নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খাদিজা আখতার রেজায়ী

খাদিজা আখতার রেজায়ী

খাদিজা আখতার রেজায়ী › বিস্তারিত পোস্টঃ

বইয়ের গল্প

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:২৯

কেউ যদি আমাকে কখনো আলোচনার আসরে নিমন্ত্রন করে আর সেখানে আলোচনার বিষয়বস্তু হয় বই, তাহলে সেখানে অংশগ্রহণ করতে বোধ হয় আমি সবচাইতে বেশী আনন্দিত হবো। কারন সেখানে আমি নিদ্বিধায় বলতে পারি আমি বই পড়তে ভালোবাসি। বই পড়ে আমি কখনো ক্লান্ত হইনা- বরং ক্লান্ত হয়ে যখন কোথায়ও বসি তখন বই আমার সমস্ত ক্লান্তি দুর করে দেয়। আর কোনো বই যখন পড়তে শুরু করি তখন বই শেষ না করা পর্যন্ত আমি অশান্তিবোধ করি। ঘরের অগোছালো বই পুস্তক গোছাতে শুরু করলে আমার সেই গোছানো কখনো শেষ হয়না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে বসে বই খুলে শুরু হয় পড়া আর আমার অগোছালো ঘর তখন আরো বেশী অগোছালো হয়ে যায়। আমি এর কোনো সুরাহা খুঁজে পাইনা, এই পড়ার অভ্যাসটাকে কি করে বদলানো যায় তাও বুঝিনা। এখনো আমাকে একথা শুনতে হয়- হায় ! এইতো পড়া শুরু হয়ে গেলো, এখন তো কোন কাজ হবেনা।

আমার এই বই পড়ার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই। আমার বয়স যখন নয় বা দশ তখন আব্বার সাথে মেজো আপার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছিলাম। মেজো আপা থাকতেন পাবনার পাকশী টাউনে। চাঁদপুর থেকে পাকশী অনেক দুর। যাবার সময় আম্মা আমার হাতে এক টাকার চাঁদি তুলে দিয়ে বললেন- বাবার সাথে যাচ্ছো, আমার কিছুই দেয়ার দরকার নেই, তবু এটা দিলাম, বুট বাদাম খেতে ইচ্ছে হলে খেয়ো, তবে বাবাকে না জানিয়ে কিছু কিনবেনা কিন্তু

আমি তো একটাকা পেয়ে ভীষণ খুশী। এক টাকায় তখন অনে-ক কিছু কেনা যেতো। এটা ঊনিশ শ ষাট বা একষট্রি সালের কথা। তখন ছ আনায় একসের চাল পাওয়া যেতো। এক আনার মুড়ি কিনে মানুষ পেট ভরে খেতে পারতো। যাই হোক আমার কাছে ওই এক টাকা অনেক বড়ো কিছু। কারন আম্মা কখনো কোনো কারনেই আমার হাতে টাকা পয়সা দিতেন না, বলতেন এতে নাকি বাচ্চাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে যায়। তবে এটা ঠিক আমার কখন কি লাগবে বা আমি কি কি পছন্দ করি এটা আমার মা ই বেশী জানতেন এবং চেয়ে নেবার আগেই তা আমার জন্যে কিনে দিতেন বা তৈরী করে রাখতেন।

যাই হোক ্ওই এক টাকার মালিক হয়ে আমার আব্বার সাথের সফর যেনো আরো বেশী আনন্দময় হয়ে উঠলো। আমরা ঢাকার পথে রওনা হয়ে গেলাম।

ঢাকায় গিয়ে ট্রেনে উঠবো। ট্রেন ষ্টেশনে গিয়ে দেখা গেলো ট্রেন আসতে ঘন্টা খানেক সময় বাকী। আব্বা আমাদের নিয়ে ওয়েটিং রুমে বসলেন। ওয়েটিং রুমের পাশের জানালাটা খোলা ছিলো। আমি দেখলাম একটা লোক বই বিক্রি করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম এক টাকার মধ্যে কোন বই পাওয়া যাবে? দোকানী বললো- হ্যাঁ এইটা নাও। বইটির নাম আমার মনে নেই, তবে লেখকের নাম আজো মনে আছে, রেয়াজ উদ্দিন আহমদ। আমি দোকানীকে জানালা দিয়ে যখন টাকা দিচ্ছিলাম তখন আব্বা খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে বললেন, কার সাথে কথা বলছো? আমি বইটা আব্বাকে দেখালাম, আব্বা বইটা নেড়ে চেড়ে দেখে বললেন ঠিক আছে। কিন্তু বাড়ী যখন ফিরলাম তখন দেখা গেলো বই কেনাটা আম্মার কাছে ঠিক মনে হয়নি, রাগ করে বললেন মাত্র একটা টাকা দিলাম তা দিয়ে ফালতু একটা বই কিনে ফেললে। আব্বা বললেন, তা একটা টাকা দিয়ে বেচারী আর কি কিনবে? তুমিতো ছোলা বাদাম খাবার জন্যে দিয়েছো, ওগুলো খেয়ে পেট খারাপ করার চেয়ে বই কিনে সে বুদ্ধিমতির কাজই করেছে। ছোট ভাইয়া সুযোগ বুঝে এসে ঘাড় কাত করে বললেন, মা যদি ওকে কুড়ি টাকা দিতেন ও কিন্তু কুড়ি টাকাই বই কিনে নষ্ট করতো। আব্বা বললেন, বই কিনলে টাকা কখনো নষ্ট হয়না। আমিতো খুশী হয়েছি ও বই কিনেছে দেখে।

আসলে আমার বইকে ভালোবাসার অভ্যাস আমার রক্তেই রয়েছে। আমার আব্বা ছিলেন বইর পোকা। আব্বার খাটের পাশেই বুক শেলপ ছিলো তাতে সাজানো ছিলো বিভিন্ন লেখকের বই, ইসলামী বই, হাদীসের বই। এছাড়া আব্বার খাটে সিথানের দু'পাশে বইর উপর বইর স্তুপ থাকতো। এগুলো কেউ সরাতে পারতোনা। আব্বা ভীষণ রাগ করতেন। আব্বা যখন বই পড়তেন তখন আশে পাশে কোনো জিনিস নষ্ট হলেও আব্বার তা খেয়াল থাকতোনা। এ নিয়ে আম্মা খুব মন খারাপ করতেন। আমার এখনো মনে পড়ে আমাদের পাশের বাড়ীতে এক মহিলা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। আম্মা যখন আব্বাকে খবরটা শোনালেন আব্বা বললেন, ‘হু’ কিন্তু বই থেকে মুখ তুললেন না। আমার ছোট চাচী আম্মাকে বললেন ভাইজান কি ও বাড়ী যাবেন? আম্মা বললেন আমার স্বামী ‘স্বামী‘ (শরৎ চন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের লেখা নভেল) পড়ছে, এটা পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথায় কার স্ত্রী মারা গেছে একথা তার কানেও যাবেনা।

এই বই পড়া নিয়ে আমি আম্মার অনেক বকা শুনেছি। বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি ভাত খেতে যেতাম না । আম্মা মাঝে মাঝে বলতেন ইচ্ছে হয় লাইব্রেরীটা বন্ধ করে দিতে। আব্বা হেসে বলতেন, তোমার তো দেখা যায় সব যুদ্ধই বইর বিরুদ্ধে। অথচ তুমি জানো বই পড়লে মানুষ অনেক কিছু শেখে, না জানা জিনিস জানে, জ্ঞান আহরণ করে, এ জন্যেই তো লাইব্রেরী দিয়েছি বাড়ীতে।

আমাদের গ্রামের সমাজ কল্যাণ সমিতির অফিস ছিলো আব্বার কাচারীতে আমাদের বাড়ীর সামনে। এই বিশাল কাচারীতেই আব্বা সমিতির লাইব্রেরী বসিয়েছিলেন, এ কারনে অহরহ বই পেতে আমার কোনো অসুবিধা ছিলোনা।

আম্মা চাইতেন আমি বই পড়া কমিয়ে দিয়ে বড় ভাবীর কাছে সেলাই শিখি, মেজো ভাবীর কাছে রান্না শিখি, মেয়ে মানুষ রান্না জানা, সেলাই জানা বেশী প্রয়োজন। বড় ভাবী নিজেও প্রচুর বই পড়তেন। নিয়মিত ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পড়তেন। বাড়ী আসার সময় বাাঁধাই করা ‘বেগমের’ বান্ডিল নিয়ে আসতেন। আম্মাকে বলতেন, আম্মা আপনি চিন্তা করবেন না সেলাই রান্না এগুলো সে চট করে শিখে ফেলবে। এখন একটু পড়–ক।

আম্মা হেসে বলতেন, এতো পড়াও তো ভাল নয়। এই রকম পড়ার অভ্যাস থেকে গেলে বিয়ের পর কি করবে। বই কিনে জামাইকে ফতুর করে দেবে। আব্বা হাসতেন- অতো চিন্তার কি আছে আমি না হয় ওকে লেখক জামাই দেখেই বিয়ে দেবো।

এভাবে বই পড়তে পড়তে একসময় দেখি আমি বড়ো হয়ে গেছি। আমার বিয়ে লেখকের সাথেই হয়েছে; কিন্তু আব্বা তার লেখক জামাতাকে দেখে যেতে পারেননি।

আজ আব্বা নেই। এখনো আমার স্মৃতিতে ভাসে আব্বা আমার হাতে এনে ‘মাহে নও’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ দিচ্ছেন, ‘বিষাদসিন্ধ’ু বই এনে দিচ্ছেন। আব্বা যখনই বাইরে থেকে ফিরতেন আমি দৌড়ে কাছে যেতাম- আমি জানতাম আমার জন্যে আব্বার হাতে কোনো বই, ম্যাগাজিন বা পত্রিকা থাকবে। আজাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ এসব পত্রিকায় ছোটদের জন্যে একটা পাতা থাকতো। আযাদে ‘মুকুলের মাহফিল’ ইত্তেফাকে ‘কঁচি কাঁচার আসর আসর’ পূর্বদেশে ‘চাঁদের হাট’ এগুলো খুব ভালো লাগতো।

আমাদের দেশে তখন পশ্চিম বাংলার লেখকদের বই বেশী পাওয়া যেতো। মুসলমান লেখকদের লেখা বঁইর প্রচার ছিলো খুবই কম। সম্ভবত সংখ্যাও কম ছিলো। আম্মাকে দেখতাম তিনি পড়ছেন, ‘গরীবের মেয়ে’ ‘আনোয়ারা’ এসব বই আমরা পড়তাম নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎ, নীহার রঞ্জন , ফাল্গুনী, আশাপূর্ণা, বিমল মিত্র বা প্রবোধ কুমার সান্যাল প্রমুখদের লেখা। যাযাবরের লেখা ক‘টি উপন্যাস তখন খুবই প্রিয় ছিলো আমার। আকবর হোসেন লিখেছিলেন কিছু বই। বাংলাদেশী অনেক লেখকদের লেখা বই তখন পাওয়া যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে। আমি যখনই যেটা পেতাম সেটা সাগ্রহে পড়তাম।

ইসলামী বইর মধ্যে তখন জনপ্রিয় ছিলো মকসুদুল মোমেনীন; কিন্তু আমার আব্বার সংগ্রহে ছিলো অনেক ইসলামী বই, যেগুলো আমি পড়তাম। আর যেটাই ভালো লাগতো আমার খাতায় নোট করে রাখতাম। আমি খাতাটার নাম দিয়েছিলাম ‘জরুরী বিষয়’। আব্বার বিশাল ইসলামী বইর ভান্ডারের আমি ছিলাম সবচেয়ে বড়ো পোকা। ওখান থেকে সংগ্রহ হাদীসগুলো দিয়ে আমার ‘জরুরী বিষয়’ নামের মোটা খাতাটি একসময় ভরে গেলো। আব্বা বললেন এটাকে বই হিসাবে বের করে দেবেন। আব্বার আকম্মিক মৃত্যতে সেটা আর হয়নি। আমি নিজেও করতে পারিনি, কারন একাত্তুরের রাজনৈতিক তুফানে উল্লেখিত জরুরী বিষয়সহ আমার তিনটি পান্ডুলিপি উড়িয়ে নিয়ে কোথায় ফেলেছে তা আর জানতে পারিনি- তবে আব্বার বই পোকাটি এখনো বই নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বই আসলেই বন্ধু, ভালো বন্ধু।



খাদিজা আখতার রেজায়ী

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.