নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যেসব কথা এই সামু ব্লগে লিখতে পারি না নানা কারনে- সেসব কথা আমার পার্সোনাল জার্নাল ব্লগে লিখি -- জার্নাল অফ জাহিদ https://journalofjahid.com/

জাহিদ অনিক

জার্নাল অফ জাহিদ

জাহিদ অনিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

চৌরঙ্গী (চলচ্চিত্র) রিভিউ

১০ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৪২

ইদের অবকাশের শেষ দিন, দেখে ফেললাম চৌরঙ্গী। উত্তমের অতিউত্তম ফাইভ স্টারীয় আতিথেয়তা আর শব্দের অতি সঠিক ও সাবধানী উচ্চারণের দুর্দান্ত সংলাপ ডেলিভারি। ৬০'র কলকাতার আভিযাত্যের পেছনের গল্প, ক্লাসিকের ছোঁয়া।



বাংলা সাহিত্য আর সিনেমার জগতে কলকাতার আভিজাত্য, জীবনের জটিলতা আর সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে কথা উঠলেই "চৌরঙ্গী" নামটা সামনে চলে আসে। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা, যেটি শঙ্করের বিখ্যাত উপন্যাস থেকে উঠে এসেছে, আজও আমাদের মনের গভীরে একটা দাগ কেটে রেখেছে। হোটেল শাহজাহানের চার দেওয়ালের মাঝে যেন লুকিয়ে আছে কলকাতার এক ক্ষুদ্র রূপ প্রতিটি দরজার আড়ালে একেকটা গল্প, সংগ্রাম, প্রেম আর হৃদয়ভাঙা মুহূর্ত। আর এই সবের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন সত্যব্রত বসু, যিনি উত্তম কুমারের অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। 

"চৌরঙ্গী" শব্দটা শুনলেই কানে একটা আভিজাত্যের ধ্বনি বাজে। এটি এসেছে "চতুরঙ্গী" বা "চতুরঙ্গ" থেকে, যার মানে "চারদিক থেকে আসা রাস্তা" বা "চারটি পথের মিলনস্থল"। সোজা কথায়, এটা একটা বড় মোড় যেখানে চারটে রাস্তা এসে মিশে যায়। শহরের এমন জায়গা সবসময়ই জটিলতা, গতি আর মানুষের ভিড়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। কলকাতার চৌরঙ্গীও ঠিক তেমন একটা সংযোগস্থল, যেখানে জীবনের নানা রং ছড়িয়ে পড়ে।



সিনেমার প্রেক্ষাপটে, হোটেল শাহজাহান নিজেই যেন এক ‘চৌরঙ্গী’ এক কেন্দ্রস্থল। এখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষের জীবন, তাদের সামাজিক শ্রেণি, আবেগ, সংকট আর অজস্র সম্পর্ক এক বিন্দুতে মিলিত হয়। প্রতিটি অতিথির গল্প এখানে একেকটি রাস্তা, প্রতিটি মোড়। তাদের সকলের জীবনধারা মিলেমিশে তৈরি হয় সেই জটিল ‘চৌরঙ্গী’ – যা কলকাতার জীবনের বহুমাত্রিক ও গভীর চিত্রকে আমাদের সামনে মেলে ধরে।



১) ছবির সারাংশ: একটা শহরের জীবন্ত ছবি

১৯৫০-এর দশকের কলকাতার চৌরঙ্গী এলাকায় গল্পটা বাঁধা। এক তরুণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিন্তু বেকার, তার বন্ধুর সাহায্যে হোটেল শাহজাহানে চাকরি পায়। প্রথমে সে এক লেডি টাইপিস্ট এর রিপ্লেস হিসেবে কাজ শুরু করে, কিন্তু ধীরে ধীরে চিফ রিসেপশনিস্ট সত্যব্রত বসুর (উত্তম কুমার) প্রধান সহকারী হয়ে ওঠে। ম্যানেজার মার্কো পোলো তার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। গল্পটা ঘুরে ফিরে আসে হোটেলের অতিথি, বিনোদনশিল্পী আর কর্মীদের জীবনের চারপাশে।

এখানে কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের লোভ, দুর্নীতি আর নোংরা দিকগুলো উঠে আসে। নতুন চাকরিপ্রাপ্ত এই তরুণ প্রথমে সব দেখে হতবাক হয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে ক্লান্তি তাকে গ্রাস করে। গল্পে দারিদ্র্য আর বেকারত্বের ছায়াও স্পষ্ট। তবে এর মূল সুরটা বাজে প্রেমের ঝংকারে অতিথি আর কর্মীদের মধ্যে সম্পর্কের নানা রঙ ফুটে ওঠে, যার বেশিরভাগই শেষ হয় মর্মান্তিকভাবে।

২) উত্তমকুমার: স্যাটা বোস; যিনি শুধু ম্যানেজার নন, এক কবি-দার্শনিক

সত্যব্রত 'স্যাটা' বোস চরিত্রে উত্তমকুমারের অভিনয় বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতা। তিনি শুধু হোটেল চালান না; চালান মানুষের আবেগের জটিল সমীকরণ। তার চোখে পড়ে অতিথিদের না-বলা কষ্ট, মুখোশের আড়ালের দুর্বলতা। তার পেশাদারিত্বই এক অনন্য শিল্প। দেখুন কী নিখুঁত ভাবে তিনি ভাষা বদলান:

ধনী ব্যবসায়ী মালহোত্রাকে স্যুটে ওয়েলকাম জানাতে তার ইংরেজি ঝরঝরে:
“Welcome, Mr. Malhotra. Your suite is ready. Hope the journey from Bombay was comfortable.”

আর মুহূর্ত না ফেরতেই, খাঁটি বাঙালিয়ানায় সেই অতিথিকেই কলকাতার মায়া ধরিয়ে দেন:
“আপনার ঘরের খিড়কির পাল্লা খুললেই তো পুরো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চোখে পড়বে। দারুণ ভিউ পাবেন!”

স্যাটার উর্দু ঝোঁক তাকে দেয় এক অতিরিক্ত মাত্রা। কোনো সন্দেহজনক অতিথিকে জেরা করতে গেলে ঠোঁটে টেনে বলবেন, “তাশখন্দ থেকে এসেছেন নাকি?” শব্দচয়নে রুচি আর কৌতুকের মিশেল। অনৈতিক দাবি এলে সরাসরি ‘না’ না বলে কূটনৈতিক ভঙ্গিতে সরে দাঁড়ান:

“I’m afraid that would not be possible at Hotel Shahjahan. However, I can refer you to a private contact… if you insist.”

এছাড়া, অতিথিদের গোপনীয়তা রক্ষায় তিনি অতুলনীয়। একবার এক ব্যবসায়ীকে মডেলের সঙ্গে দেখা গেলে তিনি শুধু বলেন,
“Mr. X hamara ek valued guest hai. Unke personal matters pe hum baat nahi karte।”
এটা শুধু কথার খেলা নয়, তার পেশার প্রতি শ্রদ্ধার প্রমাণ।



৩) প্রেম আর ট্র্যাজেডি: সত্যব্রত ও ক্যারল

সত্যব্রত আর ক্যারলের (সুপ্রিয়া দেবী) সম্পর্ক সিনেমার সবচেয়ে আবেগঘন অংশ। ক্যারল একজন বিধবা, যিনি সমাজে টিকে থাকতে ফ্যাশন শো, মডেলিং আর প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। সত্যব্রত তাকে ভালোবাসেন, কিন্তু তার জীবনের এই দিক মেনে নিতে পারেন না।

ক্যারলের আত্মহত্যার পর সত্যব্রতের নির্বাক প্রতিক্রিয়া; কোনো কথা নেই, শুধু চোখের অভিব্যক্তিতে যন্ত্রণা। এই দৃশ্য দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে যায়, জীবনের ট্র্যাজেডির এক নিখুঁত চিত্র। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার ছবিটিকে আরও গভীরতা দিয়েছে। একটি দৃশ্যে ক্যারলকে দেখা যায় জানালার পাশে বসে রবীন্দ্রনাথের গান বাজছে – এ যেন তার ভেতরের শূন্যতার প্রতিধ্বনি, তার নীরব বেদনার সুর। সুর আর দৃশ্যের এই যুগলবন্দী ছবিটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। 

৪) অন্যান্য চরিত্র: গল্পের রং

শঙ্কর (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়): এক তরুণ কর্মী, যে স্বপ্ন আর বিভ্রান্তির মাঝে নিজের জায়গা খুঁজছে।
করবী গুহ ওরফে ক্যারল (সুপ্রিয়া দেবী): গ্ল্যামারের আড়ালে লুকোনো বিষাদের প্রতীক।
অনিন্দ্য পাকড়াশী (বিশ্বজিৎ): হাসিখুশি ব্যবসায়ী, যার জীবনে সফলতা আর দায়িত্ব মিশে আছে।
সুজাতা মিত্র (অঞ্জনা ভৌমিক): উচ্চবিত্ত নারী, কলকাতার শালীনতার ছবি।
মার্কো পোলো (উৎপল দত্ত): হোটেলের ব্যস্ততায় হাসির ছোঁয়া যোগ করেন।

৫) আরও কিছু মুহূর্ত যা মনে থেকে যায়


হোটেলের বয় মৃণালের প্রেমিকা চলে গেলে তার কান্না—সাধারণ, কিন্তু মানবিক।
এক বিদেশি অতিথির কথা, “You are more than a manager. You are the soul of this hotel.” সত্যব্রতের সারাংশ ধরা পড়ে।

চৌরঙ্গী’ এমন একটি সিনেমা যা হোটেলের করিডোরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আমাদের নিয়ে যায় মানুষের অন্দরমহলে। উত্তম কুমারের অভিনয়, সংলাপের মাপা ডেলিভারি, ভদ্র ও কৌশলী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলা সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র। একটি সিনেমা কিভাবে সমাজ, ক্লাস ডিভাইড (শ্রেণি বিভাজন), ভালোবাসা, পেশাদারিত্ব সব একসাথে তুলে ধরতে পারে, তার এক অনন্য উদাহরণ ‘চৌরঙ্গী’।

এই ছবিটি শুধু একটি হোটেল আর তার কর্মীদের গল্প নয়, এটি মানুষের জীবনের জটিলতার এক অনবদ্য দলিল। ‘চৌরঙ্গী’ দেখে হয়তো আপনিও খুঁজে পাবেন আপনার জীবনের নিজস্ব ‘চৌরঙ্গী’কে। ছোট ছোট এসব গল্প"-ই তো "চৌরঙ্গী"-কে করে তুলেছে অমর। পাঁচতারা হোটেলের চকচকে ফ্লোরের নিচে যেমন ময়লা জমে, তেমনি তার আভিজাত্যের আড়ালে লেগে থাকে মানুষের ঘাম, আশা আর অশ্রুর গন্ধ...

এই ছবির থিম ও গল্পকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালে সৃজিত মূখর্জী বানিয়েছেন Shah Jahan Regency। অভিনয় করেছেন আবির, অনির্বান স্বস্তিকা, পরমব্রত। 



সত্যি বলতে, শাহজাহান রিজেন্সি (২০১৯) দেখার পর মনে হয়েছিল: "চৌরঙ্গী"-র আত্মা কি এই আধুনিক পুনর্নির্মাণে বেঁচেছে নাকি শুধু শিরোনাম আর হোটেল সেটিংয়ের শেলটা ধার করা হয়েছে?" সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে হোটেল শাহজাহান আবার ফিরে এলেও, গল্পের প্রাণে ঢুকেছে একদম নতুন রক্ত, নতুন যুগের ট্র্যাজেডি আর নতুন মেটাফর।




মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই জুন, ২০২৫ রাত ১০:৪৭

শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু বলেছেন: আপনার রিভিউ ভালো লাগলো। আমি চৌরঙ্গী উপন্যাস পড়েছি এবং দুই সময়ে বানানো দুটি মুভি দেখেছি। মূল উপন্যাস এবং উত্তম কুমারের মুভির দুটোকে খুব স্লো মনে হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে সৃজিতের শাহজাহান রিজেন্সি মুভিটা ভালো লেগেছে।

২| ১০ ই জুন, ২০২৫ রাত ১১:১০

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: শাহজাহান রিজেন্সি দেখেছি।

৩| ১১ ই জুন, ২০২৫ রাত ১২:০৮

কামাল১৮ বলেছেন: চৌরঙ্গী কয়েকবার দেখেছি।এখনো সময় পেলে অংশ বিশেষ দেখি।

৪| ১১ ই জুন, ২০২৫ সকাল ৯:২৫

রাজীব নুর বলেছেন: দুটাই আমি দেখেছি। ভালো মুভি। অভিনয় সুন্দর।

ছুটিতে আমিও কিছু পুরাতন মুভি দেখেছি। যেমন গতকাল দেখলাম- সূর্যদীঘল বাড়ি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.