নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গণমাধ্যমকর্মী, লেখক।

কাকন রেজা

গণমাধ্যমকর্মী, লেখক ।

কাকন রেজা › বিস্তারিত পোস্টঃ

আপন কাহন, বেঁচে আছি ভোরের আশায় : নিহত পুত্রের পিতার বয়ান

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:৫৪



মানুষ কখনো বড় অসহায় হয়ে পড়ে। ক্ষমতা, অর্থ সব অর্থহীন হয়ে যায়। আর যারা ক্ষমতা আর অর্থহীন তারাও উপলব্ধি করে ক্ষমতা আর অর্থও অনেক কিছু পারে না। পারে না, পারে না----

মূল লেখা :

ইদানিং মানুষ থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছে করে। কোথাও যেতে মন চায় না, পরিচিতজনদের সাথে দেখা হলেও এক ধরণের মানসিক ইতস্ততা কাজ করে। কারণ, সবাই ফাগুনের কথা জিজ্ঞেস করে। আমার নিহত সাংবাদিক পুত্র ইহসান ইবনে রেজা ফাগুনে’র (ফাগুন রেজা) কথা। একজন পিতা হিসাবে বারবার একই কথা শোনা এবং তার উত্তর দেয়া যে কতটা কষ্টকর, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে অনুমান করাটাও অসম্ভব।

তারপরও উত্তর দেই। জানি, মানুষ তাদের সহানভূতি থেকেই জানতে চায়, হয়তো ভালোবাসে বলে তাদের ভেতরও উৎকন্ঠা কাজ করে। কিন্তু সেই সহানুভূতি আর উৎকন্ঠাটুকু নেবার ক্ষমতাও এখন আমাদের অর্থাৎ ওর মা, ওর ছোট ভাইটার এবং আমার লোপ পেয়েছে। আমরা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি, আবার বুঝি সেই প্রশ্ন, আবার হৃদয় মুচড়ে উঠা জবাব। একধরণের অস্বস্তিতে থাকি সবসময়। যার ফলে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে আমাদের জগৎ, নিজস্ব পৃথিবী।

অনেকে বলেন, আপনাদের এত পরিচিতি, এত পরিচিত মানুষ তারপরেও এখনো কিছু হচ্ছে না! সত্যি বলতে গেলে আসলেই কিছু হচ্ছে না। তদন্তকারীরা বলছেন, তারা চেষ্টা করছেন। যাচ্ছেন ঢাকাসহ নানা জায়গায়। এর আগে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছেন, আরো এদিক-সেদিক করছেন, কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। এখনো ফাগুন রেজা হত্যাকান্ড পুরোটাই ক্লু-লেস।

এই যে অনেকে বলেন, পরিচিতি আর পরিচয়ের কথা। ভাবতে গিয়ে দেখি, তারা তো খুব একটা ভুল বলেন না। পরিচিতি আর পরিচয় যদি ক্ষমতা বা এমন একটা কিছুর মাপকাঠি হয়ে থাকে, তবে তো আমিও কম কেউ নই। এ বিষয়টিতো এতদিন ভেবে দেখা হয়ে উঠেনি। পরিচিতির কথা যদি বলি, দেশের অনেকেই চেনেন আমাকে নিজ নামে। অন্য কারো নামের সাথে লাগিয়ে পরিচয় দিতে হয়নি কখনো। বলতে হয়নি, অমুক পাঠিয়েছেন।

আর পরিচয়ের কথা যদি বলি, খুঁজে-পেতে দেশের প্রথিতযশা অনেকে রয়েছেন নিজ পরিবারেই। আর পরিচিতজনদের মধ্যেও রয়েছেন অনেক প্রথিতযশা মানুষ। যারা শুধু প্রথিতযশাও নন কেউকেটাও। এখন নাকি কেউকেটা না হলে কাটতে মানে দংশন করতে পারেন না। শিকড় ধরে খুঁজতে থাকলে যাওয়া যাবে আরো অনেকদূর। যদিও এভাবে কখনো কোনদিন যাবার চেষ্টা করিনি। নিজের পরিচয়টুকুই যথেষ্ট ছিল। এ নিয়েই সুখে ছিলাম, সুখি ছিলাম। বড় ছেলেটা যখন চাকুরিতে যোগ দিল এবং সবার প্রশংসা শুনছিলাম ওর ব্যাপারে, সুখের ব্যপ্তিটা আরো বেড়েছিল। তবে অকৃতজ্ঞ হইনি কখনো। পরম করুণাময়ের শুকরিয়া আদায় করছিলাম সবসময়, মনটাও ছিল সেজদায় নত। কিন্তু সেই সুখ হঠাৎ করেই পরিণত হলো ভয়াবহ অসুখে। যার কোন নিরাময় নেই।

ভাবি, আমার ছেলের ক্ষেত্রেই এই অবস্থা। অন্য যারা আছেন। যাদের বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ানোর ক্ষমতা বা সঙ্গতি নেই, তাদের অবস্থাটা কী! যাদের সন্তান নিখোঁজ হয়েছেন, তারা কি বেঁচে আছে, না আমার ছেলের মতন আঞ্জুমানে মফিদুলে’র হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। বেওয়ারিশ হিসাবে কবরে শুয়ে আছে সেই সন্তান, আর মা-বাবা হুশ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখান থেকে সেখানে। আমারও একই অবস্থা হতো। যদি আমার পরিচিতিটা না থাকতো। আমার ছেলেকে তো পরিচয়হীন করাই হয়েছিল, শুধু বেওয়ারিশ হিসাবে দাফনটা করতে পারেনি। কিন্তু অন্য যারা আছেন। যাদের পরিচিতি আমার চেয়ে কম, যাদের পরিচয়ের যোগসূত্রটা আমার মতন দূরবর্তী নয়, তাদের কী অবস্থা!

কদিন আগে আরেক বাবার সাথে কথা হলো। উনার ছেলের লাশও উদ্ধার করা হয়েছে রেললাইনের পাশ থেকে। বলা হয়েছে, ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছে। দায়ের করা হয়েছে একটি অপমৃত্যুর মামলা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কেন, কিভাবে ট্রেন থেকে পড়ে গেলো তার কোন উত্তর নেই। বেচারারা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু উপায় করে উঠতে পারেননি। অবশেষে বাধ্য হয়েই ক্ষান্ত দিয়েছেন। সেই বাবা দুঃখ করে বললেন, ‘উল্টো আমাকে ধমক খেতে হয়েছে’। দোষ দেয়া হয়েছে মৃত ছেলের, ‘ট্রেনের ছাদে উঠলো কেন’! এই তো আমাদের দেশ, আমাদের আইন প্রয়োগ আর রক্ষার অবস্থা!

এই দিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান। প্রথমত, আমার ছেলেটা বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন হয়নি। আমি দাঁড়িয়ে নিজ বুকের আর ওর মায়ের নাড়িছেড়া ধনকে কবরে শুইয়েছি। দ্বিতীয়ত, তদন্তকারী সংস্থা মোটামুটি এদিক-সেদিক যাচ্ছে। কাজ হোক না হোক, সঠিক জায়গায় হোক না হোক, তাওতো নড়ছে। অন্তত সেই বাবার মতন তো আমাকে ধমক খেতে হচ্ছে না। এই সৌভাগ্যও কতজনের হয়।
আমার সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো, আমি সঙ্গে কিছু মানুষ পেয়েছি। যারা আমাকে হাল না ছাড়ার ব্যাপারে যেমন বলে যাচ্ছেন, তেমনি নিজেরাও যে যার জায়গা থেকে যতটুকু করা সম্ভব করে যাচ্ছেন। এরমধ্যে রয়েছেন স্বজন, বন্ধু, ছোটভাই থেকে শুরু করে বেশ কজন শুভাকাংখী। তারা প্রতিনিয়িত সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন, অন্তত ন্যায়বিচার চাওয়া ও পাওয়ার জন্য।

তবে এমন কিছু মানুষও পেয়েছি যাদের অনুভূতির সবটাই আনন্দময়। তাদের স্পর্শ করে না কোন জরা-ব্যাধি-মৃত্যু। তারা সবকিছুর উর্ধ্বে। তাদের পদ-পদবী বিশাল। তাদের রয়েছে গাড়ি-বাড়ি, অতিরিক্ত নারী সবই। তারা মাঝে-মধ্যেই দেশের বাইরে প্রমোদ ভ্রমনে যান, সি-বিচ, হোটেল, সূর্যস্নানের ছবি সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট করে চেলা-চামুন্ডাদের নিজেদের সামর্থ্যের প্রমান দেন। আর আমাদের দেন দীর্ঘশ্বাস। অথচ এদের সিংহভাগকেই যদি নিজের উৎসে ফিরে যেতে বলা হয়, তবেই কিন্তু সর্বনাশ। মূলত এদের উৎসে ফেরার মতন কিছু নেই।

যাক গে, তাদের কি আছে কি নেই, ভবিষ্যতই তার জানান দেবে। যে ভবিষ্যত সম্ভবত খুব একটা দূরবর্তীও নয়। কারণ অন্ধকার গাঢ় হলেই, ভোরের আশা সন্নিকট হয়। মানুষতো আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। যার কিছু নেই, সেও উন্মুখ থাকে ভালো দিনের আশায়। যেমন আমি এবং আমরা আছি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.