নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আততায়ী।

মেহরাব হাসান খান

আমি H2O,,,,Solid,Liquid & Gas.How do you deserve me?

মেহরাব হাসান খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

শহুরে

২২ শে মার্চ, ২০২১ বিকাল ৫:৫৭


১....
তার গায়ে মারের পর মার পরছে, কেউ একজন চুলের মুঠি ধরে টানছে, কেউ একজন জামা ধরে টানছে, তার সে দিকে খেয়াল নেই। সে একমনে পিচ্চি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে," তুই কোথায় গিয়েছিলি, ভাই? আমিতো তোকে খুজেই পাইনা। না বলে চলে গেলি। ভালো খাবারের এতই লোভ তোর? এত লোভ থাকবে কেন মানুষের? দেখলি কেমন হল এখন! আমি জানতাম তুই ফিরে আসবি, এইজন্যই আর কোথাও যাইনি।"
পিচ্চি ছেলেটা হতবাক হয়ে পরেছিল। চিৎকার করে উঠলো, পাগলিটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইল। পারছে না।
ছেলেটার মা ততক্ষণে দিশেহারা! পাগলীটার মুখে এলোপাতাড়ি মার শুরু করলো। ছেলেটার বাবাই হবে হয়তো, তিনি লাথি দিলেন। ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মহিলা প্রায় দৌড়ে দূরে সরে গেলেন। মেয়েটিও পিছুপিছু ছুটলো।
ছেলেটার বাবা হাতে ইট নিয়েছে, মারবে। কেউ কিছুই বলছে না।

আমার সাথে ছোট বোন নিহান।আমরা ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে ঢাকা যাবো।নিহান আমাকে ধাক্কা দিয়ে দিল,"ভাইয়া, দেখছ না মেয়েটাকে মেরে ফেললো তো। ওকে বাঁচাও।"
আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।
নিহান দৌড়ে চলে গেল।

"ছেড়ে দিন, ও আপনার ভাই না। ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন।"
পাগলীটা ছেলেটার শার্টের কোণা ধরেই আছে। ছেলেটার বাবা ইট উঁচিয়ে আছে।
নিহান কেঁদে ফেললো,"আমার কথা শুনুন, ছেড়ে দিন। আপনাকে মেরে ফেলবেতো।"
আমি লোকটাকে থামালাম।
পাগলীটা ছেলেটাকে ছেড়ে দিল।

অনেক লোক জড় হয়ে গেল।
পাগলী বলেই হয়তো তাকে কেউ কিছু বললো না। কিছুই বলেনি, বলা যাবে না। আঘাতের চোটে নাক ফেটে রক্ত পরছে, জামার বুকের দিকটা ছিড়ে গেছে। সে দিকে তার খেয়াল নেই।
পাগলীটা নিহানকে বলছে,"তুমি কাদছ কেন?মার তো খেলাম আমি।তুমি কেন কাদছ?"
পাগলীটা হাসছে।
নিহান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,"ভাইয়া, চল উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।"
আমি বললাম, "না, নিহান চলে এসো। আমাদের ট্রেন আসবে এক্ষুনি।"
"না, দেখছ না উনার গা থেকে রক্ত পরছে। আগে উনাকে হাসপাতালে নিয়ে চল। পরে...."
পাগলীটা এগিয়ে এল, একটা ছবি দেখিয়ে বললো,"এই ছবিটা দেখ। এটা আমার ভাই, কোথায় চলে গেছে। আমি একেই খুঁজছি।খুজে পাচ্ছি না।"
নিহান আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ছেলেটা কোথায় আছে সেটা সে জানে না। সে এজন্য বেশ লজ্জিত। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না।

ঢাকাগামী ট্রেন থামলো, মানুষজন যারযার মত চল গেল। পাগলীটাও দৌড়ে চলে গেল। যেই নামছে তাকেই ছবি দেখিয়ে জানা জিজ্ঞেস করছে,"ভাই, এটা আমার ভাই শাবাব। রাগ করে ট্রেনে চড়েছিল। একে দেখেছেন? আমি শাবাবকে খুজে পাচ্ছি না।"
স্পষ্ট শুদ্ধভাষা শুনে মানুষ ভড়কে যায়। ভালো পোশাক পরা থাকলে বোঝার উপায় নেই মেয়েটা পাগলী।
শুদ্ধভাবে কথা বলা পাগলী! মানুষ একটু কৌতুহলী হয়, এটা ছাড়া আর সুবিধা পাওয়া যায় না।
মানুষের এত সুময়ও নাই। পাগলী মেয়েটা দৌড়ে দৌড়ে বাচ্চাদের দেখতে থাকে, যদি তার ভাইকে পাওয়া যায়!
মানুষজন বিরক্ত হয়, মারতে আসে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই, সে তার কাজ করছেই।

নিহান দৌড়ে গেল, পাগলীটার হাত ধরে বললো,"আপু কেন এমন করছেন, এখানে আপনার ভাই নেই। মানুষ আপনাকে আবার মারবে, এদিকে আসুন। আসুন আমার সাথে।"
নিহান তাকে হাত ধরে এদিকে নিয়ে এলো।
পাগলীটা এত মার খেয়েই কাঁদেনি। এখন কেঁদে ফেললো,"তাহলে আমার ভাইকে কোথায় পাবো?"

২....
আমরা ময়মনসিংহ রেলওয়ে অফিসার্স কোয়ার্টারের সামনে যে বেঞ্চটা আছে সেটাতে বসে আছি। মাথায় উপর একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, গাছে লাল আগুন জ্বলছে। কিছু অতিউৎসাহী কিছু লোক এখনো আমাদের ঘিরে আছে। নিহান মেয়েটার সাথে প্ল্যাটফর্মে বসে আছে, স্যাভলনে ভিজিয়ে তুলা দিয়ে মেয়েটার ক্ষত মুছে দিচ্ছে।

"নিহান, বেবি চল। এখনি ট্রেন ছাড়বে।"
"না, তুমি আগে ইনার ভাইকে খুঁজে দাও।পরে ঢাকা যাবো।"
আমার ছোট্ট দুই বোন_সানিয়া, নিহান। এদেরকে আমি অনেক ভালোবাসি। কখনো বাজে আচরণ করিনা। তবুও বেশ চোখ গরম করেই বললাম,"বেবি, চল। অনেক হয়েছে। এবার চল।"
নিহান আরও বেশি দৃঢ়ভাবে বললো,"না, তুমি উনার ভাইকে খুজে না দিলে আমি কোথাও যাবো না।এখানে বসেই থাকবো, উনার সাথেই থাকবো।"
নিহান আবার উনার সাথে প্ল্যাটফর্মে বসে পরলো।

নিহানটা এমনই জেদি!এখন আর তাকে এখান থেকে ফেরানো যাবে না।
আমি মেয়েটার সাথে কথা বলা শুরু করলাম।
তার প্রায় কিছুই মনে নেই, বাবা,মায়ের নাম, কোথায় বাড়ি, কিছুই না। কেবল একদিনের ঘটনা মনে আছে।

৩....
বড় মাঠের এককোণে পুলাপানের দল খেলছে। ধান কাটা শেষ, সারা মাঠেই গরু-ছাগল চড়ছে। এখনো সন্ধ্যা হয়নি, সূর্য এককোণে হেলে পরেছে।
মাঠের একপাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাতে একটা পেয়ারা। ডাশা পেয়ারা!সে পেয়ারাটা আমি জামার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছি।
ভাই মাঠে খেলছে। ঠিক খেলা বলা যায় না, হুদাই দৌড়াদৌড়ি, আর শাবাব খেলার অংশও না। সে দুধভাত! শাবাবকে এটা বোঝাবে কার সাধ্য!সে হুদাই দৌড়ঝাঁপ করছে।
আমার ইচ্ছে পেয়ারাটা এখনই খাই, পারছি না। আমার কাছে একটাই পেয়ারা, আর ভাইকে এখানে ডেকে নিয়ে পেয়ারা দিলেও সে খেতে পারবে না। রফিক কেড়ে নিয়ে যাবে।
রফিক আমার কাকাতো ভাই। সব কিছুতেই ওর জোরজবরদস্তি।

আসলে আমাকে, শাবাবকে কেউ দেখতে পারে না। সবাই বুঝে গেছে, আমাদের কেউ নেই। যাদের বাবা-মা নেই, আসলে তাদের কেউ নেই। সবাই আমাদের দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়। কেন এমন করে? সবাই আগে আমাদের কত আদর করতো!

বাবা-মা যখন ছিল, বড় ফুপু কত আদর করতেন। তুলে খাইয়ে দিতেন! আর সেদিন শাবাবকে গরুর চাড়িতে পানি দিতে বললেন। কি একটু দেরি হল দেখে দিলেন কষে এক চড়!
সন্ধ্যায় হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করতে দেরি হল দেখে রাতে আমাদের দুই ভাইবোনকে খেতেই দিলেন না। সে রাতেই শাবাব আর আমি আবার কাকার বাড়ি ফিরে এলাম। কাকা-কাকী বকেন, মারেন তবুও খাবার দেন। সব কষ্ট সহ্য হয়, খাবার কষ্ট সহ্য হয় না। আর শাবাব ভালো খাবার পছন্দ করে।

এখানে আসার পর থেকে অত্যাচার, গালমন্দ আগের চেয়ে বেড়ে গেল। কাকী কথায় কথায় বলেন,"গেলি না ফুপুর বাড়ি। কই? দুই দিনওতো থাকবার পারলি না! আমার বাড়ি থাকবার চাইলে আমার কতা হুনন লাগবো। নইলে চইলা যা যে দিগে যাবার চাস। ভাড়া খাটগা, আমার ঠেকা নাই।"

আমার খুব আগ্রহ হল, আমি জিজ্ঞেস করতে চাইলাম, ভাড়া খেটে আসলে কত টাকা পাওয়া যায়? কোথায় ভাড়া খাটা যায়? ভাইকে স্কুলে পাঠানো যাবে তো? পোলাও-মাংস কেনার টাকা হবে তো?
সাহস হয়নি। কাকী এমনে ভালোই, রেগে গেলে ভয়ানক হয়ে যান। সেদিন তো কাকাকে মারতে বটি নিয়ে গেলেন।কাকী কখনো মারেননি, তাই বলে মারতে পারবেন না, তা তো না। তাই আমি চুপ করেই রইলাম!

আমি খেতের আইলে বসে রইলাম। আমাকে বসে থাকতেই হয়। পাড়ার ছেলেগুলোও বুঝে গিয়েছে, আমাদের কেউ নেই। আমাদের মারলে কেউ কিছুই বলবে না। শাবাব অকারণে মার খায়, তবুও খেলতে তাকে হবেই। আমি কাছে থাকলে তবু তাকে একটু আধটু বাঁচাতে পারি।
শাবাব এখনো অনেক ছোট, তাই তাকে কোন কাজ করতে হয় না। একটু বড় হলে তাকেও হয়তো কাজ করতে হবে।

সারাদিন আমি নানা কাজ করি। সকালে থালাবাসন মাজি, উঠান ঝাড়ু দিয়ে গরুকে খাবার দিই। সকালে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে না নিতেই আবার কাপড় কাঁচতে হয়। গোসল করে খাবার পরই কাকী কোন না কোন কাজ বের করেই ফেলেন। বিকেলটা আমার নিজের, তাও নিজের জন্য কিছু করা হয় না। আমি শাবাবকে পড়ানোর চেষ্টা করি, সে কিছুতেই পড়বে না। সে খেলতে যাবে। ওরাতো আমাকেই খেলায় নেয় না, আবার ছোট্ট শাবাবকে! শাবাবকে দিয়ে এটাসেটা কাজ করানো যায় দেখে দুধভাত নেয় আরকি!আর শুধুশুধু মার দেয়া যায়তো!

আমরা ঢাকায় থাকতে স্কুলে যেতাম। এখানে স্কুলে যেতে হয় না। ঢাকায় স্কুলে যেতে ইচ্ছে হত না, বাবা এটাওটা দিয়ে ভুলিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতেন। এখানে স্কুলে যেতে হয় না, এটা আনন্দের হবার কথা। কিন্তু আমার ভালো লাগে না, মন খারাপ হয়।
কাকী কাকাকে বলেছেন," ওদের স্কুলে পাঠিয়ে কি হবে? শুধুশুধু টাকা নষ্ট।"

স্কুলে যেতে টাকা লাগে, ভাড়া খাটলে নিশ্চয়ই টাকা পাওয়া যাবে। আমি শাবাবকে স্কুলে পাঠাতে চাই। শাবাব কিছুতেই আমার কাছে পড়তে চায় না!
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, কাকী জিজ্ঞেস করবো কোথায় ভাড়া খাটা যায়, কত টাকা পাওয়া যায়?

এগুলা ভাবতে ভাবতে কখন শাবাব আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, সে দেখতেই পাইনি।
: দিদি, ল বাড়ি যাই। ম্যালা খিদা লাগছে।
: হ্যা, নবাবজাদার এতক্ষণে বাড়ি ফিরার সময় হল। বাড়ি গিয়ে আগে অ,আ,.. শিখবি পরে খাবার। আর এসব কেমন কথা, শুদ্ধভাষা বলতে পারিস না?আর কত শেখাবো!
: আমি শুধভাষা কইতাম না৷ আমি পড়তামও না। আমি বাড়িত গিয়াই খামু।বুবু তর হাতে কি? পেয়ারা নি? দে আমারে, দে....
: শুদ্ধভাবে বল তাহলে পাবি।
: বুবু, পেয়ারাটা আমাকে দাও।
: এখন না, বাড়ি গিয়ে হাত-মুখ ধুয়েই পেয়ারাটা পাবি।
: খাইতাম না তর পেয়ারা, তুই খাগা।

শাবাব হনহন করে চলে গেল।

আমি ভাইকে খাইয়ে দিলাম। শাবাবের চোখ ঢুলু ঢুলু। আমি বললা," এখনই ঘুমিয়ে পরছিস? বললাম না, খেয়ে একটু পড়তে বসবি। পড়াশোনা না করলে কেমনে হবে? এই শাবাব, এই! চোখ খোল, শাবাব!"
শাবাবের খেয়াল নেই। সে খাবার গিলছে আর ঝিমুচ্ছে।

আমার কাকা আমার কাছে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
: বকুল, মারে! আমার অভাবের সংসারে তরা কষ্ট করতাছস!
: চাচ্চু, তোমার মোটেই অভাবে সংসার না। তোমার এত বড় বাড়ি, ৩০ টা গরু, আর তুমি ১৫০ মণ ধানও পাও!
: ঐ অইল। তাওতো গরীবই, তগেরে স্কুলে পাডাইবার পারি না। তর কাকী তগেরে মারে, বহা দেয়, আমি কিছুই কইবার পারি না। মনে কষ্ট লাগে।
: কাকী আমাদের বকে তবে মারে না। তুমি আমাদের অকারণে মার। কাকী বকলে খারাপ লাগে না, তুমি বকলে অনেক খারাপ লাগে। তুমি আগে অনেক আদর করতে, এখন কর না। বাবা মারা গেল, আম্মু কোথায় চলে গেল, এরপর থেকে কর না। কেন আদর কর না?

কাকা উত্তর দিতে পারলেন না।
: শোন মা, তুই আবার স্কুলে যাবি, তরে আর কামও করন লাগবো না। ভালোমন্দ খাবি, নতুন জামা পাবি।
আমি আনন্দে হেসে ফেললাম।
: সত্যি বলছো চাচ্চু? কবে থেকে? কালকে থেকে?চাচ্চু, তুমি ভালো হয়ে গেলে!
: আগে শুন, তর এক খালা আছে। হেয় তগেরে নিবার চায়। হেয় তগেরে নিয়া পড়ালেহা করাবার চায়। এহানে থাকলে পড়ালেহা অইত না, তর চাচী ভালা, তগেরে দিয়া কাম করাইব। তরা হের কাছে যাগা।
: কিন্তু, আমার কোন খালা-মামা নেই। আম্মুই বলেছেন।
: তর খালা বিদেশ থাহে হের লেইগা তর মায় কয় নাই।
আমি চাচ্চুর হাত ধরে ফেললাম।
: সত্যি বলছো, চাচ্চু?
: মিছা কমু কিয়ের লেইগগা? আমি তর বাপের মায়ের পেটের ভাই। এই দেখ আল্লার কিরা কাইট্টা কইলাম।
আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, আবার অবিশ্বাসও না। চাচ্চু আগে অনেক আদর করতেন। বাবা-মা মরে যাবার পর থেকে কি হল কে জানে?
: আচ্ছা, কবে নিয়ে যাবেন আমাদের?
: আইজকাই। আইজকা রাইতেই।
: এত রাতে!
: আইজকাই তগেরে নিয়া বিদেশ যাইবো গা। আমারে হুস কইরা খবর দিছে।
: আমাদের নিতে এলেন না কেন?
: তুই বেশি কতা কস, না যাবার চাইলে নাই। আমি হেরে খবর পাডাই দেই।এইহানে কাম কইরা কইরা মর! আর গেলে তড়াতড়ি তৈয়ার হ।

কত রাত জানি না, ঘুটঘুটে অন্ধকার। পথঘাট কিছুই চিনি না। আমরা বসে আছি ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে, মাল ঘরের সামনে। কতক্ষণ বসে আছি জানি না।
কাকাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম, খালামনি কখন আসবেন?
তিনি বললেন, চলে আসবেন তাড়াতাড়ি।
শাবাব কিছু খেতে চাইল। তিনি কিনে আনতে গেলেন, আমাদের সাথে নিলেন না। যদি খালা চলে আসে, আমাদের না পেয়ে চলে যান। তাই আমরা বসে রইলাম। বসেই রইলাম, কাকা আর ফিরে এলেন না।

আমরা অনেকদিন একই জায়গায় বসে অপেক্ষা করলাম, হয় আমি, নয়তো ভাই সবসময় মাল ঘরের সামনেই থাকতাম। পাছে কাকা,খালা এসে আমাদের না দেখতে পান। কেউই এলেন না।

কয়েকদিন কেটে গেল, ট্রেন যায়, ট্রেন আসে! আমরা কোথাও যাই না। এটাসেটা খেয়ে, প্ল্যাটফর্মে ঘুমিয়ে দিন চলেই যাচ্ছিল। শাবাবটা লোভী, খাবারের লোভ দেখালে ওকে যে কাজ দেয়া হবে সেটাই করবে।ছোট তো তাই!

একদিন এক মহিলার ব্যাগ টেনে দিল। মহিলা বললেন ব্যাগে পোলাও আছে,তাকে খেতে দিবে। আমি ওকে ফেরাতে চাইলাম। কিছুতেই শুনলো না!
শেষবার যখন ওকে দেখলাম, তখন ও ট্রেনে বসে পোলাও খাচ্ছে। আমি ভাবলাম বোতলে পানি এনে দিই। পানি এনে দেখি ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, আমি ট্রেনে চড়তে পারলাম না। পরের ট্রেনে আমিও চড়লাম, ট্রেন চলে গেল চট্রগ্রামে। সেখানে শাবাবকে পেলাম না। ঢাকার ট্রেনে করে গেলাম, সেখানেও পেলাম না।
আমি ওকে খুঁজেই যাচ্ছি।

৪....
নিহান, মেয়েটি দুজনেই কাঁদছে।
: বকুল, এ ঘটনা তো অনেক আগের, তাই না?
: হ্যা, অনেক আগের। কতদিন আগের আমার মনে নাই।
: আপনার ভাইতো বড় হয়ে গেছে!
: হ্যা, কিন্তু এটা আমার মনে থাকে না। কোন ছোট্ট ছেলে দেখলেই মনে হয়, এটাই শাবাব। কেউ বলে দিলে তবেই মনে হয়, অনেক সময় চলে গেছে। শাবাব আর আগের মত নেই!আজকে যখন নিহান বললো তখনই মনে হল.....
: আপনি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেননি?
: চেষ্টা করেছি, পারিনি। আমি কিছুই চিনি না। সেদিনের ঘটনা ছাড়া আমার কিছুই মনে নেই। কেন মনে নেই? শাবাবকে ছাড়া আমার আর কিছু মনেও থাকে না।
: আপনিতো পাগল না, একটু ভালোভাবে থাকলে হয়তো.... কি সুন্দর করে কথা বলছেন!

মেয়েটি মাথা নিচু করে ফেললো।
: আমি জানি না। তবে পাগলী সেজে থাকাই নিরাপদ, কেউ বিরক্ত করে না। যখন ভালোভাবে থাকতে চাইলাম, পারলাম না। মানুষের মন অত্যন্ত নোংরা। লোকজন আমারে ভাইকে খুঁজে দিবে বলে জোরজবরদস্তি করে খারাপ কাজ করতে চায়। আমার মনেই থাকে না, আমি নিজেও আর ছোট নেই!কাকে বিশ্বাস করবো, কাকে করবো না;বুঝিনা।

আমি তাকে কিছু টাকা, আর যোগাযোগের জন্য ফোন নাম্বার দিয়ে চলে এলাম। কথা দিলাম, শাবাবকে খুজে পেতে তাকে সাহায্য করবো।
ঢাকা এসে নানা কাকে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। নিহান নিজেও ঢাকা এসে ঘোরাঘুরি, রিহানের সাথে খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। ওর আর কিছু মনেও নেই।

৫....
নিহান বড় হয়ে গেছে। হ্যা, আগের মতই একরোখা আর জেদি! ও রাজউক'এ পড়ে।
গত রাতে খবর পেলাম, দাদা অসুস্থ হয়ে পরেছেন। তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
নিহান ট্রেন থেকে নামতেই মহিলাটা একটা ছবি এগিয়ে দিয়ে, বললেন,"আপা, এটা আমার ভাই শাবাব। এই ট্রেনে ফিরবার কথা, তাকে দেখেছেন?"
নিহানের কানে ইয়ারফুন গোজা, সে যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বললো,"কেন বিরক্ত করছেন? অন্যদিকে যান তো। যত্তসব পাগলের আড্ডা স্টেশনেই কেন হয় কে জানে!"
আশ্চর্য!নিহান বকুলকে চিনতেই পারলো না!
নিহান নেমে হাটা শুরু করেছে, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।

আমিও এমন ছিলাম। একবার বাড়িতে একটা কুকুর পেলেছিলাম, আব্বা কুকুরটাকে দূরে ফেলে দিয়ে আসলেন। আমি নাকি অনেক কান্না করেছিলাম। সাতদিন কান্নাকাটির পর আব্বা সেটাকেই ফেরত এনে দিয়েছেন। বাড়িতে কোন ভিক্ষুক এলে কখনো ফেরত যেতে দিতাম না, যাকে ডেকেই হোক ভিক্ষা আমি দিতামই। আম্মা সবসময় বলেন,"আমার ছোট ছেলেটা অন্যরকম।"

বড় হয়ে গেছি, ঢাকা আসার পরও কখনো কেউ হাত পাতলে কাউকে ফিরাইনি। কেউ ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসতাম।
এখন আর এগুলা করি না, রেগে বলি,"যান তো, বিরক্ত করবেন না।"
ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে, নির্দ্বিধায় বলি,"ঐ তো, ঐ দিকে যান!"
আসলে আমি কোন দিকেই দেখাই না।

এমন হল কেন?
ঢাকায় আমরা এত ভিক্ষুক, অসহায় লোক দেখি;আমাদের মনটাই পাথর হয়ে যায়। শহরে এত অসহায় মানুষ, আমরা কয়েকজনকে সাহায্য করবো?আর আমরা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত, আমাদের মানবিকতাবোধ মারা যায়।

আমি আস্তে আস্তে গেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। বকুলের সাথে কথা বলার ইচ্ছে করছে আবার লজ্জা হচ্ছে খুব। ও যদি প্রশ্ন করে," শাবাবকে খুজে দেবার জন্য আপনি কি করেছেন?"
আমিতো উত্তর দিতে পারবো না।

গেটের বাইরে আসতেই দেখলাম, একটা ছোট ছেলে মাটিতে গড়াগড়ি করছে। পাশেই বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন। মানানোর চেষ্টা করছেন, পারছেন না। ছেলেটার এক দাবি,"বাবা, তুমিতো পুলিশ, মেয়েটির ভাইকে খুজে দাও।শাবাবকে খুজে দাও, এক্ষুনি দাও। নইলে আমি কোথাও যাবো না,এখানেই থেকে যাবো।"
একটা ভীড় জমে গেছে, ভদ্রলোক বিব্রতবোধ করছেন।

এই ছেলেটাও একদিন বড় হবে, বড় স্কুলে পড়বে। তারপর সব ভুলে যাবে। কেউ সাহায্য চাইলে আমার মত বিরক্ত হবে!
বড় বড় শহর আমাদের অনেক কিছুই দেয়, কিন্তু আমাদের মানবিকতাবোধটা কেড়ে নেয়। আমরা একটাই শিক্ষা পাই,'এটা তার সমস্যা, আমার তো না।'

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে মার্চ, ২০২১ রাত ৮:৪৩

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: :(

২২ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১১:৪৯

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: মেয়েটাকে এখনো দেখা যায়!

২| ২৩ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১:০৫

রাজীব নুর বলেছেন: আমি কথাটা আরেকবার বলি- আপনি ভালো লিখেন।

২৪ শে মার্চ, ২০২১ রাত ৮:২১

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ, রাজীব ভাই!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.