![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!
যুবায়ের আলী তৃতীয় বারের মত রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করল। চশমা চোখে দিয়ে বুকের কাছে ধরে রাখা পত্রিকার পাতাটা আবার চোখের সামনে মেলে ধরল। পত্রিকার পাতাটার দিকে তাকাতেই চশমার কাঁচ আবার ঝাপসা হয়ে গেল। যুবায়ের আলী আর চশমার কাঁচ মুছার চেষ্টা করল না। পত্রিকাটা বুকের সাথে চেপে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল!
যুবায়ের আলীর উচ্ছ্বসিত কান্নার ঢেউয়ের মধ্যে পত্রিকায় ছাপা হওয়া কিছু অক্ষর নক্ষত্রের মত ভেসে বেড়াতে লাগল। সেই নক্ষত্র-অক্ষর গুলো বলছে- বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রী নুষা যুবায়ের সারা পৃথিবীর স্থাপত্য জগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন। তাঁর আবিষ্কৃত বাড়ির মডেল আগামী প্রজন্ম কে হতাশা, মাদক, হত্যা, আত্নহত্যা সহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে নুষা যুবায়ের বলেন-
পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ জন্মানোর পরে প্রকৃতিই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করে। প্রকৃতির কার্যক্রম খুব সুন্দর। প্রকৃতি শিশুর চোখে দেয় বিস্ময় আর মনে দেয় প্রশ্ন! শিশু যদি চাপহীন পরিবেশে বড় হয় তাহলে তার ‘চোখের বিস্ময়’ আর ‘মনের প্রশ্ন’ কখনো নষ্ট হয়না। যে মানুষের চোখের বিস্ময় আর মনের প্রশ্ন নষ্ট হয়ে যায় নি সেই মানুষ কে কখনো হতাশা, মাদক, হত্যা, আত্নহত্যা ইত্যাদি প্রবণতা গ্রাস করতে পারে না। কারন চোখের বিস্ময় আর মনের প্রশ্ন মানুষের চেতনায় এমন একটা ফ্রিকোয়েন্সি তৈরি করে যার প্রভাবে মানুষের মন সব সময় তার চার পাশের সুন্দর গুলো কে আবিষ্কার করতে পারে। যে মন সুন্দর আবিষ্কার করতে পারে সেটা সুস্থ মন। সুস্থ মন কখনো ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়না। আমার এই বাড়ির প্রতিটা দেয়াল, দরজা , আসবাব, টিভির লোকেশন, কম্পিউটারের লোকেশন, খাবার ঘর, ওয়াশ রুম ডিজাইন করা হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ফ্রিকোয়েন্সির সাথে সঙ্গতি রেখে। রয়েছে ইন্টেরিয়র অডিও সিস্টেম। সকালে আপনার ঘুম ভাংছে পাখির ডাক শুনে, শুতে যাবার সময় শুনছেন ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দ! বেলা পরিবর্তনের সাথে সাথে দেয়ালের ঔজ্জ্বল্য এবং দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে।এই বাড়ির পরিবেশটাই এমন হবে যাতে এর বাসিন্দা দের মনের স্বাভাবিক ফ্রিকোয়েন্সি কখনো নষ্ট না হয়।জ্যামিতিক কাঠামো ছাড়া এ বাড়ির সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হবে সোলার এনার্জি ব্যবহার করে এবং সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে একটি মুল প্রোগ্রাম।
এই অসাধারণ আবিষ্কারের জন্য রয়েল ইন্সটিটিউট অভ ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট(রিবা) নুষা যুবায়ের কে অত্যন্ত সন্মান জনক স্ট্যারলিং পুরস্কারে ভূষিত করেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ডঃ দিহান আলী’র কাছে নুষা যুবায়ের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নুষা মানুষ হিসেবে অত্যন্ত বড় মাপের কারন সে সব সময় এমন কিছু আবিষ্কার করতে চেয়েছে যা পৃথিবীর জন্য শুধু অর্থহীন আরাম নয়, বরং কল্যাণ বয়ে আনবে। এই বাড়ি ডিজাইন করতে স্থাপত্য ছাড়াও মানুষের মনস্তত্ত্ব বিষয়ে নুষা কে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে। তার সাধনা আলোর পথ দেখেছে এবং নুষা আজ শুধু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশের গর্ব!
কান্না মুছে যুবায়ের আলী সামনে থাকা ঘরের মলিন দেয়ালের দিকে তাকাল। দেয়াল ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি চলে গেল সতের বছর আগে।
সরকারি অফিসের সামান্য চাকুরে হত দরিদ্র যুবায়ের আলী তেল চিটচিটে বাজারের থলে হাতে নিয়ে মুখ আমসি করে বাজারে ঘুরছে। যেই তরকারির দাম জিজ্ঞেস করে সেই তরকারির দামই যুবায়ের আলী’র সামর্থ্যের চেয়ে বেশি! তার উপরে আজ তার ছয় বছর বয়সী মেয়েটার জন্মদিন। সকালে অফিসে যাবার সময় মেয়ে বার বার বলেছে- বাবা আমার জন্য জন্মদিনের খেলনা নিয়ে আসবা। রিমোট কন্ট্রোল খেলনা!
পরিচিত দোকানী থেকে বাকীতে মেয়ের জন্য লুডু খেলার বোর্ড কিনতে কিনতে যুবায়ের আলীর বুক হা হা করে উঠেছিল। কোন বাবা কি তার মেয়েকে জন্মদিনে কাগজের লুডু বোর্ড উপহার দেয়! মনে মনে নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিয়েছিল যুবায়ের আলী। এমন একটা বিভাগে সে চাকরি করে যেখানে এক পয়সাও ঘুষ খাবার উপায় নাই!
কিন্তু যুবায়ের আলী কে অবাক করে দিয়ে তাঁর ছ’বছর বয়সী মেয়ে নুষা লুডু বোর্ড হাতে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছিল!
নুষার পিড়াপিড়িতে বাধ্য হয়ে রাতে খাওয়া দাওয়ার পর যুবায়ের আলী, যুবায়ের আলীর স্ত্রী, বোন এবং নুষা মিলে লুডু খেলতে বসেছিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নুষা খেলায় ফার্স্ট হয়ে গেল এবং তারপরেই সে বলেছিল-
- বাবা খেলার ঐ পিঠে কি আছে? ঐ পিঠের টা খেলব!
যুবায়ের আলীর ঘুম পাচ্ছিল। কাজেই সে ঘুম ঘুম চোখে জবাব দিয়েছিল-
- ঐ পিঠের টা খেলে না বাবা। ঐ পিঠে সাপ!
মেয়ে বোর্ড উল্টে সাপ গুলোর দিকে বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তারপর বোর্ড নিয়ে ছুটে গিয়েছিল ঘরের এক কোনায় যেখানে একটা পলিথিনের ব্যাগের মধ্যে তার বই খাতা গুলো তোলা থাকে। পলিথিনের ব্যাগের সুবিধা হচ্ছে বর্ষাকালে ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল এবং মেঝে চুপসে পানি উঠলেও বই খাতা ভিজে না! পলিথিন ব্যাগ থেকে পেন্সিল বের করে মেয়ে অনেকক্ষণ লুডু বোর্ডের উপর আঁকাআঁকি করেছিল। তারপর বোর্ড হাতে বাবার কাছে ছুটে এসে বলেছিল- বাবা দেখ সাপ সবগুলা মই করে দিয়েছি!
যুবায়ের আলী বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখেছিল- তার ছ’বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে নুষা বোর্ডের সবগুলো সাপ পেন্সিল দিয়ে কেটে সাপের জায়গায় মই এঁকে দিয়েছে!
নিতান্ত ছাপোষা কেরানী যুবায়ের আলী’র মন সেদিন সে মুহুর্তে অন্য রকম একটা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল। তার মন বলেছিল, আল্লাহ পাক তাকে ঘুস খাবার সুযোগ দেন নাই সেজন্য মন খারাপ করার কিছু নাই! আল্লাহ পাক তার ঘরে এমন সন্তান দিছেন যে সাপ কে মই বানিয়ে ফেলে!
সেদিন রাতেই যুবায়ের আলী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল ঘুস খাবার সুযোগ পেলেও কোনদিন খাবে না এবং মেয়ের পড়াশোনার জন্য তার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব করবে।
স্মৃতির কুয়া বেয়ে উঠে আসতে আসতে কত কিছু মনে পড়ে যুবায়ের আলীর। মেয়ের উপরে উঠার পথে দারিদ্র, কু সংস্কার সব মিলিয়ে সাপের সংখ্যা কম ছিল না। কিন্তু সে কিভাবে কিভাবে যেন সব সাপের পিঠের উপর মই বসিয়ে দিত! মইয়ের নিচে সাপ ফোঁস ফোঁস করত। আর সে মই বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে যেত!!
দরিদ্র যুবায়ের আলী মেয়ের কঠিন সংগ্রামের জীবনে সব সময় বন্ধুর মত পাশে থেকেছে। মেয়ের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয় নাই এবং মেয়েকে সব সময় স্বতন্ত্র একজন মানুষ বলে গণ্য করেছে।
আজকে তুচ্ছ(!) খবরের কাগজের একটা পাতা বুকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে যুবায়ের আলী নিজেকে নিজেই শুনিয়ে বলল- যুবায়ের আলী, তুমি বাড়ি, গাড়ি, টেকা পয়সা করতে পার নাইকা। কিন্তু তোমার মাইয়া যে পুরা দুনিয়ার জন্য এতবড় একটা কাজ করল সেইটা তে ত তোমারও বড় ভূমিকা আছে! সেইটা কি কিছু কম?
©somewhere in net ltd.