নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সভ্যতা

আমি মানুষ

কে. এস. খাঁন

আমি একজন মানুষ

কে. এস. খাঁন › বিস্তারিত পোস্টঃ

খোলা চিঠি

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১০:২৬


মা জানো? আমি একা হয়ে গেছি। কেন যেন কিছুতেই আর মন বসে না। কাউকেই আর আপন ভাবতে পারি না। সবকিছু বিষাদে ভরে গেছে। কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারি না। বেঁচে আছি একমাত্র ছোট ভাইটাকে আগলে রেখে। ওকেই আমার ভবিষ্যতের একমাত্র অবলম্বন বলে মনে হয়। তাছাড়া আর উপায় কি বল?
যে রাতে তোমাকে বেবিট্যাক্সির মেঝেতে শুইয়ে ঐ শালটায় ঢেঁকে আনা হল,যেটা এখনও আমি মাঝে মাঝে গায়ে জড়াই; ঐ রাতের কথা মনে হলে এখনও আমার বুক ফেটে যায়।চোখের কোণ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে,মোছার কেউ থাকে না। তুমি থাকলে কি আমাকে এমন করে কাঁদতে দিতে মা? বল মা! তুমি আঁচল দিয়ে আমার চোখ মুছিয়ে দিতে না? আর তুমি থাকলে কাঁদবই বা কেন? আমার কি কোন অভাব ছিল যে কাঁদব? না মা! তখন আমার অভাব ছিল অসীম। তখন একটার পর একটা বায়না ধরে তোমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছি। না না অতিষ্ঠ হবে কেন! মা কি কখনও অতিষ্ঠ হয়? অভিমান করো না,মা! তোমার মেয়ে না হয় একটা কথা বলেই ফেলেছে। কিন্তু আমার অভাব এখন সসীম যেটা কেউ আর পুরণ করতে পারে না। কে পুরণ করবে বল? বাবা আর আগের মত হাসে না, আমাদের সাথে খেলে না। সারাক্ষণ মুখ গম্ভীর করে থাকে। কোন কথা বললে রেগে যায়। আর ঐ নতুন মা টা না! খোকা কে একটুও কাছে নেয় না। বাবাও কেমন যেন হয়ে গেছে।
লক্ষি মা আমার! ফিরে এসো। তোমাকে আর কখন ও জ্বালাতন করব না। এই যে কান ধরে ওয়াদা করছি;তুমি মারলেও আর কাদঁব না। মা কি কখনও সন্তান কে মারতে পারে না? পারে। তোমার আর কি দোষ? কথা না শুনলে কার না রাগ হয়? কিন্তু মা বলে কথা! তুমি কি আর শখ করে মেরে ছিলে সেদিন,যেদিন আমি খোকাকে কাদার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার আবারর দোষ কোথায়? খোকাই তো আগে আমার চুল টেনে ধরেছিল। তাই বলে কি মা শাসন করবে না?
আমি আর অমন করে কাঁদব না;যেদিন কেঁদেছিলাম,এক মুঠো দুধ-ভাতের জন্য। সেদিনের কথাও আমার মনে আছে। ক্ষুধা লাগলে কি কেউ না কেঁদে পারে? তুমিই বা কি করবে? ঘরে যে একমুঠো চালও ছিল না। শেষ চালটা যে আমিই নিজ হাতে ফকিরকে দিয়েছিলাম। তার পরও অবুঝের মত কেঁদেছিলাম। কিন্তু তুমি কি সেদিন দেখেছিলে? গাড়ি থেকে তোমার লাশ নামানোর পর আমি কাঁদি নি। সত্যি বলছি মা! আমি একটুও কাঁদিনি।
আমি তখন অতটা বুঝতাম না,মনে হয়েছিল তুমি ঘুমিয়ে আছ। কিন্তু আমি কি জানতাম,সে ঘুমই যে তোমার চিরদিনের মত ঘুম হবে। যখন তোমাকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে কাঠের দোলনায় নিয়ে গেল ওরা;তখন আমি বাবাকে বলেছিলাম: বাবা,মাকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বাবা কি বলেছিল জানো? তোমার মা চির সুখের দেশে যাচ্ছে। আমি তখন ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম। মা! আমাকে নিয়ে যাও।আমি তোমার সাথে যাব,আমি তোমার সাথে যাব………।
সকলের কান্নার শোরগোলে এতক্ষণ আমাকে কেউ খেয়াল করেনি। আমিও ঐ পরিস্থিতি দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। এতদিন তো দেখেছি ছোটরা শুধু কাঁদে। এখন দেখছি বড়রাও সুযোগ পেলে কম ছাড়ে না। আমার তখন খুব রাগ হয়েছিল,মনে হয়েছিল বড়দের মত সবাই কে শাষন করি। কিন্তু এ অভিনব অনুষ্ঠান দেখে তখন আমার মুখ থেকে একটা কথাও বের হয়নি।
কিছুদিন আগে ছোট কাকুর বিয়েতে এত মানুষ এসেছিল! কিন্তু তারা তো এমন করে কাঁদেনি। সকলে আমোদ ফুর্তিতে মেতে ছিল। আজ আবার এ কি অনুষ্ঠান? সকলে যেন কান্নার পাল্লায় নেমেছে। ওমা, নানি এত বুড়া মানুষ!তার পরও যেন সেই প্রথম হবে। আমার বিস্ময় তখন কাটল, যখন মাকে ওরা নিয়ে গেল। এবার অনেকেই আমার পাশে আসল। সান্তনা দেয়ার জন্য সে দিন এক এক জন এক এক রকম গল্প বুনেছিলো। তুমি না কি আকাশের দেশে যাচ্ছ। আমিও নাকি এক দিন যেতে পারব। তখন তোমার সাথে দেখা হবে। আমি অনেক রাত,অনেক প্রহর, অনেক দিন ঐ প্রতিক্ষায় থাকলাম। তবুও তুমি এলে না আমাকে নিতে। সত্যিই কি তুমি আসবে!কেমন করে আসবে বল!ঐ জগৎটা কি এতই দুরে!আসতে এত সময় লাগে!
আমি তখন অতটা বুঝতাম না। এখনও যে ভাল একটা বুঝি, তাও না। মাঝে মাঝে মনে আশা জাগে,তুমি আসবে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়,সবাই সেদিন আমার সাথে প্রতারণা করেছিল। যাই ভাবি না কেন,সেদিনকার মত অমূলক চিন্তা আর করি না।
আমি তো কোন সময় তোমাকে ভুলতে পারি না। কিন্তু খোকা যে তোমাকে চিনেই না। প্রথম দিকে মা,মা বলে কাঁদত। এখন মাঝে মাঝে বলে। তবে তোমার জন্য আর কাঁদে না। এখন কাঁদে ক্ষুধা লাগলে। কি করে চিনবে বল? ওতো তোমাকে দেখেইনি। না-না, এমন মিথ্যা কথা বলতে পারব না, দেখেছে বৈকি। তুমিই তো ওকে কয়েক মাস ধরে বড় করেছ। ওর মুখে তখন একটাই বোল ছিল ,মা মা।
জানো মা!খোকা এখন সব কথা বলতে পারে,হাঁটতে পারে। এইতো সেদিন বিকেল বেলা পেছন থেকে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে পিঠে একটা শক্ত কামড় দিয়ে ভোঁ দৌড়। কেমন করে বাধা দেব? আমার হাত ওর হাতের মধ্যে আটকান ছিল। ও যে কামড় দিয়ে বড় আনন্দ পেয়েছিল। পরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছি। দুষ্টু হাসি দিয়ে কামুল মারিতি বলতে বলতে দৌড় দিয়েছিল। ওর কামড়ের যন্ত্রণায় আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আমি জোরে কাঁদিনি, পেয়ারা গাছতলায় পিঠে হাত দিয়ে বসে পড়েছিলাম,ঠোট কামড়ে ধরে। পরক্ষণেই পেছন থেকে অপরাধীর মত এসে আমার পিঠ নেড়ে দিয়েছিল। আদর করে কোলের মধ্যে নিলে ওর জামার কোনা দিয়ে আমার চোখ মুছে দিয়েছিল। জানো মা! ওকে আর মারি না। না, কোন সময়ই না। এইযে বললাম,সেদিনও যেমনি আদর করেছি। মা মরা ভাইটা আমার।এখন ওর শত অত্যাচার মাফ।
আজ তোমাকে বেশি মনে পড়ছে। তোমার কাছে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। আজ আমার পরীক্ষার ফল দিয়েছে। আমি প্রথম হয়েছি। এবার আমি আমাদের স্কুলের সবচেয়ে বড় ক্লাসে উঠেছি। সবাই বলে আজ না কি আমার সবচেয়ে খুশির দিন। কিন্তু আমি তো মোটেও খুশি না। বল মা!তুমি না থাকলে কি খুশি হওয়া যায়? স্যাররা বলেছেন আমি নাকি এবার ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পেতে পারি। আমাদের হেডস্যার একদিন বলেছিলেন তাঁর অনেক ছাত্র-ছাত্রী ডাক্তার হয়েছে,আমি না কি তাদের চেয়েও ভাল ডাক্তার হতে পারব। বল মা! আমি কি পারব? আর পারলেই বা কি লাভ? তোমাকে কি আর চিকিৎসা করতে পারব? না। তাতে কি হয়েছে?আরো কত মা অছে যাদের সন্তানেরা আজ মা হারা হওয়ার দশা। তাদের আমি সেবা করব। বল মা ! তুমি খুশি হবে না? আমি কি পারব তোমাকে খুশি করতে? তুমি একবার বল;শুধু একবার বল পারব! তুমি বললেই পারব। বিশ্বাস হয় না! বলেই দেখ না!
আমি এমনিভাবে যুদ্ধ করেই যাব। তুমি তো জানো বাবা দুই বেলা খাবার জোটাতেই হিমশিম খায়। কি করে পড়াশোনা করাবে? আমি মোড়লদের বাড়ি রোজ সকালের কাজ করে দিই। স্কুল থেকে এসে মানিক চাচার খোলায় ধান নাড়ি। মাঝে মাঝে কারো ধান ভেঙে দেই ঐ পাড়ার চাচিদের সাথে। এতেই আমাদের দুই ভাই-বোনের চলে যায়।
একবার বাবা বারি চাচার সাথে শহরে পাঠাতে চেয়েছিলেন। বাসা-বাড়িতে কাজ করে দুই পয়সা রোজগার হবে বলে। আমার কান্নায় বারি চাচা হাল ছাড়েন। কিন্তু বাবা এখনও এক পায়ে খাড়া। শেষ পর্যন্ত কি আমি যুদ্ধে জয়ী হতে পারব? এ জগৎ সংসারে আমার স্বপ্ন কি পুরণ হবে? আমি কি জাতির মায়েদের সেবা করতে পারব? মা! তুমিই জান এসকল প্রশ্নের জবাব। একবার তুমি এসে দেখে যাও,শুধু একবার! তাহলে আমি আর চোখের জল ফেলব না। তোমার জগৎ কি এতই দূরে? আসতে এতই দেরি লাগে? ঐ…যে কয়েক বছর আগে তুমি চলে গেলে। সকলে বলল তুমি আমাকে নিতে আসবে। মাঝে মাঝে সেই আশাটা জাগে। সেই প্রত্যাশায় এই খোলা চিঠি বেলুনটাতে বেঁধে আকাশের দেশে পাঠালাম;যেটা আমি ঈদের মাঠ থেকে কিনেছিলাম। মা!তুমি যদি পথেই চিঠিটা পাও তবে সাথে করে নিয়ে এস। মা,তুমি ফিরে এসো!!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.