নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অবিবেচক

অবিবেচক › বিস্তারিত পোস্টঃ

হন্টন রোগ

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩৯

হাঁটা-হাঁটি করা ভালো ব্যায়াম। তবে এই উঠতি বয়সে তার কার্যকরিতা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল এবং আছে। তবু ছোটবেলা থেকেই আমার হাঁটা-হাঁটির একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। স্কুলের ব্যস্ত সিডিউল কিংবা বাসায় এসে পড়া তৈরীর তাড়নার ফাঁকে একটু একা একা হাঁটার সময় বের করতাম। মনে আছে, মাঝে মাঝেই সাইকেল হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরতাম। আসার সময় রাস্তার পাশে দেয়ালে সাঁটানো পোষ্টারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। পথে বাবার পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যেত প্রায়ই। অতি উৎসাহে তারা জিজ্ঞাসা করতেন সাইকেল থাকতে হেঁটে যাচ্ছি কেন। হঠাৎ প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলতাম “চেইন কভার আলগা হয়ে গেছে” অথবা “ ব্রেক নষ্ট হয়ে গেছে”। মাটির দিকে তাকিয়ে খানিকটা সংকোচে মিথ্যাগুলো বলে ফেলতাম হড়হড় করে। তারাও সাইকেলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হাঁটা দিত। উত্তরগুলো দায়সারা গোছের হলেও তাদের আচরন ছিল দেখার মত।

এরপর থেকেই আমার দৃষ্টি পোষ্টার থেকে মানুষের উপর সরিয়ে আনলাম। পোষ্টারের চেয়ে মানুষ অনেক ডিনামিক। রাস্তায় বের হয়ে আমি একাগ্রচিত্তে মানুষের আচরন দেখতাম। দেখতাম তাদের মুখাবয়ব, বাচনভঙ্গি সর্বোপরি “চেঞ্জ অফ এক্সপ্রেশন”।



জীবনের ষোড়শ বছরের দিকে এটা প্রায় রোগের পর্যায়ে পরে গেল। প্রতিটি অলস সন্ধ্যায় আর বাসার শাসন নেই। মুক্ত বিহঙ্গের মত আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, মানুষ। অবাক হয়ে দেখলাম, আমি সবাইকে লক্ষ্য করলেও কেউ আমার দিকে তাকিয়েও দেখছে না। ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ক্লান্ত মানুষদের চোখে আমি পেটের দায় দেখেছিলাম। একটু ভাল থাকার আশায় কিছু প্রি-কোডেড যন্ত্র মানব রাস্তায় নামে প্রতিদিন, একই গলি পার হয়ে, একই বাসে ঝুলে, নিয়তির নির্ধারিত কর্ম সম্পাদন করে অবশ শরীরটাকে কে কার আগে বিছানায় টেনে নিয়ে যেতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নামে দিনের শেষে। এদের অনেকেরই হয়তো ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে ফুসফুসে ভরার সুযোগ হয় না, অনেকেরই হয়না পূর্ণিমার চাঁদ দেখা কিংবা তার অবুঝ শিশুটার সাথে দু’দন্ড সময় কাটানো। ব্যস্ততার ভীড়ে জীবনের যাতাকলে কখন যে ভেতরের মানুষটা মারা গেছে তা খেয়াল করার সময়ই পায়নি হয়তো। এদের অনেকেই হয়তো গান করতো এক সময়, কেউ ছবি আঁকত, কেউ খেলাধুলায় ভালো ছিল, কারো হয়তো ফটোগ্রাফির অভ্যাস ও ছিল। অথচ এখানে তারা নিজেরাই এক একটা ফটোগ্রাফ। বেঁচে থাকার সংগ্রামে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবাই এক একটা পাথর হৃদয় হয়ে গেছে।



আমি তখন তেজতুরী(বানান ঠিক আছে কিনা জানিনা) বাজার থাকি। হাঁটা শুরু করবো বলে আনন্দ সিনেমা হলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। লোকে গিজগিজ করা একটা বাসের দরজায় ৭-৮ জন ঝুলছে দেখলাম। আরও ১০-১২ জন বাসের হেন্ডেল ধরে দৌড়াচ্ছে বাসে উঠার আশায়। এর মাঝে একজন রাস্তায় পরে গেল। কিন্তু কেউ ভ্রূক্ষেপই করলোনা। যার যার মত বাসে উঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দেখে বিস্মিত হলাম। তখনও ভাবিনি আরও কিছু বাকী আছে। খানিকক্ষণ বাদেই পরে যাওয়া লোকটিই বাসে উঠার দ্বিতীয় দফা চেষ্টা চালাচ্ছে। দেখলাম জীবনের আধুনিক সংজ্ঞায়ন। বুঝলাম কেউ কারো নয়, “হয় কর, নয় মর”।জানলাম বেঁচে থাকা মানে শুধু বেঁচে থাকা নয়। আমার ভাগটুকু আমাকে কেঁড়ে নিতেই হবে, একই সাথে পা’টাকেও সবল রাখতে হবে যে কেঁড়ে নিতে আসবে তাকে লাথি মারার জন্য।

এই বোধটা নিজের মধ্যে আসতে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। তা-ই ভাবি মাঝে মাঝে। জীবনটা হয়তো অন্যরকমও হতে পারত। যা কিছু পেয়েছি আগলে রাখতে চেয়েছি অবলম্বন করে। ভুল ছিল, বড় ভুল। জীবনের অঙ্কে আবেগের সূত্র ফেললে সমাধান মিলবেনা কোনদিন। নিস্কাম বলে কিছু নেই। ছোট বেলায় বাবা বলত, পাড়ার ছেলেদের সাথে না মিশতে। কারন, ওরা খারাপ ছেলে। আমি তর্ক করতাম, ওদের সাথে মিশলে কি হয়? এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ছিল, ওরা আমাকে খারাপ করতে পারবে না কোনদিন। আসলে বাবা জানতেন আমাকে পরিবর্তন করা তাদের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু, আমার ভবিষ্যত জীবনে খুব একটা ফায়দা পাওয়া যাবে তাদের কাছ থেকে ।এখন বুঝি, বাবা আমাকে স্বার্থ-সম্পদের গোপন কুঠুরীর চাবির সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন, আমি নিতে চাইনি। এখন বুঝি, অধিকাংশ মানুষই স্বার্থ ছাড়া কাজ করতে খুব একটা অভ্যস্ত না। ২টাকা দান করলেও চাই কেউ দেখুক দান করাটা।



“পঞ্চবটী” নামে একটা সামাজিক সংগঠন খুলেছিলাম নিজের এলাকায়। অনেকেই হাত তুলেছিল,কেউ আবার অতি উৎসাহে দুই হাত। তখন কেউই বোধহয় লাভহীন কোন সংগঠনের কথা ভাবতেও পারেনি। তাই প্রথম প্রোপ্যাগান্ডা প্রকাশ করার পরই সবাই কেমন যেন নড়েচড়ে বসল। তবে তাৎক্ষণিকই কেউ চোখ উল্টাতে পারেনি হয়তো সম্পর্কের খাতিরে, হয়তো চক্ষুলজ্জায়। পাক্ষিক মিটিং এ তাদের সবাইকে কখনো এক করতে পারিনি। কারো প্রেমিকার সাথে ডেটিং, কারো ক্লাশ, কারো বাসায় কাজ ইত্যাদি নানা অজুহাত। সাংগঠনিক ক্ষমতার ঘাটতি আমার থাকতে পারে, কিন্তু ওই হাত তোলা দলে আরও অনেকেই ছিল যাদের এই ক্ষমতা ভাল। যাইহোক কোন রকমে প্রথম পর্বের কাজ শেষ করলাম। এলাকার গন্যমান্যরা আসলেন। তাদের সাথে পরিচয় হল। উদ্দীপক বানী ঝরল তাদের অনেকের মুখ থেকেই। তারা হয়তো ভাবতেও পারেনি, এই সংগঠনের মৃত্যু হতে চলেছে কিছুদিন পর। কয়েকদিন পরই বাকী যারা ছিল চোখের পর্দা কেটে ফেলল নিঃসঙ্কোচে । শুনেছি, আমার সাবেক সহকর্মীরা একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে বছর দুই আগে। এখন তাদের বাসা, বন্ধু, প্রেমিকা, পড়াশোনা সব ঐ ব্যবসা।

যা বলছিলাম, মানুষ লাভের পেছনে ছুটবে এইটাই তার সহজাত প্রবৃত্তি। এইটা মেনে নেয়াই উচিত এবং বাস্তবসম্মতও বটে। সমস্যাটা হচ্ছে ওদের বুলি। এদের কথা ও কাজে যমুনাসম ফারাক।



উফ, হাঁটতে হাঁটতে যে কোথায় চলে গেলাম টেরই পাইনি। এই হাঁটা রোগটা এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে গেল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আগে। হাঁটার পরিধিও বেড়ে গেল, এখন আর এন্ড পয়েন্ট নেই। কখনো এরকম হয়েছে যে গ্রীনরোড থেকে কাউকে ফলো করতে করতে তেজকুনীপাড়া পর্যন্ত চলে গেছি। কিন্তু যাকে অনুসরন করছি তাকে আমি চিনি না, কোনদিন দেখিওনি। হঠাৎ খেয়াল হলে সিগারেট ধরিয়ে ফিরতি পথ ধরতাম। আর রুম এসে আজকের যাত্রাপথের বিশ্লেষনে বসতাম। অন্যরকম মজা দিত ভিন্ন ভিন্ন মানুষের বিভিন্ন সময়ে আচরনের পরিবর্তন।



এই মজাটা কমতে শুরু করলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে, অনেকটা জায়গার অভাবে। এক রাস্তায় আর কত হাঁটা যায়। তাছাড়া যে পরিবর্তন দেখে মজা নিতাম তা নিজের বিপক্ষে ঘটলে সহ্য করা কষ্টকর। এখনো হাঁটার চেষ্টা করি মন চাইলে। তবে মনটাই আর আগের মত চায় না। তবু বের হলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটি, কালো রাস্তা, প্রতিক্রিয়াহীন। আগের মাদকতা নেই, অন্তর চিপেও এতটুকু রস বের করতে পারি না আনন্দের। কেউ হঠাৎ নাম ধরে ডেকে উঠলে অবাক হই, ভেতর থেকে ঠেলে বের করা শুকনো হাসি দিয়ে রাস্তা মাপা শুরু করি পায়ের কদমে। হাতঘড়ি নেই, মোবাইল বের করে সময় দেখি। এইতো আর কিছুক্ষন হাঁটলেই আমার নিজের রুম, নিজের আপন বিছানা.......................

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৬

মাক্স বলেছেন: এইতো আর কিছুক্ষন হাঁটলেই আমার নিজের রুম, নিজের আপন বিছানা......................
শেষ লাইনটা পড়েই বেশি ভাল্লাগলো। খালি ঘুম পায় আমার =p~ =p~ =p~ =p~

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:৩১

অবিবেচক বলেছেন: ঘুম যান। ঘুমের উপরে কিছু নাই ................

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.