![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিখাটির ভূমিকা না লিখলে তা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। লেখাটির শিরোনাম হওয়ার কথা ছিলো শুধু ‘ফাগুন কথা ৪’। ফাগুনকে নিয়ে ধারাবাহিক লেখার একটি এটি। ইহসান ইবনে রেজা ওরফে ফাগুন রেজা। আমার নিহত সন্তান। একজন গণমাধ্যমকর্মী। নির্ভিক এবং সৎ। অবশ্যই মেধাবী। সাথে প্রতিশ্রুতিশীল। এমন কম্বিনেশন এখনকার গণমাধ্যমের পক্ষে বড় ‘ডেডলি’। এমন কর্মীর কর্মযজ্ঞ নেয়ার মতন গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমের কর্তা আজ আর খুব বেশি নেই। যারা ছিলেন তারা সব চলে গিয়ে বেঁচেছেন। হয়তো ফাগুনও তাই, চলে গিয়ে বেঁচেছে। বাইশ বছর পূর্ণ হতে মাত্র একমাসের মতন বাকি ছিলো ওর। এত কম বয়সে কেউ ইচ্ছে করে যায় না। তাকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। খুন হয়েছিলো সে। নিখোঁজের পর গুম, তারপর খুন। তাকে নিয়েই এই লেখা।
কিন্তু মুশকিলটা হলো ফাগুন’কে নিয়ে লিখতে গেলেই ওর আগুন আমার মাঝেও ভর করে। সমাজ, রাষ্ট্রের অন্যায়গুলো মেনে নিতে কষ্ট হয়। যেমন ও মেনে নিতে পারেনি। দ্রোহ ছিলো ওর মজ্জাগত। আমারও। আমিও মেনে নিতে পারি না। অজান্তেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মন। লেখায় প্রকাশ পায় সেই দ্রোহের। করার কিছুই নেই, আমি নিরূপায়। দ্রোহ আমার নিয়তি। ফাগুনেরও তাই ছিলো। ভূমিকা শেষ, এখন মূল লেখায় যাই।
মূল লেখা
জাগতিক অর্থে, বাহ্যিক হিসাবে আমি খুব ভালো আছি। অন্তত মধ্যবিত্তের লোভী চাওয়ার যতটা দৌড় সে অনুযায়ী অনেকটাই এগিয়ে। ছা-পোষা মধ্যবিত্ত হয়েও মোটামুটি একটি গাড়ির মালিক এবং চালাই নিজেই। ড্রাইভার না রাখতে পারার অক্ষমতা ঢাকি, ভাবের প্রকাশে নিজে চালিয়ে। ল্যাপটপ আছে দুটি। একটার টাচস্ক্রিন এবং ভালো মানের অবশ্যই। সেলফোন রয়েছে গোটা তিনেক। তারমধ্যে একটা বেশ দামি। রাতে মোটামুটি বিশাল পর্দার একটা টিভিতে মুভি দেখি, তাও আবার ইংরেজি। আর কী চাই। আহা কী আনন্দময় জীবন। ও, অফিসের কথা বাদ দিলাম। এয়ারকন্ডিশন লাগানো চমৎকার অফিস কেবিন আমার। সহকারীও আছেন একজন। সুখের উপর আরো কিছু। সত্যিই কি তাই? না।
আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ আজ নেই। আমার পুত্র, ইহসান ইবনে রেজা ওরফে ফাগুন রেজা। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সন্তান এবং আলোকিত যে সন্তান। আমার সেই আলোকিত সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। একজন সৎ, মেধাবী, নির্ভিক, প্রতিশ্রুতিবান গণমাধ্যমকর্মীকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আলোকিত তরুণকে মেনে নিতে পারেনি অন্ধকারের মানুষেরা। একজন পিতা বেঁচে থাকে তার সন্তানের মাঝে। পুত্রের সাথে পিতাও মারা যায়। আমিও মৃত। সুতরাং একজন মৃত মানুষের কাছে সুখের বোধ অর্থহীন। না, আমার দুঃখগাথা লিখতে বসিনি। জানাতে বসেছি। পৃথিবীর কোন কিছুই বিনা দায়ে যায় না। কোনো মৃত্যুও নয়।
প্রতিটা নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যুই এক একটা কোরবানি। যা অন্যদের বাঁচিয়ে রাখে, রাখার জন্য। আমার ছেলেরটাও তাই। ইসলামের প্রচারক, রাসুল (সা.) এর দুই নাতির কথাই বলি। তারাও কোরবানি হয়েছেন। সন্তান শোক সইতে হয়েছে বিশ্বনবীকেও। কেনো সইতে হয়েছে তার জবাব মহান আল্লাহতায়ালাই দিতে পারবেন। যেহেতু তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি যা জানি তোমরা তা জান না।’
অনেকে মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘আপনার কি ভবিষ্যতের কোনো ভাবনা নেই! এই যে, অর্থের মোহ নেই। সঞ্চয় নেই। সামনে বিপদে পড়লে কী হবে!’ বড়রা বলতেন, ‘সারাজীবন বাউন্ডেলেই রয়ে গেলে। ভবিষ্যতের কথা ভাবলে না।’ তাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কোন ভবিষ্যতের কথা ভাববো! কার ভবিষ্যতের কথা। আমার না আমার সন্তানের। ভবিষ্যত কি সত্যিই আমাদের হাতে? ছেলের মা বলতো, টাকা-পয়সা জমাও ছেলের জন্য লাগবে না। এখন ও স্তব্ধ। সে আজ জানে, সঞ্চয় কতটা মূল্যহীন। অর্থ কতটা অর্থহীন।
আমাদের মানব জনমের লক্ষ্য সঞ্চয় নয়, মানবের কল্যাণে যতটা পারা কাজ করে যাওয়া। না, দাতা মহসিন হতে হবে না, যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে গেলেই হবে। এই যে আমি লিখছি, আমার ক্ষমতা লিখা পর্যন্ত। তাই লিখেই চেষ্টা করছি মানুষকে জাগানোর জন্য। জানাতে চেষ্টা করছি নিজের বুদ্ধি যতটা ধরে, বোধ যতটা কাজ করে। আমার ছেলেটাও তাই শুরু করেছিলো। চেষ্টা করছিলো মানুষকে সত্যটা জানাতে।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ মারা গিয়েছিলো। সব মাধ্যম জানিয়েছিলো ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমার সাংবাদিক পুত্র তার স্বভাবগত মেধা ও বোধ থেকে বুঝেছিলো, এই মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, অন্য কিছু। সে অনুসন্ধান শুরু করেছিলো। তার ধারণাই সত্যি হয়েছিলো। দেশের এক জায়ান্ট কনস্ট্রাকশন কোম্পানির অবহেলায় মারা গিয়েছিলো সেই তরুণ। যা একরকম হত্যাকান্ডই। সে খবর করেছিলো, খবর হয়েছিলো সেই কনস্ট্রাকশন কোম্পানিরও। তারা তাকে লোভ দেখিয়েছিলো। তারা ভাবতেও পারেনি এত অল্পবয়েসি একজন তরুণ মুখের উপর জানিয়ে দেবে তার কোনো লোভ নেই। এবং সে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে। যা হয়, ছেলেটাকে হুমকি দেয়া হয়েছিলো। বলা হয়েছিলো খবরটা ঠিকই নেমে যাবে এবং আপনিও নেমে যাবেন। জানি না, সে কারণেই তাকে নামিয়ে বা সরিয়ে দেয়া হলো কিনা।
মানুষের জন্য কাজের কথা বলছিলাম। আবারও বলছি, প্রতিটি মানুষ যদি তার জায়গা থেকে তার যে কাজ তা করতো, তবে সব কিছুই পাল্টে যেতো। মানুষকে অর্থের পেছনে দৌড়াতে হতো না। বাবা-মা’কে ভাবতে হতো না সন্তানের ভবিষ্যতের কথা। চুরি করে, ব্যাংক লোপাট করে, দুর্নীতি করে সঞ্চয়ের কথা চিন্তা করতে হতো না।
আমার এক বন্ধু থাকেন ইউরোপের একটি দেশে। সেখানেই সেটেলড। এক যুগ পরে দেশে এসেছেন বেড়াতে। সবারই ধারণা প্রচুর টাকা কামিয়েছে সে। আত্মীয়-স্বজন আশা করেছিলো অনেক কিছুই। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। তাকে বলেছিলাম, দোস্ত তুইতো সবাইকে আশাহত করলি। জবাবে বলেছিলো, আশাহত হবার কিছু নেই। আমরা আমাদের হত করেছি অনেক আগেই। আমি যে দেশে থাকি, সেখানের বেশির ভাগ মানুষের মাথাতেই সঞ্চয়ের চিন্তা নেই। তারা যথেষ্ট আয় করে, মান বজায় রাখা জীবন-যাপনও করে। আর বাকিটা রাষ্ট্রের উপর। তার চিকিৎসা, বাসস্থান, সন্তানের শিক্ষা তথা ভবিষ্যতের চিন্তা করে রাষ্ট্র। সুতরাং সঞ্চয়ের কী প্রয়োজন। কিভাবে সম্ভব হলো। জবাব একটাই যার যার জায়গা থেকে নিজের কাজটা করেছে এবং তাতেই ঘটেছে আমাদের চিন্তায় অসম্ভব সেই ঘটনা।
আমরা আমাদের কাজটাই করি না, করি শুধু সঞ্চয়ের চিন্তা। কাজটা করতে হবে, যার যা কাজ। তাহলেই সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত হবে। সন্তান নিরাপদে থাকবে। রাষ্ট্র গড়ার দায়িত্ব আমাদেরই। রাষ্ট্র গড়া হলে আমাদের দায়িত্ব নেবে সেই রাষ্ট্রই। যেমন নিয়েছে বন্ধুর সেই রাষ্ট্রটি। আর নিজের কাজটা না করলে এবং নিজের প্রাপ্যটা বুঝে না নিলে রাষ্ট্রই হয়ে উঠবে প্রাণ-সংহারি। রাষ্ট্রচালকরা হবেন বেপরোয়া। অনেকটা মাতাল চালকের মতন। মত্ততায় পিষে দেবেন মানুষকে, সভ্যতাকে। সমাজ হয়ে উঠবে ক্যানিবাল, নরভোজী।
©somewhere in net ltd.