![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এঁদের অনেকেই তখনো জানতেন না তাঁদের বাবা নেই। কেউ বা অনেক দিন আশায় ছিলেন, বাবা একদিন ফিরে আসবেন। কিন্তু বাবা আর ফিরে আসেননি। কীভাবে আসবেন? পাকিস্তানি সৈন্য আর রাজাকার-আলবদররা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছে। ইতিহাসের এক জঘন্যতম অধ্যায়ের বলি হয়েছিলেন সেদিন তাঁরা।
রায়েরবাজার বধ্যভূমির ওপর নির্মিত স্মৃতিসৌধে গত শনিবার বিকেলে এসে পৌঁছেছেন দুই ভাই সংগীতশিল্পী সাদী মহম্মদ ও নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ। সাদী জানালেন, একটু পরই তাঁর সরাসরি একটি অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং শুরু হবে। শিবলীর একটি বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। সেটি রেখে তিনি চলে এসেছেন। এ দুই শিল্পী শহীদ মহম্মদ সলিমউল্লাহর সন্তান।
তাঁদের বাবা মহম্মদ সলিমউল্লাহর কথা বলছিলেন তাঁরা। শিবলী তখন কিশোর। সাদী মহম্মদ স্কুলজীবন শেষ করেছেন। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার খবর পাওয়ার পরই এক অজানা আতঙ্ক নেমে এল। পরদিন যখন দুপুরের নামাজের জন্য মসজিদে গেলেন সলিমউল্লাহ, তখনই রচিত হলো বিভীষিকাময় এক অধ্যায়ের। ‘একটা গুলির শব্দ এল। রটিয়ে দেওয়া হলো, আমাদের বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। অমনি অবাঙালিরা একজোট হয়ে আমাদের বাড়ি আক্রমণ করল। কোনো রকমে আব্বাকে আমরা বাড়িতে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে চতুর্থ তলায় উঠে গেলাম। তারপর শুরু হলো বাড়িতে আক্রমণ। একটা সময় ওরা দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে গেল। আমরা ওদের বললাম, ভাই, আমরা গুলি ছুড়িনি। ওরা কেউ আমাদের কথা শুনল না। কয়েকটা শাড়ি এনে সেগুলো রশির মতো পেঁচিয়ে ছাদ থেকে পেছন দিয়ে নেমে যেতে বলা হলো। আম্মা নামতে গিয়ে পা ভেঙে ফেললেন। বাড়ির মেয়েরাও আহত হলো। পাশেই ছিল পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর এক লোক। সে একটা ছুরি হাতে এসে আব্বার শরীরে ঢুকিয়ে দিল। আব্বা মা গো বলে পড়ে গেলেন। আমরা চোখের সামনেই ঘটনাটা দেখলাম, কিন্তু বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বাবাকে আমি ধরলাম। আমাদের দিকে অবাঙালিরা তেড়ে আসছে। আব্বা বললেন, বাবা রে, আমি তো মরেই যাব। তুই সরে যা। তুই বাঁচ। আমি কোনো রকমে চলে এলাম। দেখলাম, বাবার গলায় একটি রড ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তারপর সেই অর্ধমৃত মানুষটির ওপর চালানো হলো নির্যাতন।’ এভাবেই ২৬ মার্চের দুপুরের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সলিমউল্লার ছেলে সাদী মহম্মদ।
আরেক ছেলে শিবলী মহম্মদ বললেন, ‘বাবার মরদেহ ওরা কোথায় নিয়ে গেল আমরা জানি না।’ সাদী মহম্মদ ও শিবলী মহম্মদ বাবাকে হারিয়ে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তবে তাঁদের দুঃখবোধ রয়েই গেছে। ‘যখন দেখি এ দেশে এখনো রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীরা সর্বত্রই প্রাধান্য পাচ্ছে, তখন কষ্টে বুক ভেঙে যায়।’ বললেন শিবলী মহম্মদ। দুই ভাই দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, তাঁদের চাওয়ার কিছুই নেই, তাঁদের মা এখনো বেঁচে আছেন। তিনি যদি অন্তত এতটুকু দেখে যেতে পারতেন যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, তবু কিছুটা শান্তি পেতেন।
সূর্যের তীব্রতা কিছুটা কমছে। বাতাসে উড়ছে জাতীয় পতাকা। এ সময় এলেন অভিনয়শিল্পী শমী কায়সার। তাঁর পর পরই এলেন রোকাইয়া হাসিনা। প্রথমজন শহীদুল্লা কায়সারের সন্তান, অন্যজন শিক্ষাবিদ রাশিদুল হাসানের।
শমী ও রোকাইয়া দুজনই তাঁদের বাবাকে হারিয়েছেন একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। দুজনই আজ বড় হয়েছেন। শমী এখন বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে পরিচিত একটি নাম। পাশাপাশি তিনি ধানসিড়ি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। অন্যদিকে রোকাইয়া হাসিনা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী; সম্প্রতি পেয়েছেন চ্যানেল আই সিটিসেল মিউজিক অ্যাওয়ার্ড।
রোকাইয়া হাসিনা বলছিলেন ১৪ ডিসেম্বরের কথা, ‘সকাল নয়টায় বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। আমার বয়স তখন ১২ বছর। আমাদের বাসায় সেদিন ছিলেন আরেকজন শিক্ষাবিদ আনোয়ার পাশা। তিনি মাকে বলেছিলেন, আজ খিচুড়ি খাব। হঠাৎ আমরা খেয়াল করলাম, বাড়ির আঙিনায় একটা বাস। কয়েকজন ছাত্র পরিচয়ধারী এসে আনোয়ার পাশাকে খুঁজতে শুরু করল। বাবা বললেন, তোমরা কারা? ওরা বলল, আমরা ছাত্র। আনোয়ার পাশাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলল। তখন পেছন থেকে একজন বাবাকে প্রশ্ন করল, আপনার নাম কী? বাবা বললেন, রাশিদুল হাসান। তখন সেই ছেলেটি বলল, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। আধা ঘণ্টা পরই আপনারা ফিরে আসবেন। নিচে গিয়ে দেখি বাবার শরীরে যে চাদর ছিল, সেই চাঁদর দিয়ে চোখ বাঁধা হয়ে গেছে।
টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা কান্না শুরু করতেই গুলি করতে করতেই তারা বাবা আর আনোয়ার চাচাকে নিয়ে গেল। তারপর আর বাবা ফিরে আসেননি। পরে মিরপুরে বাবার লাশ পেলাম। সেই লাশ ছিল একেবারে গলিত।’
বাবা রাশিদুল হাসানের উৎসাহেই রোকাইয়া হাসিনা গান শিখেছিলেন। বললেন, ‘বাবা ইংরেজির শিক্ষক হলেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর খুবই প্রিয় মানুষ। আমি ছোটবেলাতেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে গান শেখা শুরু করি। যে যাঁর উৎসাহে গানটা শুরু করেছিলাম, সেই বাবা আর আমার গানগুলো শুনতে পান না।’
স্মৃতিসৌধ দেখিয়ে রোকাইয়া বললেন, ‘এই রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধ হয়েছে; এর শুরুটা কিন্তু হয়েছিল আমাদের হাতেই। ১৯৯৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা প্রজন্ম ৭১-এর পক্ষ থেকে এখানে আসি এবং আমার মেয়ে অর্চি হাসান শাবল দিয়ে মাটি কেটেছিল। এখানে আমরা একটা প্রতীকী মিনার করেছিলাম।’
রোকাইয়ার কথার সূত্র ধরেই শমী বললেন, ‘৯৩ সালের সেদিন প্রজন্ম ৭১ থেকে আমরা যখন আসি, তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এসে দূরে একটি ফুলের শুভেচ্ছা দিয়ে চলে যান। এর পরই তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এলেন। আমাদের ডাকলেন। আমরা তাঁকে আমাদের দাবি জানালাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পাঠালাম। এখানে স্মৃতিসৌধ করা হবে—এমনটা জানলাম, কিন্তু পরের দুই বছরে কিছুই হলো না। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এই স্মৃতিসৌধ করা হলো।’
বাবা শহীদুল্লা কায়সারের কথা খুব বেশি মনে পড়ে না শমীর। খুব ছোট ছিলেন তিনি। ‘মায়ের কাছে শুনেছি যে, ১৪ ডিসেম্বর সকালবেলা বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এটাই শেষ। বাবা অনেক অনেক দূরে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। আজ আমি একটি অন্য কথা বলতে চাই। ৩৯টি বছর পার করলাম আমরা। এখন কিন্তু আগের স্থানে নেই বাংলাদেশ। এখন অনেক কিছুই অর্জন করেছি আমরা। এগিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। আমরা যখন থিয়েটার বা নাটকে কাজ করেছি, তখন বেশ কিছু জ্ঞানী থিয়েটারকর্মীর সংস্পর্শে এসে কাজ করেছি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে, আমি বলব না যে এখনকার তরুণ প্রজন্ম ব্যর্থ। আমি বলব, তরুণ প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে তোলার দায়িত্ব আমাদের। আমাদের আগের প্রজন্মেরও।’
শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ। বাবা ছিলেন সংগীতজ্ঞ, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...গানের সুরকার।বাড়ির লোকজন সবাই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। বাবাকে নিয়ে শাওনের খুব বেশি স্মৃতি নেই। এতটুকু মনে আছে, বিকেল হলেই বাড়িতে গানবাজনা হতো।
‘আমাদের বাড়িতে ওরা এল। এসেই খোঁজ করল, “আলতাফ মাহমুদ কে?” বাবা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আমি আলতাফ মাহমুদ।” বাবাকে ওরা ধরে ফেলল। নির্যাতনের মুখে বাবা স্বীকার করলেন, ডালিমগাছের নিচে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখা হয়েছে। বাবাকে ওরা বেয়নেট চার্জ করল। বাবাকে দিয়েই মাটি খুঁড়ে অস্ত্র তুলে আনল। তারপর বাবা, মামা ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে যায়। ১ সেপ্টেম্বর মামাদের ছেড়ে দিল ওরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখতাম, মা, নানি, মামারা বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করতেন। আমরা সে সময় রাজারবাগ এলাকায় ছিলাম। সেখান থেকে ১ নম্বর মালিবাগে চলে আসি। যখন আরও কিছুদিন গেল, তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারি বাবার অভাব। ’৮২ সালে আমাদের পরিবারের ওপর নেমে আসে আরেক ধরনের নির্যাতন। স্বাধীন দেশেই আমাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলো।’ বলছিলেন শাওন।
শাওন সেদিনের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি করে বলেন, এটা হওয়া জরুরি। বললেন, ‘স্বামী টিপু ও আমি—দুজন মিলে চলচ্চিত্রে বাবা যে জনপ্রিয় গানগুলো উপহার দিয়েছিলেন, সেগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। যেসব ছবির গান গাওয়া হবে, তার মধ্যে আছে বেহুলা, ক খ গ ঘ ঙ, দুই ভাই। বাবার আগামী অন্তর্ধান দিবসে এই গানের অ্যালবামটি নতুন প্রজন্মের জন্য নিয়ে আসব।’
শাওনের মতে, যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন একসময় খুব বেশি জোরদার ছিল, এখন সেটা অনেকটাই ভঙ্গুর। কারণ, এখন মতৈক্যের খুব অভাব। তার পরও কিছু চেষ্টা চলছে ভালো কাজ করার। এভাবে যদি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাজ করা যায়, তবে এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন অনেকটাই সমৃদ্ধ হবে।
শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনির (তন্ময়)। তিনিও বাবাকে হারিয়েছেন একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। তন্ময়ের বয়সও তখন চারের মতো। খুব বেশি কিছু মনে করতে পারেন না তিনি সেদিনের ঘটনার। পৈতৃক বাড়িতেই মুনীর চৌধুরী ছিলেন। একজন অপরিচিত লোক বাড়িতে এল। তারপর মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে গেল। ‘বাড়ির লোকজনের কাছে শুনেছি, বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন নাকি আমি চুপচাপ ছিলাম।’ বললেন তন্ময়।
বাবা নেই এ কথা তন্ময় বুঝতে পেরেছেন অনেক পরে। ‘যখন স্কুলে যেতাম, দেখতাম অনেকের বাবা আছে, কিন্তু আমার বাবা নেই। তখন জানলাম ঘটনাগুলো। তবে বাবা যে নাট্যকার ছিলেন, এ জন্যই আমি নাটক নিয়ে কাজ করছি, তা কিন্তু নয়। এটা অনেকটাই কাকতালীয়। পড়াশোনা শেষে বাবার লেখা নাটকগুলো নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করি। মুনীর চৌধুরীকে জানতে চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে থিয়েটারের বিষয়টা মাথার মধ্যে আসতে শুরু করে। একসময় নিজেই একটি দল গঠন করি। নাম ‘বঙ্গরঙ্গ’। এখন আমার কাছে মনে হয়, মুনীর চৌধুরীর লেখা যেসব নাটক আছে, সেগুলো কিন্তু মানুষের খুব বেশি কাছাকাছি আনা হয়নি। তাই আমি চেষ্টা করছি, বাবার লেখা নাটকগুলো মঞ্চস্থ করতে।’ বললেন তন্ময়।
জহির রায়হানের অন্তর্ধানের বিষয়টি ছিল আরও বেশি পীড়াদায়ক। দেশ স্বাধীন হয়েছে। বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে জহির রায়হান তখন ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। একদিন ভোরবেলা জহির রায়হান তাঁর ‘বড়দা’কে খুঁজতে গিয়ে নিজেই নিখোঁজ হলেন। অনল রায়হান বলছিলেন সে কথা। তিনি বললেন, ‘আমার বয়স তখন খুবই কম। আমার নিজেরও কিছু মনে পড়ে না। বাবার স্মৃতিই আসলে মনে করতে পারি না। যখন বাবার কোনো ছবি দেখি, তখন আবছা আবছা মনে করার চেষ্টা করি।’ বলছিলেন অনল।
অনল সাংবাদিকতা করেছেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করেছেন। এখন ধানসিড়ি বিজ্ঞাপনীসংস্থায় কাজ করছেন। অনল বললেন, ‘আসলে বাবা লেখালেখি করতেন বলে আমি এই মাধ্যমে এসেছি, সে রকম কিছু নয়। আপনা-আপনি চলে এসেছি। আমার ভাই বিপুল রায়হান নির্দেশক হয়েছে। বাবার কাজ এখনো যখন দেখি, ভালো লাগে। অনুভব করার চেষ্টা করি।’
রায়েরবাজারের বধ্যভূমির ওপর গড়ে ওঠা স্মৃতিসৌধের চারদিকের আলো তখন কমে এসেছে। একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে। এই অন্ধকার কেটে আলো দীর্ঘস্থায়ী হোক, এটাই সবার প্রত্যাশা।
©somewhere in net ltd.