![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইট, বালি আর কংক্রিটে গড়া ব্যস্ত এই শহর। এখানে কোনো মানুষ থাকে না। সবার মধ্যেই নিয়মতান্ত্রিকতা আর যান্ত্রিকতা। যেন এরা সবাই অনুভূতিশূন্য, নিষ্প্রাণ অস্তিত্ব। ঘুণেধরা সম্পর্ক আর অস্থির ব্যস্ততাই তাদের জীবন। তারা শুধু একটা জিনিসই জানে। কাজ, কাজ আর কাজ। ভোরের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে শুরু হয় তাদের দৌড়। রাতেও তাদের বিরাম নেই।
সেই হাজার হাজার যন্ত্রমানবের অন্তরালেও গুটিকতক মানুষ থাকে। যদিও সমাজ এদের মানুষ বলে স্বীকৃতি দেয় না। তবুও দেখতেতো এরা মানুষের মতোই। সস্তা স্বপ্ন আর একটু ভালোবাসা এই তাদের সম্বল। এদের কেউ মজুর, কেউ মুটে, কেউবা কুলি। কেউ কেউ দুকলম লেখাপড়াও করেছে। তাই এরা এইসব কাজ করে না। বড়লোক ব্যবসায়ীর চাপরাশি না হয় কোনো স্কুলের দপ্তরি এই জাতীয় কাজ করে সংসার চালানোতেই তাদের বেশি আগ্রহ। এতে কিন্তু তাদের স্বপ্নগুলো দামী হয়ে ওঠে না। বরং অন্যদের মতো সস্তাই থেকে যায়।
সস্তা স্বপ্ন আর ব্যস্ত শহর এই দুয়ের মধ্যে দিন কাটানো মানুষগুলোর মধ্যে একটা রিকশাওয়ালাও আছে। তার নাম মুহাম্মদ আব্দুল আউয়াল গণি। চলতে চলতে কালের পরিক্রমায় বাবা-মায়ের দেওয়া নামটা অনেক আগেই ধুয়ে গেছে। কেবল বাকী আছে গণি। এটাকেও আবার কেউ কেউ বিকৃত করে গইন্যা বলে ডাকে। গণির এতে অনেক রাগ হয়। কিন্তু তাদের সে বাঁধা দেয় না। কারণ সে জানে, বাধা দিতে গেলেই শত্রুতা বাড়বে। আর এই যান্ত্রিক শহরে গরীবদের শত্রু বাড়া মানেই জীবন বরবাদ।
রিকশা চালায় বলে শহরেই সব জায়গায়ই তার যেতে আসতে হয়। সচিবালয় থেকে পতিতালয় সব জায়গার পথঘাট তার চেনা। তার রিকশায় চড়ে সবাই। গার্মেন্টস কর্মী, শিক্ষক, ডাক্তার, চাকুরীজীবী কেউ বাদ যায় না। বড়লোক গাড়িওয়ালা ব্যবসায়ীরাও চড়ে। তবে সেটা যদি তাদের গাড়ি স্টার্ট নিতে বন্ধ করে দেয় কিংবা গাড়িটা সার্ভিসিংয়ে পাঠানো হয়। রাজনীতি থেকে শুরু করে পেটনীতি সব আলোচনারই রাজস্বাক্ষী তার এই তিন চাকার রিকশা। তার রিকশা চড়ে অনেকে আবার প্রেমও করে। প্রেমিকা না হয় বউকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। আদতে প্রেমের বাহন হয়ে গেছে তার রিকশা।
একদিন গণি বিয়েও করে। ফুটফুটে মিষ্টি একটা মেয়েকে। মা তার মানুষের বাড়ি কাজ করে। তাই এত সুন্দরী মেয়ে ঘরে রেখে যেতে সাহস হয় না। যাদের বাড়ি কাজ করে তাদের বাড়িও নিয়ে যেতে পারে না। শেষমেষ বিয়ে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে ভেবে পাত্র খুজতে থাকে। তখনই খবরটা পায় করিমা খালা। গণির পাশের ঝুপড়িটা করিমা খালার। তিনিই দুপক্ষের মধ্যে কথা বলেন। তারপর দুজনের বিয়ে হয়ে যায়। এইভাবে গণির ঝুপড়িতে জায়গা হয় আরশার। আরশা দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। চাঁদের সাথে তুলনা দেওয়া চলে তার। কিন্তু এই সৌন্দর্যে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই মেয়েটার। সেও যে গণি এবং বাকি সবার মতো সস্তা স্বপ্নের দ্রষ্টা।
বিয়ের পর, গণির ব্যস্ততা বাড়ে। এখন সে একা নয়, তার সাথে আরশাও আছে। দুজনের পেট ভরাতে হবে তার। তাই এখন সে সকাল আটটা নাগাদ রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আগে বের হতো এগারোটায়। এতে দুজনের ভালোবাসায় একটুও ভাটা পড়ে না। উপচে পড়া ভালোবাসায় দুজনেই স্বপ্ন দেখে “হয়তো একদিন সকালে কাজের চাপ থাকবে না। বিছানা ছেড়ে রাতের বাসি খাবার খেয়ে ধীরে-সুস্থে রিকশা নিয়ে বেরোবে গণি। আর আরশা চেয়ে থাকবে সেই পথে। একটু পরপর গিয়ে দেখে আসবে গণি ফিরেছে কি না। একসাথে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে দুজন। ঠিক যেভাবে পরম মমতায় একে অপরকে আগলে রাখে কপোত-কপোতীরা।”
তাদের এই এলোমেলো ভাবনা ম্লাম হয়ে যায় সানির উপদ্রবে। সানি স্থানীয় চাঁদাবাজ। লোকাল গুণ্ডা হিসেবেই ওর পরিচিতি বেশি। সমাজের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে গেছে ওর চেতনা। এতদিন ব্যবসায়ী আর ফুটপাতের দোকানদারদের থেকে চাঁদা নিলেও এখন রিকশাওয়ালাদেরও ছাড় দিতে চায় না সে। আজকে পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দিলেও নিশ্চিন্ত হতে পারে না গণি। সে জানে দিনে দিনে ওদের চাহিদা বাড়বে। তাই বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় সে। তার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যায় ঝুপড়ির কাছে আসতেই; যখন মতির সাথে দেখা হয়। মতিই আগে আগে ছুটে আসে ওর কাছে। “খবর হুনছস গইন্যা?”
“না। ক্যান কী হইছে?”
“আইজকা কর্পোরেশন থাইক্যা মানুষ আইছিল। কইয়া গেছে এই জায়গা নাকি কর্পোরেশনের। ওরা কমপ্লেক্স বানাইব।”
“কস কি? এহন কী হইব?”
“কী আবার হইব। ওরা তিনদিনের টাইম দিয়া গেছে। কইছে তিনদিনের মধ্যে জায়গা ছাড়তে। তা না হইলে ওরা আইসা ঝুপড়িগুলা ভাইঙ্গা দিব।”
“হায় আল্লা। এহন কই যামু আমরা। গরীবের শেষ মাথা গোজার ঠাঁইটাও না চইলা যায়।”
কথাটা দুই-তিনবার আওড়ে পা চালায় সে। তারপর আবার চুপ মেরে যায়। পথেও কারো সাথে কোনো কথা বলে নি।
অমাবস্যার রাতের মতো কালো মুখে যখন সে তার ঝুপড়িতে ঢুকে আরশা তখন রান্না করছিল। গণিকে ঢুকতে দেখে ওঠে দাঁড়ায় সে। গণির চেহারার গাম্ভীর্য আর কপালের কুঞ্চিত ভাঁজ দেখে আরশার বুঝতে বাকী থাকে না “গণির মনে আজ দুশ্চিন্তা ভর করেছে।” “কী হইছে তোমার? মুখটা অমন শুকাইয়া গেলো ক্যান? শরীর খারাপ করে নাই তো?”
“আরে। ওতো ব্যস্ত হইস না। হুনলাম কর্পোরেশনের লোক আইছিল?”
“হ। তোমারে কে কইল।”
“মতি।”
“ও”
“তুমি বস। আমি তোমার খাওন দিতাছি।”
“না। অহন খামুনা। তুই বয় এইখানে।”
আরশা চুপচাপ বসে থাকে গণির সামনাসামনি। অনেকক্ষণ। তারপর গণি আরশার গায়ের সাথে লেপ্টে বসে। কাঁপা গলায় বলে, “বউ। কী করি এহন। না শান্তিতে রিকশা চালান যাইতাছে না থাহন।”
“ক্যান। রিকশা চালানোর আবার কী হইছে? ওখানেও কী কর্পোরেশনের লোক বাধা দিছে নাকি?”
“কর্পোরেশনের লোক না। একটা রংবাজ। ওরে চান্দা না দিলে রিকশা চালান যাইব না। আর চান্দা দিলে চাইল তো পরে মুড়িই কিনন যাইব না। কী করি এহন। তুই ক?”
“আরে ওতো ভাইবো না। সব ঠিক হইয়া যাইব।”
“তাই যেন হয় বউ। তোর কথাই জানি ঠিক হয়।”
কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। তিনদিন পর যখন কর্পোরেশনের লোকজন এসে ওদের ঝুপড়িগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দেয় ঠিক সেসময়টাতে গণির রিকশা সানি কেড়ে নিয়ে যায়। গণিকেও মারধর করে। ওর অপরাধ ও চাঁদা দিতে চায়নি। অশ্রুভেজা চোখ আর ফাটা কপাল নিয়ে যখন গণি ঝুপড়িতে আসে ওর চোখে পড়ে কেবলই ধ্বংসস্তুপ। গণির দুচোখ আরশাকে খোঁজতে ব্যস্ত হয়ে। একটু পরেই আরশাকে খুঁজে পায় গণি। করিমা খালার সাথে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ওর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা আর দুর্ভাবনার ছায়া। গণি ওর সামনে দাঁড়ায় না। হেঁটে বাইরে চলে আসে। একবার আকাশের দিকে তাকায় আর ভাবে “গরীব হয়ে জন্ম নেওয়াটাই কী ওর অপরাধ। ও তো ইচ্ছে করে গরীব হয়ে জন্মায় নি। তবে কেন বারবার ওকেই ছাড় দিতে হবে। নিজের স্ত্রীর সামনে দাড়াতেও আজ ও লজ্জা পাচ্ছে।” ওর কণ্ঠে দুই-তিনবার একটি কথাই উচ্চারিত হয় “জন্মই আমার আজন্ম পাপ।”
অন্যমনস্কভাবে হাটতে থাকে সে। যখন চেতনা আসে ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। কারণ ও দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মাঝখানে আর একটা বাস চলে এসেছে ওর তিন হাতের মধ্যে। কেবল কয়েকটা মুহূর্ত আর একটা আর্তচিৎকার। তারপরই সব নীরব। অল্পক্ষণেই ভীড় লেগে যায় ওর চারদিকে। আরশার কাছেও খবর পৌছাতে দেরী হয়না। গণির মৃত্যুর সংবাদ ওর বুকের পাজর ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। ওর চোখ থেকে একফোটাও জল গড়ায় না। কেবল ফ্যাকাশে মুখে উদ্ভ্রান্ত চাহনিতে তাকিয়ে থাকে মৃত স্বামীর রক্তাক্ত মুখের দিকে। কেউ ওকে কাঁদাতে পারে নি। যেন ও পাথর হয়ে গেছে। এশহর গণিকে কিছুই দিতে পারে নি। দিয়েছে আরশাকে; বিধবার সাদা শাড়ি আর স্বামীর রক্তাক্ত দেহ...
©somewhere in net ltd.