| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শামীম ওসমানকে অনেকে অপছন্দ করেন। আমি তাকে পছন্দ করি, তার কিছু প্রবচনের জন্য। তিনি মাঝেমধ্যে হুমায়ুন আজাদ স্টাইলে প্রবচন বলেন। ‘আগে ধনীলোকেরা কুত্তা পুষতো এখন সাংবাদিক পোষে’, এমন প্রবচনটা তারই। এই প্রবচন যখন তার মুখ নিঃসৃত হয় তখন অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে তাকে। প্রয়াত নেতা সুরঞ্জন সেন গুপ্ত সংসদেও সে সময়ে শামিম ওসমানের সমালোচনা করেছিলেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি শামিম ওসমানের পক্ষে কেউ যদি বলেন, ‘সত্য কথা বললে কিছু বাকোয়াজ শুনতেই হয়। তা প্রভুভক্তদের গায়ে লেগে যায়।’ তাহলে হয়তো গণমাধ্যমের বাইরে তেমন আপত্তি করার লোকও পাওয়া যাবে না।
একটি খবরের উল্লেখ করি। সামাজিকমাধ্যমে অনেকের টাইম লাইনে ঘুরছে সে খবরের স্ক্রিনশট। সম্ভবত দিনাজপুরের একটি স্থানীয় পত্রিকার খবর সেটি। খবরের শিরোনামকে সংক্ষিপ্ত করলে দাঁড়ায়, ‘এমপির ব্যক্তিগত সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত’। খবরে বিস্তারিত রয়েছে সেই ‘ব্যক্তিগত সাংবাদিক’ এর করোনা আক্রান্ত হবার বিষয়টি। বলুন তো, শামিম ওসমান দোষের কথা কী বলেছিলেন!
আরেকটি স্ক্রিনশট দেখেও শামিম ওসমানের কথাটি সত্যি মনে হয়েছিলো। ‘বাটপার’ হিসাবে ধরা পড়া রিজেন্ট শাহেদের একটি বিজ্ঞাপন বিষয়ে। এই সুযোগে বলে নিই, ‘বাটপার’ শাহেদ কিন্তু ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদকও। সেই পত্রিকারই ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের স্ক্রিনশট। ‘দুই বাংলার করোনা পরিস্থিতি’ নিয়ে সেই লাইভে যারা আলোচনা করবেন তাদের ছবি দেয়া হয়েছে সেই বিজ্ঞাপনে। প্রথম ছবিটিই ‘বাটপার’ শাহেদের। ছবিতে আনন্দবাজারের সাবেক চিফ রিপোর্টারসহ, কাগজটির বাংলাদেশ প্রতিনিধিরও ছবি রয়েছে। রিজেন্টে গ্রুপের মালিক শাহেদ নিশ্চিত একজন ধনীলোক এবং একটি কাগজের সম্পাদকও। তারপক্ষে অবশ্যই সম্ভব এমন একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। তবে আলোচনাটি হয়েছিলো কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি কোনো মাধ্যমেই। আর না হয়ে থাকলে এই সাংবাদিকসহ অন্য প্রথিতযশাদের নাম ব্যবহার করা শাহেদের আরেকটি ‘বাটপারি’।
এই যে সাংবাদিকদের ‘ব্যক্তিগত’ হওয়ার ধারা, এটা শুরু হয়েছে প্রায় এক দশক ধরে। এই এক দশকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকের অবস্থান অন্তত তাই জানান দেয়। ২০২০ সালে প্রকাশিত প্যারিস ভিত্তিক সংস্থা রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার প্রকাশিত এই সূচকে দেখা গেছে ২০১৯ সালে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৫১তে। অথচ ২০১১ সালে এই অবস্থান ছিলো ১২৯-এ। মাত্র দুবছরেই ২০১৩ সালে ১৫ ধাপ নিচে নেমে দাঁড়ায় ১৪৪ ক্রমে। এই ক্রমাবনতিতে বর্তমানে ১৫১।
বলবেন, এর সাথে ব্যক্তিগত হবার সম্পর্ক কী! ব্যক্তিগত সম্পর্কটা কী কারণে, সেটা বুঝলে হয়তো এ প্রশ্নটা উঠতো না। সেই ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে একজন ‘বাটপার’ও টকশো ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠে। ব্যক্তিগত সম্পর্কই একটি জনপ্রিয় টক-শো’কে ‘ঠক-শো’ বানিয়ে দেয়। একটি ভালো অনুষ্ঠানের কার্যক্রমের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তেমনি ‘ব্যক্তিগত সাংবাদিক’ এর কারণে খবরের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর ‘ব্যক্তিগত সাংবাদিক’দের প্রমোট করার জন্যে কোনো কোনো গণমাধ্যমের কপালেও জোটে ‘ব্যক্তিগত’ তকমা। এরকম তকমা জোটা গণমাধ্যম পুরোটাই গ্রহণযোগ্যতা হারায়। মানুষ অবিশ্বাসের চোখে দেখে তাদের সকল কর্মকান্ড। চোখ বন্ধ করুন, ভাবুন। দেখবেন মনের আয়নায় পরিষ্কার ভেসে উঠেছে ‘ব্যক্তিগত’ শিরোনামের ছবি সমূহ।
সেদিন এক আড্ডায় কথা হচ্ছিল মেইনস্ট্রিম জার্নালিজম ও সিটিজেন জার্নালিজম বিষয়ে। পার্থক্য করতে গিয়ে সোজা কথায় বলেছিলাম। মেইনস্ট্রিম জার্নালিজম ফিল্টারওয়ালা টিউবওয়েল। যা ক্ষতিকর উপাদানগুলো ছেঁকে বিশুদ্ধ পানি দেয়। আর সিটিজেন জার্নালিজম হলো ফিল্টার ছাড়া। যে টিউবওয়েলের পানি পানের যোগ্য নয়। তবে এখানেও কথা রয়েছে। যখন এই ‘ফিল্টার’ সিলেক্টেড ফর্মে চলে যায় অর্থাৎ ফরমায়েশি হয়ে যায় তখনই ঝামেলটা লাগে। তখনই কর্মী ও মাধ্যম দুটোই ‘ব্যক্তিগত’ হয়ে উঠে। ব্যক্তির ইচ্ছায় ফিল্টার হয়, কোনটা যাবে কোনটা যাবে না। যার পরিণতি হলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো।
আমাদের দেশে সিটিজেন জার্নালিজমের প্রসারের কারণই হলো গণমাধ্যমের ‘ব্যক্তিগত’ হয়ে উঠার প্রবণতা। এই প্রসার সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। সিটিজেন জার্নালিজমের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো গুজব প্রচার। মেইনস্ট্রিম জার্নালিজম প্রশিক্ষিত বলেই তারপক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব হয় খবর আর গুজবের বিভাজনটা। তাই মেইনস্ট্রিমের চেষ্টা থাকে গুজবটাকে বাদ দিয়ে খবরটা পরিবেশন করার। বিপরীতে সিটিজেন জার্নালিজম প্রশিক্ষিত নয় বলেই তা খবর ও গুজবের পার্থক্যটা ধরতে পারে না। আর এই পার্থক্য ধরতে না পারাটাই সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গোশতের টুকরায় বা চাঁদে কারো ছবি, এসব সেই সিটিজেন জার্নালিজমের কুফল। এরজন্যে দায়ি কিন্তু মেইনস্ট্রিম জার্নালিজমের ক্রম ‘ব্যক্তিগত’ হয়ে উঠার প্রবণতা। মেইনস্ট্রিম বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে তবেই সাইডস্ট্রিমের উত্থান ঘটে।
গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো হলো নিজের পায়ে কুড়াল মারা নয় শুধু, কুড়ালের উপর ইচ্ছে করে নিজের পা রাখা। এই যে আজকে স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য যে সমালোচনা সইতে হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালকদের, গণমাধ্যম যদি তার কাজটা সঠিক ভাবে করতো তাহলে এমনটা হতো না। গণমাধ্যমের ধরিয়ে দেয়া ভুলগুলো রাষ্ট্রযন্ত্র সে সময়েই সংশোধন করে নিতে পারতো। অথচ তা হয়নি। যার ফলেই আজকের এই পরিস্থিতি। এমনিতেই দেশের শক্তিশারী কোনো বিরোধী দল নেই। শেষ জায়গা ছিলো গণমাধ্যম তাও প্রশ্নের মুখে। ক্রমেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর অভিযোগে অভিযুক্ত অনেক মাধ্যমই। আরেকটা কথা বলে রাখি, বিশ্বাসযোগ্যতার হারানোর কারণ শুধু ‘ব্যক্তিগত’ খবর পরিবেশনই নয়, খবর লুকানো মানে প্রকাশ না করাও এবং টুইস্ট করাও।
শেষ করার আগে আবার বলি। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ বা পোষার চেষ্টা হলো নিজের পায়ে কুড়াল মারা নয়, পয়সা দিয়ে কুড়াল কিনে এনে ঘটা করে তার উপর পা রাখা।
©somewhere in net ltd.