নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। ইহা ক্ষুধা উদ্রেক করে!

হঠাৎ ধুমকেতু

আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!

হঠাৎ ধুমকেতু › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাদা ছড়ি

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ২:১৩

মোটা ফ্রেমের কাল চশমা’য় দুচোখ ঢাকা। শুকনা গায়ে মলিন হলুদ রঙের শার্ট। কাঁধের একপাশ দিয়ে ঝুলছে একটা কাল রঙের ঝোলা। ডান হাতে ধরা শাদা ছড়ি টা ঠুক ঠুক শব্দে একবার ডান দিকে, আরেকবার বাঁ দিকে ঠুকে ঠুকে লোকটা বারান্দা বরাবর হেঁটে আসছে। আমি নজরুল ইসলাম হলে আমার রুমের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। সাদা ছড়ি আমার পা স্পর্শ করতেই লোকটা থমকে দাঁড়াল! তারপর বলল,



-ভাই আমি কলম বিক্রি করি। চকের থেইকা পাইকারি রেটে কলম কিন্ন্যা আনি। তারপর অল্প লাভে বিক্রি করি। এইখানে আমি পরথম আসছি ভাই। আপনি যদি আমারে একটু সাহাইয্য করেন তাইলে খুব উপকার হয় ভাই!



লোকটাকে সাহায্য করার স্বতঃস্ফুর্ত একটা অনুভূতি আমার মধ্যে কাজ করল। কারন টা ব্যাখ্যা করি। পাবলিক বাসে কেউ কেউ যাত্রীদের হাতে ‘দুঃখ কাহিনী সংবলিত চিরকুট সহ চকলেট’ ধরিয়ে দেয়। ব্যাপারটা মূলত ভিক্ষাই। চকলেটের মাধ্যমে ‘ আমি ত আসলে ভিক্ষা করছি না’ এইরকম একটা ভুল বার্তা দেবার চেষ্টা করা হয়। এই লোকটার এটিচুড যদি তাদের মত হত তাইলে সে তার বক্তব্য শুরু করত- ‘ভাইজান, আমি একজন অন্ধ মানুষ’ এই ভাবে। কিন্তু সে তার পুরা বক্তব্যে অন্ধত্বের উল্লেখ মাত্র করে নাই।



কাজেই আমি তাকে নিয়ে রুমে রুমে গেলাম। বলা বাহুল্য আমার প্রমোশানে(!) তার ঝোলার অনেক গুলো কলম অতি অল্প সময়ে বিক্রি হয়ে গেল এবং সে আমাকে বার বার বলতে লাগল- আপনি আমার বিরাট উপকার করলেন ভাই!



সে সহ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনি অন্ধ মানুষ, এই যে চকে যাইতেছেন, কলম কিন্না সেগুলা নিয়া আবার বিভিন্ন যায়গায় যাইতেছেন, যাতায়াত ক্যাম্নে করেন?



কেন? বাসে যাতায়াত করি।



বলেন কি? ঢাকা শহরে যাদের চোখ আছে তারাই পাব্লিক বাসে উঠতে হিমশিম খায়! আপনি অন্ধ মানুষ হয়ে-



মানুষ সাহাইয্য করে।বাস কন্টেক্টার, হেল্পার রা সাদা লাঠি দেখলে ধইরা উঠায়। বিশেষ করে দোতালা বাসে। দোতালা বাসে বড় পা’দানি থাকায় ধইরা উঠাইতে সুবিধা! চকে গেলেও সবাই আমারে চিনে। সবাই সাহাইয্য করে ভাই!



আমি তাকে বুয়েটের আরও দুএকটা হলে যাবার রাস্তা বাতলে দিয়ে আমার রুমে ফিরে আসলাম এবং মনে মনে ভাবতে লাগলাম- যে চোখ মানুষ কে চলার পথ দেখায় সে চোখ হারানোর পর ও লোকটা তার স্বনির্ভর পথ চলা থামায় নি! কি অসামান্য ব্যাপার!



এরপরে অনেক স্বাস্থ্যবান লোক কে ভিক্ষা করতে দেখে পলকে তার কথা মনে পড়ে গেলেও কয়েকমাস সময়ে ধীরে ধীরে তার স্মৃতি ঝাপসা হতে হতে আমার মস্তিষ্ক থেকে মিলিয়ে যায়।



কিন্তু এর ও পরে আরেকদিন রাতে তার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। এবং সেদিনের ঘটনা তার স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে অক্ষয় করে দেয়!



আমি আর সাদিন বুয়েটের মেইন গেটের সামনে বড় রাস্তায় ট্রাফিক আইল্যান্ড টার উপর বসে আছি।একটা দুটা রিকশার ঠুন ঠুন বাদ দিলে রাত এগারটা বাজতেই ‘পলাশি- বকশী বাজার-চাঙ্খার পুল’ হাইওয়ে প্রায় ফাঁকা! হঠাৎ দেখি আহসান উল্লা হলের গেট দিয়ে একটা সাদা ছড়ি ঠুক ঠুক করতে করতে বেরোচ্ছে! ম্রিয়মাণ সোডিয়াম এবং নিয়ন আলোয় সেই একই হলুদ শার্ট আরো অনেক বেশি মলিন লাগছে। মোটা কাল সানগ্লাস আগের মতই। কাঁধের একপাশে ঝুলতে থাকা ঝোলার ‘আনন্দময় শূন্য আয়তন’ সহজেই অনুমান করা যায়! সে আমাদের দিকেই আসছে।

মুহুর্তের বাস্তবতায় আমরা চক্ষুষ্মান হলেও মহাকালের বাস্তবতায় আমরা সবাই অন্ধ। সাদা একটা ছড়ি একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে ঠুকে ঠুকে আমরা পথ চলি। মহাবাস্তবতার সেই রূপই যেন প্রতীকী বাস্তবতা হয়ে এগিয়ে আসছে আমার এবং সাদিনের দিকে। স্থূল বাস্তব জগতে দাঁড়িয়ে আমরা পরম বিস্ময় নিয়ে দেখছি মহাবাস্তব জগতের একটা মুহুর্তের মুর্ত হয়ে উঠা। সেই মুহুর্তের কাছে আমরা আত্নসমর্পন করে আছি। সেটা পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমাদের নাই। আপন নিয়মেই সেই মুহুর্তের একটা গ্রন্থি একটা সাদা ছড়ির মৃদু আঘাত হয়ে আমাকে নয়, সাদিন কে ছুঁল! তারপর সাদিনের উদ্যেশ্যেই কথা বলে উঠল অন্ধ আগন্তুক!



- আমাকে একটু বাসে উঠাই দিতে পারবেন ভাই? এইখান দিয়া দোতালা বাস গুলিস্তানের দিক যাইব। আমাকে সেই দোতালা বাসে উঠায় দিবেন!



- আপনি কোত্থেকে আসতেছেন ভাই?, সাদিন জিজ্ঞেস করল।



- আমি আজকে শহিদ স্মৃতি হল, আহসান উল্লাহ হলে কলম বিক্রি করলাম। কলম সব বিক্রি হয়ে গেছে ভাই!



- বাহ, আপনি এই হল গুলো চিনলেন কেমনে?



- এখানে আমি প্রথম আসি নজরুল ইসলাম হলে। এক ভাই আমাকে সব রুমে নিয়ে নিয়ে যায়। ভাই আমার সব কলম বিক্রি করে দেয়। তারপর আমাকে অন্য হল গুলাও চিনাই দেয়!



- অই ভাইয়ের নাম কি?



- আমি ভাই কে নাম জিজ্ঞেস করছিলাম। ভাই নাম বলে নাই। কিন্তু ভাই সেদিন আমার অনেক উপকার করছেন। ভাইয়ের জন্য আল্লাহ’র কাছে অনেক দোয়া করছি ভাই!



সাদিন আর আমি ততক্ষণে ট্রাফিক আইল্যান্ড থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি! পলাশী বাজারের দিক থেকে আসতে থাকা অশোক লে ল্যান্ড দো’তলা বাস টার লাল রঙ মিশ্র সোডিয়াম নিয়ন আলোয় কালচে মেরে গেছে। স্পীড ব্রেকারে বাস স্লো হতেই আমরা তাকে দোতলা বাসের প্রশস্ত পা’দানি তে উঠতে সাহায্য করলাম। বাসের হেল্পার পরম মমতায় সাদা ছড়ি সহ অন্ধ মানুষ টাকে বাসের ভেতর ঢুকিয়ে নিল!



স্মৃতির ডিভিডি প্লেয়ারে এই অক্ষয় ডিভিডি গুলো যখন মাঝে মাঝে অটো চালু হয় তখন বুঝতে পারি- পেট্রোল বোমা এবং মানুষের জঘন্য নৃশংসতার চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী মানুষের একান্ত আত্ম সন্মানবোধ এবং অন্তরের ছোট ছোট মানবতা বোধ! সেই বোধ গুলোই হয়ত পৃথিবীর মানচিত্রের ছোট্ট একটা লাল সবুজ দেশ কে আজো বাঁচিয়ে রেখেছে।



(নববর্ষে পৃথিবীর মানচিত্রের ছোট্ট একটা লাল সবুজ দেশ' এর মানুষের একান্ত আত্ম সন্মানবোধ এবং অন্তরের ছোট ছোট মানবতা বোধ জেগে উঠুক সর্বোচ্চ মাত্রায়- এই প্রার্থনা করছি। সবাই কে শুভ নববর্ষ)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৩:০৭

ইমরান-উল-ইসলাম বলেছেন: ভাল লাগল ।

২| ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ২:৩৪

হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে ইমরান।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.