নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ মা পুকুর।

১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৭:৫৭

গল্পের নামঃ মা পুকুর।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।

লাইটারের আলোতে চারদিকে মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়লো। আবার পরক্ষণেই নিভে গেল। এর মাঝেই আমি আমার সিগারেটটা জ্বালিয়ে নিয়েছি। চারদিক জনমানবহীন। অথচ মাত্র নয়টা বাজে। অবশ্য গ্রামাঞ্চলের জন্য এটা গভীর রাত। সাধারণত তারা এশার নামাজের পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। একটা মামলার তদন্তের জন্য আমি ঢাকা শহর থেকে কিছুক্ষণ আগে মনিপুর গ্রামে পা রেখেছি। এই নিয়ে আমি মনে মনে বেশ বিরক্ত। শহর থেকে একটা তদন্ত করার জন্য গ্রামে আসার কোনো মানেই হয় না। যদি মামলাটা সত্যিই জটিল হতো তবে খন্দকার বা ইয়াসিনকে পাঠানো হতো বা আমার সাথে একটা সঙ্গী দেওয়া হতো। আমাকে একা পাঠাতো না। আমার বুদ্ধিমত্তার জন্য ডিপার্টমেন্টের লোকজন আমাকে বোকাবাবু বলে ডাকে। অতএব এটা জটিল কোনো মামলা নয়। শুধুমাত্র আমাকে সরানোই মূল লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে এর পেছনে জয়নালের হাত আছে। এতে সে তার শালাবাবুকে ডিপার্টমেন্টে ঢুকাতে পারবে। রাতে কোয়ার্টারে এসে ঘুম দিলাম। কেয়ারটেকার মানিক মিয়া আমার অপেক্ষাতে জেগেই ছিল। আজকাল এমন নিষ্ঠাবান সরকারি কর্মচারী আছে ভাবতেই অবাক হলাম। পরেরদিন সকালে ফাইল নিয়ে বসলাম। ফাইলটা শহর থেকে পেলেও আমি তা খুলে দেখিনি। গ্রামে আসতে হবে শুনেই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। সাধারণত গ্রামের এসব মামলাগুলো তদন্ত করতে বছরখানেক লেগে যায়। আর যদি প্রশাসনিক জটিলতা থাকে তবে শুধুমাত্র লোক দেখাতে তদন্ত টেনেটুনে লম্বা করা হয়। শেষমেষ অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। তবে গ্রামে এসে আমি কিছুটা খুশি। নূরীর ঘ্যানঘ্যান থেকে কিছুদিন মুক্তি পেলাম। তার বেতনের অংক আমার চেয়ে বেশি বলে নানান সময় নানারকম কথা শুনায়। বিরক্তিকর! নাতো পারছি ছুটতে না তো পারছি জড়াতে।
ফাইলটা খুলে মামলার মূল কাহিনী জেনে নিলাম। একটা পুকুরে গ্রামের চেয়ারম্যান তালেম হোসেনের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে। লাশটা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কি আজব! লাশটা হয়তো পানিতে ভেসে-টেসে গেছে। কিংবা রাক্ষুসে মাছ গিলে ফেলেছে। এসব তদন্ত করার জন্য শহর থেকে সিআইডি অফিসার পাঠানোর কোনো মানে হয়? গ্রামের পুলিশ কি অকর্মার ঢেকি? বুঝলাম যে, চেয়ারম্যান হলো সরকারি লোক তাই এই তোড়জোড়। লোক দেখানোর জন্য শহর থেকে অফিসার পাঠানো হয়েছে। নিজের কোয়ার্টার থেকে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর হাঁট-বাজারে এলাম। আমার স্যুট-বুট-ইন-টাই এসব দেখে সহজেই বুঝা যাচ্ছে যে, আমি শহর থেকে এসেছি। এক লোক এসে আমাকে বলল, “স্যার, গরুর মাংস লাগবে? একদম তাজা। মাত্রই জবাই করেছি। কলিজা দিব? নাকি রানের মাংস নিবেন? পায়াও আছে।” চটপট করে কথাগুলো বলল। আমি ছোট করে বললাম, “থানাটা কোন দিকে?” লোকটার মুখ মুহূর্তেই কালো হয়ে গেল। সে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে চলে গেল। আমি হাসতে হাসতে থানায় চলে এলাম। থানার ইন্সপেক্টর শফিক আমাকে একটা বড় ফাইল দিয়ে বলল, “সব এই ফাইলে আছে। এই তদন্তের ব্যাপারে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। যতসব মডার্নগিরি। অলৌকিক বলতেও যে কিছু আছে তা শহুরে লোকজন বিশ্বাসই করে না।” শেষ কথাটা বিড়বিড় করে বলল। তবে আমি স্পষ্ট শুনতে পেরেছি। কিন্তু আমি পাত্তা দিলাম না। তার রগচটা ব্যবহারে কিছুটা অবাক হয়েছি। শহর থেকে আসা একজন সিআইডি অফিসারকে দেখে যে-কারও মধ্যে একটা উত্‍সাহ ভাব থাকার কথা। কিন্তু এর মাঝে তা নেই। অদ্ভুত!

আমি তালেম চেয়ারম্যানের বাসায় এসে অবাক হলাম। তার ছেলে এই ঘটনাটি নিয়ে বেশ জোরেশোরে তদন্ত চালানোর চেষ্টায় আছে। অথচ বাকিদের মাঝে এই নিয়ে কোনো তাড়া নেই। তাদের মতে চেয়ারম্যানের বলি নেওয়া হয়েছে। কি অদ্ভুত কথাবার্তা! আমি চেয়ারম্যানের ছেলেকে কিছু প্রশ্ন করলাম আর উত্তর গুলো নোট করলাম। শেষ তাকে কখন দেখস গিয়েছিল, তার নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারটি কিভাবে জানলো, কোথায় কোথায় খোঁজ করা হয়েছে, কোনো শত্রু আছে কিনা এসব। অবশেষে আমি কোয়ার্টারে চলে এলাম। আসার সময় পথিমধ্যে দু-একজন গ্রামবাসীর সাথে এই নিয়ে আলাপ করেছি। তাদের কথা শুনে আমার প্রচন্ড হাসি পেয়েছিল। এখনো হাসি পাচ্ছে। গ্রামে একটা পুকুর আছে। সেই পুকুর নাকি গ্রামবাসীকে বিয়েশাদীর সরঞ্জাম দেয়। গ্রামবাসী পুকুরে যে লিস্ট দেয় তা সবই নাকি পুকুর দেয়। আবার বিয়ে শেষে তা পুকুরকে ফিরিয়ে দেয়। “হোয়াট ননসেন্স। স্টুপিড ভিলেজার্স।” সিগারেটটা জ্বলাতে জ্বলাতে বিড়বিড় করে বললাম। টেবিলের ওপর ইন্সপেক্টর শফিকের দেওয়া ফাইলটা পড়ে আছে। ওটা সম্পূর্ণ পড়েছি। পুলিশ ফাইলের মতে এই পুকুরে এখন পর্যন্ত বিশজনের মতো গায়েব হয়েছে। যার মধ্যে চেয়ারম্যানই উল্লেখযোগ্য। বাকিরা সাধারণ গ্রামবাসী ছিল। এক গ্রামবাসী থেকে জেনেছি পুকুর নাকি প্রতি বছরই বলি নেয়। পুকুরটিকে মা পুকুর বলা হয়। এটা শুনার পর আমি বললাম, “যেই পুকুরে মানুষ মারা যায় তা মা হয় কিভাবে?”
- ওমন বলবেন না সাহেব। পুকুর খারাপ মানুষগুলোরই বলি নেয়।
আমি বুঝে উঠতে পারছি না, তদন্ত কোত্থেকে শুরু করব। মাথার মধ্যে কিছু পয়েন্ট সাজাচ্ছি। এমন সময় ঠকঠক শব্দে আমার হাতের সিগারেটটা পড়ে গেল। মনে মনে একটু হাসলাম। পা দিয়ে সিগারেটের আগুন নিভিয়ে দরজা খুললাম। চায়ের ট্রে হাতে ভেজা চুলে এক অপ্সরা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চুল বেয়ে বেয়ে পানি তার শরীরে গড়িয়ে পড়ছে। আমি বেশ অবাক হলাম। গ্রামে এত সুন্দর পরীও থাকে!
- সাহেব আপনার চা।
- আসুন ভেতরে আসুন।
মেয়েটি টেবিলের ওপর চায়ের ট্রে রাখলো। এক কাপ চা বানিয়ে দিলো। চিনির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেনি। তবে আমার পরিমাণমতো দুই চা চামচ-ই দিয়েছে।
- তোমার নাম কি?
প্রশ্নটা করে আমি নিজেই চমকালাম। অনুমতি ছাড়াই আমি মেয়েটিকে তুমি বলে ফেললাম। সাধারণত আমি এমনটা করি না। তবে কি এই অপ্সরার সৌন্দর্য আমায় আকর্ষণ করছে? মেয়েটি ছোট করে বলল, “মা।”
আমি বিস্মিত স্বরে বললাম, “মা!”
মেয়েটি হাসি দিয়ে বলল, “আমি সবার চোখের মণি। তাই সবাই মা ডাকে। বাবা নাম রেখেছে রুমু।।”
- বেশ মিষ্টি নাম।
- শহর থেকে কত কষ্ট করে অহেতুক এলেন, তাই না?
- অহেতুক বলছো কেন?
- চেয়ারম্যান তো বলি হয়েছে। লাশও পাওয়া যায়নি। যাবেও না। আজ পর্যন্ত বলির লাশ পাওয়া যায়নি। অলৌকিক কিছুর ব্যাপারে তদন্ত-ফদন্ত করা যায় নাকি?
- অলৌকিক নাকি সাজানো তা সময় হলেই জানতে পারবে।
- শহুরে লোকদের এই একটা সমস্যা। তারা চোখে না দেখলে কিছু বিশ্বাস করে না।
- আমরা প্রমাণ বিশ্বাস করি।
- কি জানি বাপু! আমরা তো গ্রামের লোকজন মাকেই বিশ্বাস করি। মানে মা পুকুরকে। আমাদের সব প্রয়োজন পুকুরই মিটায়। তাছাড়া চেয়ারম্যান ব্যাটা লোভী ছিল। অর্থসম্পদের লোভ, নারী লোভ সবই ছিল তার। গ্রামের বেশ কিছু কিশোরীর ওপর তার কু-নজর ছিল। তাই তো মা শাস্তি দিয়েছেন। ইন্সপেক্টর মাসুদেরও একই দশা করেছিলেন।
- ইন্সপেক্টর মাসুদ?
- হ্যাঁ, এই থানার আগের ইন্সপেক্টর। সমির মোল্লার বাচ্চা মেয়েটাকে ধর্ষণ করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। মরার আগে মেয়েটা নিজ মুখে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। অথচ আইন কোনো বিচার করেনি। কিন্তু মা ঠিকই বিচার করেছেন।
আমি চায়ে চুমুক দিলাম। আমার দৃষ্টি মেয়েটির ওপর থেকে সরছেই না। তার কথা বলার ভঙ্গি যেমন চমৎকার তেমনই চমৎকার দেখতে। দুধে আলতা গায়ে রং। চোখ সরানোই মুশকিল। ঠকঠক শব্দে আমার নজর সরলো। আমি চা টেবিলে রেখে দরজা খুললাম। মানিক মিয়া চায়ের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। “চা তো আমি খেয়েছি।” কথাটা বলে পিছনে ফিরে দেখি রুমু নেই। এমনকি চায়ের ট্রেও নেই। ঠিক একই রকমের ট্রে ও চায়ের পট-কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানিক মিয়া। আমি ভীষণ অবাক হলাম। এটা কিভাবে সম্ভব? একটা মেয়ে এতো দ্রুত কোথায় যেতে পারে? চায়ের কাপ-ই-বা কোথায়? অথচ চায়ের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার!
- চা খেয়েছেন সাহেব?
- হ্যাঁ, মানে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।
সত্যটা আমি অন্তরেই চাপা রাখলাম। মানিক মিয়া চলে গেল। আমি চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। অতিরিক্ত চিন্তায় মাথা ব্যাথা শুরু করেছে। মোবাইলে তাকিয়ে দেখলাম নূরী কল করছে। কিন্তু ধরার ইচ্ছে হলো না। আমি মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালেই থানায় গেলাম। ইন্সপেক্টর মাসুদের ব্যাপারটা পুলিশ পুরোপুরি চেপে গেছে। এমনকি ফাইলেও উল্লেখ করেনি। জিজ্ঞাসাবাদ করায় ইন্সপেক্টর শফিক বলেছে অসত্‍ অফিসারদের এই দশাই হওয়া উচিত। পুকুরে নিখোঁজ হয়েছে, পুলিশ ফাইলে এমন যাদের নাম আছে। আমি তাদের সবার খোঁজ-খবর নিলাম। এরা সবাই অসত্‍ পথে জড়িত ছিল। সমির মোল্লার কাছে গিয়ে জানতে পারলাম তিনি মায়ের নিকট কৃতজ্ঞ। আইন যা করতে পারেনি পুকুর তা করেছে। আমি পুরো পুকুরটি পর্যবেক্ষণ করলাম। চারদিকে উঁচু উঁচু গাছপালায় ঘেরা বিশাল এক পুকুর। ছোটখাটো একটা দীঘি বলা যায়। চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর অসংখ্য জেলে এনে জাল ফেলানো হয়েছিল। মাছ পাওয়া গেলেও লাশের কোনো হদিস মিলেনি। পুকুরে পানি আসে যাওয়া করে খাল দিয়ে। তবে পানি আসা-যাওয়ার পথেও চেয়ারম্যানের লাশ পাওয়া যায়নি। এই পর্যন্ত কোনো লাশই সেদিকে পাওয়া যায়নি।
উপায় না পেয়ে আমি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে পুকুর সেচের অনুমতি নিলাম। কিন্তু গ্রামবাসীর কেউই নিজেদের মেশিন নিয়ে আসতে রাজি হয়নি। এমনকি দূর দূর গ্রামেরও কেউ রাজি হয়নি। টাকা দিয়েও কাউকে রাজি করানো যাচ্ছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম শহর থেকেই মেশিন আনাবো। আমার বিশ্বাস সব রহস্যের সমাধান পুকুরের মাঝেই আছে।
বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। এমন সময় একদল গ্রামের লোক হনহনিয়ে হেঁটে এলো। তাদের মধ্যমণি ইলিয়াস। গ্রামের নতুন চেয়ারম্যান। আর আমার সন্দেহ তালিকার প্রধান ব্যক্তি। চেয়ারম্যানের মৃত্যুতে তার লাভ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। গ্রামের সাধারণ নেতা থেকে সোজা চেয়ারম্যান হয়ে গেছে। ইলিয়াস চেঁচিয়ে বলল, “ভালোই ভালোই বলছি মায়ের সাথে বেয়াদবি করবেন না।”
- কিসের বেয়াদবি?
- পানি সেচ করতে চাচ্ছেন এটাই বেয়াদবি।
- এটা তো তদন্তের অংশ। আমার কাছে পারমিশনও আছে।
আমি পকেট থেকে কাগজটা বের করে দেখালাম। ইলিয়াসও একটি কাগজ বের করে বিনয়ের সাথে আমার সামনে রাখলো। বলল, “মায়ের নির্দেশ তাই বাড়াবাড়ি করলাম না। নয়তো আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়তাম। চলো সবাই।” লোকগুলো যেই গতিতে এসেছিল সেই গতিতেই প্রস্থান করলো। আমি কাগজটা হাতে নিলাম। পলিথিনের মোড়ানো একটি ছোট কাগজ। যাতে লেখা, “ওকে সাবধান করো। সেচ মানেই গ্রামের মহাপ্রলয়।”

শহর থেকে মেশিন এসেছে। কিন্তু গ্রামের লোকজনের জন্য আমি তা কাজে লাগাতে পারছি না। তারা জীবন দিতে প্রস্তুত কিন্তু পানি সেচ হতে দিবে না। কোনো রকমের হতাহতের ঘটনা ঘটলে চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। তাই আমি আপাতত সেচের ব্যাপারটা স্থগিত রাখলাম। আগে গ্রামবাসীকে বুঝাতে হবে অলৌকিক বলতে কিছু নেই। পুকুরের আড়ালে কেউ মৃত্যু নিয়ে খেলছে।
সকাল থেকে নূরী বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। এতদিন এক-দুইবারের বেশি ফোন দিতো না। আজ অনেকবার দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে সন্ধ্যার পর আমি কল দিলাম। রিসিভ করেই জেরা শুরু।
- কি ব্যাপার তুমি আমার কল ধরছো না কেন? কি সমস্যা? আমার চেয়েও বেশি ব্যস্ত নাকি?
- মামলাটা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আছি।
মুখে কথাটা বললেও মনে মনে বললাম কিসের আর ব্যস্ত? কয়েকদিন ধরে তো হাওয়া বাতাসই খাচ্ছি। নূরী বলল, “তা মামলা কতদূর এগোলে? কবে ফিরবে?”
- জানা নেই। অদ্ভুত কেইস এটা।
- তাই বলেছিলাম চাকরিটা ছেড়ে দাও। এসব তোমার দ্বারা হবে না।
- তুমি ফোন রাখো।
আমি ফোন কেটে দিলাম। আমার দ্বারা হবে না মানে? এই মেয়েটা সুযোগ পেলেই আমাকে ছোট করতে ছাড়ে না। নিজেকে কি ভাবে কে জানে! মোটা আয় করে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? ডিসগাসটিং!
এদিকে খবর পেলাম গ্রামে কারও বিয়ে হচ্ছে। এই সুযোগ পুকুরের রহস্য উদঘাটনের। রীতি অনুযায়ী সরঞ্জামের লিস্ট রাতে দিতে হয়। আর সরঞ্জাম পরেরদিন সকালে পাবে। একটা বাক্স নাকি পানিতে ভেসে উঠে। তাতেই থালাবাসন, গ্লাস, চামচ এসব ব্যবহারিক জিনিস থাকে। আমি ঘুপটি মেরে একটি গাছের ডালে বসে রইলাম। একজন লোক এসে কিছু কাগজ পলিথিনে মুড়িয়ে পুকুরে নিক্ষেপ করলো। তারপর চলে গেল। সাধারণত পলিথিন ডুবে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কিছুক্ষণ পরেই তা ডুবে গেল।
পরেরদিন সকালে আমি তদন্ত রিপোর্ট পাঠালাম। রিপোর্টে লিখলাম। পুকুরটাকে কেন্দ্র করে কেউ খুব ভয়ানক খেলা খেলছে। কোনো চক্র জড়িত আছে। এই পুকুরের মাঝে নিশ্চয়ই মূল্যবান কিছু আছে। কিংবা এই পুকুরকে কেন্দ্র করে চোরাকারবারী করা হচ্ছে।
রাতে আমি পুকুরের চারপাশে চুপচাপ ঘুরছি। একটা বাক্স ভেসে উঠতে দেখে আমি ভীষণ রকমের অবাক হলাম। আমার শরীর মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেল। এই বাক্সটি কোত্থেকে এলো? এখানে তো কাউকে আসতে দেখিনি। কিংবা বাক্স পড়ার মতো শব্দও পাইনি। তবে কি পুকুরী নিচ থেকে কেউ এসব করছে? কিন্তু আমি সাতারের কোনো শব্দই পেলাম। পুকুর পাড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কোথাও কারও অস্তিত্ব নেই।
বাড়ি চলে এলাম। রুমুকে দেখে ভীষণ অবাক হলাম। সে বসে আছে চেয়ারে। সেদিনের মতো তার চুল আজও ভেজা।
- কে তুমি?
- সেদিন তো বললাম, রুমু। আপনি না একদম ভোলা মানুষ।
খুব মায়াবী হাসির সাথে কথাটা বলল। আমার মনের মাঝে প্রচন্ড ভয় কাজ করছে। যা আমি দমানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। রুমু বলল, “কারও বিয়ে ভেঙে যাক। তা কি আপনি চান? ওরা গরীব মানুষ। যদি আসবাবপত্র না পায় তবে বিয়েতে আসা লোকজনদের আপ্যায়ন করবে কিভাবে? তখন তো বিয়েই ভেঙে যাবে।” আমি আবারও বিস্মিত হলাম। সেই বাক্সটি আমি পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলেছি তা কেবলমাত্র আমিই জানি। বাক্সের মধ্যে অজস্র থালাবাসন, গ্লাস ইত্যাদি ছিল। কিন্তু এই গোপণ কথাটা রুমু জানলো কিভাবে? কে সে? কি এটা আমার ভ্রম? আমি কি কোনো স্বপ্নের মাঝে ভাসছি?
- বিয়ে ভাঙার পাপ সইতে পারবেন তো? অবশ্য বিয়ে বন্ধন আপনার জন্য কোনো মূল্যবান কিছু নয়। কেননা আপনি তো এই বন্ধনের মূল্য জানেনই না।
- কি বলছো এসব?
- মিথ্যে বলছি? আপনার স্ত্রীকে আপনি কতটুকু সঙ্গ দেন? তার একাকীত্বের সাথী হতে পেরেছেন কি? আপনার স্ত্রীর উপার্জন আপনার চেয়ে বেশি বিধায় আপনি সবসময়ই হীনমন্যতায় ভুগেন। নিজেকে তার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। এখন সেই দূরত্বের মাঝে নতুন লোকের উপস্থিতি হয়েছে। নাজমুল। অথচ আপনার স্ত্রী আপনাকে কতটা ভালোবাসে তা বোধহয় আপনি জানেনই না। তবে এই ভালোবাসায় খুব শীঘ্রই নাজমুলের কালো দাগ পড়তে যাচ্ছে। যদি আপনি এগিয়ে না যান তবে ………
আমার বুকের মাঝে হাহাকার তৈরি হলো। আমি নূরীকে ভালোবাসি কিনা জানি না। তবে তাকে কোনোমতেই হারাতে চাই না। রুমু উঠে দাঁড়ালো। বারান্দার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “গ্রামে প্রলয় ডেনে আনিয়েন না। এতো মানুষের অভিশাপ আপনি সইতে পারবেন না।” রুমু পর্দার ওপাশে চলে গেল। আমি পর্দার আলোতে দেখতে পাচ্ছি সে তার শাড়ির আঁচল নিচে ফেলে চুল ছড়িয়ে দিয়েছে। দুই হাত পেছনে এনে পিঠে হাত দিয়েছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। তাতক্ষণিক আমার দৃষ্টি টেবিলে থাকা একটি ছোট কাগজের ওপর পড়লো। মনে হলো কাগজটি এইমাত্র উদয় হয়েছে। কাগজে লেখা, “আপনার চোখ-মন শুধুই স্ত্রীর জন্য। তাই তো পর্দার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছেন। ফিরে যান। সংসার বাঁচান।” কাগজটি ভেজা। আমি সামনে তাকালাম। বারান্দায় কেউ নেই। আমি সেখানে ছুটে গেলাম। বাইরে দূর দূর পর্যন্ত কারও অস্তিত্ব নেই। বারান্দায় পানির কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি ভেতরে এলাম। চেয়ারেও পানির কোনো অস্তিত্ব নেই। লেখার দিকে লক্ষ্য হতেই মনে পড়লো লেখার ধরণটা আমার পরিচিত। আমি ইলিয়াস চেয়ারম্যানের সেই কাগজটা বের করলাম। দুটোর লেখাই এক। আমার মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। কিছু বুঝতে পারছি না। কি হচ্ছে এসব? নূরীর কথা মনে হতেই আমি সময় নষ্ট না করে আমি ব্যাগ প্যাক করলাম। আশ্চর্য! ব্যাগের মধ্যে একটি ফিরতি টিকিট পেলাম। কালকের সকালের। কিন্তু আমি কোনো টিকিট কাটিনি।

রাত প্রায় এগারোটা। শহরে এটা স্বাভাবিক সময়। রাস্তায় অজস্র মানুষের আনাগোনা চলছে। বাসায় এসে নূরী ও নাজমুলকে আড্ডা দিতে দেখলাম। আমাকে দেখে নূরী স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আরে তুমি হঠাৎ? কোনো খবর ছাড়াই ভুতের মতো উদয় হলে কি করে?” আমাকে দেখে নূরী কিছুটা খুশি হলেও নাজমুলের মনে বিশারদ দেখা দিলো। নাজমুল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রস্থান করলো। নূরীর ভার্সিটির বন্ধু ছিল নাজমুল। আমি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলাম। নূরী আমাকে খেতে দিলো। আমি লক্ষ্য করলাম নূরী দুলছে। তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নূরী মাতলামি আরম্ভ করলো। নাজমুলের সাথে আড্ডার আসরে কিছু পানীয় জিনিস দেখেছিলাম। আমার বুঝতে কষ্ট হলো না যে নাজমুলের কি পরিকল্পনা ছিল। আমি নূরীকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। নূরীর সাথে আমার বিয়ে পারিবারিকভাবে। সে একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির ম্যানেজার পোস্টে। আর আমি একজন সিআইডি অফিসার। আমার চাকরির পদ শুনতে ভালো লাগলেও অর্থের পরিমাণ নূরীর বেশি। এই নিয়ে সে প্রায়ই বলতো সিআইডির চাকরির ছেড়ে দিতে। সে তার কম্পানিতে ভালো পদে আমার জন্য জব দিবে। বেতনও বেশি। এতে আমি নিজেকে খুব ছোট অনুভব করতাম। তবে এই নিয়ে ঝগড়া করতাম না। শুধু নিজেকে তার থেকে দূরে রাখতাম। এতে যে নূরী একাকীত্বের মাঝে ডুবে যাবে তা বুঝতে পারিনি। নূরীকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রুমুর কথা মনে পড়লো। আমি ভাবতে লাগলাম কে এই রুমু? প্রতিবার সে ভেজা থাকে কেন? মনে হয় এইমাত্র গোসল সেরে এসেছে কিংবা পুকুর থেকে ডুব দিয়ে উঠে এসেছে। রুমু যেই হোক না কেন আমি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ। তার বদৌলতে একটি কালো দাগ থেকে আমি আমার সংসারটাকে বাঁচাতে পেরেছি। তবে আরও কিছু কাজ বাকি আছে। নূরীর সাথে আমার যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তা দূর করতে হবে।

আমি শহরে স্থায়ী হলাম না। নূরীর সাথে আমার সম্পর্কের দেয়ালটা আংশিক ভেঙে আবার গ্রামে ফিরে আসি। নারী যে কোমলমতি জাতি তার প্রমাণ নূরীর সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম। সাংসারিক জীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান আলোচনার মধ্যে আছে। কিন্তু আমরা আলোচনা করেই সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করি। সিআইডি শুধুমাত্র আমার পেশা নয় আমার গৌরব-অহংকারও। এটা নূরীকে বুঝিয়ে বললাম। এতে সেও অনুতাপ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। অর্থই সব নয়। আত্মসম্মানবোধও প্রয়োজন।
এক পুলিশ বন্ধুকে দিয়ে নাজমুলকে হুমকি দিয়েছি। যাতে সে আর নূরীর ধারেকাছেও না আসে। তবে নাজমুলের ব্যাপারে নূরীকে কিছু বলিনি।
গ্রামের সেই বিয়েটা ভালোভাবেই হয়েছে। আমি যাওয়ার আগে বাক্সটি আবার পুকুরে ফেলে গিয়েছিলাম। বর্তমানে আমি পুকুর পাড়ে বসে আছি। আমার হাতে একটি হলুদ রঙের কাগজ আছে। যা পলিথিনে মোড়ানো। আমি সেটা পুকুরে নিক্ষেপ করলাম। কিছুক্ষণ পর সেটা পুকুরে ডুবে গেল। আমি স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়ে রইলাম। তারপর কোয়ার্টারে চলে এলাম। আশা করেছিলাম রুমুকে দেখতে পাবো। কিন্তু কোথাও রুমু নেই। আমি বেশ কয়েকবার রুমু রুমু বলে ডাকও দিলাম। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নূরীর সাথে ফোনে কিছুক্ষণ কথা বললাম। মিষ্টি প্রেমালাপ শেষে আমি রুমে এলাম। আমার নজর একটি হলুদ রঙের ভেজা কাগজের ওপর পড়লো। কগজের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। ওখানে লেখা আছে, “তালেম চেয়ারম্যানের লাশ চাই।” এই কাগজটি আমি কিছুক্ষণ আগে পুকুরে ফেলেছিলাম। আমার হাতের লেখা। তবে তার নিচে আরেকটা লাইন দেখতে পাচ্ছি। তাই আমি এগিয়ে এলাম। “বড় মেহেরগনি গাছে পাবে।” আমি দাঁড়ালাম না। কেয়ারটেকারকে ডেকে তুললাম। ছুটলাম পুকুর পাড়ের দিকে। এসে যা দেখলাম তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না। বড় মেহেরগনি গাছে তালেম চেয়ারম্যানের লাশ ঝুলছে। মুহূর্তেই মানুষের সমাগম শুরু হয়ে গেল। সবাই বলছে এটা মায়েরই কাজ। এতো উপরে মানুষ লাশ ঝুলাতে পারে না। আমি সবসময়ই বলতাম মানুষ পারে না বলতে এম কিছু নেই। তবে আজ এই কথাটা কেন জানি বলতেই ইচ্ছে করছে না।

অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। মা পুকুরের গর্ভে আরও অনেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে। তবে কারোই লাশ পাওয়া যায়নি। পুকুরে বলি হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া লাশের মধ্যে শুধুমাত্র তালেম চেয়ারম্যানের লাশই পাওয়াই গিয়েছিল। সময় পেলে আমি আজও মাঝেমাঝে মনিপুর গ্রামে গিয়ে মা পুকুর পাড়ে ঘুরে আসি। তবে সেদিনের পর থেকে রুমুকে আর দেখিনি। শুনেছি ইদানিং ধরে মা পুকুর নাকি আর সরঞ্জাম দেয় না। তবে এর জন্য গ্রামবাসীই দায়ী। তারা নাকি সরঞ্জাম অল্প অল্প করে চুরি করে রেখে দিতো। তাই মা নাকি নারাজ হয়েছে।

আমার জীবনে এই মামলাটা অনেক ফলপ্রসূ হিসেবে কাজ করেছে। রুমু ও মা পুকুর আমার জীবনে বড় অবদান রেখেছে। আমি জানি না রুমু ও মা পুকুরের মধ্যে সম্পর্ক কি। আমি শুধু এইটুকুই জানি আমার জীবনে এই দুটোর ভূমিকা অনেক। এই মামলাটির পর আমার প্রমোশন হয়েছে। ডিপার্টমেন্টে আমার সুনাম বেড়েছে। বেড়েছে আমার সংসারের সদস্য সংখ্যাও। নূরীর ভালোবাসায় আমাদের সংসারের বাগানে এখন দুটো ফুল রয়েছে। নূরীর মহত্ব দেখে তার প্রতি আমার সম্মান আরও বেড়েছে। সারাক্ষণ কাজ শেষে এসেও ছেলেমেয়ে ও আমার দেখাশোনা করতে তার ভুল হয় না। এত কষ্টের বিনিময়ে সে শুধুমাত্র চায় ভালোবাসা, সম্মান ও বিশ্বাস। আমিও তাকে এগুলো দেওয়ার সম্পূর্ণ চেষ্টা করি।
এটা সত্যি যে অলৌকিক বিষয়গুলো আমরা চোখে না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করি না। আমিও সেই ঘটনার পর থেকে অলৌকিক জিনিসে বিশ্বাস করি। তবে এই রহস্যটি আমি আজও কাউকে বলিনি। এমনকি নূরীকেও না। আমার বিশ্বাস আমার মাঝেই রেখেছি। এই পৃথিবীর গর্ভে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো অনেক রহস্য রহস্যই থেকে গেছে। তেমনই এক রহস্য আমার বুকে থেকে গেল মা পুকুরের নামে। রুমুর নামে।

সমাপ্ত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.