোকতাদির আঙ্কেল । এখন অবশ্য তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে গারমেন্টস দিয়েছেন । সেই মোকতাদির আঙ্কেলই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন এর কলিগ । দুজন দীর্ঘদিন একসঙ্গে চিটাগাঙে ছিলেন । আরে মোক্তাদিরের তো অ্যাজমা ছিল। আমিই তারে নাইনটি থ্রিতে ফটিকছড়িতে সত্তর হেকিমের কাছে নিয়া গেলাম । সত্তর হেকিমে কী ডোজ দিল-মোক্তাদির তো কইল শ্বাসকষ্টটা নামি কম।

আসলেই- কার কাছে যে কী থাকে আঙ্কেল। আবিদ বলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হারুন আঙ্কেলের কাছ থেকে সত্তর হেকিমের ঠিকানা নিয়ে মাকে নিয়ে একবার ফটিকছড়িতে কাছে গেলে হয় না । অবশ্য এতদিন পর -সত্তর হেকিমের বেঁচে আছেন কি না কে জানে।

তুমি ঠিকই কইছ ভাইসতা। কার কাছে যে কী থাকে। কই- ফটিকছড়িতে সত্তর হেকিম আমার ছোটবোন জামাইয়ের অ্যাজমা সারাইতে পারল? না, পারল না। কেমন নিভে যাওয়া কন্ঠে বললেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে মিসেস হারুন এলেন। ভদ্রমহিলা খুব একটা কথা বললেন না। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিলেন। মহালছড়ি থেকে আসার পথে মাটিরাঙ্গার হাটে মাইক্রো থামিয়ে ড্রাইভারকে দিয়ে তিন জোড়া কবুতর আর দুটি খরগোশ কিনেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন। সেসবেরই মাংস ছোট আলু দিয়ে ঝাল ঝাল লাল লাল করে রেঁেধছে বুড়ো কেয়ারটেকার। খেতে খেতে আড়চোখে মিসেস হারুনকে দেখছিল আবিদ । মুখচোখে উপচে পরা মাধুর্য। মায়ের সঙ্গে কোথায় যেন মিল। অথচ মা-

ভাইসতা সাবধান, একা একা বনেজঙ্গলে ঘুরবা না কিন্তু।ভাত খেতে খেতে কী মনে করে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন বললেন।

কেন আঙ্কেল? আবিদ বিস্মিত।

মহালছড়ির থানার ওসি রুকুনুদ্দৌলা সাহেবের কাছে শুনছি খাগড়াছড়ির গভীর জঙ্গলে নাকি বাঙালি তালেবানরা জড়ো হইতেছে। ঐ দিকে শান্তিবাহিনীও নাকি রিঅর্গানাইজ হইতেছে। কাজেই, অতি সত্তর কেয়ামৎ ঘনায়া আসতেছে। তাই কইলাম-একা একা মাটিরাঙ্গার বনেজঙ্গলে না ঘোরনই ভালো।

ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুনের কথা শুনে আবিদ অবাক। বলল, মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্টদের ব্যাপারটা না-হয় বুঝলাম আঙ্কেল -কিন্তু কিন্তু শান্তিবাহিনী কেন? শান্তিচুক্তি তো সাইন হয়ে গেছে।

ধুরও -তুমি যে কী কও না। ২০০১ সালে জোট সরকার আইসা তানে নানে কইরা শান্তিচুক্তির কনডিশন বাস্তবায়ন করল না। তেনারা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করবে কী-তেনারাই তো নাইনটিন সেভেনটি ফাইভে চাকমাগো ক্র্যাশ করার জন্য চিটাগাং হিল ট্র্র্যাক্টস্ এ আর্মি পাঠাইল। তারাই আবার ২০০১ সালে ক্ষমতায় বইসা নানান টালবাহানা কইরা শান্তিচুক্তির কনডিশন বাস্তবায়ন করল না। সেই আক্রোশে পাহাড়ি যুবকরা আবার একজোট হইতেছে শোনা যায়। ওইদিকে জোট সরকারের আমলে জোট সরকারের কয়েকজন মৌলবাদী মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় হাজার হাজার শিবির, জে এম বি আর হিযবুল তাহরির গং হিল ট্র্যাক্টস-এ ঢুকছে। কেন? বাংলাদেশরে আফগানিস্থান বানাইলে আমেরিকার লাভ-বাংলাদেশে ইনভেড করার উছিলা পাইব। জোট সরকারের আমলে জোট সরকারের কয়েকজন মৌলবাদী মন্ত্রী এই নিয়তে আমেরিকার টাকা খাইসে। জোট সরকারের আমলে জামাতি ইসলামিরে মডারেট গনতান্ত্রিক পার্টি কয় নাই আমেরিকা? কইছে। তাইলে? প্যাঁচ আরও আছে ভাইসতা। বাংলাদেশি মুসলিম ব্রাদারহুডেরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের টোটালি আপরুট করতে চায় । পাহাড়ি যুবকরা তাদের আর্মড প্রোটেকশান তো দিবই দিব-জাতের টান বড় টান না? কাজে কাজেই, বিপদ গ্র্যাজুয়ালি বাড়তেছে। তাই কইলাম একা একা তুমার মাটিরাঙ্গায় না ঘোরাই ভালো। তুমি বরং আজই ঢাকায় ফির‌্যা যাও ভাইসতা । যাইবা? আমি ব্যবস্থা কইরা দিতে পারি। রোডস অ্যান্ডের গাড়ি রোজ ঢাকায় যায় আসে।

দেখি। আবিদের মায়ের মুখটা মনে পড়ল। নাঃ এখন ঢাকা ফেরা যাবে না। মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যাবে না। ও দীর্ঘশ্বাস লুকায়।

খাবার পর মিসেস হারুন ভিতরে চলে গেলেন। সম্ভবত বিশ্রাম নেবেন। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন আর আবিদ বারান্দায় এসে বেতের সোফায় বসল। কি সিগারেট খাও তুমি ভাইসতা? দেও একটা ধরাই। যদিও ডাক্তার সাব ধূমপান নিষেধ করছেন-ধুরও ...সঙ্কোচ বোধ করলেও ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে একটা বেনসন লাইট বের করে দিল আবিদ । নিজে অবশ্য ধরালো না। গ্রাম্য কৃষকের মতন সিগারেট অর্ধেক টেনেছেন -এই সময়ে ভদ্রলোকের এলজিটা বেজে উঠল। কতক্ষণ মোবাইলে হু হা করলেন তিনি । তারপর এলজিটা অফ করে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এখনই আমারে একবার মাটিরাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি যাইতে হইব ভাইসতা। সেই অ্যাক্সিডেন্টের কেস। ফির‌্যা আইসা তোমারে ইন ডিটেলস সব বলব । বলেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে চত্তরে নেমে গেলেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন।

একটু পর মাইক্রোবাসটা স্টার্ট নিল।

আবিদ ঘরে না গিয়ে বেতের সোফাতেই বসে থাকল। ওর ধারনা-একটু পর মিসেস হারুন এই বারান্দায় আসবেন। খুব কাছ থেকে তখন শান্ত অভিজাত সৌন্দর্য দেখবে সে। মহিলা যদিও মায়ের বয়েসী -তাতে কী। আবিদের একটা আশ্রয় দরকার-গভীর আশ্রয়। ওর পায়ের তলার মাটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। ও একটা গভীর বিষাদে ডুবে আছে- ও ওর এক্স গাল ফ্রেন্ড রুমার ২২টি ছবি নিয়ে ঘুরছে কোনও নির্জন পাহাড়ি টিলায় পুড়িয়ে ফেলবে বলে। আবিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অন্যমনস্ক হয়ে সিগারেট ধরায়। মধ্য অক্টোবরের শীত মাখানো হলুদ রঙের রোদ ওর পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে। টিলার বাতাসে তখনও ভাসছিল শিশির ভেজা গাছের ছাল ও বুনো লতাপাতার গন্ধ । সেই গন্ধে ঘোর লাগল আবিদের । গতকাল বিকেলে মাটিরাঙ্গা পৌঁছে খুঁজেপেতে রেষ্ট হাউজ উঠেছে আবিদ। সরকারি ডাকবাংলো। জাত ভবঘুরে সে; তার সঙ্গে পারমিশন থাকার কথাই না। ডাকবাংলোর কেয়ারটেকারটি বুড়ো-জাতে ম্রো বোধহয়। একে অন্যের ভাষা বোঝার কথা না। আকারে ইঙ্গিতেই যা বলার বলেছিল আবিদ । বহুকষ্টে বুড়োকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ডাকবাংলোয় উঠে পড়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে মিরসরাই থেকে পুবমুখো হয়ে রামগড় অবধি এসেছিল আবিদ। জায়গাটা মাটিরাঙ্গার দক্ষিণে। ক’দিন তুফানের মতন ঘুরল রামগড়। পাঠাছড়া, হাপছড়ি ... সৌম্য-রনিরা তারপর হালদা নদীর ছবি তুলবে বলে মানিকছড়ির দিকে চলে গেল । মানিকছড়ি রামগড়ের দক্ষিণপুবে। আবিদ ওদের সঙ্গে গেল না। আবিদের হঠাৎই কী কারণে মানুষের সঙ্গ ভালো লাগছিল না। ওর সঙ্গে রুমার তেত্রিশটি ছবি ছিল । এগারোটি ছবি পাঠাছড়ার কাছে খুব ভোরে একটি টিলার ওপরে উবু হয়ে বসে পোড়ালো। বাদবাকি বাইশটি ছবি রেখে দিল। পরে পোড়াবে ... মাটিরাঙ্গা রামগড়ের উত্তরে। একাই সে মাটিরাঙ্গা চলে আসে। ডাক বাংলোটি ফাঁকাই ছিল। ম্রো বুড়োটি একটা ঘর খুলে দিয়েছে কাল বিকেলে। যতœ করে পাহাড়ি স্টাইলে বনমোরগ রেঁধে খাইয়েছে রাত্রে। যাওয়ার সময় বুড়োকে শ ’পাঁচেক টাকা দিয়ে যেতে হবে।

ট্যালকম পাউডারের হালকা সুগন্ধ পেল আবিদ।

পিছনে খসখস শব্দ হতেই মুখ ফিরিয়ে দেখল মিসেস হারুন। শাদা শাড়ি বদলে নীল একটা সুতির শাড়ি পরেছেন ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলা প্রায় মায়ের বয়েসী । কী রকম সঙ্কোচ হল আবিদের। আধখাওয়া সিগারেটটা রেলিংয়ের ওধারে ছুঁড়ে মারল । ভদ্রমহিলা মিষ্টি কন্ঠে বললেন, ঠিক আছে খাও। আমার ছেলেও তো আমার সামনেই খায়-কী এমন। বলে ভীষন ঘরোয়া ভঙ্গিতে আবিদের ঠিক উলটোদিকের সোফায় মিসেস হারুন বসলেন । ভদ্রমহিলার হাতে একটা নকিয়া। বললেন, এদিকে নতুন? নাকি আগেও এসেছ?

না। মাটিরাঙ্গায় আগে আসা হয়নি।

বেশ সুন্দর জায়গা। পিলাক নদী, আলুটিলা। তাইনডং, তবলছড়ি। তবে, মহালছড়ি আরও সুন্দর। কাছেই কাপতাই লেক। মিসেস হারুন বললেন।

আবিদ বলল, আমি অবশ্য রাঙামাটি গেছি বেশ কবার।

রাঙামাটি?

হ্যাঁ। আবিদ মাথা নাড়ে।

হঠাৎই মিসেস হারুন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। জান। বছর পনের আগে, তখনও শান্তি চুক্তি হয়নি, রাঙামাটিতে সাপছড়ির কাছে এক টিলায় শান্তিবাহিনীরা আমাদের ঘিরে ফেলেছিল।

বলেন কী! তারপর? আবিদকে কৌতূহল গ্রাস করে।

তারপর আর কী- মিসেস হারুন বললেন। সময়মতো আর্মি এসে পড়েছিল। গোলাগুলি হল। ওরা পালিয়ে গেল। লোকে শান্তিবাহিনী বলতে কি না কি বোঝে-আসলে ওরা তোমাদের মতোই বাচ্চা ছেলে।

আবিদ কী মনে করে বলল, আপনার হ্যাজবেন্ড কিন্তু বেশ আমুদে। দেখলে রাশভারী মনে হয়। তখন ভাবলাম আমাকে দেখে কী না কী বলেন।

কে আমার হ্যাজবেন্ড? মিসেস হারুন হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন।

কেন? হারুন আঙ্কেল- আবিদ থতমত খেল।

ভদ্রমহিলা মুখে হাতচাপা দিয়ে খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়লেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, ও। সবাই তাইই মনে করে। তুমি, এই ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার বুড়ো, মহালছড়ির গেস্ট হাউজের স্টাফরা ...

তা হলে? আবিদ অবাক।

কী তা হলে? ভদ্রমহিলার মুখে চাপা হাসি।

তা হলে আপনি হারুন আঙ্কেলের কে হন?

শুনতেই হবে?

আপত্তি না থাকলে ...

আপত্তি আর কি। আমি মিসেস হারুন নই। আমার নাম শায়লা, শায়লা পারভীন । আমার স্বামীও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি বেঁচে নেই।

সরি।

এত বছর পর সরি বলে আর কী হবে। তখন বললাম না- বছর পনের আগে তখনও শান্তি চুক্তি হয়নি রাঙামাটিতে সাপছড়ির কাছে এক টিলায় শান্তিবাহিনীরা আমাদের ঘিরে ফেলেছিল।

হ্যাঁ।

তখন ওরা ওয়াহেদ, মানে আমার স্বামীর পায়ে গুলি করেছিল।

আপনি?

আমাকেও করত। করার আগেই ছেলেটির মাথার মগজ উড়ে গিয়েছিল।

আবিদ শিউড়ে ওঠে।

আমার আজও মনে আছে- শায়লা পারভীন বলেন-আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। আমি আর আমার হাজবেন্ড পাশাপাশি পড়ে আছি ঘাসের ওপর। আমরা গোলাগুলি শুনে রেস্ট হাউজের পিছনে কাঁঠাল বনে লুকিয়েছিলাম। কেউ একজন এগিয়ে আসে। শার্টপ্যান্ট পরা। মাথায় পট্টি। চাঁদের পাশে তার মুখ- মুখটা বাঙালির মতো নয়। হাতে চাইনিজ স্টেনগান। প্রথমে ওয়াহেদের মুখের কাছে নলটা নিয়েও পরে কী মনে করে ওর পায়ের দিকে তাক করে ... তারপর আমার দিকে নল ঘোরায়। গুলি করার আগেই চাকমা ছেলেটির মাথার মগজ উড়িয়ে দিয়েছিল আর্মির গানম্যান।

আবিদ শিউড়ে ওঠে।

ওয়াহেদের ডায়াবেটিস ছিল- বাঁ পায়ে গ্র্যাংরিন হয়েছিল। শায়লা পারভীনের কন্ঠস্বরটা বিষন্ন হয়ে যেতে থাকে। পাটা কেটে ফেলতে হয়েছিল। তার পরও বাঁচানো যায়নি ওকে।

আবিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ওয়াহেদ মারা যাওয়ার পর আমি অথৈ জলে পড়লাম। ছোট ছোট দুটি ছেলেমেয়ে। তখন আমার হ্যাজব্যান্ডের বন্ধুরা এগিয়ে এল। আমি দ্রৌপদী হলাম।

দ্রৌপদী মানে? আবিদ অবাক।

দ্রৌপদীর নাম শুননি? থাক তা হলে। তোমাদের ভাষাতেই বলি-আমি আমার হ্যাজব্যান্ডের বন্ধুদের এবং আরও অনেকের এসকর্ট হলাম -মানে-সঙ্গীনি হলাম। কী এখন বোঝা গেল? নাকি আরও ভেঙ্গে বলতে হবে? তা হবে না। শাস্ত্রে নিষেদ। আবিদের ফরসা মুখটা কীরকম কুকরে যাচ্ছিল। স্ট্রেঞ্জ! এই মহিলা স্লাট! কী মিষ্টি চোখমুখ- সাবলাইম, অভিজাত, নাকে সরু নথ। তখন আবিদ ঘরে না গিয়ে বেতের সোফাতেই বসে থাকল। ওর ধারনা ছিল-একটু পর মিসেস হারুন এই বারান্দায় আসবেন। খুব কাছ থেকে শান্ত অভিজাত সৌন্দর্য দেখবে সে। মহিলা যদিও মায়ের বয়েসী -তাতে কী। আবিদ একটা গভীর বিষাদে ডুবে আছে ওর পায়ের তলার মাটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। আবিদের একটা আশ্রয় দরকার-গভীর আশ্রয়। আশ্রয় তো জুটল না-বরং ওর বিষাদ আরও ঘন হয়ে উঠল।

শায়লা পারভীন উঠে চলে যাবেন- এমন সময় তার হাতের নকিয়াটা বেজে উঠল । ওটা কানে তুলে কতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বললেন । তারপর ফোনটা অফ করে আবিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। বললেন ফিরতে রাত হবে। বেশ ঝামেলা হইছে নাকি। ঢাকার ৬/৭জন পোলাপান নাকি একটা পাহাড়ি মেয়েকে রেপ করছে। পোলাপাইনের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের এক ছেলেও বোনের ছেলেও আছে।

কী! আবিদ চমকে ওঠে। ... আমার আজও মনে আছে-আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। কেউ একজন এগিয়ে আসে। শার্টপ্যান্ট পরা। মাথায় পট্টি। চাঁদের পাশে তার মুখ- মুখটা বাঙালির মতো নয়। হাতে চাইনিজ স্টেনগান। প্রথমে মুখের কাছে নলটা নিয়েও পরে কী মনে করে পায়ের দিকে তাক করে ...

যাই। ঘুম পেয়েছে। তোমার হারুন আঙ্কেল কাল রাতে আমাকে ঘুমাতে দেননি। মাঝে মাঝে তিনি এত জ্বালাতন করেন। আমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখেন। আজও রাখবেন বলে মনে হচ্ছে।

শায়লা পারভীন চলে যান।

তারপরও ট্যালকম পাউডারের গন্ধ ভাসতে থাকে বাতাসে

আবিদ বসে থাকে। অবশ বোধ করে। সিগারেট বের করে ধরায়। শক্তি পায় না। মাথার ভিতরে শীতল স্রোত, জলের শব্দ ...ওর কেবলি মনে হতে থাকে-শায়লা পারভীনকে কিছুতেই এই রকম অস্বাভাবিক ভূমিকায় মানায় না। ডাকবাংলোর নিঃসঙ্গ ম্রো বুড়োকে মানায়-বাগানের ঐ হলুদ হলুদ সূর্যমূখির ঝারকে মানায়-এমন কী ওর অর্ন্তগত দুঃখ-শোককেও মানায় - কেবল ... কেবল শায়লা পারভীনকে কিছুতেই রক্ষিতার ভূমিকায় মানায় না। ...তারপর কখন সে উঠে দাঁড়ায়, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বাগানে নামে আসে। দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায়। তারপর দিকে হাঁটতে থাকে । বাগানে শেষ অক্টোবরের শীত মাখানো হলুদ রঙের রোদ ছড়িয়ে। তখনও টিলার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল শিশির ভেজা গাছের ছাল ও বুনো লতাপাতার গন্ধ । ডাকবাংলোর মেন গেটটা হা করে খোলা। পথটা ধীরে ধীরে নেমে গেছে। দুপাশে ইউক্যাপিটাস গাছ। দেবদারু গাছ। সেসব গাছে সবুজ রঙের ফার্ণ ঝুলে আছে। তাতে শেষ দুপুরের ঝলমলে রোদ। টিলা বেয়ে নামতে থাকে আবিদ। একটা কাঠবেড়ালী দৌড়ে গেল। আর কত যে শুকনো পাতা পথের ওপর। সিগারেটটা ছুড়ে মারল ...তাতেও আগুন জ্বলে উঠল না।

শায়লা পারভীনের স্বামীর পায়ে গুলি না লাগলে?

ঢালু পথটা পিচ রাস্তায় গিয়ে মিশেছে । ধুলো উড়িয়ে হর্ন বাজিয়ে একটা ট্রাক চলে গেল। তারপর একটা আর্মির জিপ। পিচরাস্তার দুপাশে বড় বড় কৃষ্ণচূড়া আর কড়–ই গাছ। সেসব গাছের পাতায় পাতায় অপরাহ্নের রোদ। সবুজ রঙের পুরনো একটা ধ্যাড়ধ্যারা একটা লোকাল বাস থেমে আছে। বাসের মাথায় কাঁঠাল আর মুরগির ঝাঁকা। কয়েকজন আদিবাসীর সঙ্গে দু-তিনজন হজুর-টাইপ লোক নামল বাস থেকে। চোখের পলকে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল তারা। হারুন আঙ্কেল তখন বলছিলেন: জোট সরকারের আমলে জোট সরকারের কয়েকজন মৌলবাদী মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় হাজার হাজার মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্ট হিল ট্র্যাক্টস-এ ঢুকছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের রাখতে চায় না ... কড়–ই আর কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে রাস্তার দুপাশেই হাটের মতন ভিড়। রাস্তার দুপাশেই বেতের ঝুরি নিয়ে আদিবাসী মহিলারা বসেছে। বেতের ঝুরি ভিতর শূকর। কোনও কোনওটায় বক, পায়রা কি ময়লা রঙের খরখোশ। হাটের পরিবেশটা কেমন থমথম করছিল। ৬/৭জন ঢাকার পোলাপান নাকি একটা পাহাড়ি মেয়েকে রেপ করেছে। আবিদ দ্রুত হাঁটতে পারে। পাকা কাঁঠালের গন্ধ ভাসছিল বাতাসে। এই বিকেলেও রাস্তার দু’পাশে কাঁকরোল আর করলার স্তুপ। ছালা বিছিয়ে একজন বুড়ি বসেছে দুটো পাঁতি হাঁস নিয়ে। কে কিনবে ওগুলো? মায়ের জন্য কি কেনা যায়? মায়ের ক্যান্সার। খবরটা শুনেই শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করল; মায়ের মুখটার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না ... তখনই শুনল রনি-সৌম্যরা মিরসরাই-রামগড় হয়ে আরও দক্ষিণে হালদা নদীর ছবি তুলবে বলে মানিকছড়ির দিকে যাবে। কোনওকিছু না-ভেবেই আবিদ ওদের সঙ্গ নেয়। শহরটা ছেড়ে ওর পালানো দরকার ছিল আরও একটি কারণে- রুমার ২২টি ছবিও কোনও নির্জন স্থানে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বাজারের আদিবাসী ভিড়ে চোখ ঘুরছে আবিদের। রাস্তার ধারে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা ঘরে বোনা তাঁতের কাপড় নিয়ে বসেছে। লাল রঙের। মায়ের জন্য নেব ওটা? এখন থাক। পরে। এখন রুমার ছবিগুলি কোথাও পুড়িয়ে আসি। হাঁটতে হাঁটতে মুখ তুলে তাকাল আবিদ। বাজার ছাড়িয়ে ডান দিকে একটা নালা। তারপর একটা পাহাড়ি পথ বেঁকে ওপরে উঠে গেছে। শালগাছে ঘেরা পথ। বাঁ পাশে সিমেন্টের সিঁড়ি-উঠে গেছে বৌদ্ধ মন্দিরের চাতালে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘোরের মধ্যে আবিদ হাঁটতে থাকে। তখনও কানে বাজছিল শায়লা পারভীনের কন্ঠস্বর। আমি দ্রৌপদী হলাম। দ্রৌপদীর নাম শুনেছ তো। না শুনে থাকলে বলি: দ্রৌপদী মানে এসকর্ট। কী এখন বোঝা গেল? নাকি আরও ভেঙ্গে বলতে হবে? ...ঐ মহিলা বেশ্যা! কী মিষ্টি চোখমুখ- সমাহিত, ধ্যানী, নাকে সরু নথ। অত সুন্দর বেশ্যা হয়। বাঙালি? তখন কী অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন-জান। বছর পনের আগে তখনও শান্তি চুক্তি হয়নি রাঙামাটিতে সাপছড়ির কাছে এক টিলায় শান্তিবাহিনীরা আমাদের ঘিরে ফেলেছিল। ওয়াহেদ, আমার স্বামীর পায়ে গুলি করেছিল। ডায়াবেটিস ছিল- বাঁ পায়ে গ্যাংরিন হয়েছিল। পাটা কেটে ফেলতে হয়েছিল। তার পরও বাঁচানো যায়নি ওকে।

শায়লা পারভীনের স্বামীর পায়ে গুলি না লাগলে?

টিলার ওপরে আসন্ন সন্ধ্যার গাঢ় ছায়া। আবিদ চারিদিকে তাকায়। কাঁঠাল আর শালগাছে ঘেরা খানিকটা সমতল জায়গা-আসলে সমতল জায়গাটাকে মাঠই বলা যায়-যেহেতু ঘাস আছে। মাঠের মাঝখানে বড় একটা পাথর। ডান পাশে একটা স্কুলঘরের মতন টিনসেড। কাউকে দেখা গেল না। বড় পাথরের দিকে এগিয়ে যায় আবিদ। ওর মনে হল ওকে কেউ আড়াল থেকে দেখছে। রুমার বাইশটি ছবি পকেট আছে। সেগুলি এখনও পোড়ানো হয়নি। বড় পাথরটার কাছে এসে পকেট থেকে লাইটার আর খামটা বার করল। তারপর উবু হয়ে বসে। এক পশলা বাতাস ছুটে এলো শালগাছের দিক থেকে। রুমার মুখটা আর সেই সঙ্গে মায়ের মুখটা মনে পড়ল। মাসখানেক হল মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে । এই সময় রুমা বিট্রে করল। লাইটারটায় স্পার্ক করে। ছবিগুলোর এক কোণায় লাফিয়ে পড়ে আগুনর স্ফুলিঙ্গ -তারপরে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছিল বলেই আগুন লাগা ছবির আগুন অনেকই স্পস্ট উঠল। ভিতরে ভিতরে অবশ বোধ করে আবিদ। কাদের যেন পায়ের শব্দ। মুখ তুলে দেখল ক’জন ছেলে ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। ছেলেগুলির বয়স ২২/২৩ বছরের বেশি হবে না। ওদের মায় টুপি, মুখে দাড়ি, পরনে পাকিস্তানি স্টাইলের সালোয়ার আর পাঞ্জাবি । কারও কারও পরনে গেঞ্জি। আবিদ উঠে দাঁড়ায়। কারা এরা? বাঙালি তালেবান?

এই-এইখানে আপনি কি করেন?

না, কিছু না। ঘুরে দেখছি।

কার ছবি পোড়ান?

না, মানে ... একটা মেয়ের।

কোন্ মেয়ে?

আমার এক্স গার্ল ফ্রেন্ডের

নামাজ নাই কালাম নাই- এইসবই করেন মিঞা। শালা আমেরিকানের বাচ্ছা। এই-গলায় এইটা কী। শালার পুতে গান শুনে। নামাজ নাই কালাম নাই। কোরান তেলোয়াৎ শুন না ...শালা আমেরিকানের পুটকি দিয়া বারাইছ।

কী বলতেছেন আপনারা?

চোওপ! বেশি কথা বললে কললা নামায়া ফেলমু। এই মিঞা আপনে হিন্দু না মুসলমান?

আমি আমি মুসলিম। বললাম না আমার নাম আবিদ সারওয়ার জয়।

কি নাম আপনের?

আবিদ সারওয়ার জয়।

নামাজ পড়েন?

পড়ি।

মিছা কথা।

মিথ্যে কথা বলে কী লাভ?

কয় ওয়াক্ত পড়েন?

ওয়াক্ত পড়িনা ... শুক্রবারে পড়ি ... জুম্মা

শালা ইহুদির বাচ্ছা। নামাজ পড়ে না। সত্য কইরা ক- কি নাম তোর?

নাম তো তখন তখন বললাম।

কইল মুসলমান। দেকি নুনু বাইর কর। শুয়োরের বাচ্ছা ...

এই এ কী কী করছেন ...ছাড়েন ...উহ্ ...

থাক। নাকে খত দিলে ছাইড়া দে। হাজার হইলেও মুসলমানের পোলা। অয় শালা আমেরিকানের বাচ্ছা ...তুই আবার মুসলমান হইবি। কলেমা পড়বি?

তরুণ জঙ্গিরা আবিদের জিন্সের প্যান্টটা টেনে টেনে প্রায় খুলেই ফেলেছে। ওরা আবিদের জাঙ্গিয়া খুলতে যাবে। ঠিক এমন সময় কাঁঠাল আর শালগাছের ওপাশ থেকে কারা যেন ফায়ার করতে থাকে । একজন তরুণ জঙ্গি চিৎকার করে বলল, শান্তিবাহিনী। চোখের পলকে সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ে। আবিদও ... এক নাগাড়ে কটা কট কটা কট শব্দ হচ্ছে। মেশিন পিস্তল? ওর ঠিক পাশে সেই বড় একটা পাথরটা ...ও আড়চোখে দেখল -একজন জঙ্গি ক্রলিং করে টিনসেডের দিকে যাচ্ছে। সম্ভবত অস্ত্র আনতে। বুকটা ধরাস ধরাস করছিল ওর।

কাঁঠাল আর শালগাছের ওপাশ থেকে কারা যেন ফায়ারিং করেই চলেছে। শান্তিবাহিনী। তখন হারুন আঙ্কেল বলছিলেন- প্যাঁচ আরও আছে ভাইসতা। বাংলাদেশি মুসলিম ব্রাদারহুডেরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের টোটালি আপরুট করতে চায় । পাহাড়ি যুবকরা তাদের আর্মড প্রোটেকশান তো দিবই দিব-জাতের টান বড় টান না? কাজে কাজেই, বিপদ গ্র্যাজুয়ালি বাড়তেছে।

ওপাশ থেকে কেউ গর্জে ওঠে: নারায়ে তাকবির ...

এদিকে প্রতিধ্বনি ওঠে-আল্লাহু আকবার ...

তারপর দুপক্ষের প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে আবিদের কেমন ঘোর লাগে। যদি গুলি লাগে? যদি মরে যাই? আমি নতুন করে আর কী মরব। মায়ের ক্যান্সার ... রুমাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে...শায়লা পারভীন ...

অনেক্ষণ পর।

যখন ভয়ঙ্কর সব শব্দগুলি থেমে গেছে ... আবিদ চেয়ে দেখে আকাশে মধ্য অক্টোবরের পরিপূর্ন গোল চাঁদ। কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। আজ সন্ধ্যার খন্ডকালীন যুদ্ধের বিজয়ী? ... শার্টপ্যান্ট পরা ... মাথায় পট্টি। মধ্য অক্টোবরের পরিপূর্ন গোল চাঁদের পাশে তার মুখ- মুখটা বাঙালির মতো নয় ... হাতে মনে হয় একটা স্টেনগান। চাইনিজ? প্রথমে আবিদের মুখের কাছে নলটা নিয়েও পরে কী মনে করে পায়ের দিকে স্টেনের নলটা তাক করে সে ... যেমন করে অনেক অনেক বছর আগে শায়লা পারভীনের স্বামীর পায়ের দিকে লক্ষ করে ঠিক এভাবে গর্জে উঠেছিল একটি চাইনিজ স্টেনগান...



উৎসর্গ: খলিল মাহমুদ। কেন যেন তাঁর ওইসব পার্বত্য অঞ্চলের প্রতি অন্যরকম এক টান ...

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৫/-১

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৪:৩৫

রুবাইয়াত ইসলাম সাদাত বলেছেন: মন্ত্রমুগ্ধ আমি। মনে হচ্ছিল সত্য ঘটনা। সুন্দর গাঁথুনি, জমাট। ভালো থাকুন ইমন ভাই।

০৫ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৫:১৮

ইমন জুবায়ের বলেছেন: তুমিও ভালো থেকো।
আকাশরা শুনলাম বান্দরবান যাচ্ছে।

২| ০৫ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৪:৩৮

খলিল মাহমুদ বলেছেন: মাটিরাঙ্গা উপজেলাটি খাগড়াছড়ির দক্ষিণ-পুবে।
___________________________________
মনে হয় দক্ষিণ-পশ্চিমে হবে।


গল্প সম্পর্কে অন্যবার বলবো।

০৫ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৫:১৫

ইমন জুবায়ের বলেছেন: হ্যাঁ। মাটিরাঙ্গা উপজেলাটি খাগড়াছড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমে। এক্ষুনি ঠিক করছি।

৩| ০৫ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৪:৫৩

সব্যসাচী প্রসূন বলেছেন: আমি জাস্ট হিপনোটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম....একটানে পড়ে ফেলেছি.... :| ... জটিল

০৫ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৫:১৯

ইমন জুবায়ের বলেছেন: থ্যাঙ্কস্ ।

৪| ০৫ ই মে, ২০০৯ রাত ৮:০১

সহেলী বলেছেন: পড়লাম , কখন যেন ফুরিয়ে গেল !

০৫ ই মে, ২০০৯ রাত ৮:০৩

ইমন জুবায়ের বলেছেন: আরও লেখা যেত। পাতা হিসেব করে লিখতে হয়। ৮ পাতার মধ্যে শেষ করতে হয়। যা হোক; পড়লেন বলে ধন্যবাদ।

৫| ০৯ ই মে, ২০০৯ সকাল ৯:১৬

মে ঘ দূ ত বলেছেন: অসাধারণ। পড়তে পড়তে সত্যজিৎ এর 'অরণ্যের দিনরাত্রি'র কথা মনে পড়ছিল।

..

মুসলিম ব্রাদারহুডের আগে 'বাংলাদেশী' শব্ধটা না পড়তে পারলেই বোধহয় আরাম পেতাম। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। এদিকে বাস্তবতাকে অস্বীকার করারও উপায় নেই।



০৯ ই মে, ২০০৯ সকাল ৯:২৯

ইমন জুবায়ের বলেছেন: মুসলিম ব্রাদারহুডের আগে 'বাংলাদেশী' শব্ধটা ...

এরা সব জায়গাতেই আছে। কী আর করা -এই বাস্তবতা। কিছু অসুন্দর লোক পৃথিবীটাকে অসুন্দর করতে জীবন পন করেছে। এই আক্ষেপ।

ধন্যবাদ, লেখাটা ভালো লাগার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.