নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নাজমুল হুদা নাজ

নাজ রিটার্নস

নাজ রিটার্নস › বিস্তারিত পোস্টঃ

খানা আতাঃ লিখতে বাধ্য হলাম

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১১:০৯



বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তীতুল্য ব্যক্তি খান আতাউর রহমানের জন্ম ১৯২৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানাধীন রামকান্তপুর গ্রামে। নাটক, চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীতে বর্ণাঢ্য ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই ব্যক্তিটি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন ‘খান আতা’ নামে। খুব কাছের মানুষেরা তাঁকে ‘আতা ভাই’ বলেই ডাকতেন, যদিও তাঁর ডাক নাম ছিল তারা। তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক, চলচ্চিত্র পরিচালক, কাহিনীকার, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ-রচয়িতা, গীতিকার, সুরকার, সংবাদ পাঠক এবং বেতার ও টিভির জনপ্রিয় উপস্থাপক। এছাড়াও এক সময় কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ রচনা এবং সাংবাদিকতায়ও নিয়োজিত ছিলেন।
খান আতার কর্মজীবন ছিল বিচিত্র ধারায় বহমান। মেডিকেলের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে হঠাৎ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সিভিল সাপ্লাইয়ের সাব-ইন্সপেক্টর হয়ে গেলেন। সে চাকরিটিও ছেড়ে তিনি ১৯৪৯ সালে বোম্বে চলে যান ফিল্ম বানানো শিখতে। সেখানে তিনি প্রথমে সহকারী চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ শুরু করেন, কিন্তু এ কাজের জন্য তিনি কোন পারিশ্রমিক পাননি। তিন মাস বিনা বেতনে কাজ করার পর তিনি বোম্বে থেকে করাচী চলে যান। সেখানে তিনি রেডিও পাকিস্তানে বাংলা সংবাদ পাঠকের চাকরি নেন। ১৯৫১ সালে রেডিও পাকিস্তানের চাকরি থেকে পদত্যাগ করে খান আতা ইস্ট পাকিস্তান এসোসিয়েশন এর প্রথম বাংলা নাটক ‘সিরাজুদ্দৌলা’ পরিচালনা ও নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। এরপর তিনি পাঁচ বছরের জন্য লন্ডন চলে যান। সেখানে তিনি ইউনিটি থিয়েটার এবং থিয়েটার রয়েলের সাথে কাজ করেন। এছাড়াও আরভিন থিয়েটারের ‘রক্ত কবরী’ নাটকে মায়া ব্যানার্জীর সাথে অভিনয়, ট্রাফেলগার স্কয়ারে গান পরিবেশন এবং বিখ্যাত ব্যালেড সিঙ্গার ইউবাট ম্যাককেলের পরিচালনায় একটি নাটকে অভিনয় ও গান করেন। এরপর তিনি লন্ডনে তাঁর বন্ধু আলী ইমামের সাথে যৌথভাবে ‘Ali Qulikhan’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৫৩ সালে খান আতা লন্ডনস্থ পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। লন্ডন ত্যাগ করে খান আতা দেশে ফিরে এসেছিলেন ১৯৫৭ সালে। তিনি দেশে আসার জন্য ১৫০ সিসি ব্যান্টাম মটর সাইকেল নিয়ে ইরাক, ইরান, ইজিপ্ট হয়ে করাচী পৌছেন। লন্ডন থেকে স্থলপথে দেশে ফিরার সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন আলী ইমাম। এরপর ঢাকা রেডিওতে কিছুদিন ইংরেজী ঘোষক হিসেবে তিনি কাজ করেন। ‘এই দেশ এই মাটি’ গানটি রচনার মধ্য দিয়ে খান আতা ১৯৫৯ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। অতঃপর একে একে আরো অনেক ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জীবদ্দশায় খান আতা অসংখ্য গান রচনা করলেও এ পর্যন্ত তাঁর কোন সঙ্গীত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, ফলে তাঁর রচিত গানের সঠিক সংখ্যা কত তা বলা কঠিন। ১৯৫৭ সালে খান আতা আনিস নাম ধারণ করে এ. জে. কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এরপর ‘এদেশ তোমার আমার (১৯৫৯)’, ‘যে নদী মরু পথে (১৯৬১)’ এবং ‘কখনো আসেনি (১৯৬১)’ চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম চিত্র পরিচালক হিসেবে নির্মান করেন ‘অনেক দিনের চেনা’। এরপর পাকিস্তান আমলে তিনি আরো নির্মান করেন ‘রাজা সন্ন্যাসী’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘সোয়ে নাদীয়া জাগে পানি’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘জোয়ার ভাটা’ এবং ‘সুখ দুঃখ’। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি একে একে পরিচালনা করেন ‘আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩)’, ‘আরশীনগর (১৯৮৩)’, পরশ পাথর (১৯৮৭)’ এবং ‘এখনো অনেক রাত (১৯৯৭)। এছাড়াও তাঁর স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে ‘ডানপিটে ছেলে’, ‘স্বপ্ন হলেও সত্যি’, ‘রিপোর্ট কার্ড’ ও ‘এক ঝাঁক পাখি’ এবং প্রামান্যচিত্র হিসেবে ‘গঙ্গা ও গঙ্গা’ ও ‘দুটি পাতা দুটি কুঁড়ি’ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও খান আতাউর রহমান, সিবি জামান ও তাহের চৌধুরী, এ তিন চিত্রপরিচালক একত্রে ‘প্রমোদকার’ ছদ্মনামে চলচ্চিত্র নির্মান করতেন। পরবর্তীতে জালালুদ্দীন রুমীও এ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হন। প্রমোদকার পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি হচ্ছে, ‘ত্রিরত্ন (১৯৭৪)’, ‘সুজন সখী (১৯৭৫)’, ‘দিন যায় কথা থাকে (১৯৭৯)’ এবং ‘হিশাব নিকাশ (১৯৮৫)’।
পাঠান পরিবারের সন্তান খান আতা বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য কি কি করেছেন তা মোটামুটি সবার জানা থাকলেও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই মানুষটির ভূমিকা সম্পর্কে অনেকেই অসচেতন। ব্যক্তিগতভাবে খান আতা একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও ষোল আনা বাঙালি ছিলেন। তাঁর বাঙালিত্ব বোধের মধ্যে কোন কৃত্রিমতা ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধের সময়, কিংবা এর আগে পরে তিনি সবসময়ই এই দেশ এবং দেশের মানুষের পক্ষেই কথা বলেছেন।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শহীদ মিনার চত্বরে ‘বিক্ষুদ্ধ শিল্পী সমাজ’ ব্যানারে নাটক, গান, আবৃত্তি চর্চা করা হত মানুষকে স্বাধীনতার প্রতি উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে। যদিও এর আহ্বায়ক ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম এবং এতে অংশগ্রহণ করেন গোলাম মোস্তফা, রাজু আহমেদ, মোঃ আব্দুল জব্বার, সৈয়দ আব্দুল হাদী, খন্দকার ফারুক আহমেদ, মোহাম্মোদুন্নবি, সিবি জামান, নায়ক আফসার, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী জাহেদুর রহিম, সানজিদা খানম, কলীম শারাফী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমির ছাত্রছাত্রীবৃন্দ সহ আরো অনেকে; কিন্তু এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন খান আতাউর রহমান।
অসহযোগ আন্দোলনের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি এ খবর চাউর হয়ে ওঠে। খান আতা তখন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি। ২৫ মার্চ রাত ৯টায় তিনি কাকরাইলে তাঁর অফিস সেভেন আর্টস ইউনাইটেডে প্রযোজকদের জরুরী সভা ডেকে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি রাখেন। তাঁর দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের অদম্য পরিচয় এ থেকেই পাওয়া যায়।
২৮ মার্চ সকালে কারফিউ উঠানোর পর খান আতাউর রহমান নিজের অফিসের চাবি আনার জন্য মিরপুরে তাঁর একাউন্টেন্টের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। একটি টয়োটা কোরোলা গাড়িতে এ সময় আরো তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাহের চৌধুরী, সিবি জামান এবং আমির আলী যিনি গাড়িটি ড্রাইভ করছিলেন। গন্তব্যে পৌছানোর সাথে সাথেই একাউন্টেন্ট তাঁদের অফিসের চাবি দিয়ে চলে যেতে বলে, কারণ বিহারীরা তখন বাঙালিদের মারা শুরু করেছিল। খান আতা গাড়ির কাছে পৌছাতেই দেখলেন সামনে থেকে বিহারীদের একটা বড় মিছিল দা-ক্ষুন্তি হাতে তাঁদের দিকেই আসছে! আমির আলীকে সরিয়ে খান আতা নিজেই ড্রাইভিং সীটে বসে তুমুল বেগে গাড়ি বিহারীদের মাঝখান দিয়ে চালিয়ে বের হয়ে আসেন। তাঁর এই অসম সাহসীকতা সেদিন শুধু তাঁরই না, তাঁর সহকর্মীদের প্রাণও বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
ক্র্যাক ডাউনের পর পর টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী তাঁকে দায়িত্ব দেন রেডিও পাকিস্তানে সকাল বেলা বাচ্চাদের সঙ্গীত শিক্ষার আসর পরিচালনা করার, এবং কৌশলগত কারণে খান আতা khan-ata-3তাতে রাজিও হন। ‘ক তে কলা, খ তে খাই’, এই বিখ্যাত গানটি তখনকারই রচনা। কিন্তু এসময়ও তিনি বিভিন্ন হাস্পাতাল-ক্লিনিক থেকে ঔষধ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে পৌছে দিতেন। শীত আসার আগে শীতের কাপড় এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছানোর ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। নিজে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের ঔষধ, কাপড়, টাকা এবং শেল্টার দিয়ে সাহায্য করেছেন সবসময়। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় এমন কোন দিন নেই যেদিন তাঁর গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার করা হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এদেশ তোমার আমার চলচ্চিত্রের ‘এই দেশ এই মাটি’ এবং সুখ-দুঃখ চলচ্চিত্রের ‘এইবার জীবনের জয় হবে’ ও ‘আমাদের বন্দী করে যদি ওরা ভাবে’ গানগুলি। এছাড়াও খান আতা আরো অনেক গান রেকর্ড করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সরবরাহ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস সিনেমার কাজ বন্ধ থাকলেও তিনি তাঁর ইউনিটের কাউকেই চলে যেতে দেননি। এমনকি কারফিউর মাঝে দুই-তিন ঘন্টার ব্রেকে তিনি নিজে সহকর্মীদের বাসায় বাসায় টাকা পৌছে দিতেন। জুন মাসের দিকে একবার তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে কলকাতা চলে যাওয়ার উপদেশ দেন, কিন্তু নিজের দুটি সংসার, মা, ভাই-বোন, এতগুলো সহকর্মী এবং তাঁদের পরিবার; এ সবকিছু ফেলে চলে যেতে তাঁর মন সায় দেয়নি! তিনি এখানে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের যতটা পারেন সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। খান আতা নিজের গাড়ি, অফিসের ফার্নিচার বিক্রি করে হলেও সবার সাহায্য করেছেন, কখনোই কাউকে ফিরিয়ে দেননি!
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি ১২ নং নিউ সার্কুলার রোডে (বর্তমান প্রপার্টি প্লাজা) থাকলেও মাঝে বাসা পরিবর্তন করে সিদ্ধেশ্বরী চলে যান। সেখান থেকেও বাসা পরিবর্তন করে ডিসেম্বরের ২ তারিখ তিনি খাজা দেওয়ানে একটি ভাড়া বাসায় উঠেন। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী দালালরা তাঁর সিদ্ধেশ্বরী ও খাজা দেওয়ানের নিজস্ব বাড়িটি তাঁকে খুজতে গিয়ে তছনছ করে দেয়।
অনেকেই হয়তোবা জানেন না যে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে খান আতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন, যা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
কিংবদন্তীসম এই কীর্তিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ১৯৯৭ সালের ১ ডিসেম্বর মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব তাঁর জীবনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তাই তো মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং তাঁর জীবনের শেষ চলচ্চিত্র ‘এখনো অনেক রাত’, দুটোরই বিষয়বস্তু ছিল মুক্তিযুদ্ধ। তিনি হয়তো আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তিনি বাঙালিদের কাছে সবসময় বেঁচে থাকবেন তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।খানা আতআ

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.