নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আততায়ী।

মেহরাব হাসান খান

আমি H2O,,,,Solid,Liquid & Gas.How do you deserve me?

মেহরাব হাসান খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

উড়াল পঙ্ক্ষী

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫০


"ভাইজান, মেয়ের কি মা বেঁচে নাই? তিনি মেয়েকে ঘুম পাড়াইবেন।আপনের কি চিন্তা?আপনে নিশ্চিন্তে অবিনয় করেন, আপনেরে ৫০ টাকা বাড়াইয়া দিব।"
সাত্তার খান রেগে গেলেন।
"টেকা দিয়া আমি কি করবো, আমি গেলাম।আমি এই চ্যাটের নাটক করবো না।" সাত্তার খান সিরাজ-উদ-দৌলার পোশাক পরেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন।
নাটকের ম্যানেজার তাকে কিছু বলতে পারছে না, সাত্তার খান মেম্বারের ছেলে, চেয়ারম্যানের ভাগিনা।এছাড়া সে একাই নিজ এলাকায় নাটকের আয়োজন করে।সেই নাটকে শুধু কাঠাল কাঠের জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয় দেখে এলাকার নামই হয়েছে "কাঠালীপাড়া"। এমন একটা ছেলেকেতো আর কষে চড় দেয়া যায় না।

ছাত্তার খান হেটে রওনা দিয়েছেন। তার চলার পথ লাল আলোয় আলোকিত। লোকজন নাটকের মঞ্চ জ্বালিয়ে দিয়েছে, ভালো করেছে।নাটক হবে না, মঞ্চ দিয়ে কি হবে?
তার পিছনে তাকানোর সময় নাই, তাকে বড়বোনের বাড়ি যেতে হবে। বোনের দুই সন্তান, মেয়ে হাসিনূর রাতে মামার কোল ছাড়া ঘুমায় না।চিৎকার করে কাঁদে, বোন সামলাতে পারেন না।

কাজাইকাটা বড় বাড়ির আঙিনায় পা রেখেই সাত্তার খান ভাগ্নীর কান্না শুনতে পেলেন।
বোন দৌলতুন্নেছা রাগ করলেন," ও সাত্তার, হাসিনূর তর কোল ছাড়া রাতে ঘুমায় না।তুই কেমন মামা, মেয়েরে প্রত্যেক দিন কান্দাস।আগে আইতে পারস না।চাইয়া দেখ বাবলু ঘুমায়।হাসিনূর ঘুমায় না।"
সত্যিই ভাগিনা বাবলু বেঘোর ঘুমে, বোনের কান্নায় তার সমস্যা নেই।
সাত্তার খান ভাগ্নীকে কোলে নিলেন।হাসিনূর কান্না থামিয়ে দিল।কথা বলার চেষ্টা করছে, ওর রাজ্যের কথা জমে আছে;সব মামাকে বলছে।
সাত্তার খান বললেন,"আম্মা, আমি আর জীবনে দেরি করবো না।আমি মাফ চাই।"
হাসমত পুলিশ নফল নামাজ পড়ছিলেন। তিনি নামাজ থামিয়ে সাতবার বললেন,"সুবহানাল্লাহ......" আল্লাহর কুদরত দেখলে বা শুনলে এইটা পড়তে হয়।আল্লাহ খুশি হন।মামা-ভাগ্নীর এই ভালোবাসা আল্লাহর কুদরত ছাড়া আর কি!

হাসমত পুলিশ ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরেই দেখলেন, বাড়ির পিছনে পালকি দাঁড়িয়ে আছে। দৌলতুন্নেছা বাপের বাড়ি চলে যাবে। নিজের স্ত্রীকে কয়েকটা কঠিন কথা বলা দরকার।জিজ্ঞেস করা দরকার;সে কোথায় বেড়াতে যায়, নিজের বাপের বাড়ি না স্বামীর বাড়ি? তিনি বলতে পারেন না। দৌলতুন্নেছা বাপের স্বভাব পেয়েছে। শ্বশুর হুরমুছ আলী খানকে হাসমত পুলিশ খুব ভয় পান। অতি কম উচ্চতার এই লোকটি কম কথা বলেন।কিন্তু মিনমিন করে যা বলেন, তাই মনে লাগে।মন বলে,উনি সত্য বলছেন।
দৌলতুন্নেছা স্বামীর কাছে বিদায় না নিয়েই পালকিতে চড়ে বসলেন। হাসমত পুলিশ রাগ করলেন, এটা কেমন কথা!তিনি ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য এসেছেন।কোথায় সেবাযত্ন করবে, বৌয়ের সেদিকে খেয়াল নাই।সে না বলে বাপের বাড়ি যায়। এই অবাধ্য বৌকে কটুকথা বলা যায়, শরীয়তে আছে। তিনি দৌলতুন্নেছাকেও কঠিন কথা বলতে পারেন না। যেদিন বলবেন সিদ্ধান্ত নেন, দেখা যায় সেদিন দৌলতুন্নেছা পোলাও মাংস,পায়েস রান্না করে।সে বিরাট রাধুনি। খাবার মুখে দিয়েই রাগ পরে যায়, কটু কথা বলা হয় না।

হাসমত পুলিশ কয়েক বছর পর বাড়ি ফিরলেন, একদল মূর্খ বাঙালি শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে।অনেকদিন ছুটি পান নাই।তিনি কিছুটা উত্তেজিত, অনেকদিন পর নিজের ছেলে মেয়েকে দেখবেন।
শ্বশুর বাড়ির আঙিনায় পা দিয়েই মন ভরে গেল। শিউলি আর বেলি ফুলের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ির পরিবর্তন হয়েছে,আগে দুইটা দো'চালা ঘর ছিল, এখন একটা নতুন চৌচালা ঘর উঠেছে। বাড়ি ঝকঝকে পরিষ্কার। তিনি চিঠিতে জেনেছেন সাত্তার খান বিয়ে করেছে। নিশ্চয়ই বৌ অনেক পরিষ্কার, নইলে এ বাড়িতে তার তিন শালিকা থাকে কিন্তু বাড়ি সবসময় নোংরা থাকতো!
বাড়ির পিছনে গরুর চাড়িতে পানি দিচ্ছে অতি রূপবতী এক কিশোরী মেয়ে।মেয়ের চুল লম্বা, সে সামলাতে পারছে না।চুল চাড়ির পানিতে ভিজে যাচ্ছে। মেয়েটা ঝাটকা দিয়ে চুল ঠিক করে উনার দিকে তাকালো, আহারে কী সুন্দর! উনি শব্দ করে বললেন,"সুবহানাল্লাহ"।

সাত্তার খান বড় কাতলা মাছ কাটছেন। হাসিনূর, বাবলু তাকে ঘিরে বসে আছে। হাসিনূরের পরনে ধবধবে সাদা জামা, বাবলু পড়ে আছে ইংলিশ প্যান্ট, লাল গেঞ্জি আর জাম্প কেডস। হাসমত পুলিশ খুশি হলেন, এগুলা উনিই পাঠিয়েছেন। তবে মেয়ের পা খালি কেন, মেয়ের জন্য তিনি লাল মখমলের জুতা পাঠিয়েছেন।
দৌলতুন্নেছা চিঠিতে জানিয়েছেন, হাসিনূর মামা ডাক শিখেছে, শুধু মামাই ডাকে।আর কিছু না! তবে বাবলু মাঝে মাঝে দাদা, বাবা ডাকে। কয়েক বছর কেটে গেছে, এখন হয়তো দুজনেই বাবা ডাকা শিখেছে!

"তুমি কে?" হাসিনূর, বাবলু একসাথে প্রশ্ন করলো।
"আমি কেউ না।তবে আমি তোমাদের জন্য সুন্দর জামা,কাপড় পাঠাই।"
হাসিনূর ঠোট বাকিয়ে বললো," তুমি মিথ্যুক!আমাকে সুন্দর ফ্রক, চুলের ফিতা, পুতুল মামা কিনে দেয়।মিয়া ভাইকে পাঞ্জাবি,গেঞ্জি, শার্টও মামাই কিনে দেয়।তুমি চলে যাও, তোমাকে কাতলা মাছ দিব না।"
বাবলু কিছু বললো না।দুজনেও সাত্তার খানের পিছনে লুকিয়ে গেল।
বাবলু এক'দুবার উঁকি দিয়ে বললো,"আমি তোমার ছবি দেখেছি। আম্মা বলেছেন, আজ তুমি আসবে।তুমি আমাদের আব্বা।"
হাসমত পুলিশ আনন্দে কেঁদে ফেললেন।

সাত্তার খানের দুই পুত্র, এক কন্যা। বড় পুত্র সোহাগ আর কন্যা শাপলা পিঠেপিঠি। তাদের মা আক্ষেপ করে প্রায়ই বলেন, ওদের বাবা নাকি কোন দিনই সন্তানদের কোলে নেননি।তবে প্রায়ই দেখা যেত সাত্তার খান ভাগ্নে-ভাগ্নী নিয়ে রাস্তায় হাটছেন। ওদের পায়ে কাদা,ধুলো লেগে গেলে পরনের লুঙ্গি দিয়ে মুছে দিতেন। এরা দুজন দিনের বেলা ওদের বাড়ি যেত না, কান্নাকাটি করতো। তবে রাতে ঘুম থেকে জেগে আবার কান্নাকাটি শুরু করতো, মায়ের কাছে যাবে।সাত্তার খান দুজনেকে কাধে করে মাঝরাতে মায়ের কাছে দিয়ে আসতেন।আবার সকালে নিয়ে আসতেন।উনার কোন ক্লান্তি নেই।

সাত্তার খান আমার বাবা, হাসিনূর আপা আমার ফুপাতো বোন। এতক্ষণ যা বললাম, সবই শোনা কথা।আম্মার কাছে শুনেছি, বড় ফুপুর কাছে শুনেছি।
আম্মা আরও বলেন,শাপলা আপা যখন একটু বড় হল। হাসিনূর আপা ওকে দেখেই বলতেন,"মামী, আপনি এই পরীর বাচ্চা কোথায় পেলেন!" শাপলা আপা নাকি খুব সুন্দর ছিলেন। আমার তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।তবে হাসিনূর আপাকে দেখেছিলাম। আব্বাকে আমাদের আদর না করলেও, আপা আর মিয়া ভাইকে(বাবলু) খুব আদর করতেন।কখনো কোন ভালো রান্না হলে আব্বা আগেই ওগুলো কলাপাতায় পেচিয়ে রাখতেন, ভাগ্নে-ভাগ্নীকে দিয়ে আসবেন।আব্বা ইদের কেনাকাটায় আগে আপা, মিয়া ভাইয়ের জন্যই জামা, শার্ট কিনতেন। টাকা বাচলে আমাদের জন্য কিছু কিনতেন।
তবে আমরা পুরনো কাপড় দিয়ে ইদ করিনি।আপা কিনে দিতেন!

একটা ঘটনা দাদা বলেন, তখন ভয়ংকর বন্যা হল। ব্রহ্মপুত্রের পাড় ছাপিয়ে আমাদের বাড়ি প্রায় ডুবে গেল। বাইরে যাবার উপায় নেই,খালের পানি কমেনি। নৌকা নিয়ে কেউ বের হয় না, কলেরা মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পরেছে। আপা আফসোস করে বলেন, তার বৃত্তি পরিক্ষা দেয়া হল না।মিয়া ভাই মন খারাপ করে বসে থাকেন।
পরিক্ষার দিন সকালে, সারা গ্রামের লোক পাশের গ্রামের লোক সবাই দেখেছে; সাত্তার খান কোমড় পানি ছাপিয়ে ভাগ্নে-ভাগ্নীকে দুই কাধে নিয়ে খাল পার হচ্ছে।অথচ আব্বাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তার ছোট ছেলে,এক মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে পড়ে?
আমি নিশ্চিত, সে বলতে পারবে না।
কিন্তু ক্ষণজন্মা হাসিনূর আপার প্রতি তিনি যে অসামান্য ভালোবাসা দেখিয়েছেন, সে জন্য তার সকল অবহেলা আমি ক্ষমা করে দিয়েছি!

আব্বা আমাদের অত কাছে টানতেন না।এজন্যই আপা আমাদের আদর করতেন।বড় ভাইকে নাকি তিনি খাইয়ে গোসল করিয়ে দিতেন।
আম্মাকে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন,"মামী দেখেনতো কে বেশি সুন্দরী? আপনি না আমি?"

আমার অতশত মনে নেই। এটা মনে আছে, উনার চুল ছিল কোকড়ানো, উনি অনেক লম্বা, বেশ ফরসা ছিলেন। তখন উনার রেডিমেড জামা পাওয়া যেত না। তার পায়ের মাপে জুতো হত না, আপা সব সময় ছেলেদের জুতা পরতেন। অবশ্য পরতে পারতেন না, পা কেটে যেত।আপা সবসময় খালি পায়ে থাকতেন, জুতা হাতে নিয়ে হাটতেন। বিকেলে আপা শাড়ি পড়তেন, আমরা দলবেধে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে হাটতে যেতাম।

আপা দাদির বিয়ের শাড়ি পড়েছেন। কি যে সুন্দর লাগছিল!আব্বা আপাকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন, কোথা থেকে টাকা এনে আপার উপরে ছড়িয়ে দিলেন। নজর কাটা গেল!

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। আমরা নদীর পাড় থেকে ফিরছি, পেছন পেছন একজন আসছে। আমি আগেও দেখেছি, উনি আপার পিছনে পিছনে আসেন। তখন আপা একা কলেজ যান না।অবশ্য অত যেতে পারে না। আপার কি জানি হয়েছে, প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যান। আপার সাথে আমি, বড় ভাইয়া বা আব্বা সব সময় থাকি।
আপা দ্রুত হাটার চেষ্টা করছেন।শাড়ি পরেছেন, পায়ে জুতা, জোরে হাটতে পারছেন না।আপা জুতা খুলে আমার হাত ধরে টেনে প্রায় দৌড়ে বাড়ি ফিরলেন।

পরদিন আমি যখন স্কুলে যাই, লোকটা আমাকে রাস্তায় থামালেন। উনার হাতে মিমি চকলেট, আর লজেন্স;তখন ঐগুলোর আকর্ষণ এড়ানোর সাহস আমার হয়নি। উনি আমার কাছ থেকে আপার নাম জেনে নিলেন।
আসলে উনাকে সবাই চিনে, আমিই পরে চিনেছি।উনি আপাকে পছন্দ করতেন। যেহেতু আপা আমাদের পছন্দ করতেন।তাই রুকুন ভাই, আমাদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন।
সেদিন সবাই একসাথে গোল হয়ে খেতে বসেছে। পোলাও, মাংস আর ক্ষির, আমার প্রিয় খাবার। আপা রান্না করেছেন, আপা আমাকে ডাকেনি।আমি কান ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার অপরাধ, আমি কেন রুকুন ভাইয়ের কাছে চকলেট নিলাম!

আপা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছেন, আপাকে আনতে নদীর ঘাটে গিয়েছি। একটু দুরেই দাঁড়িয়ে আছেন রুকুন ভাই। নদীর পাড়ে কাশফুলের বন, ফুলের পরাগ উড়ছে। আকাশে ঝাকেঝাকে উড়ছে সাদা বক। আর নিচে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে দু'জন, তবে এদের মাঝে দূরত্ব অনেক বেশি!
আপা তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে ডাকলেন।
"কেন বিরক্ত করছেন, রুকুন ভাই?"
"আমি তোমায় বিরক্ত করছি না।আমিতো দাঁড়িয়ে আছি, তোমার দিকে তাকাইনি পর্যন্ত!"
"কাল আপনাদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আপনাদের বাড়িতে কোন ফুলের গাছ নেই! আপনি সন্ধ্যা মালতির গাছ লাগাবেন।দেখবেন, সন্ধ্যায় কেমন ঘ্রাণ ছড়ায়।"
"তুমিই লাগিয়ে দিও।"
আপা হুট করে জোরে হাটা শুরু করলেন। বেশিদূর যেতে পারলেন না। অজ্ঞান হয়ে পরে গেলেন।
এই আপাকে শেষ দেখা, আর দেখা হয়নি।

আপা সম্ভবত তখন গুরুতর অসুস্থ। আপাকে হাসপাতাল থেকে পালকিতে করে বাড়ি আনা হয়েছে। চারপাশে শাড়ি দিয়ে আবরণ তৈরি করা হয়েছে, কিছুই দেখার উপায় নেই।আমার অত মন খারাপ হয়নি, আমি জানি আম্মা আপার মাথায় দুদিন পরপর জুই নারিকেল তেল দিয়ে দেন। আপা চোখ বন্ধ করে বসে থাকে, আর সারা বাড়ি তেলের গন্ধে ভরে যায়! এছাড়া আপা অনেকদিন পর বাড়ি এলে আম্মা আর আপা সেজে আয়নার সামনে দাড়ান।তখন আপার সাথে দেখা হবে, কথা বলা যাবে।
এগুলোর কিছুই হল না। আপা একটা ঘরে বন্দি হয়ে গেলেন, ঐ ঘরে আমাদের যাওয়া নিষেধ। আপাও আমাদের সাথে কথা বলেন না। ঘরে কি হয়, দেখার উপায় নেই। আমি, সাথী, সজীব, সাইফুল ভাই, সবুজ ভাই ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করি। আপাকে দেখা যায় না, তবে আপা মাঝে মাঝে সবাইকে ফল দেন। তখন আপার সাদা ফ্যাকাসে হাত দেখা দেখা যায়। আমি ফল নেই না, কেন নিবো?ফল খাওয়াতে হয়, আপা বাইরে এসে দিবে!

সেদিন আম্মা বিয়ের শাড়ি পড়ে সেজে, দাদির বিয়ের শাড়ি নিয়ে আপার ঘরে গেলেন। খুব খুশি হলাম, নিশ্চয়ই আপা আজ নদীর পাড়ে বেড়াতে যাবেন!
ঘরের টিনের বেড়ায় কান পেতে রইলাম, আপা কি বলে শুনবো।
"মামী, আপনি আমার চেয়ে অনেক সুন্দরী। আপনি আর আমার ঘরে আসবেন না।আমার হিংসা লাগে!"
আম্মা কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন। আব্বা সেদিন আম্মাকে খুব মারলেন, আম্মা কেন অত সেজে আপার সামনে গেল। আমি অবাক হই! কি হয়েছে? এই এক মাসেই আম্মা আপার চেয়ে সুন্দরী হয়ে গেল! কই আম্মাতো এখন রাতে আর তিব্বত স্নো মাখেন না!
কাউকে জিজ্ঞেস করবো সে উপায় নেই।সবাই অসম্ভব রেগে থাকে, আর অকারণে আমাদের মারে!

কয়েকদিন পরেই আম্মা আমাদের গোসল করিয়ে, সুন্দর জামা পরিয়ে দিলেন। আপা আজ সবার সাথে খাবার খাবেন।
আমি বিরাট উচ্ছ্বসিত, নিশ্চয়ই আপা খাবার পরে বেড়াতে বের হবেন। আজও হল না।
আপা বাইরেই এলেন না। সবাই যার যার মত খেলতে গেল, আমি ঢেকি ঘরে বসে রইলাম। কিছুই খেলাম না, আপাকে আজ বাইরে আসতে হবে।ও এলেই আমি খাবো!
আমি বসে আছিতো আছিই, আপার খবর নেই। কখন ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই।আম্মা আমাকে ডেকে তুললেন।
"আপা বের হয়েছে?"
"হ্যা, তুমি চল। আপাকে দেখবে।"

উঠোনের ঠিক মাঝখানে একটা লোহার খাটিয়া। চারপাশে ফুলপাতার নকশা করা। ওর মাঝে সাদা কাপড়ে কাউকে পেচিয়ে রাখা।আমি আগেই দেখেছি কেউ মারা গেলে মসজিদ থেকে এই খাটিয়া এনে তাকে সাদা কাপড়ে পেচিয়ে এখানে রাখা হয়। এটা দেখার কি আছে? আমি আম্মার হাত ছাড়িয়ে আপার ঘরের দিকে যেতে চাইলাম, আম্মা জোর করে ওখানেই নিয়ে গেলেন।
মুন্সি কাকা কাপড় সরিয়ে দিলেন। একটা ফ্যাকাসে সাদা মুখ, মাথায় কোন চুল নেই, গাল ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে!আমার অত ইচ্ছে নেই, তবু তাকিয়ে দেখলাম। ইনি কে চিনি না!
ওখান থেকে সরে এসেই আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম,"আম্মা, আপা কই?সন্ধ্যা হয়ে গেল।নদীর পাড়ে যাবে না?"
"শোনো, আল্লাহ যাদের খুব পছন্দ করেন তাদের নিজের কাছে নিয়ে যান।উনিতো একা থাকেন তাই।তোমার আপাকেও আল্লাহ নিজের কাছে নিয়ে গেছেন।"
"কবে ফিরবেন?"
"আর ফিরবেন না।"
"কেন?"
"তুমি খুব প্রশ্ন কর।শোনো, তোমার আপা মারা গিয়েছেন।একটু আগে তুমি যাকে দেখলে, সে তোমার আপা।"
আমি আম্মার কথা বিশ্বাস করি না। আম্মা মিথ্যা বলেন। জ্বর হলে, মিষ্টি বলে তিতা অষুধ খাইয়ে দেন।রাতে ঘুম থেকে তুলে, পানি খাও বলে দুধ খাইয়ে দেন।মিথ্যুক আম্মাকে বিশ্বাস হয় না!আর ঐটা আপা হতেই পারে না।আপা বুড়ি হয়নি,মরবে কেন?

আমি পুকুরে বেধে রাখা কচ্ছপটা নিয়ে আপার কাছে যাবো।তাই পুকুরের দিকে গেলাম। রুকুন ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।
"ভাইয়া জানেন, আপা আমাদের সাথে দেখা করে না।কথা বলে না।আপনি চলে যান, আপা দেখা করবে না।"
পুকুরে বাধা কচ্ছপটা নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আমি সন্ধ্যা মালতি গাছগুলোয় পানি দিচ্ছি।
ফুপা আমাকে ডাকলেন," এই তুমি এখানে কি কর।আস, তোমার আপার কবরে মাটি দিয়ে যাও।"
"আপনিতো পুলিশ আবার নামাজ পড়েন। মিথ্যা কেন বলেন?"

আপা আর বাইরে বের হননি। তবে একটা কবরের পাশে আব্বা আর রুকুন ভাইকে নিয়ম করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।
রুকুন ভাইদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলেই ভালো লাগে, উনি সারা বাড়ি সন্ধ্যা মালতি গাছ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছেন। এখন উনার দেয়া চকলেট আমি নির্দ্বিধায় নিতে পারি, আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য কেউ নেই!
উনার মা আমাদের বাড়ি এসে কান্নাকাটি করেন।ছেলের কি কোন গতি হবে না? তখন কিছুই বুঝিনি!

আমি কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি।একদিন রুকুন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল,উনি বাড়ির পাশে গাছ লাগাচ্ছিলেন।জিজ্ঞেস করলাম,"আর কত!এবার নিজের জনা কিছু করুন।"
"নিজের জন্যই করছি।চল, তোমায় চকলেট কিনে দেই।"
এরপর কিছুদিন আগে তার সাথে আবার দেখা।আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ।
রুকুন ভাই সন্ধ্যা মালতির চাড়া লাগাচ্ছেন।উনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটা মেয়ে,পরনে নীল শাড়ি, লম্বা চুল,হাত নীল চুড়ি দিয়ে ভরা!মেয়েটাকে পুতুলের মত লাগছে।
রুকুন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেলেন।
"বাহ!মেয়েটা সুন্দরতো।কার মেয়ে?"
"আমার মেয়ে, নাম হাসিনূর। মা, চাচ্চুকে ছালাম দাও।"
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বললো," তুমি আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাবে?বাবা নিয়ে যাচ্ছে না।একটু পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে।"

আমি আর হাসিনূর নদীর পাড়ে । ও জুতা খুলে হাতে নিয়েছে, নতুন জুতায় ওর পা কেটে গেছে।
ব্রহ্মপুত্র আগের মতই আছে,এবারও কাশফুলে নদীর পাড় ঢেকে গেছে। সাদা কাশ পরাগের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে সাদা বক।নদীতে গোধুলির লালচে আলো পড়েছে, এই আলোতে অসুন্দর কন্যাদেরও সুন্দর দেখায়।ব্রহ্মপুত্রকেউ হয়তো সুন্দর লাগছে, তবে আমার কিছু ভালো লাগছে না। নদীর পাড়ে ঘন সবুজ ঘাস, বালু নেই।তবু আমার পা আটকে যাচ্ছে, যেন পায়ে শেকড় গজিয়েছে। আমি টেনে টেনে হাটছি!
"তুমি জানো, বাবা যে ফুলগাছ লাগাচ্ছে ওগুলোর নাম সন্ধ্যা মালতি কেন?"
"না, আমি জানি না।"
"ঐ ফুলতো সন্ধ্যায় ফোটে তাই, আর কি যে ঘ্রাণ ছড়ায়।
তুমি জানো কচ্ছপ কোথায় ডিম পাড়ে?"
"না, আমি জানি না।"
"তুমিতো দেখি কিছুই জানো না।এই চাচ্চু, তুমি কাঁদছো কেন?"
"কই, আমি কাঁদছি নাতো।"
"জানো, বাবাও বাগানে বসে কাঁদেন। আমি যদি জিজ্ঞেস করি, বাবা কাঁদছো কেন? বাবাও বলেন, কই কাঁদছি নাতো।"

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪৫

ইসিয়াক বলেছেন: পড়ে মন্তব্য করবো। আমিও একটা গল্প লিখেছি , ড্রাফট করবো....

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫৬

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: অপেক্ষা করছি।

২| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:২৪

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার গল্প। গভীরতা আছে।
ভাষা সুন্দর।

১৭ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৮

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ! আপনাকে আর কত ধন্যবাদ দিই!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.