নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবনাকে লালন করি স্বদেশি হাওয়ায়

মাজহার পিন্টু

একজন মানুষ

মাজহার পিন্টু › বিস্তারিত পোস্টঃ

আয়না ও অবশিষ্ট

১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:১৩


পুরনো আদল রেখেই বাড়িটার নতুন রূপ দিয়েছে আহীর আহমেদ চৌধুরী। নতুন এ বাড়ির দ্বার উদ্ঘাটন হচ্ছে তারই একমাত্র সন্তান মিহির আহমেদ চৌধুরীর মধুচন্দ্রিমার ভেতর দিয়ে। বাড়ির আবহটা একটুও বদলাতে দেননি আহীর চৌধুরী । সারাদিন হৈ চৈ আনন্দ অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে কেটে যায় মিহির এবং শাওনের। রাতের বেলা খাওয়াদাওয়ার পর আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা একে একে বিদায় নেন। থেকে যায় মিহিরের দুই বন্ধু জাহিদ আর পলীন। শাওন অনেক ক্লান্ত বলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। বাকীরা গেস্টরূমে চলে যায় আড্ডা দেবে বলে।
বাইরে তখন ভরা পূর্নিমা। পূর্নিমার আলোয় বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরী বাড়িটাকে রহস্যময় মনে হয়। হঠাৎ করেই একটা ধেঁায়ার কুন্ডলিকে দেখা যায় বাড়িটার দিকে এগিয়ে যেতে। কয়েকটা কুকুর সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে। আড্ডা দিতে দিতে ঘুমে ঢলে এদিক ওদিক পড়ে আছে মিহির, জাহিদ আর পলীন। রাত বারোটার ঘন্টা শোনা যায়। একটা ব্লাড হাউন্ডকে দেখা যায় বাড়ির আঙিনায় পাহারা দিচ্ছে অদৃশ্য কেউ কুকুরের বেল্ট ধরে আছে। সাদা বাড়িটার চারপাশ ঘিরে ধেঁায়ার আস্তরন।
শাওন রাতের পোষাক পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে থমকে যায়। আয়নায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চোখ কচ্লে বোঝার চেষ্টা করে, একই ঘটনা ঘটে। ভাবে, পুরনো দিনের জিনিস। হয়তো কোনো কারসাজি আছে। আয়নাটাকে ঘুরে ঘুরে দেখে কিন্তু কিছুই খঁুজে পায় না। শাওন আর কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে। আয়নার ভেতর থেকে একটা ধেঁায়ার কুন্ডলি বেরিয়ে আসে। খাটের চারপাশটা ঘুরে বেরিয়ে যায়।
মিহিররা ঘুমে অচেতন। দরজার বাইরে কেউ একজন টোকা দেয় বেশ কয়েকবার। মিহিররা কোনো সাড়া দেয় না। দরজার বাইরে কারো হাসির শব্দ মিলিয়ে যায়।
শুয়ে শুয়ে ভাবছে শাওন, কি বিশাল বড়লোক মিহিররা। নতুন সংসার কীভাবে সাজাবে। হঠাৎ করেই তার কানে আসে ভায়োলিনের শব্দ। দুর থেকে ভেসে আসছে। শাওনের ভেতর কেমন একটা নেশা তৈরি হয়। দরজা খুলে বেরিয়ে যায় সে। প্যাসেজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে খঁুজতে থাকে শব্দের উৎস। একসময় একটা আধখোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দেখে একজন সাদা পোষাক পরা লোক, চেয়ারে বসে ভায়োলিন বাজাচ্ছে। লোকটা তাঁর দিকে পেছন ফিরে বসে। হঠাৎ করেই ভায়োলিন বাজানো বন্ধ করে দেয় লোকটা। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় শাওনের শরীরে। লোকটা ঘুরে তাকায় দরজার দিকে। শাওন লোকটার চেহারার দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। মিহির! মিহিরের চোখ দু’টো জ্বলছে! এগিয়ে আসতে থাকে শাওনের দিকে। শাওন ঘুরে দৌড় দিতে যাবে, দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে বীভৎস চেহারার মিহির। চিৎকার করে ওঠে শাওন। শাওনের চিৎকারে উঠে বসে মিহির। দেখে বন্ধুরা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। চিৎকারের প্রতিধ্বনি ভেসে আসে। শাওনের রূমের দিকে দৌড়ায় মিহির। রূমে ঢুকে দেখে শাওন নেই। এতবড় বাড়িতে ওরা ছাড়া কেউ তো নেই। সবাই থাকে বাইরের বাড়িতে। মিহির শাওনকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে যায়। খঁুজতে খঁুজতে শাওনকে অচেতন অবস্থায় সিড়ির ওপর পড়ে থাকতে দেখে। তাড়াতাড়ি ঘরে এনে শুইয়ে দেয় শাওনকে।
সকালবেলা ঘটনা শুনে কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। সবাই বলে ঘুমের ঘোরে নিশ্চয়ই এসব দেখেছে। কিন্তু শাওন কিছুতেই ভুলতে পারে না গত রাতের কথা। একটু পর পরই শাওন তাকিয়ে থাকে মিহিরের দিকে। শাওন আর এক মূহুর্ত এ বাড়িতে থাকতে চায় না। মিহির বোঝানোর চেষ্টা করে। এখন চলে গেলে সবাই অন্যরকম ভাববে। সুতরাং আর কয়েকটা দিন থাকতেই হবে। মিহির আশ্বস্ত করে যে, সে সারাক্ষণ শাওনের সাথেই থাকবে।
সেদিন আর বেশি রাত না করে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ে ওরা। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় মিহিরের। দেখে শাওন বিছানায় নেই। ডেকেও সাড়া না পেয়ে দরজা খুলে বেরোয়। কোথাও থেকে ভায়োলিনের সুর ভেসে আসছে। সেদিক লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় মিহির।
কিছুদুর হেঁটে যাবার পর মিহিরের চোখে পড়ে একটা আধখোলা দরজা। দরজাটা খোলার সাথে সাথে একটা দমকা বাতাস তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে চলে যায়। উঠে দেখে ঘরের ভেতর একজন ভায়োলিন বাজাচ্ছে আর শাওন বসে বসে শুনছে। মোহাবিষ্টের মত এগিয়ে যেতে থাকে মিহির। শাওন ওকে দেখে মিষ্টি হাসি দেয়। লোকটা ওর দিকে ঘুরে তাকাতে স্থির হয়ে যায় মিহির। তারই আরেক রূপ। জ্ঞান হারায় সে। ভোরবেলা জ্ঞান ফিরলে দেখে কড়িকাঠে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে আছে শাওন। বাড়ির কাজের লোকেরা এসে ওকে উদ্ধার করে।
শাওনের দেহ এনে রাখা হয় ওর ঘরে। কি করবে শাওন বুঝে উঠতে পারে না। আয়নার দিকে চোখ পড়তেই তার মনে হলো আয়নার ভেতর থেকে সাদা শাড়ি পরা একটি মেয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। চোখের ভুল বলে মনে হলেও মিহির ভুলতে পারে না ব্যাপারটা। সে আয়নাটা ভালো করে দেখে। না কোনো বেখাপ্পা কিছু চোখে পড়ে না।
আহীর আহমেদ চৌধুরী এসে শাওনের কবর দেবার ব্যবস্থা করেন। সব শুনে তিনি বলেন তাদের বংশে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল বহু বছর আগে। প্রেমের বলি হয়েছিল এ বাড়িরই নতুন বউ। তার নামও ছিল শাওন। আর ছেলেটিরও নাম ছিল মিহির। কিন্তু আহীর আহমেদ চৌধুরী এসব বিশ্বাস করেন না তাই এমন কোনো ঘটনা ঘটবে সে বুঝতে পারেনি। তিনি ছেলেকে তাড়া দেন এ বাড়ি থেকে চলে যেতে। মনে হচ্ছে এখানে আরো বিপদ অপেক্ষা করছে। আহীর চৌধুরী কাজ শেষ করে চলে যান। বাড়ির কাজের লোকেরাও বলে বাইরের বাড়িতে থাকতে। কারণ তারাও কোনোদিন ভয়ে এর ভেতর ঢোকে না। মিহির কোনো উত্তর দেয় না।
কি কারণে এমন হোলো ভাবকে ভাবতে বাড়ির ঘরগুলো ঘুরে দেখে মিহির। একটি ঘরে ঢুকতেই দরজাটা আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যায়। দমকা বাতাস এসে মিহিরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চায়। অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসে মিহির। বেরিয়ে আসতেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। পকেট থেকে ম্যাচ বের করে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে কিন্তু বাতাস এসে আগুন নিভিয়ে দেয়। সাহসী মিহির গায়ের জামা খুলে আগুন জ্বালায়। বাতাসটা বন্ধ হয়ে যায়।
নিজের ঘরে কোনোরকমে ঢোকে সে। ভাবে মিহির কি ঘটে গেল। সিদ্ধান্ত নেয় এর শেষ না দেখে সে যাবে না। বাড়ির পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে শুরু করে মিহির। অনেক খঁুজে সে একটি ছোট্ট বই খঁুজে বের করে যাতে এই বাড়ির ইতিহাস লেখা আছে।
রাতের বেলা শাওনের কথা মনে করে খুবই কষ্ট পায় মিহির। একসময় বইটা খুলে পড়তে থাকে। বইয়ের লেখক এই বংশের এক সাধু পুরুষ হাশেম চৌধুরী। তার ভাষ্য মতে, এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতার বড় ছেলে মিহির মুস্তাফি প্রেম করে বিয়ে করেছিল শাওন নামে এক দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে কিন্তু মিহির মুস্তাফির বাবা বংশ মর্যাদার কারণে বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি। একদিন গোপনে মেয়েটিকে হত্যা করে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় মুস্তাফির বাবা। পরবর্তীতে লাশটা আর সে খঁুজে পায় না। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মুস্তাফিও খুন হন বাবার হাতে। মুস্তাফির বাবাও নিহত হন নিজের ভাইয়ের হাতে। তারপরই এ বাড়ি থেকে বসবাস উঠে যায় ওদের পরিবারের। হাশেম চৌধুরী এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বলা আছে যে, দামী আয়নাটার এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। আর এই কোনো একসময় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
মুস্তাফি ভালোবেসে শাওনকে বার্মা থেকে এনে একটি দামী ড্রেসিং টেবিল উপহার দিয়েছিল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা ছিল শাওনের খুবই প্রিয়। মিহিরের চট করে মনে পড়ে যায় দিনের বেলা আয়নার ভেতর থেকে আবছা ছায়ার মত একটা মেয়েকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। তখন ভেবেছিল চোখের ভুল। মিহির প্রচন্ড রাগে দ্রুত উঠে চলে যায় সেই ঘরে যেখানে আয়নাটা আছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারে না। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। জোরে ধাক্কা দিতে থাকে দরজায়। হঠাৎ করেই দরজাটা খুলে যায়। উপুড় হয়ে ঘরের ভেতর পড়ে মিহির। দরজাটা আবার আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়।
আয়নাটা থর থর করে কাঁপতে থাকে। অদৃশ্য একটা কিছু মিহিরকে টানতে থাকে আয়নার দিকে। একসময় টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। আবার সব স্বাভাবিক।
পরদিন আহীর আহমেদ চৌধুরী এসে খেঁাজ করেন মিহিরের। কিন্তু কোথাও তাকে খঁুজে পাওয়া যায় না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দেন। ভেতর থেকে ভেসে আসে শাওনের আর্তনাদ, মিহিরের আর্তনাদ। কুকুরের কান্না, বাতাসের শব্দ। #

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.