| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হযরত আনাস (রা.) বলেন, "সেদিন ছিলো সোমবার মুসলমানরা ফযরের নামায আদায় করছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইমামতির দায়িত্বে ছিলেন। হঠাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা সিদ্দিকার হুজরার পদ্দা সরালেন এবং সাহাবাদের কাতারবাঁধা অবস্থায় নামায আদায় করতে দেখে মৃদু হাসলেন। এদিকে হযরত আবু বকর (রা.) কিছুটা পেছনে সরে গেলেন যেন নামাযের কাতারে রসূল শামিল হতে পারে। তিনি ভেবেছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শামিল হতে পারেন এবং হয়তো নামাযে আসতে চান। হযরত আনাস (রা.) বলেন, হঠাৎ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে সাহাবারা এতো আনন্দিত হলেন যে, নামাযের মধ্যেই ফেতনায় পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো অর্থাৎ তারা নামায ছেড়ে দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শারীরিক অবস্থার খবর নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত দিয়ে সাহাবাদের ইশারা করলেন, তারা যেন নামায পুরা করেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরার ভেতর চলে গিয়ে পর্দা ফেলে দিলেন।"
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অন্য কোন নামাযের সময় আসেনি। দিনের শুরুতে চাশত এর নামাযের সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.)-কে কাছে ডেকে কানে কানে কিছু কথা বললেন। তা শুনে হযরত ফাতেমা যোহরা কাঁদতে লাগলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় ফাতেমার কানে কিছু কথা বললেন, এবারে হযরত ফাতেমা (রা.) হাসতে লাগলেন।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, "পরবর্তী সময়ে আমি হযরত ফাতেমাকে তাঁর কান্না ও হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, প্রথমবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, এই অসুখেই আমার মৃত্যু হবে। একথা শুনে আমি কাঁদলাম। এরপর তিনি আমাকে কানে কানে বললেন, আমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে সর্ব প্রথম তুমিই আমার অনুসারী হয়ে পরলোকে যাবে। একথা শুনে আমি হাসলাম।"।" নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ফাতেমা (রা.)-কে এ সুসংবাদ প্রদান করেন যে , তিনি হলেন বিশ্বের সকল মহিলাদের নেত্রী। সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যন্ত্রণার তীব্রতা দেখে হযরত ফাতেমা (রা.) হঠাৎ বলে ফেললেন, "হায় আব্বাজানের কষ্ট।" একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "তোমার আব্বার আজকের পরে আর কোন কষ্ট নেই।"
নবী (সাঃ) হযরত হাসান ও হোসেন (রা.)-কে ডেকে চুম্বন করলেন এবং তাদের ব্যাপারে কল্যাণের ওসিয়ত করলেন। সহধর্মিনীদের ডাকলেন এবং তাদেরকেও ওয়ায-নসিয়ত করলেন।
এদিকে কষ্ট ক্রমেই বাড়ছিলো। বিষ-এর প্রভাবও প্রকাশ পাচ্ছিলো। খয়বরে তাঁকে এই বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রা.)-কে বলতেন, "হে আয়েশা, খয়বরে আমি যে বিষ মিশ্রিত খাবার খেয়েছিলাম তার প্রতিক্রিয়ার কষ্ট সব সময় অনুভব করছি। এখন মনে হচ্ছে, সেই বিষের প্রভাবে যেন আমার প্রাণের শিরা কাটা যাচ্ছে।" নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যেও ওসিয়ত করেন। তাদের তিনি বলেন, 'আস সালাত, আস্ সালাত অমা মালাকাত আইমানুকুম। অর্থাৎ নামায নামায এবং তোমাদের অধীনস্থ দাসদাসী।' নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা কয়েকবার উচ্চারণ করলেন।
ওফাতকালীন অবস্থা শুরু হলো। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেহে ঠেস দিয়ে ধরে রাখলেন। তিনি বলেন, "আল্লাহর একটি নেয়ামত আমার ওপর এই যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে, আমার হিসেবের দিনে, আমার কোলের ওপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাতের সময়ে আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এবং আমার থুথু একত্রিত করেন। ঘটনা ছিলো এই যে, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.) এসেছিলেন, সে সময় তার হাতে ছিলো মেসওয়াক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার গায়ের ওপর হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। আমি লক্ষ্য করলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেসওয়াকের প্রতি তাকিয়ে আছেন। আমি বুঝলাম যে, তিনি মেসওয়াক চান। বললাম আপনার জন্যে নেব কি? তিনি মাথা নেড়ে ইশারা করলেন। আমি মেসওয়াক এনে তাঁকে দিলাম। কিন্তু শক্ত অনুভূত হলো। বললাম, আপনার জন্যে নরম করে দেবো? তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আমি দাঁত দিয়ে নরম করে দিলাম। এরপর তিনি বেশ ভালোভাবে মেসওয়াক করলেন। তাঁর সামনে একটি পাত্রে পানি ছিলো। তিনি হাত ভিজিয়ে চেহারা মুছছিলেন এবং বলছিলেন, 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু' অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। মৃত্য বড় কঠিন।"
মেসওয়াক শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত অথবা আঙ্গুল তুললেন। এ সময় তাঁর দৃষ্টি ছিলো ছাদের দিকে। উভয় ঠোঁট তখনো নড়ছিলো। তিনি বিড় বিড় করে কি যেন বলছিলেন। হযরত আয়েশা (রা.) মুখের কাছে কান পাতলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বলছিলেন, "হে আল্লাহ তায়ালা! নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তি যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের দলর্ভুক্ত কর, আমাকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ তায়ালা আমাকে মার্জনা করো, আমার ওপর রহম করো এবং আমাকে 'রফিকে আলায়' পৌঁছে দাও। হে আল্লাহ তায়ালা! রফিকে আলা!"
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ কথাটি তিনবার উচ্চারণ করেন। এর পরপরই তাঁর হাত ঝুঁকে পড়লো এবং তিনি পরম প্রিয়ের সান্নিধ্যে চলে গেলেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন! অর্থাৎ আমরা সবাই আল্লাহর জন্যে এবং তাঁর কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।
এ ঘটনা ঘটেছিলো একাদশ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার চাশত এর নামাযের শেষ সময়ে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিলো তখন তেষট্টি বছর চারদিন।
হৃদয়বিদারক এ শোক সংবাদ অল্পক্ষণের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মদীনার জনগণ শোকে অভিভূত হয়ে গেলেন। চারদিকে ছেয়ে গেলো শোকের কালো ছায়া। হযরত আনাস (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেদিন আমাদের মাঝে আগমন করেছিলেন সেদিনের চেয়ে সমুজ্জল দিন আমি আর কখনো দেখিনি। আর যেদিন তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন আমি আর কখনো দেখিনি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর হযরত ফাতেমা (রা.) শোকে কাতর হয়ে বললেন, "হায় আব্বাজান, যিনি পরওয়ারদেগারের ডাকে লাব্বায়ক বলেছিলেন। হায় আব্বাজান, যাঁর ঠিকানা হচ্ছে জান্নাতুল ফেরদাউস। হায় আব্বাজান, আমি জিবরাঈল (আ.)-কে আপনার ওফাতের খবর জানাচ্ছি।"
©somewhere in net ltd.