নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবনাকে লালন করি স্বদেশি হাওয়ায়

মাজহার পিন্টু

একজন মানুষ

মাজহার পিন্টু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশ পুলিশের অন্তরচিত্র

২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:১৪



এই লেখাটি আমার সদ্য প্রয়াত মেঝভাই সাংবাদিক মনজুরুণ হকের। গত বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পিসি ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ করেই চোখে পড়লো লেখাটি। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যৌক্তিক মনে হলো তাই প্রকাশ করলাম। লেখাটি সম্ভবত কয়েক বছর আগের।..............

একটি অনুসন্ধানী গবেষণাপত্র
বৃটিশ দ্বৈতনীতিতে আবদ্ধ বাংলাদেশ পুলিশ: দরকার ব্যাপক পরিবর্তন

বাংলাদেশ পুলিশের অন্তরচিত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৫ বছর পার হয়ে গেছে। অর্থাৎ ৭১ এ যে জন্মগ্রহন করেছে সে এখন পরিপূর্ণ মানুষ। বাংলাদেশ এখন দ্রত উন্নয়নশীল দেশের তালিকার প্রথম দিকে। নেই নেই করেও অনেক কিছুর উন্নয়ন হয়েছে এখানে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যাদের উন্নয়নটা জরুরী ছিলো, সেই পুলিশ বাহিনীর তেমন কিছূ উন্নয়ন আজ অবধি হয়নি। পুলিশ বাহিনীতে বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ত্রæটি ও সমস্যা বৃটিশ আমল থেকে আরম্ভ হয়ে অদ্যাবধি বিরাজ করছে। প্রধানতঃ রাজনৈতিক দৈন্যতা, প্রশাসনিক অব্যবস্থা, আমলাদের দলাদলি, সরকারি চাকুরীজীবিদের সততার অভাব, ঢিলামী, উদাসীনতা ইত্যাদির কারণে পুলিশ অবকাঠামোর ভিতরে যুগ যুগ ধরে সমস্যাগুলো বিদ্যমান রয়ে গেছে। কোন সমস্যা নিরসনের প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথমে মনে হয় টাকা-পয়সার কথা। বিশাল বাজেট তৈরি করতে হবে, বাজেটের তহবিল কোথা থেকে আসবে এমন নানান চিন্তা এসে ভর করে অথচ বাংলাদেশ পুলিশের মরচে পড়া অবকাঠামোর এসব পরিবর্তনে আসলে বিরাট তহবিল বা বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় তেমন প্রয়োজন নেই। সমস্যাগুলো মূলতঃ পুলিশ বিভাগের একান্তই নিজস্ব সমস্যা, তবে অবশ্যই সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এর সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে সম্পৃক্ত। একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই যদি স্বয়ংসম্পূর্ণতা না থাকে তাহলে আইনের শাসন চলবে কি করে? তাই এর দ্রæত সমাধান চাইলে সরকারী বেসরকারী সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতা একান্ত প্রয়োজন। সময় এগিয়ে চলেছে প্রতিটি পলকে। জীবনযাপনের ছন্দে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে সারা দুনিয়া জুড়ে। প্রতিটি সেক্টরে ইনফর্মেশন টেকনোলজির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ইলেট্রনিক্সের বিস্ময়কর সম্ভাবনা, দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞানের এই যুগ্ম সাফল্য। আমরা এখন সাইবার জগতের বাসিন্দা। জীবন আজ ডিজিটাল চমকে স্পন্দিত। অথচ বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগের শতাব্দী প্রাচীন সমস্যাগুলো এখনো সমান প্রকট রয়ে গেছে। এসব সমস্যা দেখেও আমরা ভান করছি না দেখার। বৃটিশদের ফেলে যাওয়া আইনের “শ্বেত-কংকাল” দিয়ে সময় উপযোগী উন্নয়ন বা প্রায় আমূল পরিবর্তন কষ্টসাধ্য। দেশে শিক্ষিতের হার সামান্য হলেও সাধারণ মানুষ এখন সকল বিষয়ে খবর রাখে। এ বিষয়ে তারাও সোচ্চার। পুলিশ সংস্কার আইন করার জন্য এবার ব্যাপকভাবে জনগণের মতামত নেয়া হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে জনগণ কিভাবে পুলিশকে দেখতে চায় তার রূপরেখা। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অনেক সময় “ডান্ডা” ব্যবহার করা হয়। এতে দ্রুত ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তবে প্রয়োগটা যাতে যথোপযুক্ত হয় সে জন্যে যাদের মাধ্যমে “ডান্ডা প্রয়োগ” করা হবে তাদের প্রথমে সে কাজের জন্য উপযুক্ত করে নেয়া উচিৎ বলে পুলিশ সদস্যসহ বহু সাধারণ মানুষ মতামত দিয়েছেন।
পুলিশ সিস্টেমের ভেতরে জমে থাকা দীর্ঘকালের এই সমস্ত অনিয়ম, পেশাগত বা বিভাগীয় বঞ্চনা, বৈষম্য, অমর্যাদা, হতাশা ইত্যাদি প্রশমনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া বিকল্প পথ আপাততঃ দেখা যাচ্ছে না। যে কোনো আংশিক উন্নয়ন তেমন টেকসই বা ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে এ কথাটা আমাদের সবারই মনে রাখা উচিৎ। দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখে গেছে, অধিকাংশ পুলিশই সৎ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে আগ্রহী। সামান্য কিছু পুলিশ সদস্য পুরো বাহিনীর সুনাম নষ্ট করছে। বিভাগীয় কিছু পরিবর্তন এবং সাধারণ (পড়সসড়হ) কিছু চাহিদা (নিরুপায় পুলিশ বলছে “দাবী") পূরণ করা গেলে নিজ পেশার প্রতি তারা আরো শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্ববান হতে পারে। শুধুমাত্র সরকারি চাকুরীজীবি নয় তাদের যোগ্য ও উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে “রাষ্ট্রীয় কর্মী” হিসাবে মর্যাদা দিয়ে।

ফল্ ইন
ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলোর মধ্যে পুলিশ অন্যতম। তাদের কাজ করতে হয় রাতদিন ২৪ ঘন্টা। সরকারি অন্য কোনো বিভাগে ২৪ঘন্টা কাজ করার উদাহরণ নেই। দুই ঈদসহ সরকারি গেজেটে উল্লেখিত কোনো ছুটি পর্যন্ত তাদের দেয়া হয় না। জরুরী অবস্থা অথবা জাতীয় আপৎকালীন সময় ব্যতীত সামরিক বাহিনীগুলোতেও এভাবে পরিশ্রমের নজির দেখা যায় না। বিশেষ-সেবা হিসেবে পরিগণিত বিদ্যুৎ, গ্যাস, হাসপাতাল, রেডিও-টেলিভিশন এবং অন্যান্য বিভাগে অন্ততঃ শিফটের ব্যবস্থা আছে। আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ শ্রম আইন নির্ধারণ করে দিয়েছে কোন পেশায় “ডিউটি আওয়ার” কত ঘন্টা হবে। অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য ওভারটাইম অ্যালাউন্স দেয়ার বিধান আছে। পুলিশের ক্ষেত্রে যা কখনো কার্যকর করা হয়নি। তিনগুন অতিরিক্ত কাজের জন্য কমপক্ষে দ্বিগুন আর্থিক সুবিধা তাদের পাওয়া উচিৎ। বরাদ্দ না থাকায় সরকারি কাজের বাড়তি খরচ তারা “ম্যানেজ” করে চালাচ্ছে। পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা ও আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে তাদের মধ্যে অবৈধভাবে টাকা কামানোর প্রবণতা স্বভাবতঃ কমে আসবে। ফলে, তারা “পাবলিক ম্যানেজমেন্ট” আর “ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ম্যানেজমেন্ট” বাদ দিয়ে চোর-ডাকাত, সন্ত্রাসী ও জঙ্গী ধরার প্রচুর সময় হাতে পাবে। নিজেদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে চিন্তাশীল পুলিশদের ধারণা যুক্তিসংগত পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে জনসাধারণের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে ইতিবাচক ও সহানুভূতিশীল মনোভাব গড়ে উঠবে, যা বর্তমানে অনুপস্থিত। মর্যাদা কোনো ভোগ্য সামগ্রী নয়। জ্ঞান হবার পর পুলিশ সম্বন্ধে আমরা ভালো কথা কমই শুনে আসছি। সাধারণ মানুষের ধারণা-আমাদের দেশে পুলিশ হচ্ছে, খামোখা হম্বিতম্বি করা মলিন ইউনিফর্ম পরিহিত অন্য ধরণের আশরাফুল মখলুকাৎ। যারা তুচ্ছ ব্যাপারেও মানুষকে বিরক্ত করে, গালমন্দ করে, মারধর করে। আইনের অপপ্রয়োগ করে. আইনের অন্ধ চক্ষুর সুযোগ নিয়ে অনবরত ঘুষ খায়। আবার ক্রিমিনালদের অধিকাংশের কাছে যারা বন্ধুপ্রতিম; আত্মীয়ের মতো। পুলিশ চরিত্রের দূর্দশার এই স্থিরচিত্র দু’চার দিনে নির্মিত হয়নি। বৃটিশ আমলে প্রবর্তিত আইনের দুইমুখো নীতি না বদলানোর ফলে পুলিশের বর্তমান এই প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়েছে। বৃটিশদের পরে পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনা-জুলুম আমরা পার হয়ে এসেছি। স্বাধীনতা অর্জনকারী মহান জাতি পরিচয়ে বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়েছি। কত বড় বড় পরিবর্তন। তবে পুলিশের ইমেজে পরিবর্তন হয়নি কেন? প্রধান কারণ, পুলিশের সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় আজো উপনিবেশ আমলের মানসিকতা জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে আছে। বৃটিশরা আর এদেশে নেই কিন্তু তাদের প্রবর্তিত আইন-কানুনসমূহ সংশোধন ও পরিবর্তন না করে আজো আমরা ব্যবহার করে যাচ্ছি নির্দ্বিধায়। আধুনিকায়ন বলতে শত শত কোটি টাকার যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি আর সাজসরঞ্জাম কিনে দিলেই হবে না। গাড়িগুলোতে চড়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে যারা দায়িত্ব পালন করবে তাদের সমস্যগুলো আগে দূর করতে হবে। আবার খালি বক্তৃতা দিলে হবে না। অঙ্গীকার করা চালিয়ে গেলাম, কাজের কাজ কিছুই করা হলো না- অভাবে পরিবর্তন বা উন্নয়ন অসম্ভব। স¤প্রতি সকল পদ মর্যাদার সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। বাজার দর তুলনা করলে তারপরও পরিশ্রমের বিপরীতে একজন পুলিশম্যান’এর বেতন কমই হয়ে যায়। তাদের মধ্যে কে/কারা কিভাবে সম্পদ গড়েছে বা ঘুষ নিচ্ছে সেই হিসাব এখানে ধরা হচ্ছে না। সে হিসাব স্বতন্ত্র। কিছু সংখ্যক পুলিশ ঘুষের টাকায় বাড়ি-গাড়ি করেছে, কিন্তু সবাই নয়। এমন পুলিশ কত আছে যারা কষ্টেসৃষ্টে জীবন পার করছে। তাদের অনেক সময় ধারকর্জ করে, আত্মীয়স্বজনের সাহায্য নিয়ে সংসার চালাতে হয়। এমন সদস্যদের সংখ্যাই পুলিশে বেশী। এসকল বিষয় বিবেচনায় রেখে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিৎ ।
বহু বছর হলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাধীনতার গোলামী থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। অনেক দীর্ঘ এই সময়সীমা। অথচ পুলিশ বাহিনী স্বাধীনতার সুফল থেকে আজও বঞ্চিত রয়ে গেছে। আমাদের মতে গরিব দেশগুলোতে পুলিশকে কর্তব্য পালন করতে হয় নানাবিধ চাপের মোকাবেলা করে। অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক চাপ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিজনিত চাপ, বিভাগীয় বিভিন্ন লেভেলের চাপসহ রয়েছে নানান প্রকার চাপ। পুলিশের দুর্নীতের জন্য এসমস্ত চাপ কম দায়ী নয়। এত ধরণের চাপ পড়ে পুলিশরা তাদের “সেবাধর্ম” সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। পুলিশ সিস্টেমের কাঠামো ও অন্যান্য পরিবর্তনের পরিকল্পনা স্বাধীনবাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের ছিলো। তিনি বলেওছিলেন, “ তোরা কাজ করে যা, একদিন তোরাই এই দেশে আই জি-ডি আইজি হবি। এইসব পোস্ট এতদিন বিদেশী বৃটিশ আর পাঞ্জাবিরা দখল করে রাখতো। আমরা তাদের চিরদিনের জন্য বিদায় দিয়েছি, তাদের প্রবর্তিত বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থাকেও সময় মতো গুডবাই জানানো হবে। “বঙ্গবন্ধু থাকলে এসব পরিবর্তন অনেক আগেই ঘটতো।

মার্ক-টাইম
পুলিশ বিভাগে বিভিন্ন উন্নয়ন-আধুনিকায়নসহ বহু আগে থেকেই অত্যাবশ্যক হয়ে আছে। বিগত টার্মগুলো কোনো সরকার ততটা গুরুত্ব দেয়নি। তাঁদের ধারণা পুলিশরা তো বেতন ছাড়াও পাবলিকের পকেট থেকে টাকা-পয়সা ভালোই নিচ্ছে। সরকারিভাবে আবার আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর কি দরকার? উপর মহলের এ ধরণের মনোভাবের ফলে বিভিন্ন পদমর্যাদাার কিছু পুলিশ সদস্য বাড়তি টাকার জন্য যে সমস্ত কাজ করে বেড়াচ্ছে তার বিস্তারিত উল্লেখ সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য লজ্জাস্কর, হতাশাজনক। অজুহাত যা-ই দেখানো হোক না কেন-এই ব্যর্থতার দায়ভার অতীতের সকল সরকারের। বিগত মেয়াদের সরকারগুলো পুলিশের আইন ও অবকাঠামো সংশোধন ও পরিবর্তন করে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগের অবনতি ঠেকাতে পারতো।
জাতিসংঘ মিশন ফেরত পুলিশদের কাছে জানা যায়, তাঁরা সম্মান পান বিদেশের মাটিতে। দেশে কেন পান না? এক্ষেত্রে বিদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেইসব দেশে বাজারদরের তুলনায় বিরাট অংকের বেতন দেয়া হয় পুলিশদের এবং তাদের আইনগত কাজে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করা হয় না। আমাদের দেশে চিত্র সম্পূর্ণ এর বিপরীত। পুলিশ বিভাগে লক্ষ্য করলে দেখা যায়-তাদের ভেতরে উপরে উঠার যোগ্যতা দক্ষতা মেধা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। উন্নতির স্বপ্ন আশাও কম, কারণ সেই পরিবেশ অনুপস্থিত। স্বপ্নহীন, আশাহত মানুষ মৃতদেহের সমত‚ল্য। পেশাগত কাজে উন্নতির হাতছানি থাকলে “দুইনম্বরি’ কাজকর্মের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা এমনিতেই থাকে না। নিয়মিত প্রমোশন এবং প্রমোশনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বজায় রাখা গেলে টাকা-পয়সার প্রতি বর্তমানের ঝোঁক বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
বৃটিশরা নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আইন-কানুন তৈরি করে গেছে। আমাদের ভালো-মন্দ তারা বিবেচনা করে নাই। উপনিবেশিক আমল শেষে পাকিস্তান আমলে সাবেক আইনগুলো ছিলো অপরিবর্তিত। স্বাধীনতা অর্জনের পর সার্বভৌম বাংলাদেশ আমলেও তার রদবদল সামান্যই হয়েছে। সময়ের চাহিদা মতো আপটুডেট হয়নি। বৃটিশ আমলে ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের যেরূপ পার্থক্য ছিলো, অতঃপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাঙ্গালীদের যেমন পার্থক্য ছিলো-পুলিশ বিভাগের সর্বত্র এখনো একই রকম পার্থক্য ও বৈষম্য বিরাজ করছে। বদল হয়েছে শুধুমাত্র ব্যক্তি পরিচয়। ইংরেজ আর পাঞ্জাবি-পাঠান সাহেবদের জায়গায় এসেছিল বাঙ্গালি সাহেব। চিন্তাধারা বা দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটেনি। আজকের দিনে আমরা যে একই দেশের নাগরিক তা চোখ-কান বুজে ভুলে থাকার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। একই দেশের একই জাতির মানুষ নিয়ে গঠিত একটি বাহিনীর সহকর্মীদের পরস্পরের মধ্যে এত বেশী মানসিক দূরত্ব ও অর্থনৈতিক পার্থক্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য বিরাট ত্রæটি। অবশ্য বৃটিশের ফেলে যাওয়া আইনসমূহ কোরআনের আয়াত নয় যে, পরিবর্তন করা যাবে না। বরং করা যাবে। করা উচিত। যদিও তাদের সমস্যা অন্তহীন মনে হয় তারপরও সহজে সমাধানযোগ্য কিছু বিভাগীয় সমস্যার প্রতি লক্ষ্য করা যাক।
ব্যক্তিগত মতামত ব্যতিরেকে এগুলো তুলে ধরা হলো :

এএসপি নিয়োগ পদ্ধতির গলদ
উপনিবেশিক আমলে প্রবর্তিত এএসপি নিয়োগ এবং ইন্সপেক্টর হতে পদোন্নতির আনুপাতিক হার (রেশিও) সংশোধন দরকার। বর্তমানে এএসপি পদে ৬৭% সরাসরি নিয়োগ করা হয়, বাকি ৩৩% পুলিশের ইন্সপেক্টর থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। এতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ অফিসারদের উর্দ্ধতন পদ লাভের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে যা খুব হতাশাব্যঞ্জক। সরাসরি এএসপি পদে ভর্তিকৃতরা চাকরির শুরুতেই বিরাট অহংবোধ নিয়ে সার্ভিসে প্রবেশ করে। তারা বাইরের লোক নয়। আমাদের দেশেরই মানুষ। তাদের কোন দোষ নেই। এর জন্য দায়ী বৃটিশ আমলে চালু করা নিয়োগ প্রক্রিয়া, যা বর্তমানেও বিদ্যমান। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এধরণের কালা-কানুন এদেশে প্রবর্তন করা হয়েছে। স্বাধীন দেশের জন্য এই আইন অবাস্তব ও যুক্তিহীন। উপরের লেভেলের কর্মকর্তারা সরকারি হুকুম পৌঁছে দেয় মাত্র। সে হুকুম বাস্তবায়ন করে ইন্সপেক্টরসহ নিচের দিকে থাকা অন্যান্য সদস্যরা। যারা মাঠ পর্যায়ে মানুষের মাঝখানে থেকে কর্তব্য সম্পাদন করে থাকে। বৃটিশ আমলে ৬৭% আসতো ইংরেজদের মধ্য থেকে ৩৩% নেয়া হতো এদেশ থেকে। এই পদ্ধতিতে নিয়োগ দিতে গিয়ে একই বাহিনীর সদস্যদের দুইটি আলাদা শ্রেণীতে বিভক্ত করে ফেলা হতো। একটি এলিট ক্লাস তৈরি করা হয়েছিলো। এলিট ক্লাসটির শেষ বংশধরেরা আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অল্প পরিমাণে হলেও এখনও টিকে আছে। অবশ্য, এই ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত দেশের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করতে পারবে না। স্বাধীন দেশের নিরিখে উপনিবেশিক নিয়মবাতিল করা সরাসরি ৫০% ও বিভাগীয়ভাবে ৫০% নিয়োগ দেয়া সমীচীন ও বাস্তবসম্মত। এতে পুলিশের কাজে গতিশীলতা বাড়বে।

জনবল স্বল্পতা ও কমিউনিটি পুলিশ
পুলিশের অন্যতম প্রধান সমস্যা পর্যাপ্ত জনবল না থাকা। যা কাজের গতি শ্লথ করে দিচ্ছে। সুযোগ পাওয়া মাত্র ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। “গুড পুলিশের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য দরকার হয়। এর আসলে বিকল্প হয় না। তবে পুলিশের পেশাগত মান উন্নত করা গেলে এ সমস্যা থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া, কমিউনিটি পুলিশকে যথাযথ প্রশিক্ষণের পর দেশব্যাপী সহায়ক বাহিনী রূপে পরিচালনা করা সম্ভব। সামান্য বেতন দিতে হলেও এটি ভালো পন্থা। কমিউনিটি পুলিশ খাতে সরকারের পরিকল্পিত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।

পুলিশ বিভাগে মেয়েরা
জনবল ঘাটতি পূরণ করতে পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি ব্যাপক হারে মেয়েদের পুলিশ বাহিনীতে ভর্তির সুযোগ বাড়াতে হবে। মেয়েরাও নারীসুলভ আচরণ বাদ রাখবে পুলিশ সদস্য হিসেবে বেতন নিতে চাইলে। প্রত্যেকের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বই প্রধান। পুরুষ বা নারী পরিচয় এক্ষেত্রে মূখ্য নয়। সবার জন্য থাকবে সমান আইন, শাস্তি ও পুরস্কার উভয়ই হবে সমান। ট্রাফিক বিভাগ এবং ইদানিং জাতিসংঘ মিশনেও মেয়েরা কাজ করছে। বাংলাদেশের সামাজিক মানদন্ড স্মরণ রেখে কর্তব্য পালন করা হলে অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। শারীরিক যোগ্যতা, মেডিক্যাল ফিটনেস, মানসিক সক্ষমতা ইত্যাদি ঠিক থাকলেই যথেষ্ট। হাইওয়েসহ পুলিশের বিভিন্ন শাখায় দায়িত্ব পেতে পারে নারী সদস্যরা।

ইন্সপেক্টর, সার্জেন্ট ও এসআইদের গেজেটে আনা
পুলিশ পরিদর্শকদের পদমর্যাদা প্রথম শ্রেণীতে উন্নিত করা নিয়ে ইতিমধ্যে সরকার ও প্রশাসনের নানান স্তরে বহু কাবজাব হয়ে গিয়েছে। ইন্সপেক্টরদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, একজন ইন্সপেক্টর থানার ইনচার্জ হিসেবে একটি উপজেলার সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। উপজেলা লেভেলের সরকারি অন্যান্য সকল দপ্তরের ইনচার্জরা প্রথম শ্রেণীর গেজেটেডভূক্ত। এই অবস্থায় অন্য অফিসারদের সঙ্গে কাজের সমন্বয় করতে ও দায়িত্ব পালেনে সমস্যা ও বাঁধা সুষ্টি হয়। জনস্বার্থে কাজের গতি সাবলিল রাখতে গেজেটেড না হোক ইন্সপেক্টরদের অন্ততঃ নন-ক্যাডার (বিসিএস বর্হিভূত) ফার্স্টক্লাস অফিসার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। সাব-ইন্সপেক্টর এবং সাব-ইন্সপেক্টর ও সার্জেন্টদের নন-ক্যাডার সেকেন্ড ক্লাস মর্যাদা দেয়া দরকার। বর্তমান প্রথম শ্রেণীভূক্ত অফিসারদের নির্ধারিত সম্মান এতে বিন্দুমাত্র কমবে না।

চিকিৎসা ভাতা
বর্তমানে দেয়া হচ্ছে চারশত টাকা। ভালো ডাক্তার দেখাতে গেলে প্রথম ভিজিট দিতে হয় ৪০০ টাকা। স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের চিকিৎসার জন্য কোনো ভাতা বরাদ্দ নেই। বিভাগীয়ভাবেও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের কাঠামোগত ব্যবস্থাও অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অনুরূপ চিকিৎসা সুবিধা পুলিশকে দেয়া যুক্তিসঙ্গত। একই সঙ্গে অন্যান্য সকল শৃংখলা বাহিনীতে কর্মরতদের স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি তার বৃদ্ধ বাবা-মা বা অসহায় সর্বোচ্চ দু’জন পোষ্যকে তার পরিবারের সদস্য গণ্য করে চিকিৎসা সহায়তা দেয়া উচিৎ। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের বয়োবৃদ্ধ নাগরিকদের সামান্য পরিমাণ হলেও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান সম্ভব।

সার্জেন্ট পদবী পরিবর্তন করা উচিত
ডেপুটি ট্রাফিক উন্সপেক্টর করা উচিত। পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে চৌকষ অংশ হচ্ছে সার্জেন্টরা।
*সার্জেন্ট ও সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদা একীভূত করা দরকার। বর্তমান আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশের এই দুই লোকদের মধ্যে অবাঞ্ছিত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
সড়কযান দুর্ঘটনায় ভিক্টিম (বাদী) দের আইনের সাহায্য পাওয়া।
**সামরিক বাহিনীর বিশেষতঃ সেনাবাহিনীতে হাবিলদার ব্যাজ সার্জেন্ট করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়েছে।
*পুলিশ বাহিনীর সার্জেন্ট আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্য অপরদিকে আর্মি সার্জেন্ট সামরিক বাহিনীর সদস্য।

ট্রাফিক সার্জেন্টদের পদমর্যাদা প্রসঙ্গে
(ডেপুটি ট্রাফিক ইন্সপেক্টর হিসাবে পদায়ন করা যায়) “পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে চৌকস হচ্ছে ট্রাফিক সার্জেন্টরা। মন্তব্য করেছেন অনেক কর্তব্যরত অনেক সার্জেন্ট।” ২২/২৪ বছর ধরে সার্জেন্ট হিসাবেই চাকুরী করছেন, একধাপ প্রমোশন পর্যন্ত হয়নি। ”সরকারের এদিকে নজর দেয়া উচিত ।

আবাসন সমস্যা
থানা বা ফাঁড়ির এলাকার ভেতরে বা আশেপাশে নিজস্ব কিছু কোয়ার্টারস থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশেষতঃ থানার ইনচার্জদের জন্য মানসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা থানা কম্পাউন্ডে রাখা উচিৎ। তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বহাল রেখে সার্বক্ষণিক কাজের জন্য এটা জরুরী।

যানবাহন সমস্যা
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য গুটিকয় মেট্রো এলাকার থানাগুলোসহ দেশের সকল পুলিশ স্টেশনে কম বেশী “এক পিস” করে গাড়ি রয়েছে। সেগুলোও বেশীর ভাগ এত পুরনো হয়েগেছে যে প্রায় সময় স্টার্ট নিতে চায় না। পাবলিক গাড়ি রিকুইজিশন করে সংশ্লিষ্টদের টহলসহ অন্যান্য কাজ চালাতে হয়। সরকারি কাজে প্রতিদিন রিকুইজিশনে গাড়ি দিতে দিতে সাধারণ মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। প্রতিটি পুলিশ ইউনিটে পর্যাপ্ত যানবাহন থাকা অতীব জরুরী। একই সঙ্গে সেগুলোর মেইটেনেন্স ও জ্বালানী সরবরাহ নিশ্চিত করা আবশ্যক। সরকারি অন্যান্য বিভাগের মতো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা বিশাল দামের গাড়িতে চড়তে পছন্দ করেন। অথচ তাঁদের অধস্তনরা গাড়ির অভাবে ডিউটি করতে পারছে না-এমন ঘটনা দেশের সর্বত্র দৃশ্যমান। বিরাট মূল্যের গাড়িতে চড়লে বা না-চড়লেও বড় কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা বা বিভাগীয় সম্মান হেরফের হয় না -এটা কেন তাদের স্মরণ থাকে না বুঝা গেলো না। এটা একটি বাজে অভ্যাস, যার পরিবর্তন আনা উচিৎ। ৬০/৭০ লক্ষ টাকা দামের গাড়ির বদলে এই টাকায় ২/৩টি ভালো মানের গাড়ি পাওয়া যায়-যা দৈনন্দিন কাজে অনেকের কাজে আসবে। এছাড়া, পুলিশ মতামত দিয়েছে যে, পুলিশের সকল প্রকার গাড়িতে তাদের নিজস্ব অফিসিয়াল কালার (রঙ) ব্যবহার করা উচিত এবং অফিসিয়াল গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহারের অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত।

টি,এ, বিল ও হোল্ডিং বিল
সরকারি কাজে অন্যত্র যাতায়াত ও অবস্থানের জন্য টিও বিল ও হোল্ডিং বিল দেয়ার নিয়ম আছে। সমস্যা হচ্ছে, এই বাবদ যে পরিমাণ টাকা দেয়া হয় তা বহু যুগ আগের টাকার মূল্যমান অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছিলো। বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগুলো প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

আপাতঃ দৃষ্টিতে দেখা যায় না
উল্লেখিত ধরণের ছোটোখাটো সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ পুলিশের অভ্যন্তরে অসন্তোষ তৈরি করে চলেছে। যা বর্তমানে চূড়ান্ত মাত্রায় অবস্থান করছে। পুলিশের একটি বড় অংশ এ ব্যাপারে চরম-ব্যবস্থা নিতে উৎসাহী । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পুলিশ বাহিনী কখনো বিদ্রোহ করে না। অন্যথায় এসমস্ত বৈষম্য-কঞ্চনা তাদের বিদ্রোহী হবার জন্য চমৎকার উপাদান হতে পারে।

সকল বাহিনীতে সমতা বিধান দরকার
দেশের সমস্ত শৃংখলা বাহিনীতে বেতন-ভাতা, আনুষাঙ্গিক ও মৌলিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা বিধান করে প্রত্যেক বাহিনীর অর্থনৈতিক ব্রবস্থা চালু করা উচিৎ। কারণ কর্মক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকল বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাজারে সকলের জন্য জিনিস পত্রের দাম একই-ভিন্ন ভিন্ন বাহিনীর লোকের জন্য আলাদা নয়। আর পদমর্যাদা ভেদে দ্রব্যমূল্য কারো জন্য কম বেশী হবার সম্ভাবনাও নেই।

পুলিশ বিভাগে নতুন শাখা দরকার
বর্তমান শাখাগুলোর পাশাপাশি স্বয়ংসম্পূর্ণ রিভার (নৌ) পুলিশ, উপক‚ল (কোষ্টাল পুলিশ), সীমান্ত (বর্ডার পুলিশ) ইত্যাদি ষাখা গঠন করা উচিত। একই সঙ্গে পর্যটন পুলিশসহ নতুন/নবতর শাখা সংগঠিত করাও প্রয়োজন। নতুন শাখাগুলোর জন্য স্বতন্ত্র কার্যপ্রণালী ও কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করে জাতীয় সংসদে বিধি পুনয়নের মাধ্যমে এসব বাস্তবাযন সম্ভব। ডিআইজি লেভেল থেকে উপরের দিকে প্রতিটি শাখা (রেঞ্জ/ডিভিশন) সদর দপ্তরের মাধ্যমে সমন্বয় করা যেতে পারে। এছাড়া, পার্বত্য বা হিল পুলিশ গঠনের মাধ্যমে আদিবাসী নাগরিক ও বাঙালিদের মধ্যে আইন প্রয়োগে সমতা বিধান করা যায়। দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে “সিক্রেট পুলিশ” কার্যক্রম চালু করা যুক্তিযুক্ত।

জাতিসংঘ মিশনে অবাঞ্ছিত তদবির
জাতিসংঘ মিশনে প্রেরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সুপারিশসহ অন্যবিধ অবৈধ তদবিরের অভিযোগ করেছে অনেক পুলিশ। তারা বর্তমানে প্রচলিত বাচাই পদ্ধতি রহিত করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। বিদেশী নির্বাচক ও পুলিশ সুপার কর্তৃক বাছাই পদ্ধতি বাদদিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কেবলমাত্র সিনিয়রিটির ভিত্তিতে টঘ মিশনে পাঠানো উচিত বলে জানিয়েছে। এত অন্যায্যভাবে কারো বাদ পড়ার আশংকা থাকবে না। সাধারণ একজন পুলিশের ককাছে জাতিসংঘ মিশনে যেতে পারা মানে বৈধভাবে এককালীন কয়েক লক্ষ টাকা একত্রে পাওয়ার সুযোগ। তাদের জীবনে এটা বিরাট ব্যাপার। এক্ষেত্রে সিনিয়রিটি লংঘিত হলে কর্মজীবনে মহাশূন্যতা সুষ্টি হয়। যা কাজের স্পৃহা নষ্ট করে থাকে। শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যতীত বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য মিশনে যাওয়ার উপযুক্ত বিবেচনা করা উচিত। এ ব্যাপারে গ্যারান্টি দেয়া যায়। ভর্তি হওয়ার সময়ই তাদের ভালোভাবে যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা করে নেয়া হয়েছে। নতুন করে বাছাইয়ের কিছু নাই। অতীতকালে তদবিরের মাধ্যমে যারা পুলিশে এসেছে তারা কিছুটা দুর্বল হতে পারে তবে তারাও অনুপযুক্ত নয়। পুলিশ ইউনিটগুলোতে কর্মরত বাবুর্চিদের (রন্ধনকর্মীদের) মিশনে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব। তবে এব্যাপারে যে কোনো বাণিজ্য সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের সজাগ ভূমিকা দরকার।

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্ট ও পিআরবি
বর্তমান সময়ের উপযোগী করে ওয়ারেন্ট অব পিসিডেন্ট সংশোধন করা প্রয়োজন। ব্যাপক ঝাড়াই-বাছাই করতে হবে বিধায় এখানে বিস্তারিত উলে­খ করা হলো না। একইভাবে পুলিশ রেগুলেশন্স অব বেঙ্গল (পিআরবি) সংশোধনের মাধ্যমে সময়ের উপযোগী করা প্রয়োজন।

পুলিশের ক্রয় বিভাগ
ইউনিফর্মের কাপড়সহ পুলিশের অনেক “ডিউটি গিয়ার” মানসম্মত নয়। ক্রয় বিভাগ সরকারি টাকার অপচয় করে নিæমানের দ্রব্যাদি কিনে থাকে-“যা পুলিশ সদস্যরা চাকরির খাতিরে বাধ্য হয়ে ব্যবহার করে। না-হলে মাগনা দিলেও ব্যবহার করতো কি-না সন্দেহ আছে।”-মন্তব্য অনেক পুলিশ সদস্যের।

ডিপার্টমেন্টাল ঘুষ
এই একটি ব্যাপারে উর্দ্ধতন ও অধঃস্তনের মিল রয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে শুরু করে নিচের দিকের প্রায় সকল কর্মকর্তা ঘুষ নিয়ে থাকে। সহকর্মীদের থেকে অবৈধ টাকার বিনিময়ে বদলীসহ অন্যান্য বিভাগীয় কাজের বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পুলিশ বিভাগে প্রচলিত গালাগালির মাত্রা
রাগের বহিঃপ্রকাশের জন্য ছোট একটা দূর্বল বাচ্চা পর্যন্ত তার জানা শব্দের মধ্য থেকে সবচেয়ে খারাপ শব্দটিকে গালি হিসাবে প্রয়োগ করে থাকে। পোকামাকড়রা পর্যন্ত আক্রান্ত হলে গালির বদলে দংশনের চেষ্টা করে। আমাদের বিভিন্ন শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহে প্রয়োজনীয় মূহুর্তে ব্যবহারের জন্য গালাগালির প্রচলন রয়েছে। তবে পুলিশ বাহিনী যেহেতু একটি সেবামূলক বিভাগ তাই তাদের ব্যবহৃত গালিরও একটি নিদিষ্ট মাত্রা থাকা প্রয়োজন। শুধু গালাগালির কারনে পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরে এবং জনসাধারনের সঙ্গে পুলিশের আজ অবধি বহু বিতিকিচ্ছি ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। নিকট অতীতে কেবল মাত্রাছাড়া গালির প্রতিশোধ নিতে গিয়ে রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় টি.আই নুরুল্লাহকে কৌশলে গাড়ি দিয়ে আঘাত করেছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনাবহনকারি কর্মীরা। এতে টি.আই সাহেবের এক হাত ভেঙ্গে গিয়েছিলো। এমন নজির আরো বহু আছে। পুলিশের ব্যাবহারের জন্য গালাগালি বরাদ্দ করা দরকার। এছাড়া পুলিশে কর্মরত বিভিন্ন র‌্যাংকের মহিলা সদস্যরা পুরুষদের অনুরুপ একই মাত্রার গালাগালি প্রয়োগ করবে কি-না এবং বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা করা সমীচিন হবে কি-না এ বিষয়টিও বিবেচনা করে পিআরবি'তে সংযোজন করা যেতে পারে।

পুলিশ বিভাগে মাদকাসক্তি
পুলিশের কিছু সদস্যের মধ্যেগাঁজা, দেশী মদ ইত্যাদি নেশার প্রচলন বহু আগে থেকেই আছে। সা¤প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মাপের কর্মকর্তাদের ফেন্সিডিল সিরাপ ব্যবহারের প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে প্যাথডিন ইঞ্জেকশন, ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণের কোনো রেকর্ড নেই। বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ধূমপায়ী। এদের যথাযথ চিকিৎসা ও পূনর্বাসনের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা দরকার।

পুলিশ বিভাগে ইভটিজিং ও যৌন হয়রানি
বিভিন্ন অজুহাতে আড়াল করার চেষ্টা থাকলেও পুলিশ বিভাগে ব্যাপক ইভটিজিং ও স্বল্পমাত্রায় যৌন কেলেংকারির ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। সবচেয়ে বাজে অভ্যাস মাঠ পর্যায়ে প্রায় সকল পুরুষ সদস্য সাধারণ মানুষের মতো সমাজের নানান বয়সী নারীদের সুযোগ পেলেই উক্তত্য করে থাকে। এ ব্যাপারে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রবর্তন করা জরুরী। একজন পেশাদার পুলিশম্যান একজন সাধারণ মানুষ নয়। তার প্রশিক্ষণ ও আচরণ সাধারণ থেকে তাকে আলাদা করে থাকে।

শৃংখলা ভঙ্গের প্রবণতা ও কর্তব্য পালনে অনীহা
দেশের থানা-ফাঁড়িগুলোতে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে নগদ টাকা পাওয়া যায় না এমন সব পয়েন্টে ডিউটি না করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে। বিভাগীয় শৃংখলা ভঙ্গ করে বিভিন্ন পদের পুলিশের মধ্যে “মামার বাড়ি” সুলভ আচরণে লিপ্ত হতে লক্ষ্য করা গেছে। যার যেমন ইচ্ছা ইউনিফর্ম পরিধান করছে। লম্বা চুল-জুলপি সমৃদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাজার থেকে পছন্দসই জুতা কিনে ব্যবহার করছে। এমন কি সেন্ট্রি ডিউটির দু’ঘন্টা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে আলস্য বোধ করছে ইত্যাদি। পুলিশ বাহিনী একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। তার নিজের বিভাগীয় রীতিনীতি আছে যার বরখেলাপ গ্রহণযোগ্য নয়।

পৃথক জেলখানা প্রয়োজন
সারাদেশে ছয় শতাধিক থানা, কয়েক হাজার ফাঁড়ি ও অন্যান্য পুলিশ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন থানা-ফাঁড়িতে কতর্ব্যরতদের মধ্যে অনেক সদস্য বিভাগীয় শাস্তি পেয়ে থাকে। কিন্তু পুলিশের জন্য আলাদা কোনো শাস্তি নিবাস (কারেকশন সেন্টার, সংশোধন কেন্দ্র) আজ পর্যন্ত দেশে নির্মিত হয়নি। এটা খুবই দরকারি ব্যাপার। ভিন্ন স্থানে না দিয়ে এক জায়গায় শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা গেলে হয়। লোক চক্ষুর আড়ালেও থাকা যায়। রাজধানীর অদূরে মেঘনা থানা এলাকায় এধরণের একটি শাস্তি নিবাস বা কারেকশন সেন্টার গড়ে তোলা সম্ভব। নদীপথ ছাড়া এই এলাকায় যাতায়াতের অন্য রাস্তা নেই। নিয়ম করা উচিত যে, কারেকশন সেন্টারে পদাধিকার নির্বিশেষে সকল পুলিশ সদস্যর প্রতি একই আচরণ করা হবে। পদমর্যাদা নয় তাদের ত্রæটি-বিচ্যুতি হবে বিবেচ্য বিষয় এবং সংশোধনের সর্বাতœক চেষ্টা হবে একমাত্র লক্ষ্য।

পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান
বর্তমানে পিআরবি (পুলিশ রেজুলেশন অব বেঙ্গল)উল্লেখিত এবং পুলিশ বিভাগে প্রচলিত পুরস্কার ও শাস্তির ধরণে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বর্তমানের জটিল প্রক্রিয়া এবং পুরস্কার প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করা উচিত। শাস্তির ক্ষেত্রে আরো কঠোর-দন্ড পুলিশ সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে অধিক কার্যকর হতে পারে। এছাড়া, ছোটখাটো শাস্তি শারীরিকভাবে প্রদান করা যায় এবং সামরিক বাহিনীর অনুরূপ দন্ড প্রদান ব্যবস্থা (প্রাথমিক ও পরীক্ষামূলকভাবে) জারী করা যায়। বিশেষতঃ চাকরি থেকে স্থায়ী বরখাস্তের পথ সহজ করা উচিত।

অভিন্ন সড়কের বিভিন্ন যাত্রীরা
এক লক্ষ ত্রিশ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনীতে কন্সটেবল আছে প্রায় এক লক্ষ। উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করতে চাইলে প্রথমে তাদের দিয়ে শুরু করা উচিত। কারণ তারাই বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। সামান্য সংখ্যক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার উন্নয়ন পুলিশ বিভাগের বর্তমান অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে না। সে রকম হলে তা হবে সারা শরীরে দারিদ্র্যের চিহ্ন নিয়ে মুখে মেকআপ করে, ¯েœা-পাউডার, লিপস্টিক মেখে বড়লোকি দেখানোর মতো ব্যাপার।

ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ
এ পর্যন্ত অবসর নেয়া আইজিদের গড় পদমর্যাদা ছিলো সামরিক বাহিনীর মেজর জেনারেল র‌্যাংকের সমত‚ল্য। মাঝে কতক বছর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইকুয়াভেলেন্টও ছিলো। এটিকে রাষ্ট্রীয় অন্যান্য বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে সমতা রক্ষার জন্য পূর্ণ জেনারেল (চার তারকা) মর্যাদায় উন্নীত করা যুক্তসংগত। বর্তমান আইজিপিকে দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করা যায়।

উপদেষ্টা, সংসদীয় কমিটি ও প্রতিমন্ত্রী
সঠিক সমন্বয় না থাকায় দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত কাজে আসছে না। সকল সরকারের আমলেই দেখাগেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব সহজে জনরোষে পতিত হয়। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মন্ত্রী ও প্রধান মন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে দ্রæত গ্রহণ করা উচিত। একটি বিষয়ের উপর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব থাকা কাংখিত ফলা লাভের জন্য একান্ত জরুরী। সংসদীয় কমিটি প্রতিটি বিষয়ে খবরদারি না করলেও চলে। তারা শুধু পর্যবেক্ষণ করবেন। আপত্তিজনক কিছু না থাকলে জনস্বার্থে তাদের মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত স্থগিত করা উচিত নয়। প্রতিমন্ত্রীর বদলে মন্ত্রণালয়ের দায়-দায়িত্ব এককভাবে পূর্ণ মন্ত্রীর উপর ন্যস্ত করা আবশ্যক। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃংখলা রক্ষার জটিল ক্ষেত্রে একক কর্তৃত্ব অধিক ফলদায়ী হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

ডিসমিস
পুলিশ বাহিনীর শতকরা ৮৫ ভাগ সদস্যদের ধারণা চলমান সরকার আন্তরিক হলে পুলিশ বিভাগে অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা যাবে। নবম জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় জনকল্যাণের স্বার্থে নতুন নতুন আইন বিধি প্রনয়ণ। পুরানো আইন পরিবর্তন, পরিমার্জন অথবা বাতিল করতে বর্তমান সরকারের বেশী সময় লাগার কথা নয়। যাঁদের স্মরণ ও অনুধাবন শক্তি আছে, অভিজ্ঞতা আছে, সরকারের যেসব পরিচালনাকারীদের মনে রাখতে হয় যে-ইতিহাস অপেক্ষা করছে। আজকের অপরিনামদর্শীতা, সিদ্ধান্তহীনতা, দীর্ঘসূত্রিতা ভবিষ্যতে খারাপ ভাবে প্রতি উত্তর দেবে।


মনজুরুল হক, প্রয়াত সাংবাদিক, বার্তা সংস্থা এসপিএন

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.