![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কাওসার মাহমুদ fb.com/KawsarMahmud4
জিবন থেকে নেয়া এক এতিম ছেলের শৈশব
আমি কাওসার মাহমুদ। পিরোজপুরের ইন্দুরকানি (জিয়ানগর) উপজেলার এক পিছিয়ে পড়া জনপদ মধ্য কলারণ গ্রামেই আমার জন্ম। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, আধুনিক দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন, বৈদ্যুতিক আলো-বিহীন সমাজে ১৯৯০ সালের এক ঈদের দিনের সকাল থেকেই আমার জীবন চলার শুরু। অবহেলিত, উপেক্ষিত অন্য দশটা ছেলের মতই আমার জীবনের পথচলা আরম্ভ হয়। তারপরও আমার বন্ধু সংখ্যা ছিল খুব সীমিত! মাত্র একজন! আমার সম বয়সী ছেলেরা সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াত। তাদের কাছে স্কুলের নিয়ম-শাসন পছন্দনীয় ছিল না। স্কুল প্রাঙ্গণে মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থীরা যখন জাতীয় সংগীতে টান দিত, তারা দলবেঁধে শুনতে আসত! অতঃপর তারা গ্রামীণ খেলা-ধুলোয় হারিয়ে যেত। ইচ্ছে হত এদের সাথে মিলে যাই কিন্তু বারণ ছিল। আমাদের এলাকার নয়, এমন একজন নিরীহ ছাত্র, বহুদূর থেকে হেটে আমাদের বাড়ীর সামনের স্কুলে পড়তে আসত। ঘর থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল, সেই হবে আমার বন্ধু এবং শুধু তার সাথেই বন্ধুত্ব করা যাবে! খেলা-ধুলোর প্রতি চরম অনাগ্রহী এই সহপাঠী স্কুল ছুটির পরই সে তার গন্তব্যে রওয়ানা হত!
সীমিত বন্ধু-বান্ধবের কারণে আমার শিশুকাল কেটেছে নিজের সাথে নিজে কথা বলে, আর গাছ পালাকে শাসন করে! স্কুলের পড়া কবিতা, গল্প, ছড়া তাদের শিখাতাম। যথাযথ পড়া আদায় না করার অপরাধে, আমারই স্কুলের শিক্ষক হোসনে আরা বেগমের, বাড়ির পিছনে মানকচুর পাতা আর হলুদ ক্ষেতের গাছের সাড়ি, আমার বেত্রাঘাত আর কঠোর শাসনে নেতিয়ে পড়ত! পরদিন তাদের উপর রহম দিল হতাম। উচ্চস্বরে মাইকে শোনা গান গেয়ে মুরুব্বীদের ত্যক্ত করতাম আবার অঙ্গভঙ্গি করে কবিতা আবৃত্তি করে কখনও হাসির পাত্র হতাম! ছাত্র বিবেচিত হওয়া গাছ গুলো পুনরায় তাজা উঠলে আবারো পড়া-লেখার খবর নিতাম, ছুতো-নাথা ধরে কোন একদিন পুনরায় বেত অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। একদিন মা বললেন, “প্রকৃত পক্ষেই আমার স্কুলের শিক্ষক যদি আমার সাথে এমন ব্যবহার করে, তখন আমি কি করব”? এই কঠিন প্রশ্নের কোন উত্তর ছিলনা তবে এ কথায় মনে রেখাপাত হল, সে থেকে থামলাম।
আমি ছিলাম খুবই কৌতূহলী বালক। এই অভ্যাস আমাকে কখনও চরমভাবে ভুগিয়েছে আবার কখনও প্রশান্তি এনে দিয়েছে। মুরগী ডিম পারার আগে অনবরত ডাকে কেন? আবার ডিম পারার পরেই বা সজোরে চিল্লায় কেন? লাঙল কে বানালো? লাঙলের ধাতব ফলা বানানোর কৌশল কার থেকে এলো? কার বুদ্ধিতে গরুর কাঁধে জোয়াল জুড়িয়ে জমিতে নামানো হল। কুড়াল বা বানালো কে? তার পিছনে কায়দা করে বড় ছিদ্র বানিয়ে সেটাতে কাঠের হাতল লাগিয়ে, এই কুড়াল দিয়ে বিরাট গাছ ধরাশায়ী করা যায়! এই চিন্তা প্রথম কার মাথা থেকে এসেছিল! সমাজ-জীবনের চারিদিকে চলতে থাকা এ ধরনের বহু জিনিষে কারো কোন আগ্রহ না থাকলেও আমার মাথায় হাজারো প্রশ্ন কিলবিল করত। এসব প্রশ্ন মুরুব্বীদের দিকে ছুড়ে দিলে তারা কেউ উপদ্রব ভাবত, কেউ পাগল ঠাওরাত! এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কত ভৎসনার মুখে পড়েছি, শিক্ষকদের কাছে তিরস্কৃত হয়েছি, মুরুব্বীদের কাছে অকর্মা হিসেবে বিবেচিত হয়েছি, তার কোন হিসেব করা যাবেনা। অনেকে আমার পিতা-মাতাকে বলত একে জ্বিন-ভূতে পেয়েছে! বৈদ্যি ডেকে জিনের আছর মুক্ত করুন। বাবা সত্যি সত্যিই বাড়ীতে বৈদ্যি ডাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে এক ভিন্ন করুণ অধ্যায়। তখন শিশু মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ‘আমি যদি এসব প্রশ্নের উত্তর পাই তাহলে, কাউকে তিরস্কার না করেই উত্তর জানিয়ে দিব’।
এই কৌতূহলী খাসিয়তের জ্বালায় শুধুমাত্র একজন মানুষ কোনদিন পেরেশান হননি! তিনি আমার ‘বাবা’! যাকে হৃদয়ের সমস্ত অভিব্যক্তি দিয়ে সারাজীবন ভালবেসেছি। তিনি আমার মনের কৌতূহল মেটাতে, পারত পক্ষে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করতেন। বংশীয় ধারায় তিনিও ছিলেন পড়ুয়া মানুষ! ভাগ্যগুণে আমার বাবার, দাদার দাদা এবং তার বাবা, সবাই ছিলেন শিক্ষিত মানুষ। তাদের গোষ্টি-গত পরিচয় ছিল ‘তালুকদার’ হিসেবে। আর তালুকদাররা অধিক ভূসম্পত্তির মালীর হিসেবে বিবেচিত।
বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠেছি। জ্যৈষ্ঠের এক দুপুরে বাবা একটি বড় বই নিয়ে বসলেন। তিনি আমাকে রামায়ণের অংশ বিশেষ শুনালেন। কৌতূহলী মনে কান খাড়া করে মজাদার কাহিনী শুনতে রইলাম। ব্যস! বাবাকে প্রতিদিন পিড়াপিড়ি করতে থাকি, মজাদার পড়াটা আরো শোনানোর জন্য। একদিন মা বললেন, তুমি যখন অনেক কিছু জানতে চাও, তাহলে পড়াটা তুমিই শিখে নাও। তোমার সকল উত্তর তো বইয়ের ভেতরেই পেয়ে যাবে। মায়ের এই প্রেরণায় শক্ত করে লেগে গেলাম। কয়েকদিনের চেষ্টায় আমি বড়দের বই পড়তে পারলাম। আমার ধারণা হল, মজা বুঝি শুধু এই বইতে! বাবা আমার ধারণা পাল্টে দিলেন। তিনি কলেজ পড়ুয়া আমারই বড় ভাইয়ের বইয়ের শ্রীকান্ত অংশ থেকে ‘নতুন দা’র ঘটনাটি অংশ বিশেষ শোনালেন! এটা পড়তে গিয়ে, বাবা নিজেই অনেক হাসলেন! কম বুঝার কারণে আমি অত হাসতে পারলাম না! আমার মা স্কুলে পড়েন নি কিন্তু বাবার হাসির আতিশয্যে তিনিও হাসিতে যোগ দিলেন। বাবা-মাকে এমন করে হাসতে ও উৎফুল্ল হতে অতীতে কখনও দেখিনি। এই ঘটনাটি আমাকে খুব প্রভাবিত করে। কারো প্ররোচনা ব্যতীতই একটি বিশ্বাস আমার অন্তরে গেঁথে গেল যে, খুশী হবার জন্য বইয়ের মধ্যে বহু উপাদান আছে। অতঃপর বাবা আমাকে আদম (আ), নূহ (আ), ইব্রাহীম (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ালেন। প্রাইমারী স্কুল জীবনের সেই সময়েই সকল পড়ার অন্ত-নিহিত অর্থ না বুঝলেও, দ্রুততার সাথে পড়ার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলি। এই যোগ্যতার ফলে, বাহিরের বয়স্ক মানুষের কথার রহস্য বুঝা আমার জন্য সহজ হয়ে গেল।
সেই থেকে বইয়ের প্রতি প্রেম ও ভাল লাগার শুরু, এখনও ভালো লাগে! গিন্নী বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘ঈশ আমি তোমার গিন্নী না হয়ে যদি বই হতাম, তাহলে তোমার অনেক বেশী নজরে থাকতাম’! বই পছন্দে আমার নির্দিষ্ট কোন রূচিবোধ ছিলনা! সহজ বই, কঠিন বই, পৌরাণিক বই, যাদুর বই, তাবিজের বই, গল্প-উপন্যাসের বই, দার্শনিকের বই, এমনকি ধর্মীয় বই কোনটাই আমার রুচি ও রুটিন থেকে বাদ যেত না।
আমার ছাত্রজীবনে যে জিনিষটার বেশী অভাব বোধ করেছি সেটা হল বই! না, না, শুধুমাত্র স্কুলের বই নয়। স্কুলের বইয়ের বাহিরেও শিক্ষার্থীদের আরো অনেক বই পড়ে মানুষ হতে হয়, সেটা শ্রেণী শিক্ষকেরা তো অহর্নিশি বলতেন। ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন’ এর কথা বলে শুধুমাত্র একাডেমিক শিক্ষাকে প্রকৃত শিক্ষা না ঠাওরাতে শিক্ষকেরা হর-হামেশা পাঠদান করতেন।
প্রত্যন্ত জনপদে বসেও সারা দুনিয়া সম্পর্কে জানার অদম্য আগ্রহের কারণে, পড়ার প্রতি আসক্তি দিনে দিনে বেড়ে উঠে। সামান্য সময় পেলে, সেটাও পড়ার পিছনে ব্যয় করতাম। পুরানো বই শেষ হলে নতুন বইয়ের জন্য ঢাকায় লিখতাম কিন্তু এতে আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকত। নতুন বন্ধু বানানো, ফ্রি বই ও ম্যাগাজিনের জন্য প্রচুর চিঠি লিখতাম। বই আসত ডাক যোগে। গড়ে প্রতিদিন কিছু না কিছু আসতই। ফলে ডাকঘর ও ডাকপিয়ন যেন আমার শিক্ষা অর্জনের সাথী হয়ে পড়েছিল। বই ভাড়া করে আনতাম, একসময় এটাও শেষ হয়ে যেত। এই অভাব রোধ করতে গ্রামীণ জনপদে যার কাছে যত পুঁথি আছে, সেগুলো পড়া হলো। বাজারে কবিতার পাণ্ডুলিপি বিক্রি হত, সে সব পড়া হতো।
আমার ফেজবুক লিঙ্কঃ-
https://www.facebook.com/KawsarMahmud4
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ২:০৮
নীল আকাশ বলেছেন: সুস্বাগতম ব্লগে।
একদম শুরুতেই জিবন < জীবন বানান ঠিক করে দিন।
বই পড়ার প্রতি আপনার এই আগ্রহ অনেকদিন বেঁচে থাকুক।