![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!
এইচ আর ডিপার্টমেন্টের রবিউল সাহেবকে কে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়ে অফিস শেষ হবার দুঘণ্টা আগেই আজকে অফিস থেকে বেরিয়ে আসলেন শামসুল ইসলাম সাহেব। অফিস থেকে উনার বাসা অনেক খানি দূরে। প্রতিদিন অফিস থেকে বেরিয়ে মিনিট বিশেক হেঁটে সিএন্ডবি মোড়ে যান তিনি। সেখান থেকে রাইডারে চড়ে সোজা লালখান বাজার মোড়। রাইডারের ভাড়া আট টাকা।
আজকে ভাবলেন একটা সিএনজি নেবেন। আজকে বাসায় তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। তাঁর যে মেয়েটা এবার চিটাগাং কলেজ থেকে বোটানি তে অনার্স ফাইনাল দেবে তাকে আজকে দেখতে আসবে। সেই দেখতে আসা অনুষ্ঠানে বাবা হিসাবে তাঁরও উপস্থিত থাকা দরকার!
নিজের অজান্তেই শামসুল ইসলাম সাহেবের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। দুনিয়াতে পয়সা, পদ মর্যাদা এসব বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিষ! মেয়ের বিয়েতে মেয়ের মামার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কারন মেয়ের মামা ব্যাঙ্কে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।মেয়ের বাবার চিন্তা ভাবনা সেন্টিমেন্টাল এবং অবাস্তব! কারন তিনি একটা সাবান কোম্পানি’র সামান্য একাউন্টেন্ট এর চেয়ে বেশি কিছু কোনদিন হতে পারেন নি!
খালি একটা সিএনজি পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। শামসুল ইসলাম সাহেব হাতের ইশারায় সিএনজি থামালেন।
- লালখান বাজার যাবে?
- আসেন। ভাড়া দেড়শ টাকা!
- ভাই এত টাকা ত ভাড়া না। আশি টাকা যাবে?
সিএনজি ওয়ালা একটা অবজ্ঞার হাসি দিয়ে টান দিয়ে বেরিয়ে গেল। তাঁর নিজেকে নিঃবীর্য এবং অসহায় মনে হল। টাকাপয়সা না থাকায় এবং ছোট চাকরি করার কারনে সারা পৃথিবীটাই যেন তাকে অবজ্ঞা করছে! এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই তিনি সিএন্ডবি মোড় পর্যন্ত চলে আসলেন এবং অফ পিক আওয়ার দেখে ঠিক তখনি আসা একটা রাইডারের কান্ডাক্টর তাঁর পিঠে থাবড়া দিয়ে তাঁকে রাইডারে উঠিয়ে ফেলল! তিনি আরাম করে হাতের বাম পাশের পুরা একটা সিঙ্গেল সিট দখল করে বসলেন!
রাইডারের ভেতর বড় বড় করে লিখা ‘ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন’। এইটা মুশকিল আসানের দোয়া। শামসুল ইসলাম সাহেব বিড় বিড় করে পড়তে লাগলেন- লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন’। দোয়া পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই শামসুল ইসলাম সাহেবের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল। তিনি স্থান কাল ভুলে গেলেন! দু’হাত মোনাজাতের ভঙ্গিতে তুলে শব্দ করে বলতে লাগলেন- ইয়া আল্লাহ তুমি আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা কর। ইয়া পরোয়ারদেগার!
রাইডারের কন্ডাক্টর মায়নু’র বয়স বার বছর। মায়নু’র গলার আওয়াজ এই বয়সেই যথেষ্ট পুরুষালী! মাঝবয়সী লোকটার দিকে মায়নু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে মাঝবয়সী এই লোকটার কান্না ‘ভাড়া না দেবার ধান্ধাবাজি’ কান্না না! এর চেহারা বলতেছে এ পুরাই ‘দুই নম্বরি ছাড়া মানুষ’। মায়নু মাঝবয়সী লোকটার আরো কাছে সরে এল। ‘দুই নম্বুরি ছাড়া মানুষে’র গা থেকে পবিত্র একটা গন্ধ আসে। সেই গন্ধ নাকে লাগলে সোয়াব। মায়নু হাল্কা ধমকের(!) সুরে জিজ্ঞেস করল,
-চাচা কাঁদেন ক্যা? মনে দুঃখ?
শামসুল ইসলাম সাহেব পকেট থেকে রুমাল বের করে ভিজা চোখ মুছতে মুছতে সামনের নিষ্পাপ চেহারার ছেলেটার দিকে তাকালেন।তাঁর মনে হল এই ছেলেটা তাঁর আশেপাশের আর দশটা মানুষের থেকে ভিন্ন। আশেপাশে যার সাথে কথা বলতে যান সেই বলে, ‘আপনার চিন্তা ভাবনা অবাস্তব! ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বিদেশে থাকে। বাবার দুইটা বড় গার্মেন্টস। সৎ মানুষ বলে আপনার একটা পরিচয় আছে আর আপনার মেয়ে দেখতে সুন্দর বলেই হয়ত ওরা প্রস্তাব পাঠিয়েছে। শুধু সেন্টিমেন্টাল(!) কারনে এরকম প্রস্তাব হাতছাড়া করবেন?’ শামসুল ইসলাম সাহেব ঠিক করলেন এই মাসুম বাচ্চা ছেলেটার সাথে কথা বলে দেখবেন। ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি ছেলেটার সাথে কোথায় যেন একটা যোগাযোগ অনুভব করলেন!ছেলেটার মুক্ত চোখ দুটার কোন কোনা'ই যেন মরে যায়নি! তিনি ছেলেটাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন-
-আচ্ছা বাবা, তুমি বলত কোন মানুষের কি অন্য মানুষের অধীনে থাকা উচিত?
-ক্যা? মানুষ মানুষের অধীনে থাকব ক্যা? উপরে আল্লাহ। নিচে সব মানুষ ত সমান! রথ দিয়া কামাই করব। কামাই কইরা খাইব! নিজের ইচ্ছামত থাকব!
-বাবা যেসব মানুষ অইন্য মানুষের অধীনে থাকতে পছন্দ করে তারা কি ‘ঠিক মানুষ’?
-হেরা হইল বিরাট ধান্ধাবাজ! যার অধীনে থাকব হেরটাও খাইব! আবার ‘হের অধীনে থাকলে এই ভালা হেই ভালা’ কইয়া ‘যেই আবালটিরে ভুংভাং দিয়া রাখছে’ হের থেইকাও খাইব! এই হালারা সুমায়মত দু’দিকেই পল্টি খাইতে জানে!
শামসুল ইসলাম সাহেব অবাক চোখে বার বছর বয়সী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি তাঁর আটান্ন বছর বয়সে তিলে তিলে যে সত্য টা আবিষ্কার করেছেন এই বার বছর বয়সী ছেলে সেটাই কি অবলীলায় বলে দিল!
বহদ্দার হাটের ভাঙ্গা রাস্তায় রাইডার ব্যাপক ঝাঁকি খাচ্ছে। সামনের সিট ধরে তাল রাখতে রাখতে শামসুল ইসলাম সাহেব মায়নু’র চোখে চোখ রেখে বললেন,
-আমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসছে। ছেলে বিরাট শিক্ষিত। বড়লোক। কিন্তু দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনা!
-রেজাকার?
-হ্যাঁ!
-থাবড়া দিয়া ঘরেত্থে বাইর কইরা দেন! রেজাকারের লগে মাইয়া বিয়া দিবেন ক্যা?
-কিন্তু আমার কথা কেউ শুনতেছেনা। মেয়ের মামা বড় অফিসার। সে বলতেছে- এসব তুচ্ছ(!) সেন্টিমেন্ট দিয়ে নাকি দুনিয়া চলেনা। পৃথিবী নাকি অনেক আগাই গেছে!
-মাইয়ার মামা মানে আপ্নের শালা! হেরে আরেকটা থাবড়া দেন! হেরে কন, তর মাইয়া রেজাকারের লগে বিয়া দিয়া তুই তর দুনিয়ারে আরো আগাই দে! আমার দুনিয়া তর আগাই দেওনের কাম নাই!
-কিন্তু বাবা ওরা সবাই খুব প্রভাবশালী, উঁচু স্তরের লোক। ওদের সাথে আমি ত পেরে উঠব না!
-ক্যা? পারবেন না ক্যা? আমার গাড়ি'ত উইঠা কেউ তাফালিং করলে আমি ত হেরে গাড়ি'ত্থে নামাই দেই। কই, আগে ভালা অইয়া ল। ভালা অইয়া তারপর গাড়ি'ত উঠবি!
-আমি পারি না কেন?
-আপনে ভোঁতা দা হইয়া গেছেন। দাও ধার দেন! আপনেও পারবেন!
রাইডার মুরাদপুর পার হয়ে দু’নম্বর গেটের কাছাকাছি চলে এসেছে। শামসুল ইসলাম সাহেব বুক চিতিয়ে রাইডারের ভেতর বসে আছেন! তাঁর মনে হচ্ছে রাইডার’টা কোন রাইডার নয়। এটা একটা আস্ত ইউনিভার্সিটি এবং এই ইউনিভার্সিটির বার বছর বয়সী প্রফেসর(!) এই মাত্র তাকে পৃথিবী’র সবচেয়ে মূল্যবান পিএইচডি ডিগ্রি উপহার দিয়েছেন!
©somewhere in net ltd.