নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাছের আঁশ শুয়ে আছে ঢেউয়ের শব্দের বিছানায়।

সোনালী মাছ

সঙ্গীতের চাকর আমি। শব্দ নিয়ে লোকের জঙ্গলে অলৌকিকতা খুঁজতে ক্ষয়াই একমাত্র জীবন।

সোনালী মাছ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প - শেখর আশ্চর্যের ঘুম

১৭ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:২৪

গল্পঃ
শেখর আশ্চর্যের ঘুম


রহস্যপূর্ণ হাতটি এসে ঘুমন্ত কবি শেখরের কপালের উপরে রাখা কব্জিটি খপ করে ধরলো,যেন অন্ধকারে খুঁজতে থাকা গেরস্থ মুঠোয় পেলো চোরটিকে। বিছানা থেকে টেনে নামিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিতভাবে, সম্ভবত প্রধান রাস্তার পথেই গন্তব্য।চোখেমুখে ঘুমের দখলদারিত্ব স্পষ্ট ছাপ রেখে বসে আছে, যেন ওজনদার পাথরের চাপে তরতাজা ঘাসগুলো চেপটে মুষড়ে আছে।অসময়েই ঘুমে ইস্তাফা টানতে হয়েছে বলে ব্রেন সজাগ করতে বেশ সময় নিলো। কতদিন ঘুমোয়নি সে, হয়তো কত মাস কত বা বছর ! সেই যে মায়ের হাতে ভাঁজ করে দেওয়া কাপড়ের টাংটা নিয়ে শহরের পথে হাঁটা, আর তো পিছনে যাওয়া হয়নি। আসার সময় মা চুল আছড়াতে আছড়াতে বলে দিয়েছিলেন- "কবি হওয়ার যদি এতোই সখ, কবি না হয়ে বাড়ি ফিরবি না।" যেন ঢাকায় কোনো ওয়ার্কশপে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিশপত্রের পাশাপাশি 'কবি'ও নির্মাণ করা হয়, সেখানেই নিজেকে সঁপে দিতে হবে। চুল ছুঁইয়ে কপালে আসা নারকেল তেল আঙুলে সরিয়ে চেয়ে দেখলো দূরে দাঁড়িয়ে আছে ক্লান্ত-শ্রান্ত মজুর বাবা।গায়ে লুঙ্গীতে মাটির লেপন।গেঞ্জিতে অসংখ্য ছ্যাড়া ফুটো, কিছু কিছু ফুটো সেলাই করা মোটা সুতায়। চুলগুলো কান পর্যন্ত নেমে এসেছে,ছাটায় নি- সাবানের ছোয়াও পায়নি নিকট অতীত। তিনপাহাড়ের ওজন তাঁর মাথায়, তারচে দিগুণ ওজনের কষ্ট বুকে- অন্যদের ছেলেরা শিক্ষিত হয়ে বড় চাকরী করে, বৃদ্ধ পিতার দুঃখ সারায়। তাঁর ছেলে কিনা কবি হতে ঘর ছাড়ছে! শিশুকালে পড়ালেখা ভালো বলে কত গর্ব করতেন। শিক্ষকদের মুখে তার আইকিউ'র পরিধির বিশালত্ব শুনে আনন্দে গদগদ হয়ে উঠতেন- একদিন তাঁর আর দুঃখ থাকবে না।মজুরী খাটা আর কত সইবে হাড়! ধারদেনার পয়সাগুলো পরিশোধ করে তাঁকে শান্তিতে কবরে যেতে দেবে।...

ঢাকায় পৌঁছে শেখর যেন সাগরের মধ্যখানে পড়েছিলো। নিজেকে বড় বেমানান আর অযোগ্য বলে প্রমাণ পেলেন খুব শীঘ্রই। প্যান্টের পকেটে মোড়ানো মায়ের দেওয়া টাকা, শুকনো রুটি আর কলা দ্রুতই শেষ করে ফেলেছেন।রাস্তার পানি পান করে শরীর চলে না। ঢাকায় তখন ভয়ংকর রাজনৈতিক অস্থিরতায় মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত ১৪৪ ধারা আতঙ্কে কাটছে।দোষী নির্দোষী যে কাউকেই পুলিশ ধরে প্রিজন ভ্যানে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অফিসগামী চাকুরে, বিদ্যালয়গামী ছাত্র-ছাত্রী কিংবা সাধারণ পথিক - প্রত্যেকেই সাবধানী চোখে একে অন্যের মুখের দিকে তাকায় আর ভাবে," আজ সে সুস্থ দেহে বাসায় ফিরতে পারবে তো!"
একবিকেলে পল্টনের পথে একদল সাধারণ মানুষ বাঘ দেখা ভয়ে দৌঁড়াচ্ছে, শেখর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে,যেন জড়ো হয়ে থাকা পোঁকারদল মানুষের স্পর্শে ছিটকে স্থান ত্যাগ করছে।সে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পুলিশের সামনে।পুলিশ তাকে ধরে প্রিজনে ঢুকিয়ে মাথা গুনে কাগজে লিখলো "পঁয়তাল্লিশ জন"। কোন দলের কর্মী ভেবে তাকে ধরা হলো,তা সে আজো জানেনি। পুলিশ তাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে- তার গ্রুপের এবারের লক্ষ্য কী, ভবিষ্যৎকালে আর কী কী টার্গেট আছে, তাদের ঘাঁটি কোথায়, তার কাছে কোনো বিশেষ ধরণের বই আছে কিনা -আরো অনেক।অন্যান্য প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব তার জানা না থাকলেও, বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই মায়ের গুঁছিয়ে দেওয়ার টাং থেকে জীবনানন্দের 'রূপসী বাংলা' বের করে দিলো।পুলিশের দল বেকুবের মত চেহারা করে একে অন্যের দিকে তাকালো। শেষে কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে পুলিশ তাকে আবার প্রিজন ভ্যানে চড়িয়ে এনে রাস্তায় ছেড়ে দিলো।
তারপর আবার রাস্তায় হাটা। বড় অফিসগুলোর সিকিউরিটির ধাপ পার হতেই সে পারেনি,চাকরী আরো অনেক অনেক দূরের বস্তু। অগত্যা পত্রিকা বিক্রির কাজ নিলো। সকাল সকাল বাড়ি- দোকান- অফিসে হেটে পত্রিকা ফেরি করতে লাগলো । পত্রিকা থেকে ঠিকানা নিয়েই মাঝারি মানের একটি পত্রিকা অফিসে গিয়ে চাকরী চাইলো। পত্রিকার সাহিত্যপাতার সম্পাদক ব্রাত্য সব্যসাচী তার কবিতা পড়ে কেঁপে উঠেছিলেন। বাংলাসাহিত্যে স্নাতক শেষ করা যুবকটিকে নিজের সহযোগী হিসেবে রেখে দিলেন।হাতে কিছু অগ্রিম টাকাও গুঁজে দিলেন। সেইদিনটি ছিলো অসাধারণ অনুভূতির, মই বেয়ে আকাশে উঠে সূর্যের মাথায় টোকা দেওয়ার অনুভূতি।

ছোট একটা মেসভাড়া নিলো।চকি কেনার জোগাড় নেই তাই মেঝেতেই কাঁথা বিঁছিয়ে শোয়া। শোয়াই শুধু, ঘুম তার আসেনা। ভোর না হতেই সব্যসাচীর বাসায় গিয়ে হানা দিতো। তখনো তিনি ঘুমেই থাকতেন। ওর এমন ছেলেমানুষি কাজে তিনি ভিন্ন কিছু দেখতে পেলেন। একদিন ডেকে নিজের লেখার টেবিলে বসালেন। পীরের মত মুরিদকে নসিহত করলেন কিছুক্ষণ - "কবিত্ব অবশ্যই ঐশ্বরিক শক্তি।কেউ তা অস্বীকার করলে বুঝবে, সে কবিতা কী তা জানেনা। মুনিঋষি, সন্ন্যাসী কিংবা নবীগণ যেভাবে ধ্যান করেছেন - কবির ধ্যান তারচে' কম হবে না। আখ থেকে মেশিনে চেপে রস বের করে যেমন, ছোবড়া পড়ে থাকে, ছোবড়াটাই কবি; গ্লাস ভর্তি কবিতা পান করে পিপাসিতা। কবি হতে চাইলে তোমাকে আগে মরতে হবে।নিশ্বাস চললেই জীবন বলা চলে না। নিশ্বাস বন্ধ হবার পরই কবি বাঁচতে শুরু করে।কবি একটি বিরাট পাত্র যেখানে পরিপূর্ণ থাকে অমৃত, তার থেকে অতিসামান্যটুকুই ছুঁইয়ে পড়ে জ্বলে উঠে হীরার খনির আলো।"
সব্যসাচী দম নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে আবার বলল। শেখরের গলা শুকিয়ে গেছে, ঢোক গিলার মত থুথুও নেই মুখে।তবু শোনার আগ্রহ দমেনি। " তুমি যখন কবিত্ব পাবে; হ্যাঁ তোমাকে কবিত্ব পেতে হবে,যেমন বেলায়েত পায় দরবেশগণ, তখন কবিতা নিজেই লিখা হয়ে যাবে তুমি লিখতে হবে না। খবরদার, কখনো জোর করে কবিতা লিখতে যেওনা, সেগুলো কবিতা হবে না আর যা-ই হোক।..... "
কথাগুলো শেখরের চামড়া ছেদ করে ঢুকে গেছে বজ্রপাতের মত।অসংখ্য শেল ঝরিয়ে দিয়েছে বোধের জড়তা। ক্রমেই নিজেকে খুব শূন্য মনে হতে লাগলো। যেন সে কিছুই এতোদিন লিখেনি। আর কখনই লিখতে পারবে না।লেখালেখিটা তার জন্য নয়।রাস্তায় যতদূর হাটছে সব্যসাচীর কথাগুলো কে যেন বাজিয়ে যাচ্ছে। গোসলে- রুমে- ঘুমে কিংবা অফিসে, বেজেই চলছে রেকর্ড। তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। পরের সকালে সব্যসাচী দা বেশকিছু বই ধরিয়ে দিয়েছেন হাতে। নাম না জানা কত লেখকের বই, ভারী এবং পুরনো,ছেঁড়া। "এসব পড়বে। চিৎকার করে পড়বে। যেন নিজের ভেতর দেয়ালে প্রতিটি শব্দ হাজারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে।" শেখর বইগুলো নিয়ে বাসার পথ ধরলেন।

রাতজেগে পৃথিবীর বিখ্যাত কুখ্যাত কম-খ্যাত অসংখ্য লেখা পাঠ করতে লাগলো। পাঠ করলেন কালোত্তীর্ণ সাহিত্য- প্রবন্ধ, চিঠি আর জীবনী....
তার ভেতরে রক্তকণিকা দিনদিন অন্য বৈশিষ্ট ধারণ করতে লাগলো।মুনিঋষিদের মত ধ্যান করতে লাগলো সে, রুমের দরোজা জানালা বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকছে, আকস্মিকভাবে চিৎকার দিয়ে উঠছে ,অকারণে কেঁদে উঠছে। রুমমেটরা ভাবছে ছেলেটি পাগল হয়ে গেলো? নাকি ভূতপ্রেতে আছর করেছে?এভাবে দীর্ঘদিন কেটে যাওয়ার পর, সে অস্বাভাবিক অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলো। রাত গভীর হলেই মাংস আর রক্ত ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। সে দেখে ধীরেধীরে কিছু কাঠের টুকরোর মত আগুনের দলা তীব্রগতিতে ঢুকে যায় তার ভেতরবাড়িতে।

একদিন সব্যসাচী দা' তাকে আজিজ মার্কেটে কবিতার আড্ডায় ডাকলেন। আসরে উপনীতদের মাঝে হঠাৎ সে উপস্থিত। যেন বন্দি কোনো পাগল দড়ি ছিঁড়ে ধরা পড়ার ভয়ে দৌড়ে এসেছে।কবি শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য বিরক্তি প্রকাশ করে সব্যসাচীকে বলে উঠলেন - "এটাকে এখানে আসতে না বললে হতো না? ওর গায়ের গন্ধ আমার নাক অব্ধি চলে এসেছে।"
সব্যসাচী দা শান্ত এবং ভরাট গলায় জবাব দিলেন, "এবার তার শব্দের সুগন্ধি মশলার ঘ্রাণ শুঁকুন।বয়স কমে যাবে বছর তিরিশেক। "
শেখর গলার আওয়াজ যেন স্প্রিংএর উপর রেখে নাচিয়ে নাচিয়ে আবৃতি করতে লাগলো কবিতা। উপস্থিতি সকলে কবরের নির্জনতায় নিমজ্জিত হলো।যেন ভিসুভিয়াস থেকে গলে গলে পড়ছে বরফপথ। শ্রীকান্ত আকস্মিক উঠে দাঁড়ালেন। আবৃতি শেষ না হতেই বিকটশব্দে বলে উঠলেন - "তুমি কোন গ্রহের প্রাণী, হে যুবক? তোমার শক্তি এই ছোট গ্রহের আয়তনকে হার মানায়।তোমার শব্দরাশি পৃথিবীকে যৌবনবতী করে তুলবে বারবার।তুমি মানুষ নও,তুমি প্রকৃতির এক আশ্চর্য।... "
কিন্তু অন্যসকল উপস্থিতি বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে শ্রীকান্তের দিকে, পিঠ চাঁদের মত বাঁকিয়ে যাওয়া শ্রীকান্ত যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে! মাথার আধপাকা চুলগুলো সব কালোরঙ ধারণ করেছে! এই অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা আর ওই আড্ডাস্থলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।

কবিতা লিখতে থাকলো শেখর আশ্চর্য, অনবরত রাত জেগে । রুমের অন্যদের ঘুমে সমস্যা হতো, তাই মোবাইলের আলোতে - মোমের আলোতে কবিতার শরীর আঁকতো নির্ঘুম।চারদিক অন্ধকার, হঠাৎ হঠাৎ কবিতার অক্ষরগুলো জ্বলে উঠতো, তসবিহ যেভাবে জ্বলে। সে তখন গামছা দিয়ে ঢেকে দিতো খাতা।
পত্রিকায় চাকরীও চলল আর নিয়মিত বিভিন্ন সাহিত্যপাতা আলোকিত হতো অন্ধকারে বসে লেখা কবিতাগুলোতে। সবাই চিনতে লাগলো তার নাম। ধনীব্যক্তিদের সুন্দরী কন্যারা তার খোঁজখবর নেওয়া আরম্ভ করলো। কেউ দামী গাড়ি নিয়ে এসে তার হাত ধরে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, রেস্তোরাঁয় খাওয়াচ্ছে, লংড্রাইবে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই তার মুখের কাব্যময় ছন্দিত কথায় মুগ্ধ হয়ে ডুবে যায়। তার কবিতা এবং ভরাট কন্ঠ,দুটোই আব-এ-যমযমে ধোয়া অমৃত, এই অমৃতে স্নান করতে অভিজাত পরিবারের বউরাও শাড়ি হাটুর উপরে গুটিয়ে নেমে পড়তে লাগলো।পাঁচতারা হোটেলে রমণীদের সামনে লাইভ কবিতার ঝর্ণা পার্টি ।প্রতিটি শব্দ বেহেস্ত থেকে উচ্চারিত হয়ে তার ঠোঁট বেয়ে বেয়ে পড়ে। চরম অনুভূতিতে নারীদের শরীর হতে বসন ক্ষসে ক্ষসে পড়ে থাকে মেঝেতে। বিবসনাদের সাদা পিঠে লিখে দিয় স্বর্ণ খচিত প্রেমের কবিতার শিরোরুহ।
সে আর শুধু কবি নয়, শরাব - অতৃপ্ত নারীদের ক্যান্ডেল লাইটের আলোতে রাখা আইচসমেত মদ। সারারাতভর গিলে তাকে, সকালে পড়ে থাকে খালি বোতল।
রাজনীতিবিদ জামশেদের সতিস্ত্রী রোজেলিনাও পান করতো তাকে, আইচ মিশিয়ে নয়, র' মাল গিলতো, আলো-আধারেঢাকা শহুরে রেস্তোরাঁর গোপন কক্ষে।

এইতো যেন সেদিন,ফাল্গনে আয়োজিত সঙ্গীতানুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাইছিলো রোজেলিনা।হালকা গরমে ঘামের সরুকেচো ব্লাউজ ভেদ করে কোথায় ঢুকে যাচ্ছে- দর্শকবেঞ্চে বসে যেন শেখর আশ্চর্য গিলছিলেন সে দৃশ্য। রোজেলিনা রঙিন ঠোঁটে মুচকি হেসে ড্রেসিংরুমে ঢুকতে যাওয়ার সময় তিনিও পিছন গেলেন, জিজ্ঞেস করলেন নাম। রোজেলিনা চোখ ঘুরিয়ে জবাব দিলেন- "আমার নাম জহর। খেতে চেও না। অকালে মরবে।"
কবিরও প্রেমস্পদ জবাব- " অমন বিষে মরতেই বুঝি কবির জন্ম ।ঘাট খুলে দাও, ঝাঁপ দেবো ওই বিষ-সায়রে।" সরস্বতী গঙ্গা খুলে দিলেন,খুলে দিলেন জঙ্ঘাও;কিন্তু পূজো চাইলেন একাধিপতিনী হয়ে। কবি তো আর একজায়গায় নেই, তার বিন্দুখন্ড পড়ে আছে অসংখ্য সফেদ হংসীর পাখার ভাঁজে ভাঁজে। সেই ভাঁজ খুলে খুলে রোজেলিনা যখন নূড়ি পাথর গুলোকে সিন্দুকে সাজাতে চাইলেন তখনই হাঁপিয়ে উঠলেন কবি।

২.
অসংখ্য রজনী নির্ঘুম কাটিয়ে, প্রচণ্ড ঘুমে কাতর হয়ে একদিন কীভাবে যেন ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। কীভাবে ঘুমালেন,কবে ঘুমালেন-তা আর মনে পড়ছে না ।তবে দীর্ঘদিন, মাস বা বছর যে কেটে গেছে,তা বুঝতে পারছেন কিছু।তবুও ঘুমের পিপাসা মেটেনি এখনো। ঘুমার্ত চোখেই হেটে চলছেন, রহস্যময় হাটটি যেদিকে নিয়ে চলছে।
ঢাকার রোদের ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘের গর্জন স্তব্ধ করে রেখেছে শহরবাসী এবং পান্থদের।চুপসে আছে পাখিগুলো। ডাস্টবিনের ময়লা-পঁচা গন্ধে মইমই করছে শহর। শেখরের গায়ের জীর্ণশীর্ণ বসনের গন্ধের দাপটও কম নয়।গায়ে জড়ানো ছেঁড়া পেটিকোট; কোন্ মহিলা ঋতুশ্রাবের রক্ত মুছে ফেলে দিয়েছিল, কে জানে। অসংখ্য তালি দেওয়া বিরাট বহরের পাঞ্জাবী, আর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোমল পানীয়ের খালি বোতলের বাহার ঝুলে আছে।হাটার সময় নানান সুরে বেজে উঠে বোতলের ঝাঁক।

বহুদূর হেটে আজিজ মার্কেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। এখানে কবিতা আর সাহিত্য বিষয়ক জম্পেশ আড্ডা দিতো একসময়, মনে পড়লো। তরুণ কবি বড় কবিরা মিলে একাকার হতো। চা আর সিগারেটের ধোঁয়াসহ কবিতা আবৃতি।
তারপর পুষ্পবিতান পেরিয়ে নজরুলের কবর ডিঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার উঠোনে গিয়ে দেখলো সেই জায়গাটি, যেখানে আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবের মঞ্চে দীপ্তিময় চেহারায় কবিতা পাঠ করেছিল গুণীজনদের সামনে।
অদৃশ্য হাতটি তাকে টেনে নিয়ে গেলো কোলাহলময় মধুরক্যান্টিনে।পরিচিত অনেকগুলো মুখ চোখে পড়লো।কেউ চা পান করছে, কেউ তুমুল বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন বন্ধুদের উদ্দেশ্যে, কেউ রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ করছে মৃদু কন্ঠে। কিন্তু কেইই তার দিকে তাকাচ্ছেনা।
প্রায় প্রতিদিনই এখানে খেতো সে। কিছু খুচরো পয়সা পাবে দোকানদার, পরিশোধ করা হয়নি। গুঁটিসুঁটি মেরে বসলো শেখর আশ্চর্য ,রহস্যময়হাতটি এনে এককাপ কড়া ধোঁয়াউঠা গরম চা দিলো তাকে। চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ না উঠাতেই তার নাকে একটি পরিচিত শরীরের ঘ্রাণ নেচে উঠলো । চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে রোজেলিনা , রিক্সায় করে এক মুহূর্তে চলে গেলো। সারাশরীরে নতুন কেনা রঙ আর উড়ন্ত শাড়ির নৃত্য, পাশে বসা একটি যুবক আধখালি মদের বোতল।
চায়ের জল গলা ভেদ করে যতদূর গিয়েছে, শেখর টের পেলো , ততদূর যেন ব্লেডে ছেঁচে গেছে , এতো জ্বলছে কেনো?এমন জ্বলন আগেও একবার হয়েছিল, সম্ভবত ঘুমের পূর্বক্ষণে।
তখন রোজেলিনার স্বামী সরকারের মন্ত্রী। আর শেখরের তখন 'কথার ব্যবসা' রমরমা। সাবরিনা এসে পকেটে নতুন টাকার নোট পুরে দিয়ে দুঘণ্টা ভাড়া করে পার্কের ঝোঁপে ঢুকে যেতো । তমা তার প্রেমিকের সাথে ঝগড়া করলেই এসে মন ঠান্ডা করতে কবির 'কথার বরফ' ঢালতো । যেকয়দিন হুমাইরা তার স্বামীর গালাগাল খিস্তি গিলতে হতো, সে কয়দিন কবির কাছে এসে দুঘণ্টার কথার মালিশ সারাশরীরে নিয়ে ঘরে ফেরতো।
কিন্তু রোজেলিনা চাইলো কথার আস্ত গাছটাকে, নিজের বাগানে - সে শুধু পেড়ে পেড়ে রসালো ফল খাবে।

সবার পিপাসা মেটাতেচ্ছে কবি, কবি মরছে জল বিনা।এক সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁর এককোণে বসে রোজেলিনাকে বলল - সমুদ্রেরও পিপাসা লাগে, কার চিন্তায় সেই কথা রয়? কাঠগুঁড়োর এই বুকে বড় পিয়াস, প্রিয়ো। কে মেটাবে?
রোয়েনা তখন পাতলা শব্দে ক্ষাণিক হাসলো , "আমার শরীর ছেঁচা পানিতে কি ভিজবেনা মন? নাও, এক চুমুকে পিয়াস মেটাও।"
জিগার ভরা তরলটুকু গলায় ঢেলে দিলো কবি।অমনি বিষাক্ত জ্বলনে চৌচির হতে লাগলো বুক। কত গাঢ়তায় কতসময়তক জ্বলেছিল,তা আর মনে নেই কিছু, সেই সময়ই প্রচণ্ড ঘুমে নিমজ্জিত হয়েছিলেন কবি শেখর আশ্চর্য ।সুদীর্ঘকালের সে ঘুম আজই ভাঙ্গলো, অপ্রত্যাশিত সময়ে।

এখনো চায়ের জলে বুকে সেই জ্বলনই জ্বলছে আবার, চিৎকার দিয়ে সবাইকে জানাচ্ছে সে, কেউ যেন শুনছে না। এতো জোরে শব্দ করে বলছে পথচারী রিক্সাওয়ালা দোকানদারদের, সবাই বুঝি কান ঢিপিয়ে রেখেছে মোটা কাপড় দিয়ে!
রোজেলিনা আবার আসছে এই পথ ধরে, সাথে যুবক মদের বোতল, তরুণ কবি আসাদুজ্জামান- আজকালকার রাত মাতাল হয় এই মদেতেই!
এবার শেখর একেবারে তাদের পথের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, যাতে এড়িয়ে যেতে না পারে। রোজেলিনা প্রচুর হাসছে আর যুবকটির বাহুতে প্রহার করে বলছে - "তোমার কথায় মধু আছে, কবি।আমার তো ঘোরই কাটে না।"
কিন্তু তার কাছে এসে আর থামলো না, শেখরের শরীরের ভেতর দিয়ে তারা হেটে চলে গেলো।
শেখর চমকে উঠলো। নিজের দেহের দিকে তাকালো,তারপর রোজেলিনার দিকে।অনতিবিলম্বে বুঝতে পারলো, তার শরীরটি আসলে এখানে নেই।শরীরের ছায়াই ঘুরছে এখানে। সে মৃত।
তার বাড়ি ফেরা হয়নি। বাবার মৃত্যুর খবরটি কানে এসেছিলো। আসার সময় বাবা যে অন্যদিকে ফিরে ক'ফোটা চোখের জল ফেলেছিলো, তা আর মুছে দেওয়া হয়নি।
কবি মুখ থুবড়ে পড়লো রাস্তার মাঝে।

অমনি একটি হাত এসে তার কব্জিটি খপ করে ধরলো, মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো, কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ। রুদ্র তাঁর বিশাল কন্ঠে বলল- কোথায় হারিয়ে যাও মিয়া, হাত ফসকে? চলো আজ মসজিদের ওই পাশটায় আড্ডা জমাবো।জীবনানন্দ, রাহমান, হুমায়ুন আর আবুল হাসানসহ সবাই আছেন । কবি রফিক আজাদও আজ থাকবেন জলসায়।

১৯-৫-১৬
লেখকঃ পাভেল আল ইমরান।
দৈনিক সোনারদেশ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত গল্প

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:৫০

শরীফ বিন ঈসমাইল বলেছেন: পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলাম :(

১৭ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ১১:৪০

সোনালী মাছ বলেছেন: লেবু আর পুদিনাপাতার পাতা মিশানো বরফপানির ব্যবস্থা করবো নাকি ভাই শরীফ বিন ঈসমাইল?

২| ১৭ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:৫৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: আপাতত চোখ বুলিয়ে গেলাম। শক্তিশালী কলম। অনুসারিত।

১৭ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ১১:৪৩

সোনালী মাছ বলেছেন: ধন্যবাদ জানাই হাসান ভাই। পুরোটা পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।

৩| ১৭ ই জুলাই, ২০১৬ দুপুর ১২:০৩

সাহসী সন্তান বলেছেন: চমৎকার লেখনি আপনার! আমি অফলাইনেই বসে বসে পড়ে শেষ করে তারপর মন্তব্য করার জন্য লগইন করলাম! যদিও গল্পটা অনেক বড়, তবে এই ধরনের বড় গল্পগুলো পড়তে আমার খুব ভাল লাগে! আর এমন একটা সুন্দর গল্প উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!

শুভ কামনা রইলো!

অফটপিকঃ- আপনি যদি পোস্টটা এডিট করে ছবির লিংকটা কাট+পেস্ট করে ছবিটা একদম উপরে সংযোজন করে দেন তাহলে আরো বেশি ভাল হয়। কারণ গল্পের শেষে ছবি ঠিক মানায় না! ধন্যবাদ!

২৩ শে আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৪:৫৩

সোনালী মাছ বলেছেন: গল্পটি শুরু হয়েছে যেই ভাবনা নিয়ে, তার অতিক্ষুদ্র অংশ লিখতে পেরেছি এখানে। অতৃপ্ত ছিলাম। কিন্তু আপনার কথায় সাহস হচ্ছে। অনুপ্রাণিত হচ্ছি, গল্পটির দ্বিতীয় পর্ব লিখতে। হয়তো শীঘ্রই এর দ্বিতীয় পর্ব উপস্থাপন করতে পারবো।

আর ছবিটি উপরে নিয়ে নিচ্ছি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালোবাসা।

৪| ১৭ ই জুলাই, ২০১৬ দুপুর ২:৩২

অর্ধ চন্দ্র বলেছেন: অসাধারণ লেখনী, চালিয়ে যান,

২৩ শে আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৪:৫৪

সোনালী মাছ বলেছেন: ধন্যবাদ জানাই চন্দ্র জী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.