![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!
ভারী মেঘে আকাশটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আচ্ছন্ন আকাশের কারনেই মনে হচ্ছে পুরো শহরের উপর একটা বিষণ্ণতা চেপে বসেছে। মাত্রই জ্বলতে শুরু করা সোডিয়াম লাইটের মিটমিটে লাল আলো সেই বিষণ্ণতা কে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ময়মনসিংহ শহরের যে জায়গা টাতে হুমায়ুন আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন সে জায়গাটা রেল লাইনের কাছাকাছি। ট্রেন আসছে দেখে সিগন্যাল বাতি জ্বালিয়ে রাস্তার গাড়িটাড়ি সব আটকে দেয়া হয়েছে। লম্বা ভেঁপু বাজিয়ে এগিয়ে আসছে এগার সিন্দূর ট্রেন। হুমায়ুন আহমেদের একবার মনে হল চট করে গিয়ে ট্রেন লাইনের উপর দাঁড়ান! জীবন মৃত্যুর সীমানা থেকে উনি এখন মুক্ত।উনার উপর দিয়ে ট্রেন চলে গেলে কি হয় একবার স্বচক্ষে দেখেন! ট্রেন লাইনের দিকেই যাচ্ছিলেন। পাশ দিয়ে হঠাৎ শুনলেন, স্যার স্যার!
হুমায়ুন আহমেদ ফিরে তাকালেন। পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে।যুবকের গালে খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি। চোখে কাল ফ্রেমের পাওয়ার চশমা। পরনের সাদা শার্টের বুক পকেটেও খাপে পুরা একটা চশমা দেখা যাচ্ছে। ছাই রঙের চশমার খাপের উপর লিখা ‘লাকী অপটিকস’। হুমায়ুন আহমেদ একবার ভাবলেন বুক পকেটে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা হয়ত তার বাবার চশমা। লেন্স বদলাতে দোকানে নিয়ে গিয়েছিল। আবার মনে হল তার নিজেরই চশমা। বাবার চশমা হলে এভাবে পকেটে রাখত না। হাতেই রাখত। কিন্তু একই মানুষ তার নিজের জন্য দুটো চশমা কেন ব্যবহার করবে? একই ফ্রেমে দুধরনের লেন্স স্থাপনের প্রযুক্তি ত তৈরী হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই!
হুমায়ুন আহমেদ যুবক কে তার চশমার ব্যাপারটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই যুবক হুমায়ুন আহমেদের পা ছুঁয়ে সালাম করল। তারপর বলল, স্যার আপনি কোথায় যাবেন বলুন!
হুমায়ুন আহমেদ কিছুটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিন্তু বেশ স্পষ্ট স্বরেই বললেন, আমি খুব অল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে এসেছি।আমি এখন ময়মনসিংহ শহরে আছি এটা আমার কাছে স্পষ্ট। কুতুবপুরে আমাদের বাড়ি, বাড়ির উঠান সব স্মৃতিতে স্পষ্ট। কিন্তু প্রকৃতি বিচিত্র প্রক্রিয়ায় এই যায়গা থেকে আমার কুতুবপুরের বাড়ি কিভাবে যেতে হয় সেটা অস্পষ্ট করে দিয়েছে। প্রকৃতি খুব অদ্ভুদ!
স্যার আপনি কি আপনার বাড়ি যেতে চান?
হ্যাঁ, চাই।
আমার সাথে চলেন।
তুমি আমার বাড়ি চেন? অহো তোমার নাম ই ত জানা হয়নি।
আমার নাম খায়রুল। স্যার আমার সাথে আসেন।
হুমায়ুন আহমেদ খেয়াল করলেন যুবক তাঁর কথার শেষ অংশের জবাব দিয়েছে।প্রথম অংশের জবাব দেয়নি! এবং হঠাৎ করেই যেন যুবকের চলার গতি বেড়ে গেছে। যুবকের পিছু পিছু হুমায়ুন আহমেদ ও যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে ছুটতে লাগলেন!
টিনের বাড়ির সামনে কলা গাছে কলার কাঁদি ঝুলছে। কলা বেশির ভাগই কাঁচা। একটা দু’টায় পাক ধরেছে। হুমায়ুন আহমেদ বেশ হতচকিত হলেন! কলাগাছওয়ালা এই টিনের বাড়ি কোনভাবেই তাঁদের কুতুবপুরের বাড়ি নয়। তাকে এ কোথায় নিয়ে এসেছে যুবক?
দেখতে দেখতে বাড়ির ভেতর থেকে অনেকে বেরিয়ে এল। উনিশ বছরের তরুণী, চৌদ্দ বছরের কিশোর, ন বছরের শিশু, উনসত্তর বছরের বৃদ্ধা আর পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যবয়েসি যুবক। সবার মুখে আন্তরিক হাসি! পরম আপন জনকে নিজেদের মাঝে ফিরে পেয়ে সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।
হুমায়ুন আহমেদ একে একে সবার চেহারার দিকে তাকালেন। সবাই তাঁকে এমনভাবে দেখছে যেন ঘরের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরেছে। উনসত্তর বছরের বৃদ্ধা যেন বেশ ধমকের সুরে বললেন,
বাবা আস ত! ঘরে আস। আগে একটু সরবত খাও। তারপর জামাকাপড় ছেড়ে গোসল কর। বিকালে বেশি নাস্তা দিব না। মুরগির সালুন দিয়ে রাতে একেবারে গরম ভাত খাবা।
তরুণী বলল, মুরগির সালুন আমি রান্না করছি। খুব মরিচ দিছি। ঝাল খেয়ে আপনার গলা জ্বলবে হি হি!
শিশু বলল, ভাত খেয়ে আমলা পুকুল পালে বতে গল্প কলব কেমন!
মধ্যবয়েসি যুবক বলল, স্যার এরা খুব দুষ্ট। এদের কথায় কান না দিয়ে আমার সাথে আসেন। আপনার ঘর টা দেখিয়ে দিই!
চৌদ্দ বছরের যুবক শুধু চুপচাপ। দুচোখে অনন্ত বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে আছে হুমায়ুন আহমেদের দিকে!
হুমায়ুন আহমেদ সবার দিকে তাকিয়ে আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন-
এটা কার বাড়ি?
সবাই বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে তাকাল, তারপর সমস্বরে বলল, এটা আপনার বাড়ি!
আমার বাড়ি মানে? তাইলে আপনাদের বাড়ি কোন টা?, হুমায়ুন আহমেদ ততোধিক বিস্ময়ের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন!
আমাদের বাড়িও এইটা!, সবাই সমস্বরে জবাব দিয়ে বিস্ময়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল!
সেটা কিভাবে সম্ভব?, হুমায়ুন আহমেদ এবার বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন!
সবার পক্ষ থেকে বৃদ্ধা সামনে এগিয়ে আসলেন। স্পষ্ট একটা আবেগ বৃদ্ধাকে থর থর করে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কিছু একটা বলতে গিয়ে মুখের মধ্যে গিলে ফেললেন।হাল্কা খয়েরি রঙ শাড়ীর আঁচল দিয়ে একবার চোখ মুছলেন। তারপর থর থর কাপতে থাকা দুহাত দিয়ে হুমায়ুন আহমেদের দু’কাধ ধরলেন। তারপর বললেন,
কে মারা গেলে একটা বাড়ির ছোট বড় সব সদস্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে?, বলতে বলতে বৃদ্ধা নিজেই ফুঁপাতে লাগলেন।
কে আবার? বাড়ির কেউ মারা গেলে ছোট বড় সবাই কাঁদে!- ক্লাসের ফার্স্টবয় যে ভঙ্গিতে স্যারের প্রশ্নের জবাব দেয় সেই ভঙ্গিতে হুমায়ুন আহমেদ জবাব দিলেন।
তুমি কি জান ঠিক দু’বছর আগে বাংলাদেশে কি হয়েছে? সারা বাংলাদেশের অগণিত পরিবারের সব সদস্য তার নিজের নিজের ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল একজন মানুষের জন্য!, বৃদ্ধা এবার হাঁওমাও করে কাঁদতে লাগলেন! কান্না সংক্রামক। বৃদ্ধার কান্না দেখে অন্যরাও হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল!
হুমায়ুন আহমেদ খুব অসহায় বোধ করলেন। তিনি সব বুঝতে পারছেন। কিন্তু এ জগতের আবেগের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা এখন তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অসম্ভবের সীমানায় দাঁড়িয়ে আপাত অসম্ভব এ অভাবিত দৃশ্য তিনি কেবল দেখতে লাগলেন!
উঠানে দেখতে দেখতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক জড়ো হয়ে গেল।অগণন শিশু, কিশোর, কিশোরী, তরুণ-তরুণী,যুবক-যুবতী প্রবীন-প্রবীনা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সবাই এক নিষ্পাপ সরল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।কেবল একজন মানুষের জন্য ছাপিয়ে উঠা বুকের ভেতরের অকৃত্রিম ভালোবাসা এই মুহুর্তে সবাইকে যেন শিশুতে রূপান্তরিত করেছে!
হঠাৎ টিনের চাল ঝমঝমিয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি নামল। দেখতে দেখতে উঠোনে এক হাঁটু পানি উঠে গেল। সবাই বৃষ্টতে ভিজে একসা। কিন্তু সেদিকে কারো খেয়াল নেই। পৃথিবীর সবচে আপন মানুষকে ফিরে পেয়ে আজ যেন তাদের কিছুতেই কিছু না হবার দিন!সবাই শুধু ব্যাকুল হয়ে বলছে- স্যার আমাদের সবার বাড়িগুলো আপনার নিজের বাড়ি। বাড়িতে চলেন স্যার!
হুমায়ুন আহমেদ বুঝতে পারলেন তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে। এবার তাঁকে যেতে হবে। কিভাবে যাবেন সেই প্রক্রিয়াটা তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু প্রকৃতি তাকে ফিরিয়ে নেবার প্রক্রিয়া শুরু করেছে এটা তিনি বুঝতে পেরেছেন।
প্রকৃতির রহস্যময় প্রক্রিয়ায় হুমায়ুন আহমেদ এই মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে বাতাসে ভাসছেন। তাঁকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তিনিও কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু তাঁর হৃদয় তৃপ্ত। ঘরে ফেরার আনন্দে তৃপ্ত।
২| ২০ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:৪৮
হঠাৎ ধুমকেতু বলেছেন: ওয়েল, আপনি কি আপনার লেখাটাকে হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে চূড়ান্ত বিশ্লেষণ ভাবছেন? নইলে এটার লিঙ্ক এখানে দেবার কি মানে? আমি দুঃখিত। আপনার লেখাটা তে আমি কিছুই পাই নি।
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:০১
পরাজিত মধ্যবিত্তের একজন বলেছেন: হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর 'সাহিত্যিকের মৃত্যু এবং আমাদের গদগদে আবেগ' শিরোনামে একটি গদ্য রচনা করেছিলাম। আজ গদ্যটি স্মরণ করছি। যারা পড়েননি তাদের পড়ার আহবান জানাই।
গদগদে আবেগ
Click This Link