![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি একজন বোকা মানব, সবাই বলে আমার মাথায় কোন ঘিলু নাই। আমি কিছু বলতে নিলেই সবাই থামিয়ে দিয়ে বলে, এই গাধা চুপ কর! তাই আমি ব্লগের সাহায্যে কিছু বলতে চাই। সামু পরিবারে আমার রোল নাম্বারঃ ১৩৩৩৮১
৪.
খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে যায় মুহিবের, গ্রামের বাড়িতে সে ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠে পড়তো। ওযু করে ফজরের নামাজ শেষে বই নিয়ে বসতো, মাঝে মাঝে পড়তে বসার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতো। গ্রামের সেই দিনগুলো খুব মনে পড়ে যায় বারান্দার এই ছোট্ট ঘরে। আজও ঘুম ভেঙ্গে গেল খুব ভোরবেলাই। বারান্দার গ্রীলের অংশটা টিন দিয়ে বন্ধ করে দেয়া, গ্রীলের বাইরের দিকে প্রতিদিন ভোরবেলা একঝাঁক চড়ুইপাখী তারস্বরে কিচির মিচির করতে থাকে। তাদের এই কলকাকলীতে মনে ছুটে যায় ভাজনডাঙ্গা গ্রামের পদ্মার পাড়ে। মাঝে মাঝেই ভোরবেলা মুহিব বাসা থেকে বের হয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে চলে যেত। সূর্যোদয় এর সময়টা নদীর পাড়ে শিশির ভেজা ঘাসের উপর চুপচাপ বসে কাটিতে দিতো। আজ এই ভোরবেলা মন চাচ্ছে ছুটে যায় পদ্মাপাড়ের সেই ভাজনডাঙ্গা গ্রামে।
মন চাইলেও কিছু করার নাই, তাকে তার মামার বাসার এই ছোট্ট বারান্দায় ঘর পেতে থাকতে হবে। মুহিবের মামা সগিরুদ্দৌলাও সাত সকালে উঠে পড়েন। সম্প্রতি তার ডায়বেটিকস ধরা পড়েছে, ডাক্তারের পরামর্শ মতে প্রতিদিন ভোরবেলা হাঁটতে বের হন, ঘন্টাখানেক হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এসেই তার শোরগোল শুরু করে দেন। অফিস যাওয়ার আগে ছোট বাচ্চাদের মতো চেঁচামেচি করে বাড়িঘর মাথায় তোলেন। তার নাস্তা, ব্যাগ গুছানো, দুপুরের লাঞ্চের টিফিন ক্যারিয়ার এসব নিয়ে প্রতিদিনই পারুল মামীর সাথে চিল্লাফাল্লা না করে তিনি অফিস যেতে পারেন না। মামা অফিস যাওয়ার আগ পর্যন্ত মুহিব চেষ্টা করে মামার সামনে না পড়তে। বেশীরভাগ দিন মামা হাঁটতে বের হওয়ার পরপরই মুহিবের মামাতো ভাই ইরেন’কে মামী স্কুলের জন্য তৈরী করে দিলে তাকে নিয়ে মুহিব বের হয়ে যায়, ইরেন’কে স্কুলে আনা নেয়ার দায়িত্ব মুহিবের। ইরেন’কে স্কুলে দিয়ে সে বাসায় ফিরে না, বাসার কাছের একটা পত্রিকা স্টলে বসে থাকে। যখন দেখে মামা অফিসের জন্য বের হয়ে গেছে, তখন সে পা বাড়ায় বাসার দিকে।
আজ ইরেনের স্কুল নেই, গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। মুহিবের কলেজও বন্ধ ছিলো, কিন্তু গত দু’দিন হলো কলেজ খুলেছে, মিডটার্ম সেমিস্টার পরীক্ষা সামনেই, তাই সিলেবাস পুরোটা শেষ করার জন্য বিশেষ ক্লাসের আয়োজন। এতে অবশ্য মুহিবের তেমন কোন লাভ হবে না। সে এমনিতেই কলেজে অনিয়মিত, মামার বাসার নানান কাজে তাকে থাকতে হয়, ইরেনকে স্কুলে আনা-নেয়া, বাসার বাজার সদাই করা। প্রায় দিনই কলেজের ক্লাস মিস হয়ে যায়, কিন্তু মুহিব সাহস করে কখনো মামাকে বলতে পারে না যে তার ক্লাস আছে। গতকাল বাজার করা হয়েছে, তাই আজ হাতে তেমন বাসার কাজ নাই, তাই কলেজে যাওয়া মনস্থির করেছে মুহিব। অপেক্ষা করছে মামা বের হয়ে যাওয়ার জন্য। দশটা থেকে ক্লাস, মামা নয়টার আগেই বের হয়ে যান। যেদিন ভোরবেলায় কোন কাজ থাকে না, মুহিব সেই সময়টা বই নিয়ে পড়তে বসে। ক্লাস মিস দেয়ায় সে এম্নিতেই অনেকটা পিছিয়ে আছে, তাই চেষ্টা করে নিজে নিজে পড়ে কাভার করতে।
“কিরে আজ কি কলেজে যাবি?” পারুল চায়ের কাপ হাতে মুহিবের রুমে ঢুকলো। সকালবেলা নাস্তার আগে চা খাওয়া পারুলের অনেকদিনের অভ্যাস। মুহিব ভোরবেলা বাসায় থাকলেও মামী তার জন্যও চা বানান। যদিও মুহিবের মামা সগিরুদ্দৌলা’র এই সাত সকালে চা খাওয়া নিয়ে যথেষ্ট বিরক্তি আছে, তাই এই সকালবেলার চা পর্ব উনার আড়ালেই সেরে নেয়া হয়।
“হ্যাঁ মামী। কেন কোন কাজ আছে?”
“না। আর শোন এতো কাজ কাজ করিস কেন সবসময়? তুই কি এখানে কাজের ছেলে হিসেবে কাজ করতে এসেছিস? আগে মাথায় রাখবি তোর পড়াশোনা।”
“জ্বী, মামী।” মুহিব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মুহিবের মামী তাকে যথেষ্ট আদর করেন, কিন্তু মামা যেন তাকে দেখলেই তেলেবেগুণে জ্বলে উঠেন। অন্যের বাসায় আশ্রিত হলে অনেক কিছু মেনে নিতে হয়, এটা মুহিব এতো দিনে বুঝে গেছে।
“শোন, নাস্তা রেডি আছে। নাস্তা নিয়ে এসে খেয়ে নিস।”
৫.
পারুল রান্নাঘরের দিকে চলে যেতেই, মুহিব বইপত্র গুছিয়ে তুলে রাখলো। পড়ায় আজ মন বসছে না, বাসার জন্য মনটা কেমন উদাসীন হয়ে আছে। বাসায় ভোরবেলা তার স্কুল শিক্ষক বাবা স্কুল যাওয়ার সময় তার সাথে হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার দিনগুলো, এরপর ধীরে ধীরে সে বড় হয়ে গেল, কিন্তু বাবা-ছেলে একই সাথে স্কুলে যাওয়া আসার সময়গুলো একইরকম রয়ে গেল। এই যাত্রাপথের সময়টুকুতে তাদের বাবা-ছেলের নানান রকম গল্পে কাটতো, মুহিবের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গল্পের প্রসঙ্গ পরিবর্তিতে হতে থাকলেও গল্প ছিলো অপরিবর্তিত। মুহিব এসএসসি পাশ করার পর ঢাকায় চলে আসায় বাবা বড় একা হয়ে পড়েছেন। এখন কি বাবা’র একা একা স্কুলে যেতে কষ্ট হয়? মাঝে মাঝেই এসব ভাবে মুহিব। কখনো কখনো ভোরবেলা’র এই সময়টাতে সে কল্পনায় তার বাবার সাথে স্কুলে রওনা হয়, নানান বিষয়ে গল্প চলে তাদের দুজনের মধ্যে।
মুহিব নাস্তার প্লেট নিয়ে এসেছে রান্নাঘরে থেকে, আজকে নাস্তায় পরোটা আর মিষ্টি। এই বাসায় প্রতিদিনের নাস্তা ফিক্সড, আলুভাজি আর আটার রুটি। গতকাল বাসায় মেহমান এসেছিলো, জারুল খালার এবারের বিয়ের সম্বন্ধটা বুঝি টিকে গেল। গতকাল ছেলের পক্ষ থেকে কয়েকজন মুরুব্বী এসেছিলো বিয়ের তারিখ পাকা করতে, সাথে করে কয়েক বাক্স মিষ্টি নিয়ে এসেছিলো, সেই মিষ্টি সকালের নাস্তার। মুহিবের মামী জানে দই-মিষ্টি দিয়ে পরোটা মুহিবের খুবই প্রিয়। ঘরে নিশ্চয়ই দই নেই, থাকলে মামী অবশ্যই দই-মিষ্টি দিতেন। একটা কথা ভেবে মুহিব হেসে উঠলো। আগে গ্রামে থাকার সময়টায় তাদের নাস্তা ছিলো আগের রাতে রান্না করা ভাতের পান্তাভাত, মরিচপোড়া আর পেয়াজ। মাঝে মধ্যে রাতের বেঁচে যাওয়া ডাল বা ভর্তা, কদাচিৎ বাসী কোন তরকারী। শহরে এসে এই সাত মাসেই সে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেল! মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে।
আজকে এগারোটার পরে কলেজে ক্লাস, তারপরেও মুহিব তার মামা সগিরুদ্দৌলা বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পরপরই তৈরী হয়ে কলেজের দিকে পা বাড়ালো। বাসা থেকে তাদের কলেজের দূরত্ব তিন, সাড়ে তিন কিলোমিটার এর মতো। এই পথটুকু হেঁটে হেঁটে চলে আসে সে, রিকশা ভাড়ার বিলাসিতা করার সামর্থ্য তার নেই। আর বাসে করে আসতে গেলে প্রায় দেড় কিলো হেঁটে বাস ধরতে হয়। তাই মুহিব আর সেদিকে পা মাড়ায় না। নিজ মনে নানান বিষয়ে ভাবতে ভাবতে মিনিট চল্লিশের মধ্যে কলেজ পৌঁছে যায়। এই সময়টুকুতে সে ভাবনার জগতে এতোটায় আনমনা থাকে যে, আশেপাশের জগত সম্পর্কে তার কোন হুঁশ থাকে না। তাদের সাথে পড়ে, একটা মেয়ে, সুমনা নাম। একদিন সে তাকে রাস্তায় দেখে কয়েকবার ডাকাডাকি করলো, সাড়া না পেয়ে তার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াতে মুহিবের সম্বিৎ ফিরলো যেন। কলেজেও সে তেমন কারো সাথে মিশতে পারে না। হাতে গোনা দু’চারজন মুখচেনা পরিচিত হয়ে গেছে এই সাত মাসে, কিন্তু ‘বন্ধুত্ব’ বলতে যা বুঝায় এমন সম্পর্ক কারো সাথেই তার হয়ে ওঠেনি। কলেজে অনিয়মিত হওয়াটা যেমন এর পেছনে মূল কারণ, তেমনি মুহিবের মুখচোরা লাজুক স্বভাবও সমান দায়ী। মুহিব নিজেকে নিয়ে সারাক্ষণ একটা বলয়ে যেন বাস করে।
৬.
কলেজে দশটার দিকেই পৌঁছে গেল, কলেজের সামনের মাঠের দক্ষিণ কোনার সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া গাছের সারির নীচে দুটো টিনের খাবারের দোকান; যেটার অফিসিয়াল নাম ‘ক্যান্টিন’। সেখানে বেশকিছু ছেলেমেয়ে জটলা করে আছে, কেউ কেউ চা-সিগারেট খাচ্ছে। কলেজ বিল্ডিং এর দিকে তেমন কারো আনাগোনা নেই। মুহিব সেদিকে পা বাড়ালো, কলেজের দোতলার সিঁড়ি ঘরের ডান দিকের শেষমাথায় বিশালদেহী এক বটগাছের ছায়া এসে ঢেকে রাখে সারাক্ষণ, কলেজে এসে ক্লাস না থাকলে মুহিব সেখানটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একাকী, বটের সেই কোমল ছায়া আর ঝিরিঝিরি বাতাসে সে কল্পনায় চলে যায় পদ্মাপাড়ের ভাজনডাঙ্গা গ্রামে।
“এই মুহিব, মুহিব…”
নিজের নামের ডাক শুনে মুহিব ঘার ঘুরালো, সুমনা মেয়েটা আর সাথে দু’টা ছেলে, মুখ পরিচিত, কিন্তু নামটা মনে পড়ছে না, তার দিকেই আসছে। সে দাঁড়িয়ে পড়লো। কলেজে আসলেই এরা মুহিবের সাথে এসে কথা বলে, জোর করে তাদের সাথে ক্লাসে বসায়। মুহিব যে ক্লাসগুলো মিস করেছে সেগুলোর নোট টুকে নিতে নিজেদের খাতা মুহিবকে দেয়। বন্ধুর মতোই তারা মুহিবকে বিবেচনা করলেও মুহিব কেন যেন জড়তা ভেঙ্গে তাদের সাথে মিশতে পারে না।
“বাহ, রেগুলার ক্লাস মিস দিলেও, আজকে স্পেশাল ক্লাসে চলে এসেছো?”
“বাসায় তেমন কাজ ছিলো না, তাই…”
“গত সপ্তাহ তো পুরোটাই কামাই দিয়েছো। একগাদা নোট জমেছে, সব টুকে নিতে পারবে না। ক্লাস শেষে ফটোকপি করে নিও।”
সুমনা মুহিবের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা যেন কেমন, অতিরিক্ত সহজ সরল। প্রথমদিকে তারা ভাবতো ইচ্ছে করে ‘ভান’ করে বোকা সাজার, পরে বুঝতে পেরেছে, মুহিব ছেলেটা আসলেই খুব বেশী সহজ সরল। গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়েগুলো অতিদ্রুত নিজেদের শহুরে করার চক্করে নানান রকমের যে সকল আতলামী করে সেসবের কিছুই এর মধ্যে নেই। মামার বাড়ীতে থেকে মামার সংসারের নানান কাজকর্ম করে দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ, বাবা একটা প্রাইমারী স্কুলের টিচার, যেখানে ঠিকমত বেতন হয় না। অনেক খুটিয়ে খুটিয়ে এসব তারা বন্ধুরা মুহিবের থেকে জেনেছে। ছেলেটা কেন যেন তাদের সাথে সহজে মিশতে পারে না।
“না ফটোকপি করতে হবে না। তোমার অসুবিধা না থাকলে খাতাটা আমাকে দিয়ে দিও, আমি দু’এক দিনের মধ্যে টুকে নিয়ে ফেরত দিয়ে দিবো।
সুমনা স্মিত একটা হাসি দিলো। ছেলেটা ফটোকপি করবে না, কারণ টাকা নেই। কেউ তাকে ফটোকপি করে দিলে সেটাও নিবে না, আত্মসম্মান বোধ প্রচুর। এই আত্মসম্মান বোধ শুধু তার মামার সামনে উধাও হয়ে যায়। একবার তার মামা কলেজে আসলো কি একটা কাজে যেন, সবার সামনে কি একটা কথায় যেন তাকে ‘গাধার বাচ্চা’ বলে গালি দিলো, বেচারা মাথা নীচু করে রইলো। সুমনার এতো খারাপ লাগছিলো যে, ইচ্ছে হচ্ছিলো তার মামাকে গিয়ে বলে, ‘তুই গাধার বাচ্চা, বুইড়া গাধা’।
“আচ্ছা খাতা নিয়ে যাও, যে কদিন লাগে রাখতে পারো, তাড়াহুড়োর কিচ্ছু নাই।”
মুহিব খাতা নিয়ে তার ব্যাগে চালান করে দিলো।
“পড়াশুনা হচ্ছে তো ঠিকমত?”
“হু” সামনের দিকে তাকিয়ে মুহিব নীচু স্বরে বললো। সুমনা খেয়াল করেছে মুহিব সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। সেটা শুধু তার সাথে না, সবার সাথেই।
“তোমার মাথায় যে ব্যাথাটা হয়, সেটা কি এখনো হয়।”
“সবসময় হয় না, পড়তে বসলে বা কোন কিছু নিয়ে খুব বেশী ভাবলে তখন ব্যাথাটা ফিরে আসে।”
“তুমি কবে যাচ্ছো আমার সাথে? আমি কিন্তু আব্বুকে বলে ডাক্তার আংকেলের কাছ থেকে এপোয়ন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছি। উনি বলেছেন যে কোন দিন উনার চেম্বারে সন্ধ্যার পর চলে আসতে।”
“দেখি, খুব বেশী ব্যাথা হলে যাবো একদিন।”
মুহিব তার এই মাথা ব্যাথাটার কথা বাসায় কাউকে জানায়নি। মাস দুয়েক আগে ঘটনা, কলেজে ক্লাস গণিত ক্লাস চলছে, ইন্ট্রিগাল ক্যালকুলাসের একটা অংক, স্যার বোর্ডে লিখছেন। এই স্যারের অভ্যাস অংক মাঝখানে অসমাপ্ত রেখে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকে র্যান্ডমলি কাউকে দাঁড় করান, তাকে অঙ্কের পরের অংশটুকু করতে বলেন। সেদিন হুট করে মুহিবকে দাঁড় করালেন, মুহিব অংকটা মনোযোগ দিয়েই দেখছিলো, খুব কঠিন না হলেও মোটামুটি ভালোই কঠিন অঙ্ক। মুহিবকে স্যার বোর্ডে ডাকলেন, মুহিব অঙ্কটা শেষ করে নিয়ে এসেছে, ঠিক তখন হুট করে তার মাথা পেছনের দিকের বামপাশে তীব্র একটা ব্যাথার ঝাঁকুনি অনুভব করলো, এরপর আর কিছু মনে ছিলো না। সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিলো। পরে তাকে তুলে নিয়ে ক্লাসের ছাত্ররা মাথায় পানি দিলে সে চোখ খুললো। এরকম কেন হলো সে নিজেও জানে না। তবে তারপর থেকে প্রায়ই খুব বেশী মনোযোগ দিয়ে কোন কিছু পড়তে গেলে মাথার বাম পাশে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব করে।
৭.
আজকে ক্লাস ছিলো ইংরেজীর, পরীক্ষার খুব বেশী বাকী নেই, স্যার বেশ কিছু সাজেশন দিলো। আজকের ক্লাসে এসে ভালোই হয়েছে, পরীক্ষার জন্য ভালো কাজে দিবে। ক্লাস শেষ হলো দুপুর একটার দিকে, এমনিতে ক্লাস হয়ে একঘন্টা দশ মিনিটের, আজকে স্পেশাল ক্লাস বলেই টানা দু’ঘন্টা ক্লাস চললো। ক্লাস শেষে মুহিব বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো, পেছন থেক সুমনা এসে তার সাথে হাঁটতে লাগলো।
“এই মুহিব তোমাদের গ্রামের নামটা যেন কি?”
“ভাজনডাঙ্গা”
“হু, ভাজনডাঙ্গা। নামটা খুব সুন্দর। আমরা কিন্তু পরীক্ষার পর তোমাদের ভাজনডাঙ্গায় বেড়াতে যাবো, মনে আছে?”
মুহিব মৃদু হাসলো, কিছু বললো না। অনেকদিন ধরেই তার কলেজের এই বন্ধুরা, (আসলেই কি মুহিব এদের বন্ধু মনে করে? মুহিব নিজেও জানে না) তাকে ধরেছে তার সাথে তাদের পদ্মার পাড়ের ভাজনডাঙ্গা গ্রামে যাবে। মুহিব এমনিতে খুব কম কথা বলে, একদিন ক্লাস শেষে পরের ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছে তারা। কথায় কথায় সবাই তার গ্রামের বাড়ী সম্পর্কে জানতে চাইলে সে তার গ্রামের বাড়ী সম্পর্কে বললো। পদ্মা পাড়ের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের ভাজনডাঙ্গা গ্রাম, যার অনেকটাই পদ্মার ভাঙ্গনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মুহিব কল্পনায় দেখে পাড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একদিন স্রোতস্বিনী পদ্মা একসময় তাদের বাড়ীর সীমানা ঘেঁষে এসে দাঁড়াবে। মুহিবে তাদের বেড়ার ঘরের জানালার লাগোয়া চৌকিতে শুয়ে শুয়ে পদ্মার ঢেউ দেখতে দেখতে হাতে কোন গল্প বই নিয়ে বসে থাকবে।
এরকম বর্ননা শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল, সাথে সাথে প্ল্যান করলো পরীক্ষার শেষে তারা দলবেঁধে মুহিবের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। মুহিব কিছুই বলেনি, কিইবা বলবে? তাদের দুখানা ভাঙ্গাচোরা ঘর, একচিলতে উঠোন যার একপাশে কাঁচা পায়খানা আর অন্যপাশে কলাপাতার ঘের দিয়ে তৈরী রান্নার জায়গা। এদের নিয়ে গ্রামে গেলে এরা থাকবে কোথায়, বসবে কোথায় এসব ভাবলেও মুহিবের লজ্জা লাগে।
কলেজ হতে মিনিট পাঁচেক হাটলেই বাসস্ট্যান্ড, এখান হতেই সুমনাসহ অন্যান্যরা বাস ধরে। আর মুহিব বাঁদিকের রাস্তা ধরে পা বাড়ায় বাসায় উদ্দেশ্যে। বাসস্ট্যান্ড চলে এসেছে, বাসের জন্য সবাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। মুহিবের পাশে সুমনা দাঁড়িয়ে। তাদের গ্রাম সম্পর্কে প্রতিবারই মেয়েটা আগ্রহ নিয়ে নানান প্রশ্ন করে, গ্রামের অনেক গল্প শুনতে চায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ঢাকায় জন্ম, বেড়ে ওঠা বলেই হয়তো মেয়েটার গ্রাম নিয়ে এতো আগ্রহ। হুট করেই দুটো বাস একসাথে চলে আসলো, সবাই যার যার গন্তব্যের জন্য উঠে পড়তে লাগলো। একটি বাসের জানালার পাশে বসে ছিলেন মুহিবের মামা সগিরুদ্দৌলা। জানালা দিয়ে হুট করে চোখে পড়লো মুহিব একটা মেয়ের সাথে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, মেয়েটা হাত নেড়ে নেড়ে কিছু বলছে, মুহিব মাটির দিকে চেয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠলো সগিরুদ্দৌলার। যার চালচুলো নেই, দুবেলা খাবার জোটে তার দয়ায়, মাথাগুঁজে আছে তার বাড়ির বারান্দায়, সে এর মধ্যেই মেয়ে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা শুরু করে দিয়েছে! আজ বাসায় ফিরে ধরতে হবে ‘গাধার বাচ্চা’টাকে। সগিরুদ্দৌলা এখন অফিসের কাজে মতিঝিলের দিকে যাচ্ছেন, মেজাজটা ঠান্ডা রাখা দরকার। কিন্তু মুহিবকে দেখেই তার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। আজকে বাসায় ফিরে ‘গাধার বাচ্চা’কে জুতাপেটা করতে হবে। গ্রামে মামা-বাবা না খেয়ে মরছে, আর ছেলে ঢাকায় এসে মামার বাড়িতে থেকে রঙ্গতামাশায় মেতেছে।
============================================================================
আগের পর্বঃ
* ঠাই (গল্প) - ১ম পর্ব
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে মে, ২০২৫ সকাল ১১:০৬
রাজীব নুর বলেছেন: ভালো।