নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এম আলম তারেক

এম আলম তারেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন ঈদ ফেরৎ যাত্রীর সাথে একটি লঞ্চের কথোপকোথন

০৫ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৫



যাত্রী : ভাই, আপনার নামটা।

লঞ্চ : এমভি খান।



যাত্রী : খান মানে, আপনি কোন খান- শাহরুখ খান, ইমরান খান, সালমান খান, সাকিব

খান গোত্রীয় নাকি এস খান গোত্রীয় আর্শিবাদপুষ্ট।



লঞ্চ : অবশ্যই শেষের জনের------, সেতো আমাদের গুরুদের মহাগুরু। আমাদের নাকি

চালায় সে? আমাদের মালিক-মহাজন সবাই তার চরণধুলি নিতে ব্যস্ত, যতবার

তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ ততবার ফটোসেশন আর ততবার ফটোগুলো বাড়ীর দেয়ালে

টাঙ্গিয়ে রাখার মহাআয়োজনে ব্যস্ত থাকে। আমাদের মালিক তার আসার খবরে

নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে সবার আগে তার গাড়ীর দরজা খুলে

দিয়ে অতিশয় ভদ্রাকারে বিনম্রচিত্তে সালাম দিয়ে গুরুভক্ত হিসেবে শিশ্যগিরি রেনু

করার জন্য।



যাত্রী : আমি তো ঢাকায় যাব, তবে কি উঠতে পারি আপনার উপর?

লঞ্চ : কেন নয়, দেখছেন না, দুশতাধিক জনকে নিয়া বসে আছি, আপনারা না উঠলে

তিনশ হবে কিভাবে, তিনশ না হলে তো আর পদ্মার বুকে বুক রাখতে পারবোনা।



যাত্রী : আপনার ধারণক্ষমতাতো ৯০ জন। অতিরিক্ত তাও আবার তিনগুনেরও বেশী

সংখ্যক যাত্রী হয়ে নদীতে ভাসা ঠিক হবে? বর্ষাকাল, পদ্মার যে অবস্থা।



লঞ্চ : তাহলে বসে থাকেন ঢাকায় যেতে হবে না, গ্রামে ফিরে গিয়ে দেশ তথা গ্রাম-

মার্তৃকার সেবায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন। আমাদের মালিক-মহাজনরা আপনাদের

অতিরিক্ত যাত্রী না করে কখনও এপার থেকে ওপারে নেবেনা।



যাত্রী : প্রশাসন ও পুলিশ বসে যে তদারকি করছে, তাদের সামনেই আমাকে অতিরিক্ত

যাত্রী হয়ে যেতে হবে, এটা কেমন কথা?



লঞ্চ : বসে থাকেন, আর মনে মনে যপতে থাকেন পরেরটাতে যাই, পর পর করতে

করতে দেখবেন রাত হয়ে গেছে, রাত হলে তিন গুনের জায়গায় পাঁচগুন করে পাটের

গাইট আকারে সাজিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। তখন ঠিকই যাবেন।



যাত্রী : প্রশাসন ও পুলিশ ওরা মানুষের জানমালের কথা ভাববে না। ওদের কি মানবতা

নেই।



লঞ্চ : আছে, মানবতা আমাদের মালিক-মহাজনদের কাছে বন্ধি, দেখছেন না মালিক-

মহাজনের দেয়া টাকায় মুখের ভিতর চা-পানের রসময় মিষ্টি পিকের গড়াগড়ানি

করাচ্ছে। মালিক মহাজন চা-পান বাবদ যা দিয়েছে তাতেই খুশি থাকতে হবে, আর

তাদের কথামত চলতে হবে শুধুমাত্র লাঠি নিয়ে বসে বসে অপেক্ষা করবে কখন

মালিক পক্ষের কোন হোমরা চোমড়া চেলার সাথে কোন যাত্রীর বাকবিতন্ডা শুরু হবে।

শুরু হলেই মাতবরি ফলিয়ে বেচারা যাত্রীকে পেদানিসহ হেনস্তা করে মালিক পক্ষের কাছে নিষ্ঠাবান-দায়িত্বপূর্ণ-কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ ও প্রশাসন হওয়া যাবে। এমনও হতে পারে গুরুদের আর্শীবাদে মহাগুরুর কল্যাণে এক ফুল থেকে দুই ফুল লেগে যাবে-কারওবা সহকারী থেকে পূর্ণ পদবী চলে আসবে।



যাত্রী : আমারতো অফিস আছে আমাকে যেতেই হবে, অফিসে ঠিকমতো না গেলে চাকরী

চলে না গেলেও নানা কৈফিয়তের দায়ে দায়ী হতে হবে।



লঞ্চ : ওঠেন ভাই, ওতো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। জীবনতো একটাই একজীবনে এত

ভয় করে লাভ কি? আজ না হয় কাল প্রয়াণ হবেই।



যাত্রী : হ্যাঁ উঠতেই হবে, জীবন চালাতে প্রায় নিশ্চিত মরণের পথেও পা বাড়াতে হয়।

হায়রে ভাগ্য আমার আমিই কি সোনার বাংলার সোনার ছেলে? নামেই সোনা

সবসময়ই অতিরিক্তের খাতায় নাম লেখাতে হয়, আমার জীবনের চেয়ে ওদের একশ টাকার মূল্য অনেক বেশী।



লঞ্চ : আরে ভাই আপনিতো ঠিকই বলেছেন।



যাত্রী : ঠিকই তো বলতে হয় প্রয়োজনই ঠিক বলতে শেখায়।

লঞ্চ : তাহলে আসেন-আমার বুকে।‌



যাত্রী : উঠলাম ভাই, ভালয় ভালয় পার করে দিয়েন। গ্রামে বউ-ছেলে-মেয়ে কানপেতে

আছে আমি কখন ঢাকায় পৌছে ফোন দিয়ে কাপাকাপা নেটওয়ার্কে হিমালয়সম কঠিন

ভালবাসা নিয়ে বলব- আমি ভালভাবে পৌছেছি, চিন্তা করো না আমি ভাল আছি।



লঞ্চ : হ্যাঁ ভাই জীবনের স্বাদ তো ওখানেই- ওই স্বাদের আশাতেই মানুষ মরণের পথেও

জীবনকে তুলে দিতে চায়।



৪০ মিনিট পর-



লঞ্চ : ভাই, ঢাকার সার্ভেয়ার মহোদয় আমার মহাজনের কাছ থেকে কিছু উপহার সামগ্রী

নিয়েছিল তাই আমার রং করা দেহখানি ভালভাবে না দেখেই একটি সনদ দিয়ে

দিয়েছিল, তারপর আবার প্রদেয় সনদের শর্ত ভঙ্গ করার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়ে

মালিক-মাহজন যে বোঝা চাপাইছে, তাতে আর আপনাকে বোধহয় ওপারে নিতে

পারলাম না। কেমন জানি মনে হচ্ছে, মনে হয় আপনার সাথে এ দেখাই শেষ দেখা।



যাত্রী : আপনার সাথে এত কথা বললাম আর কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আপনি জীবন

বাঁচানোর জন্য কিছু দিবেন না? দিয়েন আমি তো সবই বললাম। বউ-ছেলে-মেয়ে

আমাকে ছাড়া একদিনও বাচবে না, আমি পদ্মায় বুকে মরলে তারা পদ্মার পানে

হাঁটা ধরবে পদ্মার বুক চিরে আমাকে হয় বের করে নিয়ে যেতে চাইবে অথবা

তারাও আমার স্মরনে সলিল সমাধিস্ত হতে চাইবে।



লঞ্চ : দিব কি ভাই যা আছে তা নির্ধারিত ৯০ জন যাত্রীর জন্যেও যথেষ্ট নয়। ওগুলোর

দাম নাকি অনেক তাই কম পয়সার জীবন বাঁচাতে ওগুলো বেশী রাখতে মানা, যা

আছে তা সংগ্রহ করতে গেলে আরও অবস্থা খারাপ মারামারি করে ছিনিয়ে নিতে

হবে না পেলে সলিল সমাধিস্ত হওয়ার আগেই কিল ঘুষিতে মরতে হবে।



যাত্রী : আপনে যেভাবে বলছেন তাতে তো মনে হয় বউ-ছেলে-মেয়ের মুখ আর দেখা হবে

না।



লঞ্চ : হ্যাঁ ভাই কেমন জানি মনে হচ্ছে, মনে হয়ে ডানদিকে দিয়ে ঢেউয়ের প্রকোপে পানি

উঠে গেছে, হ্যা তাইতো আমি তো ডুবে যাচ্ছি। ভাই সাঁতার জানলে সাঁতরানোর

চেষ্টা করেন, না হয় মরণের জন্য প্রস্তুত হন।



যাত্রী : ভাই সাঁতারতো জানি, কিন্তু এই পদ্মায় কি আমার সাঁতারের মত অবস্থা আছে।



লঞ্চ : তাহলে ভাই বিদায়...............। আর দেখা হবে না, যারা আপনার পুর্বসূরী ছিল

তাদের সাথে তারাতাড়ি মোলাকাত করেন, যান বিদায়...............



যাত্রী : আমার বউ এর ভাই সরকারী দল করে আমি মরলে তোমার মালিককে সে ছাড়বে

না। সে তাকে জেলের ভাত খাওয়াবেই নিশ্চিত যাবৎ জীবন এমনও হতে পারে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ।



লঞ্চ : না ভাই কিছুই হবে না, শুধু আপনি কেন? আপনার মত আর দুইশ জন মরলেও

বড়জোড় একটা তদন্ত কমিটি, তারপর প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিল অথবা জেলা

প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু অনুদান তাও ঠিকভাবে পরিবার পরিজনেরা পাবে কিনা

সন্দেহ আছে? অবশ্য আপনাদের সলিল সমাধি হওয়ার সেই পূণ্যময় জলের ঠিকানা

খুজতে অনেক নেতা-মন্ত্রী আসবেন, সান্তনা দেবেন আবার চলে যাবেন।



আমার মালিক-মহাজনের কোন ক্ষতিই হবে না, কারন আমি লোহার তৈরি, আমার কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নষ্ট হবে না, আমি যেমন আছি তেমন থাকব শুধু কিছু সময় জলের তলে থাকব, আমারে বাচাতেঁ তথা মালিক-মহাজনের সম্পদ বাঁচাতে আসবে আমাদের বড় দুই বড় ভাই রুস্তম আর হামজা। তবে আপনাদের বাচাতে কেউ আসবে কিনা জানি না, তবে কেউ সাহস নিয়ে জলে নামলে আপনার পকেটে কিছু আছে কিনা তা আগে দেখবে তারপর চিন্তা করবে জলে ছাড়বে নাকি ডাঙ্গায় তুলবে, ভাববে ডাঙ্গায় তুললে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে-বাড়লে সরকারের ক্ষতি কারন আপনার বউ-ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু অনুদান রাখতে হবে।



অবশেষে আপনি মালিক-মহাজনকে আগ্রিম টাকা দিয়ে মৃত্যুর যে টিকেট কিনেছেন, তার পূর্ণতা পাবে। আপনার জন্য মালিক-মহাজনের চিন্তার কিছু নেই কারন আপনার কাছে তাদের কোন পাওনা নেই।



কিছুদিন পর যখন তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিবে রিপোর্টে লেখা থাকবে, অতিরিক্ত যাত্রীই লঞ্চ ডুবির প্রধান কারণ- যাত্রীরা জোরপূর্বক অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যাত্রা করতে লঞ্চের চালক ও সহকারী কে বাধ্য করেছে- আর যদি চালক চলে যায় পর পাড়ে তবে লেখা থাকবে চালকের ভুলেই বা গাফিলতিতে লঞ্চটি ডুবেছে। যেন মৃত্যুর পরেও চালক ও যাত্রীকে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করে মালিক-মহাজনকে রক্ষার চেষ্টা, আর এ চেষ্টাই স্বাভাবিক কারণ যারা তদন্ত কমিটির সদস্য থাকবে তারা তো মালিক-মহাজনদের আর্শীবাদপুষ্ট।



বিদায় ভাই ---- আর দেখা হবে না শেষ বিদায়। দোয়া করি আপনার বউ-ছেলে-মেয়ে আপনার লাশটি যেন ফিরে পায়। আপনার মুখটি যেন শেষবারের মত দেখতে পায়।



অভিষাপ রইল আমার মালিক-মহাজন আর নির্বোধ প্রশাসনের উপর যারা আপনার মৃত্যর জন্য দায়ী------------

বিদায়--- বিদায়--------







(কাল্পনিক)-কাউকে কটাক্ষ করা জন্য নয়, আমরা সবাই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।

গতকালের লঞ্চডুবিতে যারা প্রান হারিয়েছে তাদের সবার মাগফেরাত কামনা করছি ও আত্মীয়-পরিজন সবাই যেন ধৈর্য ধারণ করতে পারে সেই শক্তি দেওয়ার জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছি।







এম আলম তারেক

০৫/০৮/২০১৪

‍‍‍

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.