নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একেবারে সোজা সাপটা ভাষায় নিজের সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চাই;আমি একজন মুসলিম;জন্মসুত্রে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে।হানাফি,মালিকি,শাফেয়ী,হাম্বিলি কিংবা আহলে হাদিস,সুন্নী,সালাফী কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে আমি অভ্যস্ত নই।জানার ইচ্ছা আমার চিরন্তন।জানানোর ইচ্ছাও ব্যাপক।

মু মাহফুজ আজিম

পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দদায়ক কাজগুলোর একটি হল নিজের সম্বন্ধে লেখা।কাজেই বোঝা যায় মিথ্যা আর তোষামোদে ভরপুর।অনেক দিন অপেক্ষা করেছি এই অংশটা লেখার জন্য। কিন্তু লিখি নাই কারণ আমাদের আশেপাশের লোকজন খুবই যন্ত্রণাদায়ক।একটা মানুষকে তারা ভালবাসবে সেটা যে কারণেই হোক কিন্তু কোনদিন বুঝতে দেবে না।খালি এখানেই শেষ না, যেই কারণে ভালবাসা আবার সেই কারণকেই সবার সামনে নিজের কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজ হিসেবে প্রচার করে।

মু মাহফুজ আজিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জয়ন্তীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী ।

২৬ শে মে, ২০১৪ রাত ১২:৪৮

বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত তথা সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ কবি নজরুল। প্রেমের কবি, সাম্যের কবি ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুলের লেখনী ধুমকেতুর মত আঘাত হেনে আমাদের জাগিয়ে তুলেছিল। তাঁর জীবনের জানা ও অজানা কিছু তথ্য দিয়ে এই রচনা লিখছি



নজরুল অর্থ কি ?

মুক্তির কাণ্ডারি । ভাবতে অবাক লাগে ইসলামকে তিনি বাংলাভাষি সাহিত্য প্রতিভায় একাই সমৃদ্ধি করেছেন ।তার অসংখ্য ইসলামী গান , গজল , কবিতা ও রচনায় , বিশ্ব সাহিত্যর রত্ন বিশেষ । যা মানুষেরকল্যান ও মুক্তির পথ পাথেয় । আমি তার কবিতার একজন ফ্যান। তবে তার গভিরতা কতটুকু তাত্ত্বিক সামান্য উপমা দিব ।

"দ্যুলোক ভূলোক গোলোক ভেদিয়াখোদার আরশ আসন ছেদিয়া " কথাটি যথার্থ ।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ - ১৯৭৬) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪শে মে ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। নজরুলের ছেলেবেলার ডাকনাম ছিল দুখু। নজরুলের যখন নয় বছর বয়স তখন তাঁর পিতা মারা যান। আর্থিক কারণেই সে লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে বাড়ির পাশেই অবস্থিত এক মাজারে খাদেম ও মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেছেন কিছুদিন। ছোটবেলা থেকেই নজরুলের মন ছিল গানবাজনার দিকে। তাই সে লেটোরদল নামে পরিচিত এক যাত্রা দলে মাত্র ১২ বছর বয়সে হাসির নাটক ও গান রচনা করে খুব সুনাম অর্জন করেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল কাজী নজরুলের সাহিত্যজীবন। লেটোর দলে শিশু নজরুলের কৌতুক-রচনা,



রবনা কৈলাসপুর, আই এম ক্যালকাটা গোইং

যত সব ইংলিস ফেসেন, আহা মরি কি লাইটনিং।

ইংলিস ফেসেন সবি তার, মরি কি সুন্দর বাহার।

দেখলে বন্ধু দেয় চেয়ার, কাম অন ডিয়ার গুড মনিং।



ছোটবেলা থেকে নজরুল ভরঘুরে ছিল এজন্য কোন স্কুলেই দীর্ঘসময় নিয়ে লেখাপড়া করেনি। চার-পাঁচটা স্কুলের নাম আমরা জানতে পারি। দশমশ্রেণীতেই কবির স্কুলজীবন শেষ হয়। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, বৃটিশ সরকার বাঙ্গালীদের নিয়ে ব্যাংগল রেজিমেন্ট নামে একটা সেনাদল গঠণ করলে ১৯১৭ সালে কাজী নজরুল সেখানে যোগ দেন। সেখানে থাকা অবস্থায় রাশিয়ার বিপ্লব ও লেনিনের লালফৌজের সমর্থনে অনেক কবিতা লিখেছিলেন কিন্তু বিধিনিষেধ থাকায় খবরের কাগজে ছাপানো সম্ভব হয়নি। কবি নজরুল দুই বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। ১৯২০ সালে কলিকাতা থেকে নবযুগ নামে একটি বামপন্থি পত্রিকা বেড় হলে কবি নজরুল সেখানে সহকারী সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকার অফিসেই থাকার জায়গা হয়েছিল। ১৯২১ সালে মোজাফফর আহমদের সাথে কমউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজে সাহায্য করেছেন। বাংলা সাহিত্যে আরবি ও পার্শীশব্দের ব্যবহার তিনিই প্রথম করেছিলেন এজন্য অনেক হিন্দুলেখক নজরুলকে পছন্দ করতেন না। ১৯২১ সালের জুন মাসে নার্গিস খাতুনের সাথে বিবাহ ঠিক হয় কিন্তু কাবিন নামায় ঘরজামাইয়ের কথা থাকায় নজরুল রাগ ও অপমানে বিয়ের আসর থেকে রাতেই কুমিল্লায় চলে আসেন। এই শহরে ইনদ্র কুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সাথে নজরুলের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। সেই পরিবারে বিরজাদেবীকে তিনি মা ডাকতেন। সেই পরিবারের মেয়ে আশালতা বা প্রমীলাকে(২৫শে এপ্রিল ১৯২৪)কাজী নজরুল বিয়ে করেন।



হিন্দুদেবতার নামে গান কবিতা লিখতেন এইজন্য নজরুলকে ইসলামের শত্রু বা কাফেরকবি বলে অনেকে ডাকতো। কাজী নজরুল লিখেছেন -

মৌ-লোভী যত মৌলবী আর মোল্লারা কন হাত নেড়ে,

দেব দেবী নাম মুখে আনে,

সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।

ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও,

যদিও শহীদ হইতে রাজী ও।



আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,

আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,

চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর !

আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন।



মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।



আমি চির বিদ্রোহী বীর –

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!



বছরখানেক লেটো দলের সঙ্গে গান গেয়ে বেড়িয়ে আবার ফিরে এলেন পড়াশোনার জগতে। তিনি নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। তারপর কিছুদিন হাই স্কুলে পড়তেন। সেখানে প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। তাকে নজরুল খুব পছন্দ করেছিলেন। কুমুদরঞ্জনও নজরুলকে খুব পছন্দ করতেন। নজরুলের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন; ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।

কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর অর্থের অভাবে তাঁকে স্কুল ছাড়তে হলো। রোজগারে নেমে গেলেন। প্রথমে কিছুদিন কবি বাসুদেবের দলে গান গেয়ে বেড়ালেন। তারপর কিছুদিন রেলওয়ের এক খ্রিস্টান গার্ডের খানসামা হিসেবে কাজ করলেন। এরপর আসানসোলের এক চা রুটির দোকানে নিলেন রুটি বানানোর কাজ। কিন্তু তিনি ছিলেন জাত কবি। রুটি বানাতে বানাতে মুখে মুখেই ছড়া বেঁধে ফেলতেন। আটা বেলছেন, গা বেয়ে টপাটপ করে ঘাম ঝরছে; এরই মাঝে ছড়া বলতেন;



মাখতে মাখতে গমের আটা

ঘামে ভিজলো আমার গা’টা...



একদিন এক পুলিশ ইন্সপেক্টর কাজী রফিজ উল্লাহ্‌ ঘটনাটা দেখে ফেললেন। নজরুলকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে। বর্তমানে এটাই জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানের নিয়ম কানুন ভালো লাগলো না তার। পালিয়ে গেলেন। ফিরে আসলেন রাণীগঞ্জে, সিয়ারসোল হাই স্কুলে। এটাই ছিলো তার জীবনের প্রথম স্কুল। কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের মাথরুন স্কুলে পড়ারও আগে তিনি এখানে পড়তেন। এবার এই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক তাঁকে অনেক অনুপ্রাণিত করলেন। তাদের মধ্যে বিপ্লবী নিবারণচন্দ্র ঘটকও ছিলেন। ছিলেন সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, হাফিজ নুরুন্নবী ও নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও।



তার প্রিটেস্ট পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। এমন সময় শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বৃটিশ ভারতের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য সেনাবাহিনীর ডাক এলো। পরীক্ষা টরীক্ষা ফেলে তিনি চলে গেলেন যুদ্ধ করতে। আর এই যুদ্ধে গিয়েই তাঁর মধ্যে এলো এক বিশাল পরিবর্তন। সেনাবাহিনী থেকে দেশে ফেরার পর শুরু হলো নজরুলের সাহিত্য জীবন। এই যে তিনি কলম ধরলেন, অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ আর তার কলম থামাতে পারেনি। এমনকি তার আনন্দময়ীর আগমনে কবিতাটির জন্য তাকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়েছিল। বিচারে তার এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডও হয়। তবু তাঁর কলম থামল না।



১৯২২ সালের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০ এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।

১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দী প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দী দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দী বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন;



আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...।পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন..।

এমনকি বাঙালীর ঈদের আনন্দের সাথে জড়িয়ে আছে নজরুলের রচিত;রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...



অত্যাচারী বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে নানা অনিয়ম, অনাচার আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি অবিরাম লিখে গেছেন। আনন্দময়ীর আগমনে কবিতার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো ১৯২৮ সালে। ১৯৩০ সালে তাঁর প্রলয় শিখা নামের একটি বই বাজেয়াপ্ত করলো সরকার। সঙ্গে ছয় ছয় মাসের জন্য জেলে থাকার আদেশও দেয়া হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবশ্য বৃটিশ সরকার এই আদেশ কার্যকর করেনি।



তার প্রথম ছেলে একেবারে বাচ্চা থাকতেই মারা গিয়েছিল। আর প্রলয় শিখা বাজেয়াপ্তের বছরে মারা গেল তাঁর আরেক ছেলে বুলবুল। তিনি একেবারেই ভেঙ্গে পড়লেন। বুলবুলকে নিয়ে তিনি বহু কবিতা আর গান লিখেছিলেন।

" ঘুমিয়ে গেছে ক্লান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।"



নজরুলের পরের দুই ছেলে অবশ্য মারা যাননি। বরং দু’জনই বেশ নামও কুড়িয়েছিলেন; কাজী সব্যসাচী আবৃত্তিকার হিসেবে, কাজী অনিরুদ্ধ বাদক ও সুরকার হিসেবে। ১৯৩৯ সালে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তাঁর স্ত্রী প্রমীলা নজরুল। আর ১৯৪২ সালে কবি নিজেই প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। তখনকার ভারতের ভালো ভালো হাসপাতালে তার চিকিৎসা করানো হলো; লুম্বিনী পার্ক আর রাঁচী মেন্টাল হসপিটালে। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ১৯৫৩ সালে সবাই মিলে তাঁকে আরো ভালো চিকিৎসার জন্য পাঠালো ইংল্যান্ডে। সেখানকার চিকিৎসকেরাও কিছু করতে পারল না। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হলো জার্মানিতে। সেখানেও কিছু হলো না। সবাই একবাক্যে বলে দিল, কবির অসুখ চিকিৎসারও অতীত।



নজরুলের যে কষ্ট কেউ বুঝেনি, যে চিত্র কেউ দেখেনি : কবি নজরুলের জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট কী ছিল?

তার জীবনী পড়লে দেখা যায়, এত তেজোদ্দীপ্ত ও বিদ্রোহী কবি কিন্তু তার পরিবারের কাছে নিতান্ত অসহায় ছিলেন। একজন মুসলিম কবি হয়েও তিনি বিয়ে করেছিলেন একজন হিন্দু নারীকে। যদিও তার প্রথম বিয়ে হয়েছিল নার্গিস নামের এক তরুণীর সাথে।



কবি তার এই হিন্দু স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীর কাছে অসহায় ছিলেন। বাড়ীতে তিনি তাদের সামনে ভগবান ও জল বলতেন আর বাইরে এসে বলতেন পানি ও আল্লাহ। যদিও কবি হিন্দুদের জন্য শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন, কিন্তু ইসলামের জন্য তিনি প্রচুর গজল ও লেখা রচনা করেছেন।



কিন্তু মুসলমান হয়ে তিনি ইসলামের জন্য হামদ নাত লিখবেন, এটা সহ্য হতো না তার শ্বশুরগোষ্ঠীর। ইসলামী লেখার জন্য তারা কবিকে নির্মম কথা শোনাতো, উপহাস করতো, কবির শ্বাশুড়ী এ বিষয়ে দারুণ ক্ষ্যাপাটে ছিলেন।



তবু কবি নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে লিখতেন আল্লাহ ও রাসুলের নামে। এখানেই শেষ নয়, কবি তার দুই ছেলেকে খৎনা করার কথা বলারও সাহস পেতেন না তার পরিবারের কাছে।



মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করেছে’ এই অভিযোগে যারা কবির স্ত্রী ও শ্বশুর পরিবারকে দূর দূর বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল, কবির নাম যশ প্রচার হলে এরাই আবার দলে দলে এসে কবির বাড়ীতে দীর্ঘদিন ধরে থাকতো, খেতো, আমোদ ফূর্তিতে মত্ত থাকতো।



এমনও হয়েছে কবির শ্বাশুড়ী পরিবারকে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কবি নজরুল বাধ্য হয়ে ট্রেনের দু বগি রিজার্ভ করতেন, সেইসাথে সামানপত্র নেয়ার জন্য ওয়াগন ভাড়া করতেন। এসবের খরচ মেটাতে গিয়ে কবি যে কত মানুষের কাছে হাত পেতে ধার করেছেন, তার হিসেব নেই।



কবির খুব কাছের বন্ধুদের স্মৃতিকথায় দেখা যায়, এজন্য কবি কয়েকবার নীরবে লাঞ্চিত অপমানিত হয়েছিলেন। এতো করেও কবির তার স্ত্রীর পরিবারের মন ভরাতে পারতেন না। মুন্সী জুলফিকারের কাছে একসময় কবি বলেই ফেললেন কথা প্রসঙ্গে, তুমি তো আমার শ্বাশুড়ীকে চেন না। ওরা হচ্ছেন যেন রাঘব বোয়াল, কিছুতেই আমি ওদের পেট ভরাতে পারলাম না।’’



জুলফিকার হায়দার তার প্রত্যক্ষ বর্ণনায় লিখেছেন, কবির শ্বাশুড়ী যেন তার প্রতি আরোপিত অপবাদ ও ঘৃণার জবাব দিতে তার বাড়ী থেকে আগত অতিথিদেরকে দু হাত ঢেলে আপ্যায়ন করতেন। কখনো কখনো দু একজনের খাবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে তিনি কবির পকেট থেকে তৎকালের দশ বিশ নয়, একেবারে চল্লিশ টাকা পর্যন্ত খরচ করাতেন। নিজেদের আত্মঅহমিকা আর ভাব দেখানোর এতসব আয়োজনের সব দায় মেটাতে হতো একা কবি নজরুলের। ফলে অর্থ অভাব আর টানাটানি লেগেই থাকতো তার সংসারে।



হিন্দু সাহিত্যিকদের একটি বিশেষ গোষ্ঠী ছিল যারা সর্বক্ষণ কবিকে নির্দয় ভাবে মানসিক যন্ত্রণা দিত, গোঁড়া হিন্দু স¤প্রদায় তাকে পরিহাস করত।এই ছিল একদিকের দৃশ্য।



অন্যদিকে এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করায় তৎকালের মুসলিম সমাজও কবিকে তিরস্কৃত করত, এমনকি তারা তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। সারাদেশের জাগরণে যার গান প্রেরণা যোগায়, সে নজরুল তাদের কাছে ছিলেন ঘৃণার পাত্র।



ফলে ঘরে ও সমাজে এমন বিপরীত ও অসহনীয় একটি পরিবেশে কবি থাকতেন চরম দুঃখে ও মানসিক বেদনায়। আর এসব ভুলে থাকার জন্য তিনি সবসময় ছাদফাটানো হাসি আর আড্ডার উপায় বেছে নিতেন। তবু আশ্চর্যের বিষয়, দুরন্ত মনের চঞ্চল কবি কাজী নজরুল ইসলাম কীভাবে তার জীবনের এ বৈপরীত্য মেনে দিন কাটাতেন, সুর সাগরে সাহিত্য ভান্ডারে প্রাণসঞ্চার করতেন?



কাজী নজরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে যে কতটা নিঃসঙ্গ ছিলেন, তার মনের অবস্থা কতো বেদনাময় ছিলো, এর প্রমাণ মিলে তার বিভিন্ন চিঠি থেকে। এজন্যই হয়তো তিনি ঘুরে বেড়াতেন নানা জায়গায়। কয়েকবার তিনি এসেছেন আমাদের এই ঢাকায়, এসেছেন কুমিল্লায়, ফরিদপুরে, যশোরে, খুলনায়, চট্টগ্রামে, সিরাজগঞ্জে, ঠাঁকুরগায়ে।



বেগম মাহমুদ নাহারকে লেখা চিঠির এক জায়গায় কবি লিখেছেন, তোমরা ভালবাস আমাকে নয়, আমার সুরকে, আমার কাব্যকে। তোমরা কবিকে জানতে চাও না নজরুল ইসলামকে জানতে চাও?”



কাজী মোতাহার হোসনকে লেখা এক চিঠিতে কবি নিতান্ত দুঃখের সাথে লিখেছেন, “বন্ধু আমি পেয়েছি- যার সংখ্যা আমি নিজেই করতে পারবো না। এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু। ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে ওঠেনি কেউ। আমার চোখের জলের বাদলা রাতে এরা কেউ এসে হাত ধরেনি।”



এমনই অসংখ্য চিঠি থেকে কবির মনোবেদনার যে দুঃখময় চিত্র ফুটে ওঠে, তার পূর্ণ বিবরণ দিলে চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল। কবির ব্যক্তিজীবন তাই সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। মায়া ও করুণার অপূর্ব অনুভুতিতে মন সিক্ত হয়ে আসে।



১৯৬২ সালে মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী। কবি তখন প্রায় বোধশক্তিহীন। লিখতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, কথা বললে কিছু বুঝতে পারেন না।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী রাস্ট গঠন এর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান ভারত সফরে কলকাতায় এসে ভারত সরকারের কাছে আবেদন রাখেন স্বাধীন বাংলাদেশে কবির জন্মদিন পালন করার।

কবিকে ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জাগত্তরিনী স্বর্ণ পদক প্রদান করে এবং ১৯৬০ সালে ভারত সরকার পদ্মভূষণ প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালে কবিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের ডি-লিট উপাধি প্রদান করেন।



কাব্যগ্রন্থ সমূহঃ



অগ্নিবিণা(১৯২২),

দোলন চাঁপা (১৯২৩),

বিশের বাঁশি(১৯২৪),

চিত্তনামা(১৯২৫),

সাম্যবাদী(১৯২৫),

সর্বহারা(১৯২৬),

ঝিঙেফুল(১৯২৭),

ফণিমনসা(১৯২৭),

সিন্ধুহিল্লোল(১৯২৭),

সঞ্চিতা(১৯২৮),

জিঞ্জীর(১৯২৮),

সন্ধ্যা(১৯২৯),

চক্রবাক(১৯২৯),

প্রলয় শিখা(১৯৩০),

চন্দ্রবিন্দু(১৯৩০),

নতুন চাঁদ(১৯৪৫),

মরু ভাষ্কর(১৯৫৭),

সঞ্চয়ন(১৯৫৫),

শেষ সওগাত(১৯৫৮),

ঝড়(১৯৬০)



গল্প সমগ্রঃ ব্যাথার দান, রিক্তের বেদন



নাটকঃমৃত্যু ক্ষুধা



যে যে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেনঃ লাঙ্গল, ধূমকেতু, নবযুগ, মোসলেম ভারত



নজরুলের শেষ বাণী

বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম...



১৯৭৬ সালে জানুয়ারী মাসে কবিকে বাংলাদেশে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ২১ শে পদকে ভূষিত করা হয়। ২৪শে মে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রাহমান কবি নজরুল কে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্মি ক্রেস্ট উপহার দেন এবং নজরুল এর চল চল চল সঙ্গীত টিকে বাংলাদেশের রন সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করেন। ২৯শে আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবি পিজি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কবির গানের (মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই,যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই... ) ভাষায় বলে যাওয়া ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবি কে সমাহিত করা হয়।



কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী প্রতি বছর বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। কবিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। তার রচিত চল্‌ চল্‌ চল্‌, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল বাংলাদেশের রণসংগীত হিসাবে গৃহীত হয়েছে। তার স্মৃতিবিজড়িত বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ত্রিশালে ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও শিশু সংগঠন বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। এছাড়া সরকারীভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট। ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।



আমাদের জাতীয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন। সারা জীবন দুঃখের সঙ্গে লড়াই করা, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, ধর্মের নামে অনাচার আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধাচারণ করা পাগলাটে স্বভাবের এই কবি আমাদের জন্য রেখে গেছেন সাম্যের ঐকতান;

গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্‌ ।

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,

সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।



লেখায় যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে সহায়ক হিসেবে সাহায্য নেয়া হয়েছে বাংলা উইকিপিডিয়া, গুগুল সার্চ ইঞ্জিন এবং কল্যাণী কাজী লিখিত নজরুল, দ্যা পোয়েট রিমেম্বারড হতে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.