![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!
আমার এখন আট চাকার একটি রোলস রয়েস আছে। কিন্তু দু’চাকার বাইসাইকেল টিকে আমি খুব মিস করি। যারা আমাকে গরিব থেকে বড়লোক হয়ে গেছি বলে ভাবছেন তারা বোকার স্বর্গ থেকে ফিরে আসার প্রস্তুতি নেন। আট চাকার রোলস রয়েস মানে হচ্ছে আমি, বৌ আর দুই বাচ্চা সহ আমার সংসারজীবন। দু’চাকার বাইসাইকেল মানে আমার ফেলে আসা রোমহর্ষক ব্যাচেলর জীবন! ভবিষ্যৎ উন্নতির চিন্তায় মগজ কে অযথা ভারী না করে ব্যাচেলর জীবন টা কিছুটা ইচ্ছে সুখে কাটানো উচিত। এই সুখ স্মৃতির ব্যাক-আপ পরবর্তী জীবনে অনেক কঠিন মুহুর্তের মুখোমুখি হতে মনে একটা বাড়তি শক্তি যোগায়।
ব্যাচেলর জীবনের সেরকম একটা সুখ স্মৃতির গল্পই আজকে বলব।
তখন সদ্য বিশ্ব বিদ্যালয় পাশ করেছি। দেখতে দেখতে চলে এসেছে রোজার মাস। রোজার মাস আসা মানেই আমার কাছে নতুন নতুন এক্সেপশনাল ইফতার পার্টি’র আইডিয়া বের করা। গত বছরের এক্সেপশনাল আইডিয়া ছিল ইফতার এর প্যাকেট নিয়ে গাছে উঠে যাওয়া।তারপর গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসা। তারপর ছোলা মুড়ি বুন্দিয়া বেগুনি পেঁয়াজু ভরা পলিথিন গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া। তারপর আজান দিলে সেখান থেকে নিয়ে নিয়ে ইফতার করা।
গত বছর সোনার গাঁ’র এক নাম না জানা গ্রামে আম গাছের ডালে একটা পাখি আমি আর চঞ্চলের সাথে ইফতার করেছিল। এটা কি পাখি আমি বলতে পারবনা।পাখি’র গলার আওয়াজ বুঝতে পারি নাই। সন্ধ্যা’র অন্ধকারে পাখি’র গায়ের রঙ ও বুঝা যায় নাই।
ত এবারে এক্সেপশনাল আইডিয়া আসল মাঝ নদী তে ইফতার। নৌকা ভাড়া করব। যখন আজান হবে নৌকা থাকবে মাঝনদীতে। আশেপাশে পানি ছাড়া আর কিছু থাকবে না।
এরকম আইডিয়া বাস্তবায়নের জন্য একই মানসিকতার বন্ধুকে খবর দেয়া দরকার।‘ইফতার করার জন্য নৌকা নিয়ে পানি’ত যাবার কি দরকার? ডায়নিং টেবিলে বসে ইফতার করলেই ত হয়!’ টাইপ মানসিকতার বন্ধুকে খবর দিয়ে লাভ নাই।
চঞ্চল ছাড়াও নাজমুল আমার সেই সময়ের একই মানসিকতার বন্ধু। নাজমুলের ছোটবেলায় শখ ছিল একটা বাঘ পোষা। মৃত্যুর আগে অন্তত একবার আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে সিংহের ডাক শুনে আসা জরুরি- এই বিষয়ে সে আমার সাথে পুরোপুরি একমত ছিল। আমি নাজমুল কে খবর দিলাম। ঠিক হল প্রথম রোজার দিন ই আইডিয়া বাস্তবায়ন হবে। নবীগঞ্জ ঘাট থেকে আমরা হেলালের নৌকা ভাড়া করব। হেলাল শীতলক্ষ্যায় এমন হিসাব করে নৌকা চালাবে যাতে ইফতারের সময় নৌকা গিয়ে মেঘনা নদী’র মোহনায় উপস্থিত হয়!
আমি তখন শেওড়াপাড়া থাকি। দুপুরের পরে রওনা দিলে ইফতারের আগে যাত্রাবাড়ীই পার হতে পারব কিনা সন্দেহ আছে। কাজেই আমি রাস্তায় গিট্টু লাগার আগেই সকাল সকাল রওনা দিয়ে নারায়নগঞ্জের কিল্লারপুল চলে গেলাম। নাজমুলের ডেরা কিল্লারপুল!
সকাল দশটার দিকে নাজমুলের ডেরায় পৌঁছে দেখি নাজমুল তখনো চিংড়ি ভঙ্গিতে খাটের উপর শুয়ে ঘুমাচ্ছে। নাজমুলের খাটের পাশের গোল কাঠের টেবিলের উপর গোল্ডলীফ সিগারেটের লাল সাদা প্যাকেট। পাশে খালি চায়ের কাপ। কাপের তলায় সিগারেটের অনেকগুলো পোড়া ফিল্টার! মনে হল একবারে সেহেরি খেয়ে ঘুমাতে যাবার আগে নাজমুল সিগারেটে টান দিতে দিতে অভিযান নিয়ে অনেক চিন্তা করেছে! একই সাথে একটা ভয় এবং শিহরণ আমার মেরু দন্ড দিয়ে বয়ে গেল! সিগারেটের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে প্রথম রোজার দিনের প্রথম সংযমের পরীক্ষা দিতে দিতে নাজমুলের বিশাল ডবল খাটের উপর আমিও নাজমুলের উল্টো দিকে চিংড়ি হয়ে শুয়ে পড়লাম!
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখলাম- শীতলক্ষ্যা’র বুক চিরে বৈঠা মেরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছোট্ট নৌকা। বৈঠার তালে তালে ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ দেখি বিশাল একটা হাঙ্গর আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। হাঙ্গরের সাদা ধারালো দাঁতের কয়েকটা পোকায় খাওয়া! হাঙ্গর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোন করে তেড়ে এসে সোজা আমার গলা কামড়ে ধরল!
ঘুম ভেঙ্গে দেখি নাজমুল আমার গলার উপর পা তুলে দিয়েছে! স্বপ্নের হাঙ্গর সময় মত ঘুম ভাঙ্গিয়ে না দিলে দম আটকে মারাই যেতাম! মাস খানেক নখ না কাটার কারনে আমার আঙ্গুলের নখ বেশ লম্বা হয়েছিল। আমি নাজমুলের পায়ে নখের খোঁচা দিয়ে রক্ত বার করে ফেলার আগে মনে পড়ল- রক্ত বের হলে রোজা ভেঙ্গে যায়!
ঘুম থেকে উঠে নাজমুল বলল- তুই আর হেলাইল্লা নৌকায় বইয়া থাকবি, আমি আজকে নৌকা চালামু!
নাজমুলের নৌকা চালানোর শিকার হয়ে আমি আর চঞ্চল একবার তুরাগ নদী’তে মরতে বসেছিলাম। সেই কথা আমি নাজমুল কে স্মরণ করিয়ে দিলাম। নাজমুল আমার কথায় পাত্তাই দিল না। হাতের মাসল ফুলিয়ে আড়মোড়া ভাংতে ভাংতে বলল- তহন ত পোলাপাইন আছিলাম। এহন ত পোলাপাইন না।
তুরাগ নদী’র ঘটনা দুবছর আগের!
বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে রোদের তেজ কমে এলে আমরা বের হলাম। মুন্সি চাচার দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট আর এক প্যাকেট খেজুর কিনলাম।বড়সড় একটা পেপারও মুন্সি চাচার থেকে চেয়ে নিলাম। তারপর রতনের হোটেল থেকে বুন্দিয়া, ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু আর বেগুনি কিনলাম। নাজমুল বলল, রতইন্না! পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ কাইট্টা কাগজের ঠোঙ্গার মইধ্যে দিয়া দে! আর পলথিনের মইদ্যে সর্ষের তেল দিবি হাওয়ার পোলা!
নবীগঞ্জ ঘাটে হেলাল নৌকা নিয়ে তৈরি ছিল। আমাকে আর নাজমুল কে দেখেই দাঁত বের করে হাসল! নাজমুল গরম চোখে হেলালের দিকে তাকিয়ে বলল- হেলাইল্লা! তর না হুনলাম মাইয়া অইছে? মিষ্টিমুষ্টি খাওয়াস নাই কি মনে কইরা? তুই কি মনে করছত-
বাইত চলেন আজকা! আজকে আমগো বাইত আপ্নাগো দাওয়াত!, নাজমুলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হেলাল দরাজ গলায় বলল।
নৌকা ছইওয়ালা এবং রোদ তখনো মরেনি। পশ্চিমে হেলে যাওয়া সূর্্যে র ‘প্রতিবিম্ব-শরীর’ যেন বিশাল নদীর বুকে শুয়ে আছে। নদীর ঢেউ বা নিঃশ্বাসের তালে সেই শরীর উঠানামা করছে। কাজেই ইফতার,সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচ নিয়ে আমি আর নাজমুল ছই এর ভেতরে ঢুকলাম। ছই এর ভেতরে একটা মাদুর পাতা। সেই পাতা মাদুরের উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। অর্ধবৃত্তাকার ছইয়ের কোনা দিয়ে অসীম রহস্যময় নীল আকাশ দেখতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। সেই আকাশ পথে ভেসে যাচ্ছে বিশাল বড় বড় মেঘের টুকরো। একটা মেঘের টুকরো দেখতে পুরা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের মত। হাতে ধরা বিশাল চুরুট থেকে ধোঁয়া উড়ে উড়ে যাচ্ছে। চেহারায় গভীর চিন্তার ছাপ দেখে মনে হচ্ছে কঠিন বিপদে আছে শার্লক হোমস!
‘হেলাইল্লা, গান টান গাস না হালায়!’
বলার অপেক্ষা মাত্র! হেলাল সাথে সাথেই গান ধরল- সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে শুধাই!
হেলালের গান কেমন ছিল সেই প্রশ্নের জবাব পাবার উপায় একটাই। পুর্বপুরুষ সবাই মাঝি ছিল এবং সে নিজেও মাঝি এরকম কারো গলায় মাঝ-নদী বা মাঝ-সমুদ্রে আব্দুল আলীম বা আব্দুল জব্বারের গান শুনতে হবে!
মৃদু মন্দ ঢেউয়ে নৌকার দুলুনি এবং হেলালের গানের মায়ার আবেশে শীতলক্ষ্যা’য় ঘুরতে ঘুরতে একসময় দেখলাম সূর্যের গায়ে সোনালী রঙ চড়তে শুরু করেছে। হেলাল কে মেঘনার মোহনার দিকে নৌকা চালাতে বলে আমি আর নাজমুল উঠে বসে পেপার টা মাদুরের উপর বিছিয়ে দিলাম। তারপর ইফতারের প্যাকেট গুলো খুলে সব ইফতার পেপারে ঢাললাম। তারপর পেয়াজু, বেগুনি গুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে দিলাম। পেঁয়াজ মরিচ আর সর্ষের তেল মাখালাম। বুন্দিয়া মাখালাম। মুড়ি সবশেষে মাখানোর জন্য রেখে দিলাম। মুড়ি আগে মাখাই ফেললে ‘ফোঁ’তা ফোঁ’তা’ হয়ে যাবে অর্থাৎ মিইয়ে যাবে।
আমরা তখন অথৈ নদী’র মাঝখানে লোকালয় থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আজান বা সাইরেন শুনা কোন সমস্যা নয়। কারন হেলালের সাথে রেডিও ছিল।মাকসুদের ‘মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না’ গান বাজারে বেরিয়ে গেছে যেই সময়ের কথা বলছি সেই সময়ের বেশ ক’বছর আগে!
আজানের মিনিট পাঁচ আগে আমরা যেখানে পৌঁছলাম সেটা মেঘনা নদী’র মোহনা নয়। কিন্তু সেখানে আমরা অনেকটা ইলেক্ট্রিক খাম্বার মত দেখতে একটা খুঁটি পেয়ে গেলাম। মাঝ নদীতে এই খুঁটি কেমনে কোত্থেকে আসছিল এটা আমার কাছে এখনো রহস্য এবং আমি ভুলেও কখনো এই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করি নাই পাছে এতে করে এই ‘স্মৃতি মুভি’র গা ছমছামানো ভাব টা নষ্ট হয়!
আমরা কিছু বলার আগেই হেলাল খুঁটির সাথে নৌকা বেঁধে ফেলল। তারপর বৈঠা নৌকার উপর তুলে শুইয়ে দিয়ে সেও আমাদের সাথে ছই এর ভেতর এসে বসল। হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা নৌকা দ্রুত গতিতে নদীর ঘাটের দিকে যাচ্ছে। নৌকায় সাদা পাঞ্জাবী, টুপি পরিহিত সাদা দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক আর মাঝি ছাড়া কেউ নেই। বুঝলাম উনাদের ইফতারের তাড়া!
আমি আর নাজমুল মুখ ঘুরিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম- হেই মাঝি, মাঝি ই ই, নৌকা ঘুরান! আমাদের সাথে ইফতার করে যাআন!!
নৌকার মুখ ঘুরল।
মাঝনদী’র সেই অদ্ভুদ ইফতার পার্টিতে মহান আল্লাহ পাক আমাদের সাথে ইফতার করার জন্য দু’জন মেহমান পাঠিয়ে দিলেন। নৌকার ছইয়ের মধ্যে পাঁচ মায়ের পেটে জন্ম নেওয়া আমরা পাঁচ আদম সন্তান আপন ভাই হয়ে বসে ইফতার করলাম। ইফতার শেষে পরম করুনাময় এর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করলাম।
৩০ শে জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৯
হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ধন্যবাদ মদন ভাই!
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৫
মদন বলেছেন: ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।