![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Dipak Ray, Kalirhat, Krishnagar, Nadia, WB, India, Ph. 9775179985 Mail. [email protected]আমি লিখি, লেখার চেষ্টা করি। যা বিশ্বাস করি না, তা লিখি না। শিক্ষকতা আমার পেশা, লেখালেখি-সাংবাদিকতা নেশা। আমার লেখার সমালোচনা হলে, আমি সমৃদ্ধ হই।
সহজ পাঠ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী বই। পশ্চিমবঙ্গে সরকারী ও সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যাল্যগুলিতে সহজপাঠের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ আবশ্যিক হিসাবে পড়ানো হয়। প্রথম ভাগের প্রচ্ছদ লাল এবং দ্বিতীয় ভাগের প্রচ্ছদ সবুজ। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই বইদুটির সব লেখাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। আর ভিতরের আকা সবকটি ছবি চিত্রকর নন্দলাল বসুর। বিদ্যাসাগরের বর্নপরিচয়ের ভাষা যতটা কঠিন, সহজপাঠের ভাষা ঠিক ততটাই সহজ সাবলীল, চলিত ভাষায় লেখা। এই সহজপাঠ দীর্ঘ চার দশক ধরেই প্রাথমিকে অবশ্যপাঠ্য হিসাবে চালু আছে। 'ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া' দিয়ে বইটির শুরু। ভিতরের ছবিগুলিও বেশ মানানসই। ছবিগুলোর একটা বিশেষত্ব হল, প্রথম ভাগের ছবিগুলো মোটা দাগের ছাপা ছবি। আর দ্বিতীয় ভাগের ছবিগুলো সবটাই রেখাচিত্র। কয়েকপুরুষ ধরে এই বইদুটিই পড়েই ঘটেছে বেশিরভাগ বাঙ্গালীর বর্নপরিচয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে বিশ্বভারতীর অনুমতিক্রমে এই সহজপাঠ প্রাথমিকে চালু হয়। সরকার এই দুটি বই বিনামূল্যে বিদ্যালয়গুলিতে সরবরাহ করে থাকে। পাশাপাশি, অতীতের গুরু ট্রেনিং, পরবর্তীতে বেসিক, পিটিটি বা অধুনা ডিএড ট্রেনিং এর সময়তেও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এই বইদুটি পড়ানো হয়। সেই থেকে সহজ পাঠ নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রাথমিকে ছিল, আছে। ৩৩ বছর আগে আমি নিজেও পড়েছি, ৫ বছর আগে আমার ছেলেও পড়েছে, আর ৬ বছর ধরে আমি নিজেও পড়াচ্ছি আমার বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের। কখনো সহজ পাঠ তুলে দেবার মতো কোন কথা আমার গোচরে আসেনি। তবে মাঝে একবার মুদ্রনজনিত কারনে সহজ পাঠ বইদুটির আকৃতি ও মুদ্রনজনিত পরিবর্তন ঘটেছিল। আর ক্ষীনদৃষ্টি পড়ুয়াদের জন্যে একটু বড় হরফে ছাপা হয়েছিল। আর কখনো সরকারী ছাপাখানা ছাড়া অন্য কোথাও বইদুটি ছাপাও হয়নি। তবে বিশ্বভারতীর কপিরাইট আইন উঠে যাবার পরে অনেক প্রকাশনা বইদুটি রঙ্গীন ও বড় আকারে প্রকাশ করেছিল বেসরকারী বিদ্যালয়ের জন্য। কিন্তু সরকারী বিদ্যালয়ে বইদুটি এখনো ঐতিহ্য মেনে আদি ও অকৃত্তিমই আছে। গতবছর এই রাজ্যে নতুন সরকার আসার পরে সরকারপন্থী নাট্যকর্মী শাওলী মিত্র রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপন কমিটির প্রথম বৈঠকে 'সহজ পাঠকে পুনরায় প্রাথমিকে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব' দেন। বিষয়টি প্রচারমাধ্যমের দৌলতে প্রচারিত হয়। বহু মানুষ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। বিতর্কের শুরু হয় এখানেই। সহজ পাঠ বিদ্যালয়ে চালু আছে কি নেই খোজ না নিয়েই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও বিধানসভায় ঘোষনা করেন, 'রাজ্য সরকার সহজ পাঠ কে আবশ্যিকভাবে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনবে'। একইভাবে বেশ কয়েকজন বিদ্দ্বজনও কোন খোজখবর না নিয়ে এই বিষয়ে ঘটা করে সমর্থনসুচক লেখা বিভিন্ন পত্রিকাতে লেখেন। আর এই বিভ্রান্তিকর প্রচারের গন্ডী শুধু এই বঙ্গেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিদেশের প্রচারমাধ্যমেও গুরুত্ত্ব দিয়ে প্রচারিত হয়েছে। একটি পত্রিকাতে লেখা হয়েছে, 'বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসীন হয়েই রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি আখ্যা দিয়ে সহজ পাঠকে সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে'। আরেকটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে, 'সহজ পাঠের কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই, এই অজুহাতে আশির দশকে বামফ্রন্ট সহজ পাঠকে সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েছে'। কয়েক কদম বাড়িয়ে একজন লিখেছেন, 'সহজ পাঠ পাঠ্যসুচিতে ফিরিয়ে এনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে শ্রেষ্ট বাঙ্গালী বলে প্রমান করলেন'।নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি জানিয়েছে, 'সহজ পাঠ কখনো পড়ানো বন্ধ হয়নি'। বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বলেছে, 'যা বন্ধ হয়নি, তা কি করে ফিরিয়ে আনা হবে?' পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বলেছে, 'যা বরাবর ছিল, তা ফিরিয়ে আনার কথা বলে একটা বিভ্রান্তি তৈরী করা হয়েছে'। প্রাথমিক শিক্ষক কল্যান সমিতি বলেছে, 'আমরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ, মনে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে তার পারিষদেরা কেউ ভুল পথে পরিচালিত করছেন, ভুল বোঝাচ্ছেন'। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের আধিকারিকেরা বলছেন, 'যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সেহেতু আমাদের কিছু বলা শোভা পায় না'। আসলে মুশকিল হল, কেউ মুখ্যমন্ত্রীকে সঠিক কথাটা বলে বিরাগভাজন হতে চাইছেন না। ফলে একটা ভুল এবং বিভ্রান্তি এখনো রয়েই গেল। সহজ পাঠ আগের মতই চালু রইল, অথচ সরকারী বিজ্ঞপ্তিও বের হল নতুন করে চালু হবে বলে। বিষয়টি নিয়ে বিধানসভায় আপত্তি তুলেছিলেন বিরোধী দলের জনৈক বিধায়ক। দুখানি সহজ পাঠ বই তুলে ধরে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়। কিন্তু সরকারপক্ষের থেকে বলা হয়, 'মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন'। আবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন, 'সহজ পাঠের তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ড চালু করা হবে'। পরিহাসের বিষয় এটাই যে, সহজ পাঠের তৃতীয় ও চতুর্থ পাঠ চালু করতে হলে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আবার জন্মগ্রহন করে নতুন করে লিখতে হবে। কারন, উনি সহজ পাঠের প্রথম ও দুটি ভাগ ছাড়া যে লিখে যেতে পারেননি। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন অনেক কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। সেই কাজগুলি ঠিকঠাক করাই হবে তার সরকারের নীতি। কিছু অবিবেচক, তোষামুদে লোকজনের কবলে পড়ে, ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলে সেই দায় বর্তাবে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর উপরেই। যাতে সরকারের এবং দলের বদনামও হচ্ছে। বিরোধীরা নতুন নতুন ইস্যু হাতে পাচ্ছে। এই সহজ সত্যিটা কি বুঝতে পারছেন না মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী?
©somewhere in net ltd.