![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এস কে দাস: স্মৃতিটা তো আজকের নয়— এই শতাব্দীরও নয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝির দিকের, পঞ্চাশের দশকে যখন সবে স্কুল জীবন পেরিয়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ছি। তখন রূপকথা সিনেমা হলে পালিয়ে সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত ছবিগুলো দেখতাম। রূপকথা সিনেমা হলটিও নবনির্মিত— তাই একদিকে নতুন হলে সিনেমা দেখা অপরদিকে সুচিত্রা-উত্তমের ছবি দেখা। আকর্ষণ ছিল স্পষ্টতই দু’রকমের। কিন্তু প্রধান আকর্ষণটি যে ছিল সুচিত্রা-উত্তমের অভিনয়— তা বলাই বাহুল্য। আমার সেকালের কোনো কোনো বন্ধুর মতো আমি তেমন একটা সিনেমাভক্ত বা সিনেমাপাগল ছিলাম না। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটত সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত কোনো চলচ্চিত্রের প্রচার শুনলে। এত চমত্কার অভিনয়— এত সুন্দর চেহারার শিল্পী এতই তাদের নৈপুণ্য, এত চমত্কার কাহিনী, ক্যামেরার অভিনব-ঝলকানি সব মিলিয়ে সিনেমা হলের অপূর্ব পরিবেশ আর পিনপতন নীরবতা। জানতাম না সুচিত্রা সেন পাবনার মেয়ে, এ খবরটি জানলাম বহু দিন পর। তখন থেকেই মনে হতো সুচিত্রা সেনের হোক না হোক আমাদের নিশ্চয়ই পাবনা শহরকে নিয়ে গর্ববোধ করার আছে কারণ এই পাবনা শহরই হলো কিংবদন্তি চিত্রনায়িকা— বাংলাদেশের সম্পদ এবং এ উপমহাদেশের অহঙ্কার সুচিত্রা সেনের বাল্যকালের ও প্রথম যৌবনের এবং শিক্ষাজীবন শুরু ও সমাপ্তির স্মৃতিঘেরা শহর। সুচিত্রা সেন তার অভিনয় নৈপুণ্যে বাঙালি মাত্রকেই অভিভূত করেছেন— সারা উপমহাদেশের চিত্রজগেকই সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আজ যখন আমি লেখাটি লিখছি তখন তিনি কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালের ৬-বি নম্বর কেবিনে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিত্সাধীন ছিলেন। এই কেবিনেই অসংখ্য বাংলা চলচ্চিত্রে তার অতি প্রিয় এবং বাংলাদেশসহ সারা ভারতবর্ষে এবং পাকিস্তানেও অত্যন্ত জনপ্রিয় চিত্রনায়ক উত্তম কুমার বারংবার চিকিত্সাধীন থাকতেন হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে। এই কেবিনেই চিকিত্সাধীন অবস্থায় ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মহানায়ক উত্তম কুমার মৃত্যুবরণ করেন। আমরা সবাই জানি, সেই উত্তম কুমারই ছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের অভিনীত অসংখ্য চিত্রনাট্যের সর্বাপেক্ষা প্রিয় জুটি-প্রিয় নায়ক। যখনই অসুস্থ হন, যখনই রোগাক্রান্ত হন সুচিত্রা সেন— তিনি এসে ভর্তি হন ওই বেল ভিউ হাসপাতালে আর থাকেন ওই কেবিনেই। এই কেবিনটি সুচিত্রার কাছে তাই অত্যন্ত আবেগের। সুচিত্রা সেন আর সুস্থ হয়ে ওঠেননি। ১৭ জানুয়ারি তার জীবনাবসান হয়েছে। পাবনায় তার পৈত্রিক ভিটায় শেষকৃত্যের যে শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তা রক্ষিত হয়নি।
সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা। তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে পাবনা শহরে। পড়তেনও পাবনার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমানে সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়)। তার সহপাঠী বান্ধবীদের মধ্যে অল্পসংখ্যক হলেও বেশ কয়েকজন এখনও জীবিত এবং পাবনা শহরেই অবস্থান করছেন। তারা সুচিত্রা সেনের নাম শুনলেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। গৌরবান্বিত বোধ করেন সুচিত্রা সেনের সঙ্গে বাল্যকালীন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে। দেশ বিভাগের ধারাল খড়েগর আঘাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ধুমায়িত উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণে সুচিত্রা সেনকে অতি অল্প বয়সেই দেশ ত্যাগ করতে হয়। সুচিত্রা সেন পাবনার মেয়ে। পাবনাবাসীসহ সারা বাঙালি জাতি সুচিত্রাকে নিয়ে গর্বিত। সুচিত্রা সেনের বাবা করুণাময় সেনগুপ্তও পাবনার সন্তান। ১৯৪৬ সালে দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাবনা পাকিস্তানের অংশে পড়লে স্রেফ তার ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য স্মৃতিবিজড়িত পাবনা শহর ছেড়ে চলে যান কলকাতায় স্থায়ীভাবে। সুচিত্রা সেন তখন একজন কিশোরী-পাবনার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। কলকাতা যাওয়ার আগেই সুচিত্রা সেন পাবনায় তার শিল্পানুরাগ দৃশ্যমান করে তুলতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছিলেন। কাজটি কিন্তু তত্কালীন সময়ে খুব একটা সহজ ছিল না।
সুচিত্রা সেনের অভিনয় জীবন খুব একটা দীর্ঘ না হলেও তা ছিল নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। তার জীবন-নায়িকাও তিনিই। বিয়ে করেছিলেন, একান্তই নিজের পছন্দমতো, সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে। আবার বিয়ের দেড়-দু’দশকের মাথায় তিনি তার স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের ছেদও টেনে দিয়েছেন নেহায়েতই স্বেচ্ছায়-ঠিকমতো বনিবনা না হওয়ার কারণে। এরপর তিনি আর বিয়ে করেননি। আবার অত বড় বৈচিত্র্যময় যে নায়িকা, অভিনয় জীবন থেকেও তিনি ছেদ টেনে দিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন অনেক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব থেকে বাংলা ছবির শ্রেষ্ঠ নায়িকা বিবেচিত হয়ে।
বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেনের সর্বাপেক্ষা পছন্দের নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। আবার উত্তম কুমার কোনো ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ে চুক্তিবদ্ধ হলে নায়িকার ভূমিকায় চাইতেন সুচিত্রা সেনকেই। এই জুটি আমার জানা মতে, বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ জুটি। যার ফলে সবার মুখে মুখেই পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকজুড়ে হামেশাই শোনা যেত সুচিত্রা-উত্তমের নাম। আরও একটি মজার ব্যাপার। সুচিত্রা চাইতেন তার নামটি থাকবে আগে এবং পরে উত্তম কুমারের নাম। তাই হতো। সবাই বলত সুচিত্রা-উত্তম-কাউকেই কদাপি বলতে শুনিনি উত্তম-সুচিত্রা, যেমনটি আমরা সচরাচর শুনতে অভ্যস্ত। তাদের অভিনয় নৈপুণ্য, চেহারায় দীপ্তি এবং তাবত্ ভঙ্গিমা সারা বাংলাদেশকে মাতিয়ে রেখেছে দীর্ঘদিন। মোটকথা বাংলা চলচ্চিত্রের বাজার মোটামুটি একতরফাভাবেই দখল করে রেখেছিলেন এই জুটি। তাদের চরিত্র সাধারণত থাকত রোমান্টিক ধরনের। রোমান্টিকতায় ভরপুর থাকত তাদের সব ভঙ্গিমা কিন্তু আদৌ কোনো প্রকার অশ্লীলতা দেখা যায়নি তাদের অভিনীত কোনো ছবিতেই। আর সে কারণেই বাঙালি অভিভাবকরা সে যুগে যথেষ্ট রক্ষণশীলতায় আচ্ছন্ন থাকা সত্ত্বেও তাদের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের কদাপি সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত কোনো ছবি দেখতে বারণ তো করেনইনি বরং অনেক ক্ষেত্রে তারাও ছেলেমেয়েদের সঙ্গী হতেন, একত্রে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতেন নিসঙ্কোচে। এটি একটি ব্যতিক্রমী ধরনের বিষয়ই ছিল বটে।
সুচিত্রা সেন কতটি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন? তার একটি তালিকা উল্লেখ করা যাক— ১৯৫৪ সালে ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ‘এটম বোমা’, ‘ওরা থাকে ওধারে, ‘দুলি’, ‘মরণের পরে’, ‘সদানন্দের মেলা’, অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ‘গৃহপ্রবেশ’ ও ‘বলয়াগ্রাস’, ১৯৫৫ সালে ‘সাঁঝের প্রদীপ’, ‘সাজঘর’, ‘শাপমোচন’, ‘মেজ বৌ’, ‘ভালোবাসা’ ও ‘সবার উপরে’, ১৯৫৬ সালে ‘সাগরিকা’, ‘শুভরাত্রি’, ‘একটি রাত’, ‘ত্রিযামা’, ‘শিল্পী’ ও ‘আমার বৌ’, ১৯৫৭ সালে ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হলো দেরি’, ও ‘জীবন তৃষ্ণা’। ১৯৫৮ সালে ‘রাজলক্ষ্মী’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘চন্দ্রাণী’ ও ‘সূর্য তোরণ’ ১৯৫৯ সালে ‘চাওয়া পাওয়া’ ও ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ১৯৬০ সালে ‘হাসপাতাল’ও ‘স্মৃতিটুকু থাক’ ১৯৬১ সালে ‘সপ্তপদী’ ১৯৬২ সালে ‘বিপাশা’ ১৯৬৩ সালে সাত পাকে বাঁধা ও ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ১৯৬৪ সালে ‘সন্ধ্যা দীপের শিখা’ ১৯৬৭ সালে ‘গৃহদাহ’ ১৯৬৯ সালে ‘কমল লতা’ এবং ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ । মোট বাংলা ছায়াছবির সংখ্যা দাঁড়াল ৫৩টি। যার সবই বক্স অফিস হিট করেছে।
এরপর দেখা যাক সুচিত্রা সেন অভিনীত হিন্দি ছবিগুলোর তালিকা। ১৯৫৫ সালে ‘দেবদাস’, ১৯৫৭ সালে ‘মুসাফির’ও ‘চম্পাকলি’, ‘১৯৬০ সালে ‘বোম্বাই কা বাবু’ ও ‘সরদে’ ১৯৬৬ সালে ‘মমতা’ এবং ১৯৭৪ সালে ‘আঁধি’। মোট হিন্দি ছবি দাঁড়াল সাতটি এবং সাকল্যে ৬০টি। আরও বাংলা ও হিন্দি ছবিতে নায়িকাসহ নানা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক-প্রযোজকরা প্রতিনিয়তই তার দুয়ারে হানা আজও দেন। কারণ সুচিত্রার জেদ তিনি আর অভিনয় করবেন না। বড্ড জেদি মেয়ে তিনি কিন্তু অহমিকাচ্ছন্ন নন এতটুকুও।
সুচিত্রা সেনের বাড়িতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য চিঠি ডাকযোগে এসে থাকে। কিন্তু সে চিঠিগুলো খুলেও দেখেন না। তেমনই আবার প্রত্যহ অসংখ্য টেলিফোন কল আসে কিন্তু তিনি রিসিভার হাতে তোলেন না— তার তরফ থেকে অবশ্য অন্য একজন রিসিভার ধরেন শুধু এই কথাটি বলতে যে সুচিত্রা এখন কারও সঙ্গে কথা বলবেন না। তার এক বন্ধু একদিন সুচিত্রার বাড়িতে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি তো একদিনও তার ফোন পেলেন না— ব্যাপারটা কি? সুচিত্রার জবাব ছিল— বাঃ রে , ফোন তো আমি কাউকেই করি না। ফোন করতে হবে আমাকে— আমি রিসিভ করব। তাও তো করো না। তোমার ফোন জানলে অবশ্যই করব। কারণ তুমি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বলেছিলেন সুচিত্রা। সুচিত্রার বিয়ে হয়েছিল দিবাকর সেন নাসব এবং চিত্রতারকার সঙ্গে হঠাত্ করেই বিয়ের পিড়িতে বসেন সুচিত্রা দিবাকর ১৯৪৭ সালে যথেষ্ট কম বয়সে। কিন্তু সেই ভালোবাসার বিয়েটি শেষমেশ টিকল না। সুচিত্রা সেন যখন সাতপাকে বাঁধা ছবির শুটিং করেছেন, তখন তার দাম্পত্য জীবনেরও ইতি ঘটার প্রক্রিয়া চলছে। দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটলেও সুচিত্রা পরে আর কাউকে বিয়ে করেননি। দিবাকর সেনের ‘সেন’ টাইটেলটাই শুধু ধারণ করেছিলেন তিনি। তাদের একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন একজন চিত্রশিল্পী। কিন্তু সেও মায়ের মতো অভিনয় শিল্পকেই আঁকড়ে ধরে আছে যদিও খ্যাতিতে এখনও মায়ের কাছাকাছি যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সুচিত্রার স্বামী দিবাকর সেন আজ বেঁচে নেই— বেঁচে নেই উত্তম কুমারও ।
গোটা মহাদেশ সুচিত্রা সেনের প্রাণবন্ত, প্রাণোচ্ছল জীবনকে স্মরণে রাখছেন। রাখবেন চিরকাল।
পাবনার মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ কদাপি ভুলবে না তাদের এ গর্বিত নায়িকাকে।
©somewhere in net ltd.