নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যে সুন্দর করে হাসতে জানে না,সে মন খুলে ভালোবাসতে জানে না।

Omar Ali Ashraf

আমি একজন মুসলিম

Omar Ali Ashraf › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : অবিশ্বাসী বিশ্বাস

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:১১


মাঝেমাঝেই আমার ইনসমনিয়া হয়, রাতে ঘুম আসে না। জেগে জেগে সকাল হওয়ার অপেক্ষা করি। এছাড়া উপায় থাকে না। পরীক্ষা এলে অভ্যাসটা উল্টে যায়। সন্ধ্যার পরেই রাজ্যের ঘুম চেপে আসে আমার চোখে। কালরাতেও কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কেউ বলতে পারে না। হিমি আমার পাশে বসে ছবি আঁকছিল। সেও দেখেনি আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। মা নাকি খুব ডাকাডাকি করেছেন রাতের খাবার খেতে। আমি উঠিনি। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখি আমার ঘরের দরজায় একটা কাগজ সাঁটানো। মেয়েলি হস্তাক্ষরে সেখানে লেখা, "একবেলা না খেলে একরাত ঘুম বন্ধ।"

হিমি এসে বলল, ভাইয়া! বাবা তোমাকে ডাকছে।
বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ। আমাদের সংসারটাকে তিলেতিলে গড়ে তুলে এ পর্যন্ত শূন্য থেকে বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছেন। তার শরীর কাটলে হয়ত দেখা যাবে একফোঁটাও রক্ত নেই, সব পানি। শরীরের সমস্ত রক্ত পানি করে তিনি আমাদেরকে মানুষ করছেন। পরীক্ষায় পাশ করে ভালো চাকরি নিয়ে আমি বাবার কষ্ট দূর করব। ইতোমধ্যে একটা চাকরির অফার এসে গেছে। কিছু সাইড ইনকাম করছি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। বাবা আমাকে কখনোই ডাকেন না। খুব সম্ভব আমাকে কখনো বাবার প্রয়োজনই হয় না। স্কুলে থাকতে লেখাপড়ার আদেশ উপদেশ যা কিছু দেয়ার ছিল, মার কাছে বলতেন। এখনো যা দরকার, মার কাছেই বলেন। মা টেপরেকর্ডারের মতো সব মুখস্থ করে নেন। তারপর ভাত খেতে বসলে একনাগাড়ে তার প্লেয়ার বেজেই চলে। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে উঠে চলে যাই। দূরে গিয়েও শুনি, মার ক্যাসেট বন্ধ হয়নি, তিনি বলেই যাচ্ছেন।
বাবা আমাকে বসতে বলে বাক্স থেকে সিগারেট বের করলেন।
আগে দেখতাম, ছোটরা সিগারেট খাওয়ার সময় বড় কেউ এলে হয়ত সিগারেট ফেলে দেয় অথবা হাত পেছনে লুকিয়ে ফেলে। বড়দের সামনে সিগারেট খেলে তারা বেয়াদব ভাবেন। কিন্তু তারা ছোটদের সামনে সিগারেটে ফুঁক দিলে যে ছোটরা বিব্রত হয়, সম্ভবত বড় হলে এ ধারণা কিংবা ভদ্রতাটুকু থাকতে নেই। কলেজ লাইফের আগে এমনটা হলে বিব্রত বোধ করতাম। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা স্যারদের সামনে বসে সিগারেট ফুঁকি। অনেক অধ্যাপক নিজেই হাতে সিগারেট ধরিয়ে দেন।
বাবা মুখের ভাঁজ খুললেন, হিমিকে নিয়ে কী করি বলত!
আমি কিছু না বুঝে চুপ করে থাকলাম। বাবার বোধহয় হাতে সময় কম, এক নাগাড়ে তিনি বলে যাচ্ছেন। এতদিন পর আমি বুঝতে পারলাম, মা আমাকে বাবার উপদেশ শ্রুতিবাণী শোনাতে গিয়ে কেন মাঝখানে থেমে দম নেন না!
বাবার ইচ্ছা, ভবিষ্যতে হিমি ডাক্তার হবে। পুরুষরা যেমন অসুস্থ হয়, মহিলারাও রোগে আকক্রান্ত হয়। দেশে পুরুষ ডাক্তারের অভাব নেই, অথচ মহিলা ডাক্তার খুঁজেই পাওয়া যায় না।

আমি পড়ার রুমে ফিরে এলাম। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি আবার বইতে মন গুঁজে দেয়ার চেষ্টা করলাম। পারছি না। বেলকনিতে সার দিয়ে টব পেতে সাজানো বাগান থেকে হিমির গলার শব্দ আসছে। ভারি মিষ্টি কণ্ঠ। হিমি যখন গানের সুর ওঠায়, আমি তন্ময় হয়ে যাই। স্কুলে কলেজে ভার্সিটিতে কত মেয়ের গান শুনেছি, এতো সুন্দর রিনিঝিনি কিন্নরী কণ্ঠ আমি আর শুনিনি। হিমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে-
"আমার ও পরান ও যাহা চায়
তুমি তাই , তুমি তাই গো
আমার ও পরান ও যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো...।"
খালি মুখে রবীন্দ্রসঙ্গীত এতো মধুর হয়, হিমির গলায় না শুনলে আমি বিশ্বাসই করতাম না। তাছাড়া ছোটদেরকে যদি জিগ্যেস করা হয়, কে বড়, নজরুল না রবীন্দ্রনাথ? অনায়াসেই তারা বলে দিবে, নজরুল! হিমির রবীন্দ্রপ্রীতি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
হিমি! এই হিমি! এইদিকে আয় তো! আমি ডাকলাম।
মা বললেন, ফরহাদ! হিমি আজকে স্কুলের হোম ওয়ার্ক কমপ্লিট করেছে কি না, দেখ তো!
আমি জানি, হিমি হোম ওয়ার্ক কমপ্লিট করেনি। সব টিচারের দেয়া বাড়ির কাজ সম্পূর্ণ শেষ করলেও বাংলার পণ্ডিত স্যারের দেয়া বাড়ির কাজ কখনোই সে সবটুকু শেষ করে না। হয়ত হিমিদের ক্লাসের কেউই করে না। আমরা যখন এই স্কুলে পড়তাম, রাজু ছাড়া আর কেউ স্যারের দেয়া হোম ওয়ার্ক করতাম না। স্যারকে বিরক্ত করাতেই ছিল আমাদের আনন্দ। রাজু প্রতিটি কাজই আমাদের বিপরীত করত। এ জন্যই বোধহয় সে ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিল। ফার্স্টবয়রা অন্য ছাত্রদের চোখে ভালো থাকে না। রাজুকে আমরা কেউই দেখতে পারতাম না। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত সুরে সুরে ছড়া কেটে আমরা তাকে খেপাতাম,
"মীনা রাজু টিয়ে
ল্যাংটাকালের বিয়ে!"

হিমি জানে, তাকে ডাকা মানেই আমি বলব, হিমি! একটা গান শোনা!
হিমি গানের সুর ওঠাল-
"ভালোবাসি ভালোবাসি
সেই সুরে কাছে দূরে জলেস্থলে বাজায়,
বাজায় বাঁশি ভালোবাসি, ভালোবাসি।"
ভালোবাসা জিনিসটা কী? মায়ের সঙ্গে যে ত্যাঁদড়ামো করি, এটা ভালোবাসা? বাবাকে যে মোটেও ভয় পাই না, এটা ভালোবাসা? চার বছর আগে যে হিমিকে একটা চড় মেরেছিলাম, এটাই কি ভালোবাসা? বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন সেকেন্ড ইয়ারের মীরুকে একদিন না দেখলে বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগে, এটাই বোধহয় ভালোবাসা।
আমি হিমিকে বললাম, ভালোবাসার ব্যাখ্যা কর! লজ্জা পেয়ে হিমি বলল, যাহ্! হিমির যাহ্ বলার ধরনে আমার একটা সিনেমার ডায়ালগ মনে পড়ে গেল। এই মুহূর্তে মুভিটার নাম মনে কর‍তে পারছি না। অভিনয়ের এ পর্যায়ে এসে নায়ক নায়িকার ব্লাউজের একটা বোতাম খুলল। নায়িকা লজ্জার ভান করে বলল, যাহ্! আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওই সময়ে নায়িকার পরনে নীল রঙের শাড়ি ছিল। আলো আঁধারিতে তাকে অপ্সরী মনে হচ্ছিল। বিকেলে যখন হিমিকে সঙ্গে করে বেড়াতে যাই, আমি তাকে অপ্সরী ডাকি। হিমি লজ্জার অভিনয় করে। আমার কাছে ভীষণ ভালো লাগে। আমি ঠিক করেছি, পাশ করে চাকরি পেলে প্রথম মাসের বেতন দিয়ে হিমিকে একটা নীল শাড়ি কিনে দিব, দুই জোড়া বালা আর এক জোড়া নূপুর। আর একটি নাচের পোশাক। হিমি অপ্সরী সেজে নেচে নেচে গান গাইবে। আমি তাকে ড্যান্সের স্কুলে ভর্তি করে দিব। মা বাধা দিবেন, জানি। বাবার মানসিকতা আমি বয়সের এই ছাব্বিশ বছরেও বুঝে উঠতে পারিনি। হিমিকে ডাক্তার বানানো তার স্বপ্ন, সুতরাং তিনিও আপত্তি তোলাটা স্বাভাবিক। যে যা-ই বলুক, আমি হিমিকে পৃথিবীর সেরা সিঙ্গার এবং ড্যান্সার বানাব। আমার বিশ্বাস, হিমির যে ট্যালেন্ট, একটু কোশেশ করলেই সে দুনিয়া কাঁপানো একট্রেস হতে পারবে।
মা আবার ডাকলেন। ফরহাদ! হিমির হোম ওয়ার্ক দেখেছিস? আমি কোনো উত্তর দিলাম না। আগে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, মা বাবা শিক্ষক আর ধর্মগুরু যা বলে, তা ঠিক ঠিক পালন করতে হয়, নইলে পাপ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমার ভুল ভাঙ্গল, পাপ বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই, সব ধর্মব্যবসায়ীদের সৃষ্ট অন্ধভয়।
হিমি বলল, ভাইয়া! তোমার কবে চাকরি হবে?
আমি বললাম, এই তো পরীক্ষা, তারপর রেজাল্ট প্রকাশের পরই চাকরি হয়ে যাবে।
চাকরির বেতন পেলে তুমি আমাকে দশ টাকা দিয়ো!
আমি আদুরে হাসি দিয়ে বললাম, টাকা তোর কী দরকার! ছোট মানুষ। পরে তো টাকা হারিয়ে কাঁদবি!
হিমি কিছু বলল না, পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে চলে গেল।
হিমির মতো থাকতে দশ টাকা আমার কাছে অনেক টাকা ছিল। একবার আমাদের যে থার্ড পণ্ডিতকে কেউ ডরায় না, কয়েকদিন স্কুলে অনুপস্থিত। হেড স্যার এসে জানালেন, তার গোটা গা বসন্ত গুটিতে ছেয়ে গেছে। বিষব্যথায় খেতেও পারেন না, ঘুমোতেও না। আমরা সবাই স্যারের কষ্ট অনুভব করে জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম। ছুটি হতেই আমরা দলবেঁধে স্যারের বাড়িতে ছুটলাম। স্যার গায়ে ঢাকাই মসলিনের মতো একটা ফিনফিনে পাতলা কাপড় জড়িয়ে ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের দেখে ভীষণ খুশি হলেন। স্যারের বাড়ি থেকে বের হয়ে আমরা একটা আমগাছের নিচে দাঁড়ালাম। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামী কাল আবার আমরা স্যারকে দেখতে আসব। রোজরোজ খালি হাতে আসা মানায় না। আগামী কাল আমরা স্যারের জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসব। কাল স্কুলে আসার সময় একজনে বাড়ি থেকে পাঁচ টাকা করে নিয়ে আসবে। পরদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম, আমাদের পরিকল্পনার কথা জানতে পেয়ে স্যার আমাদেরকে কষ্ট করে যেতে নিষেধ করে দিয়েছেন।
স্যারের কথা বলে অনেক কষ্টে বাবার কাছ থেকে পাঁচ টাকা নিয়েছি। এই টাকা ফেরত দেয়ার কোনো চিন্তাই মনে এল না। টাকাটা কীভাবে খরচ করব, ভাবতে ভাবতে দুই দিন চলে গেল। একবার দাঁড়াই আইসক্রিমের দোকানের সামনে, তখন মনে পড়ে গুড্ডু মেয়ার ঝাল চটপটির কথা। গুড্ডু মেয়ার দোকানে গেলে মনে পড়ে মুসলিমের আলুর দম আর পেঁয়াজুর কথা। অনেকদিনের শখ, ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য একটা নাটাই কিনব, সেটার কথাও মনে আসে। মিজানের সাথে ঝগড়া করে ওরটার চেয়েও সুচালো মাথাঅলা লাটিম কিনে ওরটায় কোপ বসিয়ে দুটুকরো করে দিব মর্মে হুঁশিয়ার করেছিলাম, সে কথাও মনে আসে। আমার আর কিচ্ছু কেনা হয় না। দুই দিন পরে দেখলাম দোকানে নতুন আইসক্রিম এসেছে। আখের রসের আইসক্রিম। আট আনা দিয়ে সেটা কিনে খেলাম।
তখন পাঁচ টাকা আমার কাছে অনেককিছু ছিল। হিমিও হয়ত দশ টাকা নিয়ে ওরকম বিভ্রান্তিতে পড়বে! মজা করে তার থেকে সেসব কাহিনি শুনব। আমার চোখে আমারই বোন হিমির রূপটা ভেসে ওঠে। কানে বাজতে থাকে তার কিন্নরী কণ্ঠ।
মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। হিমিকে নিয়ে আমার পরিকল্পনা খুলে বললাম। মা বাবার বলা ইচ্ছেটা মনে করিয়ে দিলেন। আমি উঠে চলে এলাম। একটা হলদে পাখি মাথার পাশ দিয়ে উড়ে গেল। ডানা মেলার সঙ্গে সঙ্গে তার উন্নত বক্ষ টানটান করে ফুলে উঠেছে। দুই ডানা মেলেছে দুটি বাহুর মতো। হলুদ শাড়িতে মোড়ানো পীতান্বত বক্ষের মতো দেখা যাচ্ছে তার বুক। উন্নত বক্ষের মেয়েদেরকে হলুদ শাড়িতে কেমন দেখায়? আমি হিমিকে নীল শাড়ি কিনে দিব। ছোট্ট মাছরাঙার মতো সে নীল শাড়ি পরে এবাড়ি ওবাড়ি ছুটোছুটি করবে। মন খুলে গান গাইবে। তাকে আমি নারীদেরকে চেপে ধরে রাখা মধ্যযুগীয় এই অন্ধকার সমাজ থেকে বের করে এনে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরব।
নারী অধিকারের স্লোগান তুলে আমরা আন্দোলন করি। অন্য ঘরের নারীকে বাইরে আনার সংগ্রম করি। নিজের ঘর সেই সৌদি আরব পাকিস্তানের মতোই সংকীর্ণ মানসিকতাপূর্ণ। লোকে এসব বলে খোঁটা দেয়। আমি নিজের ঘর থেকেই শুরু করে এই খোঁচার জবাবে একটা আদর্শ উপমা দাঁড় করাতে চাই। আমি জানি, হিমি পারবে। তার যে অঙ্গসৌষ্ঠব এই কচি বয়সেও উন্মাদের মতো ফুলে উঠছে, গানের রিনিঝিনি কণ্ঠ, সে পারবে সবাইকে তাক লাগিয়ে মাতাল করে তুলতে। তার যে অবয়ব, অঙ্গ কাঠামো, একট্রেস হতে পারলে রূপের ঝলকে মানুষ বেকারার না হয়ে পারবে না। হিমি স্কুল থেকে ফিরে এলে আমি তাকে আরেকবার পরখ করে দেখি। হিমি মুচকি হাসে। রহস্য করে বলে, ভাইয়া তুমি দিনদিন কেমনযেন হয়ে যাচ্ছ!

পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। সবাই খুশি। মার মুখে হাসি দেখলাম না। বাবাকেও একটু গোমরামুখো মনে হল। আমার হাতে সময় খুব কম। এক্ষুনি বের হতে হবে। আমার রেজাল্টে সাংস্কৃতিক ফোরামের বন্ধুরা সেলিব্রেশনের আয়োজন করেছে। নারী আন্দোলন, প্রগতি আন্দোলন ও মুক্তবুদ্ধি চর্চায় আমার মগজ থেকে উৎপাদিত প্রশ্নে এরা খুবই খুশি। রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই ওদের পক্ষ থেকে একটি এনজিও সংস্থায় ভালো সেলারিতে জবের অফারও এসেছে। আজকের পার্টিতে হয়ত আরো ভালো কোনো প্রস্তাব আসবে। আমি দ্রুত বের হয়ে গেলাম।

খুব ভালো মানের চাকরি হয়েছে আমার। আমাকে বলা হয়েছে, 'তুমি যা বিশ্বাস কর, তা-ই লালন কর। নিজের বিশ্বাসের ওপর আস্থাবান থেকে কাজ করে যাও।' আমি বুঝে ফেলেছি, আমাকে অনেক কাজ করতে হবে। অর্থ রোযগারের কৌশল এবং পদক্ষেপ আমার হাতের মুঠোয়। আমার চোখের তারায় ঝিলিক খেয়ে গেল হিমির সরল মুখখানি। যে করেই হোক, ওকে পপিউলার বানাবার সংকল্প করেছিলাম আমি। একদিন আমার কাছে দশ টাকা চেয়েছে, মনে পড়ে। আরেকদিন ফেরিঅলার কাছে সোনালি রঙের খাঁজকাটা একজোড়া চুড়ি কিনে দিতে বায়না ধরেছিল, আমি পারিনি। দুঃখ হয়েছে ভীষণ। এবার বেতন পেলেই আমি তার জন্য শুধু চুড়ি নয়, একজোড়া নাচের ঘুঙুরও নিব। মায়ের জন্য একজোড়া জামদানি শাড়ি কিনব। একটা হিন্দি মুভিতে নায়কের মা মহারাণীকে লাল পেড়ে সবুজ শাড়ি পরিহিত দেখেছিলাম। ওই শাড়িতে রাণীকে যেমন প্রতাপশালী দেখাচ্ছিল, মনে মনে আমি মায়ের চেহারা কল্পনা করেছিলাম। বাবার জন্য কিনব কোট টাই। মীরুর কথা মনে পড়ল। গত ডিসেম্বরে আমার বার্থডেতে ব্রান্ডের একটা দামি ঘড়ি গিফট করে হাতে পরিয়ে দিয়েছিল। তার জন্মদিনে আমি কিছু দিয়ে উইশ করতে পারিনি। ঠিক করেছি, চাকরি করে বেতন পেলে দামি কিছু গিফট করব। এমন কিছুই দেব, যেটার গোপন স্থানে লিখে দিতে পারব, "আমি তোমাকে ভালোবাসি মীরু"!
ভাবতে ভাবতে আমার উৎসাহ বেড়ে গেল। আমি অফিসের কম্পিউটার ব্যবহার করে টুইটে প্রশ্ন ছুঁড়লাম, "নবি মহম্মদ সত্যিকারের অবতার হলে ওহুদ যুদ্ধে তার দাঁত ভাঙ্গবে কেন?"
পরেরদিন থেকে খেয়াল করলাম, অফিসে আমার কদর আরেকটু বেড়ে গেছে। ওদিকে দেশজুড়ে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা আমার নিন্দায় মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল, আমি জনসাধারণের কাছে পরিচিতি পেয়ে যাচ্ছি। এদেরকে ফুঁসিয়ে তোলার জন্য আমি আবার টুইট করলাম, "নবি মহম্মদ যদি আল্লার অবতার এবং বন্ধু হয়, আমার কথায় আল্লা চুপ করে বসে আছে কেন? এই ধর্মান্ধ জঙ্গিরা কি তাদের আল্লার চেয়েও বেশি শক্তিশালী? নাকি এটাই প্রমাণ হল, আল্লা বলে কেউ নেই?"
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেশজুড়ে আমার তীব্র সমালোচনা শুরু হল। অফিসের বস হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমার টেবিলে এলেন। এটাসেটা বলে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, "নিজের মতামতকে সবকিছু থেকে শক্তিশালী মনে করবেন। এর বিপরীতে গোটা দুনিয়াও যদি আপনার বিরুদ্ধে যায়, ভড়কে যাবেন না। কাজ করতে থাকুন, কর্মই আপনাকে মহান করে তুলবে। ইউএসএ থেকে আমাদের এনজিও সংস্থার ডিরেক্টর অফিসে বাংলাদেশ থেকে আপনার ডিপার্টমেন্টের একজন জেনুইন চেয়েছে। আমরা চাই আপনি এপ্লিকেশন করুন।"
মাত্র সপ্তাহখানেক বাদেই আমার ফ্লাইট। প্রস্তুতির জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম। প্রথম মাসের বেতন তুলে নিয়েছি। মনে আমার আনন্দ ধরে না। এটা ওটা কিনে বাসায় গেলাম। হিমির জন্য একটা পিয়ানোও কিনেছি।
বাসায় গিয়ে দেখি বাবা নেই। কিছু না বলে কোথাও চলে গেছেন। মায়ের মুখ ব্যাজার। চোখ লাল। একটু আগে কেঁদেছেন, বোঝা যায়। হিমি বাগানে গুনগুনিয়ে গাইছে। আমার আস্কারা পেয়ে আরো ডাঙর হয়ে উঠেছে এতোদিনে। রবীন্দ্রনাথের ন্যাওটা ছিল তার ভাতিজি ইন্ধিরা, হিমি দিনদিন আমার ন্যাওটা হয়ে উঠছে। আমাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। আমি ডাকলাম, এই হিমি!
হিমি এল না। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে গান বন্ধ করে দিল। আমি আবার ডাক দিলাম, হিমি!
কানে দুইটা ফুল গুঁজে হিমি দৌড়ে এসেছে। বোনটির জন্য কেন একজোড়া কানের দুল আনলাম না, আফসোস হল। হিমি পিয়ানো নেড়েচেড়ে দেখছে। আমি ইউটিউবে একটা ভিডিও অন করে দেখালাম, পিয়ানো কীভাবে বাজায়। হিমি উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল, ভাইয়া, কাল শুক্রবার, আমাদের স্কুল ছুটি। তুমি আমাকে পিয়ানো বাজানো শেখাবে?
বোনটির জন্য আমার মায়া হল, তাকে বলতে পারছি না, কদিন বাদেই আমার ইউএসএর ফ্লাইট। আমি চলে গেলে হয়ত তার আর শিল্পী হয়ে ওঠা হবে না। যে মডার্ন হিসেবে তাকে আমি গড়ে তোলার সংকল্প করেছি, তার হয়ত কিছুই হবে না। বাবা পিটিয়ে হলেও তাকে ডাক্তার বানিয়ে ছাড়বেন। মৌলবিঘরের জঙ্গি মহিলাদের মতো হিজাব পরতে বাধ্য করবেন। আচ্ছা, আমার মা-ও তো হিজাব পরেন! মা কি জঙ্গি?
হিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তার বুক আর কোমরের নিচটা আরেকটু ফুলেছে। এখনই সময়- আমার পরিচিত ড্যান্স পার্টনারের এক মাস্টার আছে। ধরে ধরে মেয়েদেরকে নাচ শেখায়। আমার ধারণা, হিমিকে তার হাতে তুলে দিতে পারলে এই চোখ কোমর নিতম্ব আর বুকের উপর সগৌরবে ফুলে থাকা বক্ষঃস্থলগুলো খুব ভালোভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠবে।
হিমি এখনো পিয়ানো নেড়েচেড়ে দেখছে। অভাবের সংসারে এই বস্তু ছিল অকল্পনীয়। হিমির বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। আমি পকেট থেকে দুইটা দশ টাকার নোট বের করলাম। হিমি আমার কাছে দশ টাকা চেয়েছে, আমি বিশ টাকা দিব। তার বয়সে থাকতে স্যারকে দেখতে যাব বলে বাবার কাছ থেকে পাঁচ টাকা নিয়েছিলাম। সেই পাঁচ টাকা আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা মনে হয়েছিল।
হিমি!
জি!
তুই টাকা চেয়েছিলি, এই ধর!
দশ টাকার নোট দুইটা কেন! আমার একটা লাগবে।

হিমি দশ টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি মার রুমে গেলাম। হাতে বেতনের টাকা দিয়ে কেনা মিষ্টি দিয়ে খুশি কর‍তে চাইলাম। মা কিছু বললেন না। মসজিদে সন্ধ্যার আযান হচ্ছে, মা অযু করতে চলে গেছেন। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না-- ধর্ম মানুষকে এতোটা অন্ধ করে দেয় কেন? আমি যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করছি, এখানে তো কোন অন্ধত্ব নেই! আমরা মানুষকে ধর্মের কুসংস্কার থেকে বের হয়ে এসে পৃথিবী এবং বাস্তবতাকে চেনাচ্ছি। আমাদের মতটাই যে সঠিক, এটা বোঝাতে কত যুক্তি দিচ্ছি। তবু কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী গাঁটরি গাঁটরি যুক্তি প্রমাণ নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে টক্কর দেয়। তারা যে কুরআন হাদিসের উক্তি বলে প্রমাণ দেয়, সেই কুরআন হাদিসই তো আমরা বিশ্বাস করি না! ইউএসএতে বসে নিজের ঘরের সবাইকে বদলাতে না পারি, হিমিকে আমি নিজের মতো করে গড়ে তুলবই।
শুক্রবার ভোর থেকে হিমিকে অন্য রকম লাগছে। আরেকটু রূপসী হয়েছে মনে হয়। নাচের ড্রেস পিয়ানো ঘুঙুর পেয়ে তার চোখ আনন্দে চকচক করছে। আমি ওকে ড্রেস পরে নাচতে বললাম। হিমি লজ্জা পেয়ে বলল যাহ্! আমি ওকে কাছে টেনে গলায় একটা লকেট ঝুলিয়ে দিলাম। হিমি ফ্রকের ভেতর থেকে একটা ধবধবে শাদা টুপি বের করে আমার মাথায় মুকুটের মতো পরিয়ে দিয়ে বলল, যাও ভাইয়া, জুমার আযান হয়েছে, নামায পড়ে এসো। তোমার মতো চাকরি করে বেতন পেলে আমি মার জন্য একটা শাদা শাড়ি আর বাবার জন্য ধুতি পাঞ্জাবি কিনে আনব। ওগুলো পড়ে নামাযে দাঁড়ালে তাদেরকে একদম নিষ্পাপ দেখাবে।


গল্প : অবিশ্বাসী বিশ্বাস
ওমর আলী আশরাফ

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.