| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চলো স্বপ্ন ছুঁই
একটু পড়ি, একটু লিখি
মত্স্য ভবন মোড়ে বাস থেকে নেমে হলের(শহীদুল্লাহ হল) উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। আমি যখন ফুটপাত দিয়ে হাঁটি তখন খুব আস্তে আস্তে কদম ফেলে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করি।এর ফলে ফুটপাতের বিভিন্ন কাজকর্মের দিকে নজর ফেলা সহজ হয়।
প্রথমেই ডান পাশে দেখা গেল বার কাউন্সিল এর সুউচ্চঅট্টালিকা । ভবনের দিকে তাকাতেই মনে হল এইতো সেই ঐতিহ্যবাহী ভবন,যেই ভবনের মানুষগুলো প্রায় সবাই বিত্তবান বা বড় বড় মানুষ। বার কাউন্সিল ভবনের সবাইকে বিত্তবান বা বড় মানুষ বলার কারণ হল এই যে, তারা সবাই সমাজের উপর তলার মানুষ হয় ধনে নয়তো জ্ঞানে । এরাই সমাজ বিনির্মানে আত্ম-মানবতার শেষ আশ্রয়স্থল । নিঃস্ব,দুস্থ মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য এই মানুষ গুলোর অবদান অনস্বীকার্য। তারা ভালোকে খারাপ বললে আদালত খারাপ বলে ,আর খারাপকে ভালো বললেও আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া তা খারাপ বলতে পারে না।
এই ভবনের সামনেই দেখি দুস্থ,ভাগ্যহারা মানুষদের আনাগোনা। না ,তারা নিজেদের অধিকার চাইতে আসেনি,সুবিচার প্রত্যাশা করার জন্য ভিড় জমায়নি । এই সুবিশাল ঢাকা শহরে মাথা গোঁজার মত ঠাই খুজতে এই বিশেষ স্থানের বিকল্প তাদের কাছে কতটুকু আছে ????।
এর কারণ হয়তো দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসতে আসতে এই ভবনের আশ-পাশ খালি হয়ে যায় নয়তোবা শীতের রাতে বাতাস থেকে বাঁচতে এটা হতে পারে উত্তম জায়গা। যে ভবন সারাদিন সবার অধিকার নিয়ে কর্মব্যস্থ থেকে । আর সন্ধ্যা নামতেই তা হয়ে যায় ভাগ্যহীনদের শেষ ঠিকানা !!!!!
একটু সামনেই দেখি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট এর গেইট। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেখানে অপরাধী হোক আর নিষ্পাপ ব্যক্তিই হোক প্রত্যাশা একটাই সুবিচার,নিরপেক্ষ,স্বচ্চ বিচার ।
তার সামনেই সুবিচারের আশায় শীতের রাতে বসে আছে গুটি কয়েক ছিন্নমূল মানুষ । তারা সুবিচার চায় কোর্টের কাছে নয় তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ,যিনি পরম আদরে সৃষ্টি করে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছেন আমৃত্যু কষ্টকে সাদরে বরণ করার জন্য।
এমন এক পৃথিবীতে তারা এসেছেন যেখানে বহুজনের আকাশ সমান অট্টালিকা থাকলেও তাদের রাত্রীযাপনের জায়গাটুকুও নেই। গেইট থেকে মাত্র ৩০-৪০ গজ দূরে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তির কর্মস্থল হলেও গেইটের সামনে তারা সমাজের স্ট্যাটাসবিহীন মানবকুল !!!!
একটি নীচু স্তরের প্রাণি আর তাদের মধ্যে এতটুকুই তফাত যার হিসেব মাঝে মধ্যে তাদের মনে নাড়া দিয়ে উঠলেও প্রাণিদের সেই ক্ষমতা নেই এতটুকু । ৩০-৪০ গজের দূরত্বের হিসেবেও আছে আকাশ-পাতাল তফাত কেননা একদিকের কাজ যখন শেষ ,গেইটের সামনের মানুষগুলোর তখন আশ্রয়স্থল খোজার পালা শুরু।
রাস্তার ঠিক বাম পাশেই নগর উন্নয়ন ভবন যা এই মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাসকে দীর্ঘায়িত করে এই ভেবে যে,নগর উন্নয়ন এর দরকার আছে কিন্তু তাদের(এই মানুষগুলোর) উন্নয়ন কতটা দরকার ???তা কতটা বিলম্বিত হতে পারে ??? এক জীবনে একবেলা পেট পুরে খাওয়া আর নির্বিঘ্নে ঘুমানোর মত অধিকার বা সুযোগ কি তাদের জন্য অবশিষ্ট আছে ???
একটু আগালেই পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় , যেখানে দুই শ্রেনীর মানুষ ছাড়া তেমন বেশি মানুষের ভিড় দেখা যায় না—
এক. পৃথিবী যাদের দু’হাত ভরে দিয়েছে । মাতৃভূমিতে যারা তাদের অর্থবিত্ত খরচ করার জায়গা বা খরচ করে তৃপ্তি পায় না বা দেশীয় সেবা যাদের মনঃপূর্ত হয় না , দেশ যাদের হৃদয়কে শান্ত করতে পারা না তারা।
দুই. দেশ যাদেরকে পরিবার নিয়ে দু’বেলা দুমুঠো ভাত জোটাতে কর্ম দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এই মন্ত্রণালয়ের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষেও ঘরহীন মানুষদের আশ্রয়স্থল এর কমতি নেই ।
হোক বসবাসের অযোগ্য রাস্তায় ধূলোবালির ঘনঘটা ,তাতে কি দিন শেষে শরীর এলিয়ে দেয়ার জায়গাতো আছে!!!!! এটাই কম কিসে ???
রাষ্ট্র তাদের কাছে যে ট্যাক্স নিচ্ছে তার দায় স্বরূপ ফুটপাতে ল্যাম্পোস্ট এর অলোয় ঘুমানোর স্বাধীনতাতো দিচ্ছ !!!!!
মোড় থেকে সামনে এগুলে বাম পাশেই চামেলী হাউস যা সিরডাপ এর প্রধান কার্যালয় যেখানে বিভিন্ন দেশের ভাগ্য উন্নয়ের কর্ম পরিধি নির্ধারিত হয়। তবে এর সামনের ফুটপাতের মানুষগুলোর ভাগ্য উন্নয়ন এর দায়িত্ব কাদের ????
এর সীমান দেয়াল কি এতই পুরু যে ফুটপাতের মানুষগুলোর কান্না ভিতরের মানুষের সাড়া জাগাতে পারে না !!!! তা নয় , যখন এই স্থানে সভা হয় তখন তো ফুটপাতের মানুষগুলোর জন্যই আলোচনা হয় যার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাদের থাকার জায়গাটুকুও সাময়িকভাবে হারাতে হয় !!!!
এতে তাদের লাভই হয় কিছু দিনের জন্য অন্য জায়গায় নতুন বাসস্থান খুজে নিতে হয়,যা অনেকটা ভ্রমণ এর বিকল্প হিসেবে ধরে নেয়াই শ্রেয়।
একটু এগিয়ে দেখি ডান পাশে অনেক মানুষের আনাগোনা। রাত ৮ টার একটু বেশি হলেও ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি – কেননা নয়তো এই জায়গাটুকুও বেদখল হতে পারে, নয়তো রাত বেশি হলে শীতের প্রকোপ বাড়বে তখন শীত বেশী অনুভূত হবে । শীত নিবারণের তেমন জামা-কাপড়ও নেই ফলে একবার যদি ঘুম এসে যায় তবে এইসব শীত তেমন কোন বড় ব্যাপার না, রাত পোহালেতো সূর্য উঠবেই তখন এই পৃথিবীর বৈষম্য বিলীন হয়ে যাবে (রোদ পোহাবার অধিকার সবার সমান ,ফুটপাতে একটু বেশি !!! )।
রাস্তার ওপারে ছোট্ট লাঠিতে ঝুলানো আছে –কুটুম বাড়ি ০ কিঃমিঃ । ওপারে মুখরোচক খাবারের লিফলেট আর এপারে প্লাস্টিকে করে ভাত খাওয়ার চেষ্টা !!!! কত অদ্ভুত দুনিয়া !!!
আরও একটু সামনে সচিবালয়ে যাওয়ার রাস্তা আর কার্জন হলের দেয়াল ঘেঁষে খুপরি,প্লাস্টিকের ছাউনি,সরু সংসার !!!! সচিবালয়ে ভাগ্য নির্ধারিত হয় বাংলাদেশের, আর এদের ভাগ্য নির্ধারিত হয় কারো ফেলে দেয়া পচা ভাতে, আশ্রয় হয় চারকোণা ছোট্ট টুকরিতে !!!
তবে তাদের সুভাগ্য এই যে -প্রতি বছরই সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের পরিধি বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে । তবে কবে যে এই পরিধি এই মানুষগুলো পর্যন্ত পৌছাবে তার আশায় রাত্রীযাপন করা ছাড়া তাদের কাছে কি পথই বা খোলা আছে ????????
একটি পথ হয়তোবা খোলা থাকতেও পারে জীবনের কাছে আত্মসমর্পণ করা । তা কি জন্ম অবধি থেকেই শুরু করেনি ?????
আস্তে আস্তে হাঁটছি আর ভাবছি –জীবন এইসব মানুষগুলোকে সবই দিয়েছে স্ত্রী,সন্তান,মা,বাবা ,পরিবার-পরিজন। শুরু এতটুকু সুখ দিলে বিশ্বভ্রহ্মান্ডের কি ক্ষতি হত !!!!!!!!! আরও কিছু মানুষ হয়তো মায়ের কোলে সুখে রাত্রী-যাপন করতে পারত ।
আরো কিছু বাবা হয়তো সন্তানকে না খেয়ে ঘুমাতে যেতে দিত না । আরও কিছু নারী হয়তো স্বামীর সোহাগ পেত,উপভোগ করত মাতৃত্বের দাবির যথার্থতা !!!!!!
আরও কিছু শিশু হয়তো জীবনের শুরুতেই মানবীয় নির্মমতা উপলব্ধি করত না । আর অল্প কিছু মানুষ হয়তো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুমোতে যেত না । তাতে কি বিশ্ব সংসার ভালোভাবে চলত না ???????????????????
‘ঘরহীনদের ঘর’
২৩/১১/২০০৬
রাতঃ ১১.০৩ ঘন্টা
©somewhere in net ltd.