![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রোহিঙ্গা সংকট : বিশ্বমানবতা লুণ্ঠিত
মোহাম্মদ মাসুদ
দিন যতই যাচ্ছে বিশ্ব উন্নয়ন মঞ্চ ততই ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু অবনতি হচ্ছে মানবিকতার। মানবিক জায়গাগুলো খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। এই সংকট নির্দিষ্ট কোনো আবর্তে আটকা নয়। আজ বিশ্বপরিমণ্ডলে সেই সংকট প্রখর হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর বুকে বর্তমানে যেসব ঘটনায় মানবিকতা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে; তাদের মধ্যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-ইস্যু অন্যতম। এছাড়াও এ কাতারে সিরিয়া-সংকট, জঙ্গিবাদ ইস্যু, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটও প্রখরভাবে উল্লেখযোগ্য।
অতিসম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নেমে এসেছে পৃথিবীর সকল দুঃখ আর কষ্টের পাথরগুলো। যা গ্রহণ-শক্তি কতটা ভয়ঙ্কর তা শুধু ঐ রোহিঙ্গাদের অনুভূতি-শক্তিই বলতে পারে। আজ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের উক্তি ধরে বলা যায়:“ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।” ঈশ্বরই বলুন আর বিধাতাই বলুন, তাকে আজ রোহিঙ্গা-পল্লীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ পৃথিবীর সকল কান্নাগুলো একত্রিত হয়ে রোহিঙ্গাদের চোখ বেয়ে পড়ছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চলছিল বরাবরই। তারা যেন মিয়ানমারের অভিশাপ। মিয়ানমারের সর্বমহল আজ নিজেদের ইতিহাস থেকে রোহিঙ্গাদের চিহ্ন মুছে ফেলতে চায়। তাই সরকার, প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই সেই কালো অধ্যায়ের নিকৃষ্ট কাজে নিজেকে যুক্ত করছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব বিরল। আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ছবিগুলো দেখলে যেকোনো মন-আশ্রিত হৃদয় একবার হলেও নীরবে কেঁদে উঠবে।
সম্প্রতি, ৯ অক্টোবরে মিয়ানমারের তিনটি নাসাকা চেকপোস্টে কতিপয় রোহিঙ্গার হামলায় নয়জন সীমান্ত রক্ষীবাহিনী নিহত হলে এর ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের জীবনে নেমে আসে এক দুর্বিষহ অধ্যায়। শুরু হয় রোহিঙ্গাদের উপর হত্যা, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ নানান ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। এর পূর্বেও ২০১২ সালের ৩ জুন তিন রোহিঙ্গা কর্তৃক এক রাখাইন তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে রাখাইন রাজ্যে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধরা মিলে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত দমন-নিপীড়ন শুরু করে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ছাড়া নিপীড়িত রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্ত ও সমুদ্র উপকূলে আশ্রয় নিতে শুরু করে। আজ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। তারা কেউ নদীতে ভাসছে, কেউ সাগরে ভাসছে আবার কেউ মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আবার কেউ কেউ হয়তো কোনো আশ্রয় শিবিরে শরীরে পুষ্টিহীনতা, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ নানান মরণব্যাধি সাথে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করার পরও ১৯৮২ সালে সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে। বলা যায়, দেশটিতে এখন রোহিঙ্গা নিধন ‘একটি সরকারি মন্ত্র’ হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বলা যায়, গত ৯ অক্টোবর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিধন অভিযানে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নিহত হয়েছে ৮৬ জনের মতো। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও উপরে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দাবি অনুযায়ী, প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় সাড়ে ১২শ’ স্থাপনা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
মানবাধিকার বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিয়ানমারে এই কর্মকাণ্ডের প্রতি ধিক্কার দিয়ে এক বিবৃতিতে জানান, “মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমষ্টিগতভাবে শাস্তি দিচ্ছে।” অন্যদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে।”
মানবাধিকার লুণ্ঠিত এই কর্মকাণ্ডে বিশ্ব হতবাক হলেও মিয়ানমার এবিষয় পিছপা বা সমাধানের পথ না খুঁজে তারা তাদের নীতিতে কাজ করে যাচ্ছে। দেশটিতে দীর্ঘ বিরতির পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি। অনেকই মনে করেছেন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এই নেত্রী দীর্ঘ দিনের রোহিঙ্গা সংকট মুছে দিবেন। কিন্তু তিনিও আজ নীরবে রোহিঙ্গাদের দমন নীতি সমর্থন ও কৌশলে রাজনীতি করে চলেছেন।
কোনো দেশের সীমান্ত খুলে দেওয়া আজ স্থায়ী সমাধান নয়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা- শিশু, নারী, পুরুষ সবার মুখ থেকে স্থায়ীভাবে কান্না আজ মুছে দিতে হবে। এই সংকট নিরসনে ক্ষমতাধর বিশ্বরাজনৈতিক দল ও সংস্থাগুলোকে দায়িত্বের সাথে কাজ করতে হবে। তবে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে মায়ানমার সরকার-প্রশাসনকেই। তাদেরকে আজ প্রাচীন গোঁড়ামি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে; আজ গুরুত্ব দিতে হবে মানবধর্মকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]
[প্রকাশিত: দৈনিক ইত্তেফাক, উপ-সম্পাদকীয়, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬]
লিংক:- Click This Link
©somewhere in net ltd.