![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফু চাচা তার মোটা কাঁচের চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে শ্রাগ করেন, "বালক, ফালাফালি কম করো। উৎসবটা ভূতের- তোমার যন্ত্রনায় তো তারা বাপ বাপ কইরা পলাইবো দেখতাছি!"
আয়েশী সুর চাচার গলায়। আমি সিগারেটের ধোঁয়ার এপাশ থেকে হাসি। তারপর সিরিয়াস গলায় উত্তর দেই, 'চাচমিয়া, তোমার এ নিয়া সন্দেহ আছে এখনও? ভীষণ দুঃখ পাইলাম!’
আমরা আসলে ভূত উৎসবের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। সেই ব্যস্ততা প্রকৃতই এক ভূতুরে ব্যাপার-স্যাপার! এটা সেটা মিলিয়ে রাজ্যের জিনিসপত্র কেনা হয়েছে কোম্পানির ফান্ডের বারোটা বাজিয়ে। ফু চাচাই সব কিছু দেখভাল করছেন, গত দুদিন ধরে কাজকর্ম সব শিকেয় তুলে আমি তাকে সাহায্য-টাহায্য(!) করি আর কি! আমরা চাচা-ভাতিজা মিলে খুব ব্যস্ত ভঙিতে দৌড়ের উপর থাকি সারাদিন, সন্ধ্যাবেলায় চাচার পিকআপ ট্রাকের পেছনের ডলায় বসে পানাহার করতে করতে সারাদিনের কাজকর্মের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করি।
‘আচ্ছা চাচা, তুমি তো ঠিক ভূত উৎসব করা টাইপের মানুষ না। এই বোগাস স্পিরিচুয়াল জিনিসাদি তোমার বিশ্বাস হয়?’
চাচা বলে, "সব গাঁজাখোরের কাজকর্ম, বুঝলা মিয়া? দুনিয়ার কত লোক না খায়া মরে, আর শালা আমরা ভূতের শ্রাদ্ধ কইরা গুচ্ছের ট্যাকা উড়াই! ফাইজলামি আর কি!" গজগজ করেন চাচা। আমি মনে মনে বলি, ‘আমরাই কি কম যাই!’ ভাজা মুরগীর উপাদেয় ঠ্যাংগুলো উদরে চালান করতে করতে মুখে বলি, 'সেটাই তো চাচ্চু!'
আবার শুরু করে চাচা, "ভাতিজা, তবে কি জানো... জিনিসটা আসলে... আসলে ঠিক বিলিভ করা বা না করার সাথে সম্পর্কিত না। এই উৎসব আমাগো বহু প্রাচীন একটা ট্র্যাডিশান। ছুটুবেলায় দেখছি বাপ দাদায় পালন করছে। তবে এইটার পজিটিভ দিক হইলো, মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য আমাদের রোবোটিক জীবনের খানিকটা সময় ব্যয় করতেছি! বেশ একট হইচই হয়। সবাই এবাড়ি ওবাড়ি যায়, সামাজিকতার একট চর্চাও হয়। এই ভূতের পিছনে ট্যাকা আর সময় খরচা করার পেছনে আমার অন্তত এইটাই কারন।"
‘এইসব পজিটিভ বিষয়। কিন্তুু মৃত পূর্বপুরুষদের ভূত বইলা খাতির করায় আমার কিঞ্চিত আপত্তি আছে, ইউ নো? এই মাসে তোমরা যে ফালতু কিছু কুসংস্কার প্রশ্রয় দিয়া... এই যেমন, সাঁতার কাটা এই মাসে বন্ধ। ক্যান? ভূতে নাকি ঠ্যাঙ টাইনা ধরবো... তোমাদেরই পূর্বপুরুষের ভূত! এইরকম আরও আছে, কইতে গেলে রামায়ন... চাচা, পারো বটে তোমরা... শেলুখাশ!’
চাচা আমার কথার প্রতিবাদ করে। আহারের সাথে পানের প্রভাব তার মধ্যে কাজ করে ধীরপায়ে! সে ভূত-টূতে বিশ্বাস করে না, এক কালের মাও সে তুং-য়ের দীক্ষিত কমরেডের সাথে আমি শিষ্টাচার বজায় রাখছি না! আধুনিক তথাকথিত প্রগতিশীলদের তার এইসব কারনেই পছন্দ হয় না। আর এইসব আচার-অনুষ্ঠান ট্র্যাডিশান ছাড়া তার কাছে আর কিছুই না- ইত্যাদি বলতে বলতে চাচা চ্যাচামেচি করে। রাত বাড়ে এদিকে, বাড়ি ফেরার সময় বয়ে যায়। কাল সকালে উৎসব, আমরা আয়োজনের পুরোটা আরেকবার রিভাইজ করি... নাহ, সব একদম ঠিকাঠাক! সিকিউরিটি লোকটাকে সবদিকে খেয়াল রাখতে বলে আমরা গোছগাছ করে গাড়িতে উঠি।
রাস্তায় একটা গ্যাস স্টেশনে থেমে পেট্রোল রিফুয়েলিং করে চাচা। তারপর সেভেন এলেভেনে গিয়ে কয়েক প্যাকেট সিগারেট, কিছু খাবার, আরো এইটা সেইটা কেনে। আবার যাত্রা শুরু হয়।
রাতের পথ একটু শুনশান, আমি এসিটা বন্ধ করে জানালার কাঁচ নামেয়ে দেই। আকাশে একটা অর্ধেক চাঁদ। আমার আস্তানা শহরের শেষপ্রান্তে।
নিজের এপার্টমেন্টের কাছাকাছি এসে শরীর খারাপের বাহানা জুড়ে দেয় ফু চাচা, তার নাকি মাথার পিছনে যন্ত্রনা হচ্ছে! আমিও নাছোড়বান্দার মতো বসে থাকি, ‘ফাইজলামি করো বুড়া? আমি এখন কি ভূতের কান্ধে চইড়া বাড়ি যামু? নামায়ে দিতে হবে আস্তানার সামনে... তারপর অন্য কথা।’
অনুরোধ বিফলে যাচ্ছে দেখে অন্য পথ ধরে চাচা- সিগারেটের একটা প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলে, "খাড়াও মিয়া, বিড়ি ধরাও। তুমরা এই যুগের পুলাপাইন, কম্প্রোমাইজ নামে একটা জিনিষ আছে, জানো? আইচ্ছা, একটানে আমার এই পেগাসাস নিয়া চইলা যাও! এই রইলো লাগাম... থুক্কু চাবি!"
আমি তেরিয়া গলায় উত্তর দেই, 'ফাইজলামি করো বুড়া? আমার কি লাইসেন্স আছে? তোমার এই ঝরঝরা স্ক্র্যাপ নিয়া দুই কিলোমিটার যাওয়ার আগেই ঠুলায় থামায়া ফিটনেস সার্টিফিকেট দেখতে চাইবো। আমারে পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে? চালাও... মানে মানে চালাও বলতাছি!'
চাচার স্বর আরোও নরম, "ওকে, ওকে... আমি ট্যাকশি ডাইকা দিতাছি ম্যান!’ আমি সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা পকেটস্থ করে বলি, ‘এখন কয়টা বাজে খিয়াল আছে বুড়া? ‘ট্যাকহি’ আর ‘ট্যাকশি’ যাই কও, লেট নাইট সার্ভিস চার্জে ভাড়াটা প্রায় ডবল এখন, সেইটা কে দেবে জনাব? কনফুসিয়াসের ভূত?’ চাচা মানিব্যাগ বের করতে করতে বিড়বিড় করে ‘কে আবার? হাজী সাব!’
সিটবেল্ট খুলতে খুলতে আমি মনে মনে হাসি- বুড়ো ভূতের ভয়ে যাচ্ছে না, একা একা ফিরতে হবে যে! এই মাসে একা একা চলাচল করা নিষেধ! একলা পেলে ভূতেরা ঘাড় দেবে মটকে! বুদ্ধু কাহিকা!!
চাচামিঞা চলে গেলে আরেকটা সিগারেট জ্বেলে কল করি ট্যাক্সি কোম্পানীতে। ঠিকানাটা জানাতেই বলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাহন পৌঁছে যাবে। ব্যাকপ্যাক থেকে পানির বোতল বের করে গলা ভেজাই। তারপর কানে হেডফোন গুঁজে বিচ্ছিন্ন হই মানুষ অথবা ভূতের পৃথিবী থেকে!
ট্যাক্সি চলে আসে বলে দেয়া সময়ের মধ্যেই। আধপোড়া সিগারেট রাস্তায় পিষে এগিয়ে যাই কুচকুচে কালো গাড়িটার দিকে। সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলি... 'এসিটা বন্ধ করো ব্রো! আমরা বরং একটু রাতের বাতাস সেবন করি!'
এসির গুঞ্জন বন্ধ হয়... ধীরে পাশের জানালাটা যায় খুলে। খোলা জানালায় অজস্র বাতাস। কানে বাজছে পিংক ফ্লয়েড... "উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার"... অনবদ্য!
পাশে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাই! শীতল একটা স্রোত বয়ে যায় মেরুদন্ড বেয়ে! ছানাবড়া চোখে তাকিয়ে দেখি ড্রাইভারের সিটে পোশাক পরা একটা নরকঙ্কাল স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বসে আছে!
©somewhere in net ltd.