![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!
সূর্য উঠবে, সূর্য ডুববে। চাঁদ উঠবে, চাঁদ ডুববে। এসব নিয়ে কারো মনে কোন প্রশ্ন নাই। কারন এসব প্রশ্নের জবাব বহু আগেই জ্যোতিপদার্থবিদ রা দিয়ে দিয়েছেন এবং সেই জবাবগুলো আমরা সবাই জানি। ঠিক তেমনি আমাদের দেশে লঞ্চ যাত্রা করবে, এবং প্রতি বছর লঞ্চ ডুবে মারা যাবে অগুনতি 'সস্তা মানুষ'। এটা নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন বা আহাজারি করা উচিৎ না কারন প্রশ্নের জবাব আমরা জানি। কিন্তু তারপরেও আমরা ‘আহ,উহ’ করি! কারন এটা প্রমান করা জরুরি যে ভরা বর্ষার নদীতে যেরকম উথাল পাথাল ঢেউ আছে সেরকম আমাদের হৃদয়েও উথাল পাথাল আবেগ আছে। আমরা পাষাণ না।
আহ,উহ করলাম। কোন অসুবিধা নাই। তবে আবেগের ঢেউ কিছুটা ঠাণ্ডা হলে লঞ্চ ডুবার যে কারন টা আর সবার মত আমরাও জানি সেটা নিয়ে একটু চিন্তা করা উচিত।
স্কুলের বিজ্ঞান বইয়ে ছোট্ট একটা প্রশ্ন থাকত- ‘একটা পেরেক সমুদ্রে ফেললে ডুবে যায়। জাহাজ ভাসে কেন?’ জবাব টা খুব সহজ। জাহাজ সাইজে বিশাল হলেও জাহাজের ঘনত্ব পেরেকের চেয়ে কম। ঘনত্ব= ভর/আয়তন। পানির ঘনত্ব হল ১। কোন জিনিষের ঘনত্ব যদি ১ এর কম হয় তাইলে সেটা পানির উপর ভাসবে। ১ এর বেশি হলে সেটা ডুবে যাবে। এটা একেবারে বেসিক। এই বেসিক মাথায় রেখেই বয়া থেকে নৌকা, লঞ্চ,জাহাজ সব ডিজাইন করা হয়। এর পরে আসে ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার।
ভারসাম্য জিনিষ টা কি? ছোট বেলায় লিচুর বিচি, গুনা তার( জিআই তার) আর ম্যাচের কাঠি দিয়ে আমরা একটা খেলা খেলতাম। গুনা তারের ছোট একটা টুকরা কে ধনুকের মত বাঁকিয়ে সেটার দুই প্রান্ত দুইটা লিচুর বিচির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতাম। তারপর গুনা তারের মাঝ বরাবর একটা ম্যাচের কাঠি আটকে দিতাম। পুরা জিনিষ টা তৈরি হবার পর ম্যাচের কাঠি’র তলা টা বুড়ো আঙ্গুলের উপর রাখলে দেখা যেত সুন্দর ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। কাঠি একদম খাড়া অবস্থায় একটু ডাইনে একটু বাঁয়ে দুলছে কিন্তু কোন দিকে উল্টে পড়ছে না।কাঠির সাথে সাথে লিচুর বিচি দুইটাও একবার বাঁ দিকে আরেকবার ডান দিকে দূলছে। কাঠি থেকে প্রায় সম দূরত্বে থাকা প্রায় সম ভরের দুইটা লিচুর বিচি এখানে পুরা জিনিষ টার ভারসাম্য রক্ষা করছে অর্থাৎ জিনিষ টাকে কোন একদিকে উল্টে পড়তে দিচ্ছে না। নৌকা,লঞ্চ, জাহাজ ডিজাইন করার সময় এই ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার টাও মাথায় রাখতে হয়।
একটা নৌকা লঞ্চ বা জাহাজ যখন নদী বা সমুদ্রে চলে তখন সেটাকে সময় অসময়ে বেশ বড়সড় ঢেউ এর মোকাবেলা করতে হয়। গতিশীল জলযান চলতে গিয়ে সর্বোচ্চ কত জোরে ঢেউয়ের সাথে ধাক্কা খেতে পারে সেটা হিসাবে আনতে হবে। ডিজাইন এমন হতে হবে যাতে সর্বোচ্চ ধাক্কা তেও জলযান ভারসাম্য না হারায়। জলযান যতটুকু ধাক্কা সইতে পারবে তার চেয়ে বেশি ধাক্কার ঢেউ নদী বা সাগরে উঠতে পারে কিনা সেটা বোঝার জন্য আবহাওয়া অফিস আছে। সেরকম হলে আবহাওয়া অফিস সংকেত দেবে- নৌ চলাচল বন্ধ। কারন এখন নদী বা সমুদ্র নিরাপদ নয়।
এখন ধরা যাক সঠিক ডিজাইনের একটা লঞ্চের নির্মান খরচ এক টাকা। লঞ্চের মালিক কি চিন্তা করবে? সে চিন্তা করবে খরচ কিভাবে কমানো যায়! সে মিটিং ডাকবে। মিটিং এ উপস্থিত থাকবে কিছু মূর্খ আর কিছু জ্ঞান-পাপী। এরা বুঝিয়ে দেবে এভাবে এভাবে গাণিতিক দুই নম্বরি করে লঞ্চ ডিজাইন করলে নির্মান খরচ পড়বে পঞ্চাশ পয়সা। সে ক্ষেত্রে ত্রুটি পূর্ন ডিজাইন যারা পাশ করবে তাদের ঘুষ দিতে হবে দশ পয়সা। পঞ্চাশ আর দশ, মোট ষাট পয়সা।বাঁচল চল্লিশ পয়সা! যে চল্লিশ পয়সা বাঁচল সেটা ব্যাঙ্কে রেখে দেন বা অন্য ব্যবসায় খাটান। লঞ্চে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা একশ। যাত্রী উঠাবেন আড়াইশ। দুইটা ইদের মৌসুম পার করতে পারলে দুই বছরের মাথায় আপনি আরো একটা লঞ্চের মালিক হবেন।এই হল আমাদের পরামর্শ এবং এখন আপনি কি করবেন সেটা আপনার বিবেচনা।
লঞ্চ মালিকের চোখ লোভে অলরেডি চকচক করে উঠেছে। ব্যবসায়ী মাত্রেই জন্মগত ভাবে পরিসংখ্যানের ছাত্র। সে অলরেডি হিসাব করে ফেলেছে- এই ফর্মুলায় আগামী পাঁচ বছরে যে লঞ্চগুলো ডুববে তার একটা যদি তার ও হয়, তাও সে আরো অন্তত পাঁচ টা লঞ্চের মালিক হতে পারবে।পাঁচ টা লঞ্চ! যেন পাঁচ টা সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস!!
তারপর ও সে আদিখ্যেতা করে বলবে- আঁহ হাঁ! মানুষের জাণ নিয়ে কঠা! ডিজাইন উয়িক হলে মানুষেড় মিত্ত্যু হঠে পাড়ে!
জ্ঞানপাপী এবং মূর্খরা তখন সম-স্বরে বলবে- যাত্রী দের হায়াৎ থাকলে লঞ্চের ডিজাইন যেরকম ই হোক, লঞ্চ অবশ্যই ডুববে না! লঞ্চ নদী তে নামানোর আগে আমরা ভাল করে মিলাদ পড়িয়ে দেব। লঞ্চের ত্রুটিপূর্ন ডেকের উপর দাঁড়িয়ে বড় হুজুর দোয়া করবেন- ইয়া পরওয়ারদেগার, লঞ্চ যেন না ডুবে। তোমার কুদরতের হাত দিয়ে এই লঞ্চ এবং এর যাত্রীদের হেফাজত কর। তাদের কে সকল বালা মুসিবত থেকে রক্ষা কর।
হায়রে পাপিষ্ঠ মানুষ আমরা! আমরা আল্লাহ পাকের নির্দেশ না মেনে সামান্য কিছু অসৎ উপার্জনের জন্য সবসময় এভাবে আল্লাহ পাকের সাথে রসিকতা করি! আমরা ভুলে যাই যে আমরা সবাই জীবন নামক এক টাইটানিকের যাত্রী যেটা আজ হোক কাল হোক ডুববেই এবং আমাদের হতে হবে চূড়ান্ত বিচারের মুখোমুখি। সেদিন যদি আল্লাহ পাক জিজ্ঞেস করেন-
বান্দা, ধর তোমার শোবার ঘরে তুমি সিলিং ফ্যান লাগাচ্ছ। মিস্ত্রি বলল, শুধু বল্টু দিয়ে ফ্যান ঝুলাই? নাট দেবার দরকার নাই। নাট দিলে অযথা পয়সা খরচ হবে! আল্লাহ’র হুকুম থাকলে নাট না থাকলেও বল্টু খুলে পড়বে না। হে আমার বান্দা অই ফ্যানের নিচে তুমি তোমার বৌ-বাচ্চা নিয়ে ঘুমাও। ফ্যান খুলে গেলে সোজা তোমার ঘুমন্ত বাচ্চার গায়ের উপর গিয়ে পড়বে। সেই ক্ষেত্রে দু পয়সার নাট খরচ বাঁচাতে গিয়ে তুমি কি তোমার বাচ্চার মৃত্যু ডেকে আনতে নাকি মিস্ত্রী কে বলতে- ওরে পাষণ্ড মিস্ত্রি! বল্টু কে যে নাট দিয়ে আটকাতে হয় সেই জ্ঞান ত আল্লাহ পাক তোমাকে আমাকে দিয়েছেন। জ্ঞান মানেই ত এক ধরনের নির্দেশ! সেই জ্ঞান কে অস্বীকার করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করে তুমি যদি আল্লাহ তায়ালার দয়া ভিক্ষা কর তাইলে তোমার চেয়ে বড় শয়তান, বড় ধোঁকা বাজ ত স্বয়ং ইবলিশ শয়তান ও নয়! জবাব আছে?
জবাব নাই।
জবাব যতদিন নাই ততদিন ভুতের তাণ্ডবের মত ঘুষ খেয়ে ডিজাইন পাশ করা থাকবে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে লঞ্চ ছাড়া থাকবে। সূর্য উঠবে, সূর্য ডুববে। চাঁদ উঠবে, চাঁদ ডুববে। লঞ্চ ছাড়বে, প্রতি বছর লঞ্চ ডুবে মারা যাবে হাজার হাজার ‘সস্তা মানুষ’।
সস্তা মানুষ বলেই আমরা দামী মানুষেরা তাদের জন্য দুচার দিন ‘আহ উহ’ করে তাদের পরিবার কে অসৎ উপার্জনে কেনা দূ’চার টা ছাগল টাগল দিয়ে আমাদের হৃদয়ের মহত্ত্ব প্রমান করব। আমরা ‘দামী মানুষ’ বলেই সেই সব অসৎ প্রতারক যারা ঘুস খেয়ে ত্রুটিপুর্ন নকশা অনুমোদন দেয় এবং এবং লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী উঠায় তাদের ‘কেশ’ ও ছিঁড়তে চেষ্টা করব না কোন দিন! কারন তারাও আমাদের মতই দামী মানুষ এবং একজন দামী মানুষের অন্য দামী মানুষ দের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখা তার নিজের দাম বজায় রাখার জন্য সবচেয়ে জরুরী।
©somewhere in net ltd.