নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জিম মরিসন

সে এক বিরাট ইতিহাস!!

জিম মরিসন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্যবসায় উদ্যোগ

১২ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৭

চায়ের দোকানের সামনেই মহল্লার ছোটভাই রুহুল কে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। উদ্দেশ্য যদিও ছিল চা পানের, কিন্তু সামনের এই মূর্তিমান আপদ দেখে পাশের সিএনজির পেছনে লুকিয়ে পরবো, ধরা পরে গেলাম! আমাকে দেখে রুহুল চোখমুখ শক্ত করে চেহারায় ভীষণ সিরিয়াস একটা ভাব এনে দোকানের ভেতরে নিয়ে গেল।

বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল চিত্ত! বুঝতেই পারছি, অল্পে রক্ষা নেই আজ। স্মরন করার চেষ্টা করলাম কার মুখ দেখে দিন শুরু হয়েছিল, পারলাম না। ইশারায় দোকানদার কে দুটো চায়ের ফরমায়েশ দিয়ে তিক্ত স্বরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি সমস্যা রে? আমার মাথা আগে থেকেই ব্যথা করতেছে, বিস্তারিত আলোচনার দরকার নাই- অল্প কথায় বলবি।'

মিনিটখানেক ইনিয়ে বিনিয়ে ভূমিকার মধ্যেই বুঝতে পারলাম রুহুল অল্প পুজির কোন ব্যবসা করতে চায় এবং এই মহোদ্যোগে আমার সুচিন্তিত(!) পরামর্শ আশা করছে। মনে মনে ভাবলাম, এইযে আরেকটা শুরু হলো!

এখানে বলে রাখা ভাল, এই বলদের শরীরে উদ্যমের ফ্যাক্টরি আছে বোধহয়। কিন্তু মস্তিষ্কের প্রোডাকশন খুব খারাপ- রদ্দি! দুইদিন পরপরই নতুন নতুন হাস্যকর সব প্ল্যান নিয়ে আসে এবং আমার মাথাব্যথা শুরু হবার আগে পর্যন্ত সেসবের দাড়ি-কমা সহকারে বর্ননা করে যায়! মাঝেমধ্যে বিরক্ত হই, ধমক দেই; একদিন কান দিয়েছি মলে। বেহায়া হেসে বলে কি, 'আপনে বড়ভাই। বিপদে পইরা আপ্নের কাছে আসমু নাতো কই যামু?! মঞ্চাইলে এই কানও মইলা দ্যান!' মাথা ঘুরিয়ে অন্য কান এগিয়ে দেয় রুহুল।

এখনও বিরক্ত হলাম যথেষ্টই, কিন্তু প্রকাশ করে লাভ নেই। সমাজের বেশিরভাগ মানুষই অন্যের বিরক্তির থোড়াই কেয়ার করে! আর তারমধ্যে মাথামোটা মানুষের বড় দোষ, অন্যের সমস্যা বুঝতে চায় না। রুহুলও বোঝেনি।

আমার মাথা কাজ করছিল দ্রুত। এই নির্বোধটাকে ধমকিয়ে কিংবা মেরে ঘায়েল করা যাবে না। ওকে সাইজ করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে। আর সেটা অবশ্যই একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হতেই হবে। এই সাতাশ বছর বয়সে কাউকে দেখে পালাচ্ছি- নিজের কাছেই ইমেজ সংকটে পরে যাব! জন্মের মতো জব্দ করতেই হবে ওকে, নইলে নিস্তার নেই।
বিরক্তি চেপে বেমালুম ভাল মানুষটি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-'ব্যবসা করবি, ভাল কথা। কিন্তু ক' দেখি, ব্যবসা কারে কয়? মানে ব্যবসার থিমটা কি?'

ছোট ভাই মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমতা আমতা করতে লাগল।

হেসে বললাম, 'ভুইলা গেছিস? আরে ভাই, লজ্জার কি আছে? সেই ইস্কুলের পড়া মন্থাকে এতদিন পরে? তাও যদি টোকাটুকির অভ্যাস না থাকতো।'

রুহুলের হাত তার মাথা চুলকানোর গতি বাড়িয়ে দিল। ছেলেটার মাথায় উকুন আছে কিনা, কে জানে? ছোট্ট বিরতি নিতে বাধ্য হলাম, মুঠোফোনে একটা মেসেজ এসেছে। কেউ একজন জানতে চায় কেমন আছি। রিপ্লাই দিলাম না। একগ্লাস পানি খেয়ে ওকে বললাম, 'বাদ দে। বল দেখি, কোন ব্যবসা পছন্দ তোর?'

রুহুলের হাত মাথা থেকে ঘাড়ে নেমে এল, গদগদ স্বরে উত্তর আসে 'এই জন্যই তো ভাই আপ্নের কাছে আসা। কি করা যায়, কন তো?'

আমি বলতে থাকি, 'শোন্- ব্যবসা হইলো এমন একটা রোজগার পদ্ধতি যা বুদ্ধি খাটাইয়া করা লাগে। ধর, তুই রেইনকোটের ব্যবসা করলি, কিংবা শীতবস্ত্রের। এগুলা সিজনাল ব্যবসা... বছরের অর্ধেকটা সময় মাছি মারা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আবার ধর কিছু ব্যবসা আছে সারাবছরই মারমার-কাটকাট! ধর... কাচা তরকারির ব্যবসা, ভাতের হোটেল... রাস্তার পাশে থাকে না... নিম্নবিত্ত শ্রমিক কিংবা রিকশাওলারা খায়?... তারপর ধর অটোরিকশার ব্যবসা....!'

বলতে বলতেই ওর চেহারার পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলাম। খুব সেজেগুজে প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন, আহা... ঠিক আছে, চাকরির ইন্টারভিউ দিতেই না হয় গেলেন; উটকো গাড়ি এসে রাস্তার কাদাপানিতে মাখিয়ে দিল আপনাকে। ওই গাড়ির দিকে যে দৃষ্টিতে তাকাবেন, সেই দৃষ্টি ওর চোখে! কি যেন বলতে যাচ্ছিল. হাতের ইশারায় থামতে বলি ওকে।

চা এসে গেছে, আয়েশী চুমুকে মুখের বিস্বাদ ভাব দূর করার প্রয়াস পাই। ওকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলি, 'কোন কাজই তো ছোট নারে ভাই! তোর তো ক্যাপিটাল ভাল না, ছোটখাটো ব্যবসা ছাড়া গতি নাই।' শেষ দিকে চিন্তিত সুর আমার গলায়।
শুরু করার আগে তোর ব্যবসার সংগা জানা লাগবে না? ব্যবসা জিনিসটা কি, কোন ধরনের ব্যবসায় লাভ বেশি... আবার কোন ব্যবসা তোর জন্য প্রযোজ্য, এগুলান জানা দরকার না??'

আবারও থেমে চায়ের কাপে মনোযোগী হহ, অধৈর্য্য আদ্র কন্ঠের জবাব আসে, 'হ, বলেন, সংগা প্রকারভেদ সব বলেন। তা এগুলান কি কন? আপ্নে সিরিয়াস কথায় ইয়ার্কি করতাছেন, আমার সমস্যারে হালকা কইরা দেখতেছেন! আর আমি করমু ভাত তরকারির ব্যবসা... আপনে মিয়া ছোটভাইয়ের সাথে ফাইজলামি করেন!!'

ওর গলায় বাষ্প! উফফফ্... পুরুষ মানুষ হয়ে এতো ন্যাকামী কিভাবে করে? অসহ্য!
থমথমে মুখে পকেট হাতরে সিগারেট বের করি। ধীরে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ঘোরালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে স্পষ্ট গলায় বলি, 'আমি কি ব্যবসা করি, পরামর্শ চাইতে আসছিস ক্যান বেত্তমিজ? পরামর্শ চাইলে যা কমু তা শোনা লাগবে। তোর ধৈর্য্য কম, তোরে দিয়া হবেনা! সেই যে গিটার নিয়া দৌড়াদৌড়ি করলি মাসখানেক। একটা কর্ডও ধরা শিখতে পারলি না। ধৈর্য্য নাই, হুটহাট কিছু একটা ভাবনা আসলেই হইলো?'

একটু থেমে চায়ের কাপে আমার অন্তিম চুম্বন, 'এইজন্যেই সারাজীবনে একটা মেয়ের সাথেও প্রেম করতে পারিস নাই। ব্যবসা করতে চাইলে ব্যবসারে ভালবাসা লাগে। ধৈর্য্য নিয়া ব্যবসায় মন দেয়া লাগে। ছাগল দিয়া কি ধান মাড়াই হয়?' সুক্ষ্ম ধোঁয়ার একটা পর্দা আমাদের মাঝখানে, এপাশ থেকে বলি আমি।

রুহুলের নিশ্চুপ মুখ। রেগে যাচ্ছি দেখে আমাকে নিজের মতো করে কথা বলার সুযোগ দিল বোধকরি। তার সদাই অস্থির চেহারায় শান্ত এবং ধৈর্য্যশীল ভাব আনার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো!

বলতে থাকলাম, 'ব্যবসা করতে হইলে বুদ্ধি খরচ করা লাগবে। তোর ঘটে যা আছে ওই দিয়া ব্যবসা... গাছের গোটা- ঝাকাইলেই পরে, না?'

চায়ের দোকানের বাঁশের বেড়া, তার ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের রোদ এসে পরেছে আমার পিঠে। শার্টের সাদায় প্রতিফলিত আলোর এক অদ্ভুত আভা ঘরজুড়ে! রুহুল কে দেখে মনে হচ্ছে যথেষ্ট প্রভাবিত, মনোযোগী হয়ে শুনছে আমার কথা।

'শোন, এই যে কমলালেবুর স্বাদের ট্যাং... প্রথমে বাজারে আইসা বলল, "প্রচন্ড গরমে শীতলতার স্বস্তি পেতে ঠান্ডা পানিতে ট্যাং গুলে খান।" পাবলিক ঠান্ডা পানিতে ট্যাং খাইলো। গরম শেষে আবার নতুন বিজ্ঞাপন নিয়া হাজির... "এই শীতে উষ্ণতা পেতে গরম পানিতে ট্যাং গুলে খান!" পাবলিক তাও খাইলো। এই হইলো ব্যবসা!!'

রুহুলের চোখ চকচকে দেখাচ্ছে, ওষুধে কাজ হচ্ছে তারমানে। ওকে আস্তে আস্তে উঁচু করছি, মাথার ওপর তুলে মারবো এক আছাড়!

'ব্যবসা করবি, যে ব্যবসায় মাইর নাই। সারাবছরই মানুষ ব্যবহার করবে, এইরকম কোন পণ্যের... ধর...মুরগীর ব্যবসা।"

'মুরগীর ব্যবসা!! ভাই! আমি মুরগী বেচুম!!' যেন খাবি খাচ্ছে ডাঙায় তোলা মাছ, চোখে ঘোর অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইলো! লম্বা শ্বাসে অক্সিজেন টানলো রুহুল, নিজেকে ধৈর্য্যশীল প্রমাণের চেষ্টায় এবার অন্তত ব্যর্থ হলো না সে! 'না মানে মুরগীর ব্যবসা বাদে অন্যকোন...! মুরগী আমার ঠিক পছন্দ হয় না।'

'উমমমম...!' প্রায় ফুরিয়ে আসা সিগারেটে শেষ টান দেই অবহেলায়, তারপর পিষ্ট করি মেঝেতে। 'তাইলে সমাজসেবামূলক কাজ করতে পারস একটা। সমাজের সেবাও করলি, আবার ব্যবসাও।' যেন দারুণ কিছু আবিষ্কার করেছি, নিজের উরুতে চাটি মেরে উদযাপন করি। ওর কৌতুহলী চোখজোড়া আমাকে লক্ষ্য করছে। 'এই আইডিয়া তোর পছন্দ হইতে বাধ্য। এই ১৮ নং ওয়ার্ডে ৭৫০০ জন্য ভোটার আছে। তারমানে ১৫০০-র মতো বাড়ি। পৌরসভার গাড়ি এইসব অলিগলিতে ঢোকে না, এইখানে সেইখানে ময়লা পইরা থাকে। তুই পৌরসভার অনুমতি নিয়া প্রত্যেকটা বাড়ির ময়লা সংগ্রহ করলি। ৪টা ভ্যানগাড়ি, ৮ জন শ্রমিক কাজ করব প্রজেক্টে। প্রতিদিন ২টাকা হারে প্রত্যেকটা পরিবার এই সেবা গ্রহণ করবে। শ্রমিকদের মুজরী পরিশোধ করার পর ভালই থাকার কথা।' এক নিঃশ্বাসে বলি আমি।

রুহুল ঘোৎ ঘোৎ করে উঠলো, আমার রুচি এতো খারাপ- তা কল্পনাতেও ভাবেনি সে। যেন এখনই ময়লার গন্ধ পাচ্ছে, নাক কুঁচকে বলল, 'ভাই, এই ব্যবসাও পছন্দ হয় না। অন্য কিছু কন! বাজেট কম বইলা কি মেথর হমু?'

বিল চুকিয়ে দিয়ে বললাম, 'সমস্যা হইল তোর বাজেট কম।' চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ি আমি। 'উমমমম.... ইউরেকা! পাইছি!'

অনাগ্রহী চেহারায় উৎসাহের আভাস, 'কি পাইছেন?' জিজ্ঞেস করে রুহুল।

আমি বলি, 'পাবলিক টয়লেটের ব্যবসা!!'

শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায় রুহুল, আফসোসের সুরে বলে, 'আপ্নের কাছে পরামর্শ চাওয়াটাই বোকামি হইছে। আপ্নের নজর খুবই ছোট! আর যদি কোনদিন...!' কথা অসমাপ্ত রেখেই বিদায় নিল সে।

আমার মিশন সফল! না হলেও ক্ষতি নেই, ওকে ট্যাকল করার উপায় পেয়ে গেছি!


পরিশিষ্টঃ
চায়ের দোকানের বাইরে সন্ধ্যা হচ্ছে সবেমাত্র, পাখিদের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা আকাশে। হাঁটতে হাঁটতেই ফোন বের করে একটু আগের মেসেজে মনোযোগ দেবার প্রয়াস পাই। উত্তরে লিখি, 'ভাল নেই তুমি ছাড়া!'

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই মে, ২০১৫ রাত ৯:২৫

বটের ফল বলেছেন: লাইক বাটনে চাপ দিতে বাধ্য হলাম।

আসলেই কোন কাজ ছোট নয়। তবে একথা নিশ্চিত বলা যায়, রুহুল চরিত্রটি যদি সত্যিই বাস্তবে থেকে থাকে, তবে তার জীবনে অনেক দুঃখ অপেক্ষা করছে।

কাজের ক্ষেত্রে আমাদ্বের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার।

ভালো থাকবেন অনেক বেশি।

১৩ ই মে, ২০১৫ সকাল ৭:৪৪

জিম মরিসন বলেছেন: রুহুল চরিত্রটি একেবারেই বাস্তব, শুধু তার বাস্তব বোধের অভাব আছে কিছু। পোলাপাইন মানুষ- বয়স কম তো, সময়ে আশা করি ঠিক হয়ে যাবে। B-)
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। শুভকামনা রইলো... :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.