নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আগুনপরী

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৫

আগুন! হলুুদ শিখার আগুন আমি! কেউ কেউ কাব্যিক ঢঙে বলে, ‘ওগো হলুদ শিখার আগুনপরী, ইচ্ছে করে তোর বুকে ঝাঁপিয়ে মরি!’ আমি হেসেই মরি! কিন্তু মারি না। আমার হলুদ শিখায় আকৃষ্ট হয়ে কতো না অজানা-অচেনা মানুষ পোকার মতো ছুটে আসে, আগুনে ঝাঁপায়, কাউকেই মারি না আমি; যারা আসে তারা যে আমার খদ্দের লক্ষ্মী! আমি কেবল তাদের সাথে খেলা করি। মহাকালের দামাল খেলার আনন্দে ভাসাই তাদের, নিজে ভাসি। দেহরেকাব সাজিয়ে আমি তাদের সেবা করি, কামসেবা।
কেউ বলে, ‘নাগিনী তুমি, বীণের সুরে উন্মাতাল হয়ে যাও, এতেই তো বীণ বাদকের আনন্দ!’ সত্যিই, আমি ফণা তুলি, শিস দিই। কিন্তু দংশন করি না, বিষ ঢালি না; ঢালি অমৃত!

আমি জানি, আমার হলুদ রঙের আগুন শিখার ভিতরে লুকোনো আছে মৃত্যুর আগুন। আমি সে আগুনে নিজে পুড়ি, কিন্তু কাউকে পোড়াই না। অথচ আমি চাইলেই সেই আগুন বাতাসের মতো ছড়িয়ে দিতে পারি হাজারো পুরুষের শরীরে, ভয়ংকর নাগিনীর মতো বিষ ঢেলে দিতে পারি হাজারো বীণ বাদকের দেহে!

চার প্রজন্ম ধরে আমরা পল্লীতে বাস করছিলাম। ভদ্রলোকেরা আমাদের পল্লীর নাম দিয়েছেন-যৌনপল্লী, পতিতালয়, বেশ্যাখানা ইত্যাদি। আমার নানীর মুখে শোনা কথা, তার মা নাকি ভদ্রবাড়ির বউ ছিলেন, কাজী বাড়ির বউ! নানীর বাবা আরো দুটো বিয়ে করার পর তার মাকে যখন তালাক দেন, তখন তার মায়ের কোলে এক বছরের মেয়ে আর চার বছরের একটি ছেলে। ছেলেটিকে অবশ্য তার বাবা রেখে দেন। তারপর নানীর মা মেয়ে কোলে পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে ঠিকানা খুঁজে পান পল্লীতে। সেই এক বছরের মেয়ে-ই আমার নানী।

আমার মায়ের জন্ম পল্লীতেই, আমারও। আমার মায়ের বাবা কে, মা তা জানতেন না। নানীও জানেন না কে তার সন্তানের পিতা। আমার বাবা কে, আমিও তা জানি না। তবে আমার মা যাকে-তাকে ঘরে তুলতেন না। লুঙ্গি পরা লোকজন মায়ের কাছে ভিড়তে গেলে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিতেন। আমি দেখেছি, মায়ের ঘরে যারা ঢুকতেন, তারা বেশ ফিটফাট বাবু গোছের মানুষ। মা দেখতে ভীষণ সুন্দরী ছিলেন। সবাই বলে, আমিও আমার মায়ের মতো হয়েছি। উচ্চতা ভালো, চিকনাই শরীর, আর গায়ের রঙ? ঐ যে বললাম, আগুনের হলুদ শিখা! এমনি এমনি কী আর আমার নাম হয়েছে আগুনপরী!

এ থেকেই অনুমান করতে পারি, আমার বাবা কোনো ভদ্র বাড়ির, ভদ্রগোছের মানুষ-ই হবেন! হয়তো আমার বাবা এখন তার স্ত্রী এবং অন্য ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে ভাল বাড়িতে থাকছেন, সুখে-শান্তিতে হেসে-খেলে দিন পার করছেন। ঘটনা অনেকটা মহীরুহের বীজের মতো; কোনোটা অঙ্কুরিত হলে জায়গা পায় বড়লোকের বাড়ির বাগানে, অনেক যত্নে লালিত-পালিত হয়; আবার কোনোটা অঙ্কুরিত হয়ে বেড়ে ওঠে আস্তাকুঁড়ে, আস্তাকুঁড়েই হয় বিনাশ।

মা হঠাৎ মারা যান আমার তেরো বছর বয়সে। মা মারা যেতেই নানী আমাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে লাইনে নামিয়ে দেন। আসলে না নামিয়ে উপায় ছিল না। তেল প্রায় ফুরিয়ে, শিখা হারিয়ে নানী তখন মিইয়ে যাওয়া পলতে! ভুলেও কোনো পোকা সে পলতের কাছ ঘেঁষে না। অগত্যা খেয়ে-প’রে বাঁচার জন্য নাতনিকে তার অপরিণত শিখা-ই উন্মোচন করতে হয়, শিখার লোভনীয় হাতছানি দিতে হয়। আমি তখন অনেক কিছুই বুঝি না, আমি তখন একটা নিভাঁজ সাদা কাগজের পাতা। দাগ-ময়লা বিহীন সাদা কাগজে একটু একটু করে দাগ পড়তে থাকে। আমি একটু একটু করে শিখতে থাকি জীবনের জটিলতা-কুটিলতা, সত্য-মিথ্যার অলিগলি, আনাচ-কানাচ। এখন আমার বয়স বাইশ।

চার প্রজন্ম ধরে পল্লীতে আমাদের বাস; পল্লী-ই আমাদের ঘরবাড়ি, সংসার; আমাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের নিত্যসঙ্গী। আমাদের পল্লী অনেক মানুষের কাছেই নরকের দুয়ার, কিন্তু আমাদের কাছে তো মন্দির; কামমন্দির! কামমন্দিরের তীর্থযাত্রীদের ছুড়ে দেওয়া টাকার অন্ন খেয়েই তো আমরা হাজার দেড়েক মানুষ এতোদিন বেঁচেছি। যারা আমাদের পল্লীকে নরকের দুয়ার বলে, ঘৃণায় কপাল কুঁচকে তাকায়, ধর্মের বড় বড় বুলি দেয়; তারা কেউ কোনোদিন অন্তরচক্ষু দিয়ে দ্যাখেনি আমরা হাজার দেড়েক মানুষ কীভাবে দিন যাপন করি। আমাদের চেয়ে আর কে ভাল জানে যে, এ জীবন বড় যাতনার, বড় কষ্টের। এ ব্যথার উপশম আমরাও চাই। স্বামী-সন্তান-সংসার কোন নারী না চায়? কিন্তু কীভাবে? হুট করে পল্লী ছেড়ে গেলেই কি আমরা ভদ্র সমাজে ঠাঁই পেতাম? কাজ পেতাম? পেতাম না। সমাজের মানুষদের খুব ভাল করেই চিনি আমরা। তারা রাতের বেলা ফুর্তি করে পয়সা ছুড়ে দিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু দিনের বেলা আমাদের নাম শুনলেও যেন তাদের জাত যায়! আমরা তো সব সময়ই চেয়েছি কেউ আমাদের পাশে এসে দাঁড়াক। আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুক, যাতে আমরা কাজ করে সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করতে পারি। কিন্তু কেউ আমাদের যন্ত্রণা বোঝেনি, আমাদের কথা শোনেনি। আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি। এই দেড় হাজার মানুষের দায় কেউ নিতে চায়নি, নেয়ওনি। না কোনো সরকার, না কোনো প্রতিষ্ঠান। বরং আমাদের নাম ভাঙিয়ে বিদেশ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা এনে তা লোপাট করে দিয়েছে কিছু কপট দরদী এন,জি,ও।

সেই তেরো বছরে কাজে নেমেছিলাম, এখন আমার বয়স বাইশ। প্রায় দশ বছর ধরে কাজ করছি। এই দশ বছরে কতো যে অজানা-অচেনা মানুষ আমার অতিথি হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। এরপরও আমার কোনো পাপবোধ নেই। জন্মের পর একজন কৃষকের সন্তান যেমন কৃষিকাজ দেখতে দেখতে বড় হয়, একজন তাঁতির সন্তান যেমন বুনন দেখতে দেখতে বড় হয়, তেমনি আমিও কামকলা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। দেখেছি একাজেই আমাদের আনন্দ-বেদনা, অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা। তাই এই কাজটিকেই আমি স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছি। এই কাজটিই আমার কাছে সত্য।

এতো বছর ধরে এতো এতো মানুষের কামনা-বাসনা, শারীরিক ক্ষুধার উপশম করেছি। আমার শরীরে পড়েছে হাজারো বেগানা পুরুষের দাঁত-নখের আঁচড়। কিন্তু কোনোদিন নিজেকে অপবিত্র মনে হয়নি। কারণ, দেহ বিকিয়েছি জীবিকার তাগিদে, কোনো ছলনা-প্রতারণার আশ্রয় নিইনি। আগত অতিথিদের আপ্যায়নেও ত্রুটি করিনি কখনো।

কিন্তু কাল রাত থেকে নিজেকে কেমন অপবিত্র মনে হচ্ছে! এতো বছরে হাজারো পুরুষ আমাকে যা করতে পারেনি, কাল রাতে মাত্র তিনজন পুরুষ তা করেছে। আমাকে অপবিত্র করেছে, যেন নর্দমার পচা গন্ধে ভরে গেছে শরীরটা; নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে নিজেরই ভীষণ ঘেন্না হচ্ছে!

পরশু বিকেলে হঠাৎ-ই বাড়িওয়ালারা এসে আমাদেরকে ঘর ছেড়ে দিতে বলে। একটা বিপদের আভাস কয়েকদিন ধরেই পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেটা যে এতো দ্রুত আর এমন কদর্য ও নির্মমভাবে আসবে তা আমরা কেউ-ই বুঝে উঠতে পারিনি। নেতার সাথে হাজী সাহেব, মাওলানা এবং আরও কিছু লোকজন মিলে আমাদের উচ্ছেদের নীল নকশা করেছে শুক্রবার দিন জুম্মার নাজাজের পর, মসজিদেই। বাড়িওয়ালারা ঘর ছাড়ার কথা বলার পরপরই বিপদের গন্ধ পেয়ে কেউ কেউ পল্লী ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু আমাদের অনেকেরই যাবার কোনো জায়গা নেই। বাড়ি-ঘর, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, কোথাও কেউ নেই। পল্লী-ই আমাদের ঘর-বাড়ি, বাবা-মা, পরমাত্মীয়। পল্লী ছেড়ে আমরা কোথায় যাব? ‘কিচ্ছু হবে না’ এই আশায় বুক বেঁধে আমরা অনেকেই থেকে যাই পল্লীতে।

কাল সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই শুরু হয় তাণ্ডব! নেতার পোষা গুণ্ডারা পল্লীতে ঢুকে জিনিসপত্র ভাঙচুর আর মানুষজনকে মারধর করতে শুরু করে। আকর্ষিক আক্রমণে চিৎকার আর কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পল্লীর বিশুদ্ধ বাতাস। আমি তখন খাবার জল নিয়ে ঘরে ফিরছিলাম, নরপশুদের তাণ্ডব দেখে আমার ঘরের দিকে দৌড় দিই। দেখি নানী দরজায় দাঁড়িয়ে ভীত চোখে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি ঘরে ঢোকার পর মুহূর্তেই নানীকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে দুই পাষণ্ড ঘরে ঢোকে, একটু পরই আরো একজন।

বাইরে চাঁদের আলো থাকলেও ঘরের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদের তাড়াতে বিকেলেই পল্লীর বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয়। অন্ধকারে আমি কারো মুখ দেখতে পাই না, শুধু বুঝি যে তিনটে শরীর আমার শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আমার জামা-পাজামা ছিঁড়ে নগ্ন করে তারা বাঘের মতো খুবলে খেতে চাইছে আমার শরীর! আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি, কিন্তু আমার দূর্বল প্রতিরোধ নিমেষেই মুখ থুবড়ে পড়ে। এই প্রথম আমি ধর্ষিত হই, এই প্রথম আমি অপবিত্র হই!

পাষণ্ডরা আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে যাবার সময় আমার এতোদিনের জমানো সম্বল লুটে নিয়ে যায়। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে আমার আলমারির জিনিসপত্র ভেঙে তছনছ করে, ভাঙচুর শেষে আমার টাকার ব্যাগটি নিয়ে যায়। আমি বাঁধা দিতে গেলে একজন আমার গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে আমাকে বিছানায় ফেলে দেয়। আমার পৃথিবীটা দুলে ওঠে ভীষণ জোরে। বিছানায় শুয়ে ঘোরলাগা অবস্থায় আমার কানে আসে ওদের কণ্ঠ, ‘সকালের মইেদ্যে ঘর না ছাড়লি আগুনে পুড়াইয়া মারুম খানকি গুলারে!’

সব হারিয়ে আমি নগ্ন অবস্থায়ই বিছানায় পড়ে থাকি। অন্ধকারে মিশে থাকি। আমার গলা দিয়ে কান্না বের হয় না। আমি তখন কাঁদতেও ভুলে গেছি। লজ্জায়-ঘৃণায়-ক্ষোভে আমি কামড়ে বালিশের কাভার ছিঁড়ে ফেলি।

কতোক্ষণ ওভাবে পড়ে ছিলাম জানি না। নানী এসে আমার গায়ে হাত রাখতেই আমি যেন সম্বিত ফিরে পাই। নানী বলেন, ‘ওঠ। জিনিসপত্তর গোছগাছ কর। সকালেই চলে যাওন নাগবো।’

আমি কোনো কথা বলি না। পল্লীর ঘরে ঘরে তখন কান্নার রোল উঠেছে। বুকের ব্যথা কান্না আর বিলাপ হয়ে আছড়ে পড়ছে পল্লীর বাতাসের গায়ে। কান্নাজড়িত বিলাপ শুনে বুঝতে পারি, কেবল আমি নই, আমার মতো আরো অনেকেই তার সারাজীবনের সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে।

নানী আমায় আবার তাড়া দেন, ‘ওঠ লো বুন, ব্যাগ-বুগ গুছা।’

এবার আমার গলা থেকে ছিটকে বের হয় কান্না। কান্না জড়ানো গলায় বলি, ‘কী গুছাবো নানী? যা নেবার ছিল, তা তো নিয়ে গেল!’

নানীও আর কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন। নানী বাইরে শক্ত হয়ে থাকলেও তার ভেতরের কান্না প্রাণে বাজে! কারণ পল্লীতে আমার কেটেছে মাত্র বাইশ বছর, আর নানীর বাহাত্তর! রাতে আর আমাদের কিছুই খাওয়া হয় না। আমি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।

তখন অনেক রাত। নানী ঘরে নেই। আচমকা আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘরের সামনে থেকে গুনগুন সুরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে আমার কানে। আমি হাতড়ে হাতড়ে অন্য একটা পাজামা প’রে, অনাবৃত শরীরে একটা ওড়নার আবরণ দিয়ে দরজার বাইরে এসে দেখি, নানী কাঁদছেন। আমি নানীর পাশে গিয়ে বসি। আমি ঝুঝতে পারি, নানীর ভেতরে শঙ্কা জেগেছে তার ভবিষ্যত নিয়ে। নানী হয়তো ভাবছেন এই দুঃসময়ে আমি যদি তাকে ফেলে চলে যাই, তখন তার কী হবে!

আমি নানীর কাঁধে হাত রেখে বলি, ‘ভয় পেয়ো না নানী। আমি যেখানেই যাই, তোমাকে নিয়েই যাবো। আমি যদি অভুক্ত থাকি, তুমিও থাকবে। আমি যদি একমুঠো ভাত খাই, তুমিও খাবে।’

আমার কথা শুনে নানী হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি নানীর মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে তার রুক্ষ-পাকা চুলে হাত বুলিয়ে দিই।

আকাশে তখন ফুটফুটে চাঁদ। পল্লী সুনসান, অন্ধকার। কারো ঘরে খদ্দের নেই, শীৎকার নেই, লাস্যময়ী হাসি নেই, খিস্তি-খেউড় নেই, গান নেই। আছে নীরব হাহাকার, নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস। আমার জন্মের পর পল্লীতে এমন মৃতরাত আর দেখিনি!

নানী হঠাৎ আমার বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘এই চাঁদ মরে, আবার নতুন চাঁদ জন্মাইলেই ঈদ।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘আর ঈদ!’

ভোরবেলায় আলো ফোটার পরপরই নানীর হাত ধরে আমি পল্লী ছেড়ে চলে আসি। আসবার সময় মা ফাতেমার মন্দিরে সেজদা দেয় নানী। বুক চাপড়ে কেঁদে বলে, ‘এই জুলুমের বিচার তুই করিস মা। তোর উপর বিচারের ভার দিলাম।’

আমি নানীর হাহাকার শুনি আর মা ফাতেমার মন্দিরের চাতালের সামনে পড়ে থাকা ভাঙা কাচের চুড়ির দিকে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।

পল্লীর সদর গেট পার হয়ে রাস্তা ধরে খানিকটা পথ হেঁটে আসতেই হাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা। হাজী সাহেবের পথ রোধ করে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রাখেন নানী। বিব্রত হাজী সাহেব চোখ নামিয়ে দৃষ্টি ছুড়ে দেয় পথের বুকে।

নানী বলেন, ‘চোখ নামায়া নিলা যে রহমত! চিনবার পারো নাই? অহন তো চিনবাই না। ভেক ধরছো যে! আমারও চামড়ায় ভাঁজ পড়লো, আর তুমিও ভেক ধরলা। অহন ধর্ম রক্ষার ভার লইছো, সমাজের মাথা অইছো। ভালো অইবো না তোমার। নেতার কথায় লাফাইয়া এতোগুলান মাইনষের প্যাটে লাথি মারলা। আল্লায় এর বিচার করবো।’

বিব্রত হাজী সাহেব একটা কথাও বলে না, এদিক-ওদিক তাকিয়ে নানীকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আমরাও পা বাড়াই অজানার উদ্দেশে।
আজ সারাটা দিন আমরা দু’জন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিকেলে আশ্রয় নিয়েছি পার্কের ছাউনির নিচে। বিকেল থেকে টানা বৃষ্টি নামার পর এখন বৃষ্টি থেমেছে। চারদিকে হালকা অন্ধকার। জ্যোৎস্না রাত হলেও মেঘের কালো ভেজা কাঁথায় ঢেকে আছে চাঁদ। ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। সারাদিন আমাদের পেটে কিছু পড়েনি। প্রাণে বাঁচতে হলে লোকজন করে খেতে হবে, আমাদের মুখে কেউ খাবার তুলে দেবে না। আমি নানীর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। তার চোখ-মুখ বসে গেছে। গত চব্বিশ ঘন্টায় নানীর বয়স যেন আরো বেড়ে গেছে। না, আর বসে থাকা চলবে না। আমি ব্যাগ খুলে সাজ-গোজের জিনিসপত্র বের করি। খুব বেশি কিছু নিয়ে আসতে পারিনি পল্লী থেকে। অল্পকিছু জামা-কাপড়, সাজ-গোজের জিনিসপত্র আর কিছু টুকিটাকি দরকারি জিনিস নিয়ে এসেছি। আমাকে সাজতে দেখে নানী বলেন, ‘সাজতাছস যে?’
‘কি আর করবো! রাস্তায় যখন নামছি, রাস্তায়ই লোকজন করে খাব।’

নানী চুপচাপ আমার সাজা দ্যাখেন। পার্কের রাস্তা দিয়ে লোকজন আসে-যায়, কেউ কেউ সান্ধ্যকালীন শরীরচর্চায় ব্যস্ত। দু-চারজন তাদের কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে। আমার রূপসজ্জা শেষ হলে জিনিসপত্র ব্যাগে রাখি। তারপর ব্যাগের পকেট থেকে বের করি কন্ডোমের প্যাকেট। প্যাকেটের গায়ের লাস্যময়ী নারী আর হাস্যজ্জ্বল পুরুষের ছবি দেখে আমার মাথায় দপ করে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। খুন চেপে বসে আমার মাথায়। আমি প্যাকেটটা ছুড়ে দিই জল-কাদার মধ্যে।
‘ফ্যালাইলি যে?’ উদ্বিগ্ন নানীর প্রশ্ন।
‘লাগবো না।’
নানীর কণ্ঠে বিস্ময়, ‘রোগ ছড়াইবো তো!’
‘ছড়াক।’

আমার মুখে উত্তাপ মাখানো ‘ছড়াক’ শব্দটা শুনে নানী চমকে ওঠেন। তবু নানী আমার হাত ধরে মিনতির সুরে বলেন, ‘খদ্দের আমাগো লক্ষ্মী, তাগো সর্বনাশ করিস না।’

আমি হা হা করে উচ্চ স্বরে হেসে উঠি। নানী অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পার্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকা কয়েকজন মানুষও থমকে দাঁড়ায়, হয়তো নষ্ট মেয়েমানুষ ভেবে আবার হাঁটতে শুরু করে। কারণ, যৌনপল্লী উচ্ছেদের খবর কেবল এই শহরে নয়, সারা দেশের গরম খবর এখন। এই শহরের রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলেই সবাই এখন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। যৌনকর্মীদের কেউ কেউ শহরের সভ্য মানুষের হাতে হেনস্তা হচ্ছে, মার খাচ্ছে।

আমি হাসি থামিয়ে নানীকে বলি, ‘নানী, যতোদিন পল্লীতে ছিলাম, খদ্দের আমার কাছে লক্ষ্মী ছিল। আজ থেকে খদ্দের আমার কাছে শুধুই পোকা। জঘন্য পোকা। আমি এই পোকাগুলোরে তিলে তিলে পুড়িয়ে মারবো!’

নানীকে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে থাকতে বলে আমি পা বাড়াই পার্কের রাস্তায়।

আগেই বলেছি যে, আমার হলুদ রঙা অগ্নিশিখার মধ্যে লুকোনো আছে মৃত্যুর আগুন, আমি চাইলেই সে আগুন ছড়িয়ে দিতে পারি হাজারো পোকার শরীরে, পুড়িয়ে মারতে পারি! কালরাতে যে তিন পাষণ্ড আমাকে ধর্ষণ করেছিল তাদের শরীরেও ঢুকে গেছে মৃত্যুর আগুন। ওরা মরবে। ধীরে ধীরে পুড়ে মরবে।

মাস ছয়েক আগে আমার শরীরে ধরা পড়েছে এক ভয়ানক রোগ। আমার শরীরের এই আগুন এতোদিন আমি কারো শরীরে ধরাইনি। কিন্তু আজ থেকে ধরাবো। এই সমাজ আমার পেটে লাথি মেরে আমাকে রাস্তায় নামিয়েছে। আমি সমাজের মূলে আগুন ধরিয়ে দেব, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেব!

আমার হলুদ শিখায় আকৃষ্ট হয়ে ঐ তো দুটো পোকা ছুটে আসছে। আমি ওদের কাছে টানবো। আমি হলুদ ডানায় জাপটে ধরে আমার গভীরে অবগাহন করাবো ওদের। পোড়াবো, ওদেরকে জন্মের মতো পোড়াবো আমি আগুনপরী, আগুন ডানার ছলনায়! আয় পোকার দল, আয়....


ঢাকা।
জুলাই, ২০১৪।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.