নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন খুলে হাসলে- পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকেই অসম্ভব সুন্দর দেখায়

লোকালয়ের আড়ালে

মন খুলে হাসলে- পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকেই অসম্ভব সুন্দর দেখায়

লোকালয়ের আড়ালে › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার প্রিয় কবিতা সমগ্র - দুই (ব্লগে আমার প্রথম বর্ষ্পুর্তি পোষ্ট)

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:২২

লিখা আমার ধাঁতে নেই তাই লিখার অভ্যাসও নেই। পড়তেই বেশী ভালোবাসি। আজকে আমার ব্লগে ১ বছর ৫ দিন। আপনাদের জন্য আমার প্রিয় ১০টি কবিতা শেয়ার করলাম এবং প্রতিটির আবৃত্তিসহ।



চিঠি

বুদ্ধদেব গুহ

-------------------------------------------------

কুরচি,

তোমার চিঠি হঠাৎ এই শীতের সকালে এক রাশ উষ্ণতা বয়ে আনলো। পাতা ঝরে যাচ্ছে সামনের শালবনে। বিবাগী হচ্ছে ভোগী। রিক্ততার দিন আসছে সামনে। এরই মধ্যে তোমার চিঠি যৌবনের দুতীর মতো; এলো এক ঝাঁক টিয়ার উল্লাসী সমবেত সবুজ চিৎকারের মতো। তার মানে এই নয় যে- তোমার চিঠি দুর্বোধ্য। উপমার খোদ ক্ষমা করে দিও। কেমন আছ তুমি? জানতে চাইলেও জানতে পাই কই?



সকাল থেকেই তোমাকে আজ খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছিল। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুম ভাঙ্গলো বড় এক চমকে। এক জোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। যে পাখিদের ডাক বড় একটা শুনিনি এদিকে। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি- এক জোড়া স্কারলেট মিনি-ভেট এসে বসেছে আম গাছের মাথায়। আমার ঘুম ভাঙ্গা নিয়ে পাখিরা- আহা রোজই যদি আসতো। আর তারপরই তোমার এই চিঠি। দিন আজকে ভালো যাবে আমার।



বলছিলাম যে, সকাল থেকেই তোমাকে সুন্দর একটি চিঠি লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু সুন্দর সুখের যা কিছু ইচ্ছা তা দমন করার মধ্যেও বোধহয় এক ধরনের গভীরতর সুখ নিহীত থাকে। থাকে না? আজ চিঠি লিখবোনা তোমাকে। তার বদলে একটি স্বপ্নহার পাঠাচ্ছি, লেখক কবি না তবুও তার নাম গোপন থাক। কি যে দেখেছিলাম তোমার ঐ মুখটিতে কুরচি। এত যুগ ধরে কত মুখইতো দেখলো এই পোড়া চোখ দু'টি। কিন্তু, কিন্তু এমন করে আর কোনো মুখ'এইতো আমার সর্বস্বকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেনি। ভালো না বাসলেই ভালো...... বড় কস্ট ভালোবাসায়।



ভালোবাসাতো কাউকে পরিকল্পনা করে বাসা যায় না। ভালোবাসা হয়ে যায়, ঘটে যায়। এই ঘটনার ঘটার অনেক আগের থেকেই মনের মধ্যে প্রেম পোকা কুড়তে থাকে। তারপর হঠাত'ই এক সকালে এই দুঃখ সুখের ব্যাধি দূরারোগ্য ক্যান্সারের মতই ধরা পড়ে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। অমোঘ পরিণতির জন্যে অশেষ যন্ত্রনার সংগে শুধু নীরব অপেক্ষা তখন। কেউ যেনো কাউকে ভালো না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে দেয়। তার সব কিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পরে।



স্বপ্নহার, তোমায় পাঠাই



নীল নদীটির নিবিড় পাড়ে,

ঘুম পাওয়া রোদ চমকে চেয়ে অলস পায়ে,

যখন হাটে মাঘী মাঠের ন্যবা ধরা শুন্যতাতে

ঠিক তখনই আমার বুকের গভীর থেকে

স্বপ্নগুলো ঝাপটে ডানা

অস্ফুটে কি কইতে কইতে নড়েচড়ে!





স্বপ্নগুলো খুব ভীতু হয়,

আমার স্বপ্ন; সবার স্বপ্ন।

তবুও আমি স্বপ্ন দেখি

রুপের রাজা, গুনের গুনীন,

মুঠির মাঝে মুক্ত মলিন,

সব পাখিদের মুগ্ধ করা মন্ত্র নিয়ে

আসবো ফিরে বারে বারে।

আমার কিছু স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন নিয়ে মালা গাঁথি

স্বপ্ন মালা।

ছিপছিপে সেই মেয়ে, ছিপছিপে সে।





কুরচি দেখি কি করতে পারি? তোমার সাথে বেড়াতে যাবার। ইচ্ছে তো কত কিছুই করে। এই জীবনে ক'টি ইচ্ছে পুণ্য হলো বলো? কারই'বা হয়? এমনিতে আমার অনেক কষ্ট। এমন করে ডাক পাঠিয়ে আর কষ্ট বারিওনা। একা একা মজা করতেও বিবেকে লাগে। যার বিবেক বেচে থাকে, তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক বিবশ হলেই বাঁচি।





ভালো থেকো

তোমার প্রিথু দা





প্রিয় রুদ্র

তসলিমা নাসরিন

-------------------------------------------------

প্রিয় রুদ্র,

প্রযত্নে, আকাশ

তুমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলে। তুমি কি এখন আকাশ জুরে থাকো? তুমি আকাশে উড়ে বেড়াও? তুলোর মতো, পাখির মতো? তুমি এই জগত্সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছো। তুমি আসলে বেঁচেই গেছো রুদ্র। আচ্ছা, তোমার কি পাখি হয়ে উড়ে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না? তোমার সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে? ইচ্ছে তোমার হয় না এ আমি বিশ্বাস করি না, ইচ্ছে ঠিকই হয়, পারো না। অথচ এক সময় যা ইচ্ছে হতো তোমার তাই করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে – করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারাদিন পথে পথে হাটতে – হাটতে। কে তোমাকে বাধা দিতো? জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিলো। এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছো। আমার ভেবে অবাক লাগে, জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই। ওরা তোমাকে ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি রেখে এলো, তুমি প্রতিবাদ করতে পারোনি।



আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘ বছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলী খালার সাথে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন ! তুমি আর কারো সঙ্গে প্রেম করছো, এ আমার সইতো না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম ! তাই কি? যেন আমাকেই তোমার ভালোবাসতে হবে। যেন আমরা দু’জন জন্মেছি দু’জনের জন্য। যেদিন ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেলো বাড়ি থেকে, আমার খুব দম বন্ধ লাগছিলো। ঢাকা শহরটিকে এতো ফাঁকা আর কখনো লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার এতো হাহাকারও আর কখনো জমেনি। আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। আমার ঘরে তোমার বাক্সভর্তি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ ছিলো চার বছরের। এতো বছর পরও তুমি কী গভীর করে বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে ! সেদিন আমি টের পেয়েছি।



আমার বড়ো হাসি পায় দেখে, এখন তোমার শ’য়ে শ’য়ে বন্ধু বেরোচ্ছে। তারা তখন কোথায় ছিলো? যখন পয়সার অভাবে তুমি একটি সিঙ্গারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছো। আমি না হয় তোমার বন্ধু নই, তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম বলে। এই যে এখন তোমার নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক আমিই বোধ হয় অনুপস্থিত থাকি মেলায়। যারা এখন রুদ্র রুদ্র বলে মাতম করে বুঝিনা তারা তখন কোথায় ছিলো?



শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিলো। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে … তুমি বোঝোনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এই ভেবে যে, তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছো ! তার গল্প শোনাচ্ছো ! ঠিক এইরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিলো তোমার ! আজ আরেকজনের জন্য তোমার অস্থিরতা। নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বলো? তুমি শিমুলকে নিয়ে কি কি কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে ! আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে, কেমন হয়েছে। আমি বললাম, খুব ভালো। শিমুল মেয়েটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি, তুমি তাকে ভালোবাসো, যখন নিজেই বললে, তখন আমার কষ্টটাকে বুঝতে দেইনি। তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি ঠিকই কিন্তু আর কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয়।



আকাশের সঙ্গে কতো কথা হয় রোজ ! কষ্টের কথা, সুখের কথা। একদিন আকাশভরা জোত্স্নায় গা ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের। তুমি দু চারটি কষ্টের কথা বলে নিজের লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে। “ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও”। মংলায় বসে গানটি লিখেছিলে। মনে মনে কার চিঠি চেয়েছিলে তুমি ? আমার? নেলী খালার? শিমুলের? অনেক দিন ইচ্ছে তোমাকে একটা চিঠি লিখি। একটা সময় ছিলো তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। তুমিও লিখতে প্রতিদিন। সেবার আরমানিটোলার বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা। তুমি পাবে তো এই চিঠি? জীবন এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের কখনো মেটে না, তবু মানুষ আর বাঁচে ক’দিন বলো? দিন তো ফুরোয়। আমার কি দিন ফুরোচ্ছে না? তুমি ভালো থেকো। আমি ভালো নেই।



ইতি,

সকাল




এখন আমার

আবুল হাসান

-------------------------------------------------

আমার এখন নিজের কাছে নিজের ছায়া খারাপ লাগে

…রাত্রিবেলা ট্রেনের বাঁশি শুনতে আমার খারাপ লাগে

জামার বোতাম আটকাতে কি লাগে, কষ্ট লাগে

তুমি আমার জামার বোতাম অমন কেনো যত্ন করে

লাগিয়ে দিতে?

অমন কেন শরীর থেকে অস্তে আমার

ক্লান্তিগুলি উঠিয়ে নিতে?

তোমার বুকের নিশীথ কুসুম আমার মুখে ছড়িয়ে দিতে?

জুতোর ফিতে প্রজাপতির মতোন তুমি উড়িয়ে দিতে?

বেলজিয়ামের আয়নাখানি কেন তুমি ঘরে না রেখে

অমন কারুকাজের সাথে তোমার দুটি চোখের মধ্যে

রেখে দিতে?

আমার এখন চাঁদ দেখলে খারাপ লাগে

পাখির জুলুম, মেঘের জুলুম, খারাপ লাগে

কথাবর্তায় দয়ালু আর পোশাকে বেশ ভদ্র মানুষ

খারাপ লাগে,

এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা. . .

খারাপ লাগে

খারাপ লাগে

মোটের উপর, আমি অনেক কষ্টে আছি.. কষ্টে আছি বুজলে যুথী

আমার দাঁতে, আমার নাকে, আমার চোখে কষ্ট ভীসন

চতুর দিকে দাবি আদায় করার মত মিছিল তাদের কষ্ট ভীষণ বুজলে যুথী

হাসি খুসি উড়নচন্ডি মানুষ এখন তাইতো এখন খারাপ লাগে, খারাপ লাগে

আরে তাছাড়া, আমি কি আরে যিশু নাকি- হাবিজাবী ওদের মতন সবসহিষ্ণু

আমি অনেক কষ্টে আছি

কষ্টে আছি, কষ্টে আছি

আমি অনেক কষ্টে আছি

কষ্টে আছি, কষ্টে আছি |




প্রতীক্ষা

রফিক আজাদ

-------------------------------------------------

এমন অনেক দিন গেছে

আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,

হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে

নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-

কোনো বন্ধুর জন্যে

কিংবা অন্য অনেকের জন্যে

হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো...

এমন অনেক দিনই তো গেছে

কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি-

হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রো

একসঙ্গে বেরুবো।”

এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি

কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো

উচ্চারণ করেছিলো, “বাড়ি থেকো

ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।”

হয়তো বা ওর মনের মধ্যে ছিলো

চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো;

-আমি অপেক্ষায় থেকেছি।

যুদ্ধের অনেক আগে

একবার আমার প্রিয়বন্ধু অলোক মিত্র

ঠাট্টা ক’রে বলেছিলো,

“জীবনে তো কিছুই দেখলি না

ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া।

চল, তোকে দিনাজপুরে নিয়ে যাবো

কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,

বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ

দেখবি,

পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি,

গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান

পেয়ে যেতেও পারিস,

তৈরী থাকিস- আমি আসবো”

-আমি অপেক্ষায় থেকেছি;

আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি- শত্রুর

জন্যেও

অপেক্ষায় থেকেছি,

বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে

অপেক্ষায় থেকেছি-

কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায়

থাকবো না,

-প্রতীক্ষা করবো।

‘প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই

জন্যে খুব যত্নে

বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,

অভিধানে শব্দ-দু’টির তেমন কোনো

আলাদা মানে নেই-

কিন্তু আমরা দু’জন জানি

ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,

‘অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ—

আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন,

অনেকের প্রয়োজন মেটায়।

‘প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,

ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের

অযোগ্য,

আমরা কি একে অপরের

জন্যে প্রতীক্ষা করবো না ?

আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের

মতো দাঁড়িয়ে থাকবো-

ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের

জন্যে প্রতীক্ষমান,

আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো

আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,

দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে

আমার পায়ে শিকড় গজাবে...

আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না.





আমাকে ভালোবাসার পর

হুমায়ুন আজাদ

-------------------------------------------------

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,

যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই

উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।



যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে

এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।

পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত

ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে

নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।



আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।

রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়

ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি

এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার

যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।



আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,

বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,

ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,

লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।



না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে

থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়

ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।



তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,

আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে

সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।



আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।

নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী

শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে

মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।



শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে

ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর

জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে

তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-

পবিত্র অজর।






পাঁচালী : দম্পতিকথা

জয় গোস্বামী

-------------------------------------------------

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন

এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা

পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।



অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে

তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন

পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।



মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান

লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন

পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে

মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন

পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।



এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি

রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম

লটারি, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব

লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।



দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিত্‍কার করবে সেল

দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন

পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।



কবিত্ব ফুড়ুত্‍ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে

বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প উপন্যাসোপম

পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।



নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে

ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজা বেদি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।



দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে

একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব

আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।



সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা

হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।



এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে

এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।






মেঘবালিকার জন্য রূপকথা

জয় গোস্বামী

-------------------------------------------------

আমি যখন ছোট ছিলাম

খেলতে যেতাম মেঘের দলে

একদিন এক মেঘবালিকা

প্রশ্ন করলো কৌতুহলে



“এই ছেলেটা,

. নাম কি রে তোর?”

আমি বললাম,

. “ফুসমন্তর !”



মেঘবালিকা রেগেই আগুন,

“মিথ্যে কথা । নাম কি অমন

হয় কখনো ?”

. আমি বললাম,

“নিশ্চয়ই হয় । আগে আমার

গল্প শোনো ।”



সে বলল, “শুনবো না যা-

সেই তো রাণী, সেই তো রাজা

সেই তো একই ঢাল তলোয়ার

সেই তো একই রাজার কুমার

পক্ষিরাজে

শুনবো না আর ।

. ওসব বাজে ।”



আমি বললাম, “তোমার জন্য

নতুন ক’রে লিখব তবে ।”



সে বলল, “সত্যি লিখবি ?

বেশ তাহলে

মস্ত করে লিখতে হবে।

মনে থাকবে ?

লিখেই কিন্তু আমায় দিবি ।”

আমি বললাম, “তোমার জন্য

লিখতে পারি এক পৃথিবী ।”



লিখতে লিখতে লেখা যখন

সবে মাত্র দু-চার পাতা

হঠাৎ তখন ভুত চাপল

আমার মাথায়-



খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম

ছোটবেলার মেঘের মাঠে

গিয়েই দেখি, চেনা মুখ তো

একটিও নেই এ-তল্লাটে



একজনকে মনে হল

ওরই মধ্যে অন্যরকম

এগিয়ে গিয়ে বলি তাকেই !

“তুমি কি সেই ? মেঘবালিকা

তুমি কি সেই ?”



সে বলেছে, “মনে তো নেই

আমার ওসব মনে তো নেই ।”

আমি বললাম, “তুমি আমায়

লেখার কথা বলেছিলে-”

সে বলল, “সঙ্গে আছে ?

ভাসিয়ে দাও গাঁয়ের ঝিলে !

আর হ্যাঁ, শোন-এখন আমি

মেঘ নই আর, সবাই এখন

বৃষ্টি বলে ডাকে আমায় ।”

বলেই হঠাৎ এক পশলায়-

চুল থেকে নখ- আমায় পুরো

ভিজিয়ে দিয়ে-

. অন্য অন্য

বৃষ্টি বাদল সঙ্গে নিয়ে

মিলিয়ে গেল খরস্রোতায়

মিলিয়ে গেল দূরে কোথায়

দূরে দূরে…।



“বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়

বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়-”

আপন মনে বলতে বলতে

আমিই কেবল বসে রইলাম

ভিজে একশা কাপড়জামায়

গাছের তলায়

. বসে রইলাম

বৃষ্টি নাকি মেঘের জন্য



এমন সময়

অন্য একটি বৃষ্টি আমায়

চিনতে পেরে বলল, “তাতে

মন খারাপের কি হয়েছে !

যাও ফিরে যাও-লেখ আবার ।

এখন পুরো বর্ষা চলছে

তাই আমরা সবাই এখন

নানান দেশে ভীষণ ব্যস্ত

তুমিও যাও, মন দাও গে

তোমার কাজে-

বর্ষা থেকে ফিরে আমরা

নিজেই যাব তোমার কাছে ।”



এক পৃথিবী লিখবো আমি

এক পৃথিবী লিখবো বলে

ঘর ছেড়ে সেই বেড়িয়ে গেলাম

ঘর ছেড়ে সেই ঘর বাঁধলাম

গহন বনে

সঙ্গী শুধু কাগজ কলম



একাই থাকব । একাই দুটো

ফুটিয়ে খাব—

. দু এক মুঠো

ধুলো বালি-যখন যারা

আসবে মনে

. তাদের লিখব

লিখেই যাব !



এক পৃথিবীর একশোরকম

স্বপ্ন দেখার

সাধ্য থাকবে যে-রূপকথার—

সে রূপকথা আমার একার ।



ঘাড় গুঁজে দিন

. লিখতে লিখতে

ঘাড় গুঁজে রাত

. লিখতে লিখতে

মুছেছে দিন—মুছেছে রাত

যখন আমার লেখবার হাত

অসাড় হল,

. মনে পড়ল

সাল কি তারিখ, বছর কি মাস

সেসব হিসেব

. আর ধরিনি

লেখার দিকে তাকিয়ে দেখি

এক পৃথিবী লিখব বলে

একটা খাতাও

. শেষ করিনি ।



সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে

বৃষ্টি এল খাতার উপর

আজীবনের লেখার উপর

বৃষ্টি এল এই অরণ্যে

বাইরে তখন গাছের নিচে

নাচছে ময়ূর আনন্দিত

এ-গাছ ও-গাছ উড়ছে পাখি

বলছে পাখি, “এই অরণ্যে

কবির জন্যে আমরা থাকি ।”

বলছে ওরা, “কবির জন্য

আমরা কোথাও আমরা কোথাও

আমরা কোথাও হার মানিনি—”



কবি তখন কুটির থেকে

তাকিয়ে আছে অনেক দূরে

বনের পরে, মাঠের পরে

নদীর পরে

সেই যেখানে সারাজীবন

বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে,

সেই যেখানে কেউ যায়নি

কেউ যায় না কোনদিনই—

আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে

সেই দেশে সেই ঝরনাতলায়

এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়

সোনায় মোড়া মেঘহরিণী—

কিশোর বেলার সেই হরিণী ।






কুড়ি বছর পরে

জীবনানন্দ দাশ

-------------------------------------------------

আবার কুড়ি বছর পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!

আবার কুড়ি বছর পরে—

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

কার্তিকের মাসে—

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে—তখন হলুদ নদী

নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়—মাঠের ভিতরে।



অথবা নাইকো ধান খেতে আর;

ব্যস্ততা নাইকো আর,

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

পাখির নীড়ের থেকে খড়

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল।

জীবন গিয়েছে চ'লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!



হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে

সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের,

ঝাউয়ের—আমের;

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!



জীবন গিয়েছে চ'লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আবার!



তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে—

বাবলার গলির অন্ধকারে

অশথের জানালার ফাঁকে

কোথায় লুকায় আপনাকে!

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে—



সোনালি-সোনালি চিল—শিশির শিকার ক'রে নিয়ে গেছে তারে—

কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে






দুঃসময়

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-------------------------------------------------

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,

সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,

যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,

যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,

মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,

দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—

তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

এ নহে মুখর বনমর্মরগুঞ্জিত,

এ যে অজাগর-গরজে সাগর ফুলিছে;

এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত,

ফেনহিল্লোল কলকল্লোলে দুলিছে।

কোথা রে সে তীর ফুলপল্লবপুঞ্জিত,

কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা—

তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

এখনো সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী,

ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত-অচলে;

বিশ্বজগত্ নিশ্বাসবায়ু সম্বরি

স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে বিরলে;

সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি

দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা—

ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

ঊর্ধ্ব আকাশে তারাগুলি মেলি অঙ্গুলি

ইঙ্গিত করি তোমা-পানে আছে চাহিয়া;

নিম্নে গভীর অধীর মরণ উচ্ছলি

শত তরঙ্গে তোমা-পানে উঠে ধাইয়া;

বহুদূর তীরে কারা ডাকে বাঁধি অঞ্জলি

`এসো এসো’ সুরে করুণ-মিনতি-মাখা—

ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহমোহবন্ধন;

ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা।

ওরে ভাষা নাই, নাই বৃথা ব’সে ক্রন্দন;

ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজ-রচনা।

আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ-অঙ্গন

উষা-দিশাহারা নিবিড়-তিমির-আঁকা—

ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।






এ কেমন ভ্রান্তি আমার

– রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

-------------------------------------------------

এ কেমন ভ্রান্তি আমার !

এলে মনে হয় দূরে স’রে আছো, বহুদূরে,

দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে আকাশ।

এলে মনে হয় অন্যরকম জল হাওয়া, প্রকৃতি,

অন্য ভূগোল, বিষুবরেখারা সব অন্য অর্থবহ-

তুমি এলে মনে হয় আকাশে জলের ঘ্রান।



হাত রাখলেই মনে হয় স্পর্শহীন করতল রেখেছো চুলে,

স্নেহ- পলাতক দারুন রুক্ষ আঙুল।

তাকালেই মনে হয় বিপরীত চোখে চেয়ে আছো,

সমর্পন ফিরে যাচ্ছে নগ্ন পায়ে একাকী বিষাদ- ক্লান্ত

করুণ ছায়ার মতো ছায়া থেকে প্রতিচ্ছায়ে।

এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি..



কুশল শুধালে মনে হয় তুমি আসোনি

পাশে বসলেও মনে হয় তুমি আসোনি।

করাঘাত শুনে মনে হয় তুমি এসেছো,

দুয়ার খুল্লেই মনে হয় তুমি আসোনি।

আসবে বললে মনে হয় অগ্রিম বিপদবার্তা,

আবহাওয়া সংকেত, আট, নয়, নিম্নচাপ, উত্তর, পশ্চিম-

এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি।



চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,

চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভূবনে আছো।

মন্তব্য ২১ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (২১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:৩২

নাজমুল হাসান মজুমদার বলেছেন: +++++++

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৪২

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: প্লাসের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

২| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:৩৭

ইমতিয়াজ ১৩ বলেছেন: ২য় বছরে পদার্পনে বিশাল পোষ্টে প্রথম ভাল লাগা

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২২

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: ভালো লাগাতে আমার পোষ্ট সার্থক।

৩| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:৫৪

যোগী বলেছেন: দারুন সব কবিতারা
প্রিয়তে না নিয়ে পারলাম না আর।

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৩

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ।

৪| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:২১

শায়মা বলেছেন: এই চিঠিকাব্যগুলো আমারও খুব প্রিয়!!!!!!

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:২১

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: চিঠি কাব্যগুলো ভীষণ আবেগী। আমার কাছে সবসময় চিঠির আবেদনটাই সবসময় বেশী মনে হয়েছে। একটা সময় ছিলো চিঠিই ছিলো যেকোন ভাবের প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। ধন্যবাদ শায়মা।

৫| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:০৪

দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: +++
প্রিয়তে।

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:২৭

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: ধন্যবাদ।

৬| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:২১

আরজু পনি বলেছেন:

আমার খুবই প্রিয় একটা লেখা আছে এখানে।
বিশেষ করে সেই লেখার সম্মানে পোস্ট প্রিয়তে ।

আপনাকে বর্ষপূর্তির অভিনন্দন রইল ।

:)

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৩৯

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: ধন্যবাদ আরজুপনি। আপনার প্রিয় একটা লেখা শেয়ার করতে পেরে ভালো লাগছে।

৭| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ২:১৪

বিদ্রোহী বাঙালি বলেছেন: সরাসরি প্রিয়তে নিয়ে নিলাম। :) শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৫৬

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: ধন্যবাদ ঘাসফুল ভাই।

৮| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:১৩

এহসান সাবির বলেছেন: চমৎকার একটি পোস্ট দিয়েছেন।

শুভেচ্ছা রইল।




একটি বিষয় শেয়ার করলাম, আসলে শেয়ার না করে থাকতে পারলাম না... :)
আপনার পোস্টে প্রাথম কবিতা/ চিঠি

চিঠি
বুদ্ধদেব গুহ'র লেখা,
কুরচি,
তোমার চিঠি হঠাৎ এই শীতের সকালে এক রাশ উষ্ণতা বয়ে আনলো। পাতা ঝরে যাচ্ছে সামনের শালবনে, বিবাগী হচ্ছে বগি। রিক্ততার দিন আসছে সামনে। এরই মধ্যে তোমার চিঠি যৌবনের ধুতির মত এলো এক ঝাঁক টিয়ার উল্লাসিত সমস্ত সবুজ চিৎকারের মত। তার মানে এই নয় যে- তোমার চিঠি দুর্বোধ্য। উপমার খোদ ক্ষমা করে দিও। কেমন আছ তুমি? জানতে চাইলেও জানতে পাই কই?


এখানে প্রথম প্যারাটা দেখুন, কমা,দাড়ি,কিছু বানান ভুলের জন্য শব্দ গুলোর পরিবর্তন এসেছে, তার ফলে পুরো বিষয়টির মানগত অবস্থানের পরিবর্তন এসেছে। নেটে সব জায়গাতে প্রায় একই ভুল, কেউ একজন ভুল লিখে পোস্ট দিয়েছিল সেটা সবাই কপি করে চালিয়া যাচ্ছে। পারলে আমরা ঠিক করে দিই, সঠিক টা সবাই জানুক।



ছবিটা বইয়ে পাতা থেকে নেওয়া, ১৯৯৪ সালের নবম মুদ্রণের ২৮১ নং পাতায় অথবা ২০০৪ সালের পরিমার্জিত সংস্করণের ২৩৬ নং পাতায় চিঠি পাবেন।

ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইল।


২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:২০

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: আমি এডিট করে দিবো, তবে আবৃত্তিতে কিন্তু একটু অন্যরকম আছে। আমি দেখে ঠিক করে দিবো। আপনার বইয়ের দেয়াতে পুরো চিঠিটা নেই।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:২০

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: ঠিক করে দিয়েছি। ভুল থাকলে ঠিক করে দিবেন।

৯| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:৪০

লিমন আজাদ বলেছেন: চমৎকার পোস্ট।

+++++

ভাল থাকবেন।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:২৮

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: ধন্যবাদ লিমন আজাদ।

১০| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:৫৯

আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় বলেছেন:
চমৎকার পোস্ট।


জয় গোস্বামীর 'পাগলী তোমার সঙ্গে' শীর্ষক যে কবিতাটা দিলেন, এইটা এই নামে অনেকে জানলে ও কবিতাটির নাম কিন্তু ভিন্ন। জয় গোস্বামীর দেয়া নাম হলো 'পাঁচালী : দম্পতিকথা'
দেখে নিবেন।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৩

লোকালয়ের আড়ালে বলেছেন: ধন্যবাদ দুর্জয় ভুল সংশোধন করে দেয়ার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.