নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর সহকর্মী প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, বিজ্ঞানশিক্ষক, দার্শনিক ও কবি স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে উঁচু করে আত্মপরিচয়ে পরিচিত করতে যে ক'জন মহাপুরুষ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের অন্যতম স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী, শিক্ষক, শিল্পোদ্যোক্তা, সমবায়ী, সমাজসেবক ছিলেন। দেশী শিল্পায়ন উদ্যোক্তা প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন বেঙ্গল কেমিকালের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কিউরাস নাইট্রাইট-এর আবিষ্কারক। ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রিট আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারটি তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। বিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের জন্য ১৮৮৬ সালে তিনি সম্মান সূচক ডিগ্রী ১৮৮৭ সালে পি,এইচ,ডি, ১৯১১ সালে ডি,এস,সি ১৯৯২ সালে সি,আই,ই, এবং একই বছর দ্বিতীয় বার ডি,এস,সি উপাধি লাভ করেন। ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯৪৪ সালের আজকের দিনে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমাদের জাতীয় জীবনে উজ্জ্বল পুরুষ কবি স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আজ ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিবসে তাঁকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
১৮৬১ সালের ০২ আগস্ট খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ূলী গ্রামে এক বনেদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তার পিতার নাম হরিশচন্দ্র রায় এবং মা'র ভূবনমোহিনী দেবী। পিতা হরিশচন্দ্র রায় স্থানীয় একজন জমিদার ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই প্রফুল্লচন্দ্র অত্যন্ত তুখোড় এবং প্রত্যুৎপন্নমতি ছিলেন। তার পড়াশোনা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। ১৮৬৬ থেকে ১৮৭০ সাল এ চার বছর কাটে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রফুল্ল চন্দ্রের পিতা মাতা স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করলে ১৮৭১ সালে পিতার আগ্রহে তিনি হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশা রোগের কারণে তার পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে থাকার এই সময়টা তার জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছে।বাবার গ্রন্থাগারে প্রচুর বই পান তিনি এবং বইপাঠ তার জ্ঞানমানসের বিকাশসাধনে প্রভূত সহযোগিতা করে। তাঁরপর তিনি ১৮৭৪ এ আলবার্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৮৭৮ সালে এন্ট্রান্স পাস করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে পড়েন এবং ১৮৮১ সালে এফ,এ পাশ করেন তিনি। ১৮৮২ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি এবং অনার্স সহ স্নাতক শ্রেণীতে অসাধারণ মেধার বলে তিনি গিলক্রিইষ্ট বৃত্তি নিয়ে চলে যান এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকেই বি,এস,সি ডিগ্রী নেন। ১৮৮৭ সালে রসায়নশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণার জন্য এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হোপ পুরস্কার পান। ১৮৮৮ সালে দেশে ফেরেন।
দেশে ফেরার পর শুরু হয় রসায়নের অধ্যাপণা গবেষণা ও বিভিন্ন সামাজিক কাজ।পরের বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। শুরু হয় তাঁর শিক্ষক ও গবেষকজীবন। ঘি সরষের তেল ও বিভিন্ন ভেষজ উপাদান নিয়েই তিনি প্রথম গবেষণা শুরু করেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৮৮৯ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ১৯৩৭ সাল থেকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এত দীর্ঘ বর্ণাঢ্য শিক্ষকতার জীবন খুব কম মানুষের ভাগ্যে হয়েছে। তার বাচনভঙ্গী ছিল অসাধারণ যার দ্বারা তিনি ছাত্রদের মন জয় করে নিতেন খুব সহজেই। তিনি সকল ক্ষেত্রেই ছিলেন উদারপন্থী। বাংলা ভাষা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে ছিল। তিনি বুঝেছিলেন, বাংলায় বক্তৃতা ছাত্রদের অনুধাবনের পক্ষে সহায়ক। তাই ক্লাসে বাংলায় বক্তৃতা দিতেন এবং পড়ার সময় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের জীবনকাহিনী এবং তাদের সফলতার কথা তুলে ধরতেন।
নির্লোভ, পরোপকারী, শিক্ষাবিস্তারে নিবেদিতপ্রাণ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৮৯২ সালে মাত্র ৮০০ টাকা মূলধন নিয়ে বেঙ্গল ক্যামিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানিটির নাম কারণ করা হয় দি বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিটিক্যাল। ১৮৯৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর প্রথম গবেষণা পত্রের নাম ছিল ‘ অন দি কেমিক্যাল একজামিনেশন অফ সার্টেন ইন্ডিয়ান ফুড স্টাফস, পার্ট ওয়ান, ফ্যাটস অ্যাণ্ড অয়েলস।’ পরবর্তীকালে প্রফুল্লচন্দ্রের গবেষণার মূল বিষয় ছিল নাইট্রাইট যৌগ নিয়ে কাজ, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়। রসায়ন শাস্ত্রে গবেষণারত প্রফুল্ল চন্দ্র মারকুইরাস নাইট্রাইট এর মত রসায়ন শাস্ত্রে মৌলিক পদার্থ উদ্ভাবনে চমকে দেন বিশ্বকে। পি, সি, রায়ের কর্মকান্ডে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতবর্ষের মহীশুর, বেনারস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করেন।
দেশ বিদেশে তার অসংখ্য সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান আজও মানব সেবা দিচ্ছে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯০৮ সালে রাড়ুলীতে সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাগেরহাটের পি, সি কলেজ, খুলনা সিমেট্রি রোডে এ, পি, সি শিশু বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও অনুদান প্রদান করেন। ১৯৩৪ সালে নিজ জেলা শহর খুলনায় মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য আচার্য্যদেব খুলনার সোনাডাঙ্গায় প্রতিষ্ঠা করেন সমবায়ভিত্তিক প্রফুল্ল চন্দ্র কটন মিল লি.। দেশভাগের পর এ, পি, সি কটন মিলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় খুলনা টেঙ্টাইল মিল। ১৯৩৭ সালে মানিকতলায় স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। চিরকুমার এই বিজ্ঞানী তার জীবনে অর্জিত সমস্ত সম্পদ মানব কল্যানে দান করে গেছেন।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তিনি অসাম্প্রদায়িকই শুধু ছিলেননা বরং সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মূলোৎপাটনের জন্যও চেষ্টা করেছেন সবসময়। ১৯০৫ সালে ড. কুদরত-এ-খুদাকে প্রেসিডেন্সী কলেজে থেকে রসায়নে প্রথম বিভাগ দেয়া হয়। অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রফুল্লচন্দ্র নিজের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কুদরত-এ-খুদাকে প্রথম বিভাগ দেন। সারা জীবনে অনেক প্রচ্ছেদ রচনা করেছেন অনেক বই লিখেছেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাঁর লদ্ধে উল্লেখযোগ্য কতগুলি হলঃ ১। India Before and After the Sepoy Mutiny (সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে), ২। সরল প্রাণীবিজ্ঞান, বাঙ্গালী মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার, ৩। হিন্দু রসায়নী বিদ্যা এবং মোট ১৪৫টি গবেষণাপত্র।
ফাদার অব নাইট্রাইট খ্যাত বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার পি,সি, রায় ৭৫ বছর বয়সে পালিত অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেওয়ার পরও আট বছর বেঁচে ছিলেন। সেই সময়ও কেটেছে বিজ্ঞান কলেজের একটি ছোট কক্ষে, যেখানে ছিল একটি খাটিয়া, দুটি চেয়ার, খাবার ছোট একটি টেবিল, একটি পড়ার টেবিল ও একটি আলনা। যেসব ছেলে তাঁর কাছে থাকত, তাদেরই একজনের হাতে মাথা রেখে তিনি ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন মাত্র ৮৩ বছর বয়সে বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তার ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকী। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
২| ১৬ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:১১
মাইরালা বলেছেন: মহান এই ক্ষণজন্মাকে লাল সালাম।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:৩২
গোঁফওয়ালা বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক কিছু জানলাম। অনেক অনেক শ্রদ্ধাঞ্জলি এই কীর্তিমান মানুষটাকে।