![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ওমর আলী আশরাফ
বাদশাহ শাহজাহানের নির্মিত দিল্লি জামে মসজিদের নকশার অনুকরণে নির্মিত মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদ। প্রযুক্তি ও উপকরণের দুর্লভ আমলের এসব স্থাপত্যশিল্প দেখে সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।
মুঘলসম্রাটগণ আমাদের অবিভক্ত ভারতবর্ষে ৩০০ বছরের বেশি সময় রাজত্ব করেন। এই দীর্ঘ সময়কালে সম্রাট এবং তাদের আমলারা ভারতবর্ষজুড়ে অসংখ্য ইমারত, মসজিদ, ব্রিজ নির্মাণ করেন। বিচিত্রসব কারুকার্যে স্থাপিত হত তাদের স্থাপত্য শিল্পগুলো। এই বজরা শাহী মসজিদও সেগুলোর একটি।
মুঘলসম্রাট মুহম্মদ শাহের আমলে দিল্লির বিখ্যাত জামে মসজিদের আদলে নির্মিত হয় বজরা শাহী মসজিদ। মুঘল জমিদার আমানুল্লাহ খান ১১৫৪ হিজরি, ১১৩৯ বঙ্গাব্দ, ১৭৪১ ঈসায়ি সালে— আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে সবুজের বুক ফুঁড়ে বিচিত্র কারুকার্যের এই মসজিদ নির্মাণ করেন।
জমিদার আমান উল্লাহ খানের বাড়ি ছিল এখানে। তিনি তার বাড়ির সামনে ৩০ একর জমিতে একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। চারপাশে তার উঁচু পাড়। পশ্চিম পাড় নির্বাচন করেন মসজিদ নির্মাণের জন্য। প্রায় ২০ ফুট গভীর থেকে তৈরি হয় মসজিদের ভীত। দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৬ ফুট, প্রস্থ ৭৪ ফুট, উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ১.২২ মিটার। তিনটি ঊর্ধ্বমুখী মর্মভেদী নীলিমাছোঁয়া গম্ভীর গম্বুজ। সুদৃশ্য মার্বেল পাথর দিয়ে সুশোভিত তাদের পিঠ। আলোয় ঝলমল করে সূর্যের রাগী তেজে, চাঁদের মায়াবী জোছনায়। তার দিগন্তবিভোর রহস্যভেদি আহ্বান আমাদের আলোড়িত করল। গম্বুজকে ঘিরে আছে আলোকদানির মতো কতগুলো ছোট ছোট মিনার। মসজিদের দেয়াল ও পিলারের মাথা ফুঁড়ে তারা তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।
মসজিদে প্রবেশের জন্য তিনটি দরজা। উপরটা গোল হয়ে বেঁকে আছে ধনুকের মতো। প্রবেশের পথে আছে কয়েকটি ছোট ছোট গম্বুজ। দূর থেকে চোখ পড়লেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কেবলা দেয়ালে তিনটি কারুকার্য খচিত মিহরাব। মসজিদের বাইরের চারকোণে আকাশের দিকে মাথা তুলে স্থির হয়ে আছে অষ্টভুজ আকৃতির চারটি সুদৃশ্য বুরুজ।
গোটা মসিজদেই নকশাচিত্রে সুরম্য অঙ্কনে উৎকীর্ণ হয়ে ফুটে আছে মুঘল আমলের শিল্প নিদর্শন, স্থাপনা কৌশল। দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে, পিলারের বদনজুড়ে, তোরণের উদর ফুঁড়ে ফুল ফুটে আছে দর্শকদের দিকে চেয়ে হেসে, লতারা এঁকে বেঁকে উঠে গেছে ওপরে। মসজিদের প্রতিটি অংশ অতি সূক্ষ্মভাবে অলংকৃত করা হয়েছে বিভিন্ন রঙের চিনামাটির পাত্রের টুকরা দ্বারা।
মসজিদের সামনে সুদৃশ্য তোরণ। দেয়ালে তার শতরকম কারুশিল্প— ফুল পাতা লতাপাতা, ছোট ছোট খোপ— কুমিরের খাঁজকাটা লেজের মতো খসখসে। তোরণের ওপর আরেকটি গম্বুজ। আকৃতিতে ক্ষুদ্র, গাম্ভীর্যে মহীয়ান। তাকে বেষ্টন করে আছে আলোকদানির মতো কতগুলো ছোট ছোট মিনার। তোরণে মিনারে সৌন্দর্যের সম্ভাষণ। তোরণ ও মসজিদ-ভবনের মধ্যবর্তী স্থানে দিল্লির জামে মসজিদের মতোই খোলা চাতাল। মসজিদের ভেতরে মুসল্লিদের জন্য স্থান সংকুলান হয় না। আগুনঝরা রোদে পুড়ে শত শত মুসল্লির সঙ্গে আমরাও এখানে দাঁড়িয়ে জুমুআর সালাতে শামিল হলাম। চাতালের পাশে আছে মহিলাদের জন্য সালাত আদায়ের ঘর।
জুমুআর খুতবা দিয়ে ইমামতি যিনি করলেন, তার নাম হাসান সিদ্দিকী। তার সপ্তম পূর্বপুরুষ, পবিত্র নগরী মক্কা শরিফের বাসিন্দা, সময়ের বিখ্যাত বুযুর্গ, মাওলানা শাহ আবু সিদ্দিকী এই মসজিদের প্রথম ইমাম ছিলেন। মোঘলসম্রাট মুহম্মদ শাহের বিশেষ অনুরোধে তিনি ইমামতির দায়িত্ব নিয়ে এখানে আসেন। এখন পর্যন্ত যোগ্যতা অনুসারে তার বংশধরেরাই এই মসজিদের ইমামতির মহান কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন।
মসজিদের বাউন্ডারি দেয়ালের গেইটের উপরের অংশে এবং মসজিদের ভিতরের দেয়ালে লাগানো বাংলা ও ফার্সি শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, নির্মাণের প্রায় ১৭৯ বছর পর ১৯১১ থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে বজরার জমিদার খান বাহাদুর আলী আহমদ ও মুজির উদ্দীন আহমদ মসজিদটি সংস্করণ করেন।
১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক এই মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষা এবং দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য তদের তদারকিতে নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এলাকাবাসী জানাল, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদ তাদের সংরক্ষণে নিলেও সরকারের পক্ষ থেকে মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের তেমন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যার কারণে ধীরে ধীরে মসজিদের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকালে গম্বুজ ছুঁইয়ে পানি ঢুকে মসজিদের ছাদ ভিজে থিকথিকে হয়ে যায়। ওজু ও গোসলের জন্য তৈরি বিরাট দীঘিটি ভরাট হয়ে বিলে পরিণত হচ্ছে।
দেশের এবং দেশের বাইরের নানান রহস্য সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যপ্রিয় মানুষ বজরা শাহী মসজিদে সালাত আদায় করতে এবং মোঘল স্থাপত্য নিদর্শন পর্যটনে আসে। আমাদের সমবয়সী একজন তরুণকে দেখে এগিয়ে গেলাম। নাম তার মাকসুদুর রহমান। মেডিকেলের ছাত্র। পাশের গ্রাম ওয়াসেকপুর থেকে এসেছেন তিনি। মাকসুদুর রহমানের কাছে অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি সময় ও সুযোগ পেলেই এখানে চলে আসি। এই মসজিদ মোঘল স্থাপত্য নিদর্শন হওয়ায় একই সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য দেখতে পারি এবং সালাত আদায় করতে পারি। মসজিদের অনন্য সৌন্দর্য আমাকে বারবার এখানে আসতে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে।
নোয়াখালীর মাইজদী শহর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি. উত্তরে সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরায় বিখ্যাত ও অনিন্দ্য সুন্দর এই মসজিদ। প্রধান সড়কের পশ্চিম দিকে তাকালেই দীঘির জলে মিনারার ছায়া— এপাশে জল, ওপাশে মসজিদ— তার পায়ের নিচে সারাক্ষণ দীঘির জলের রিনিঝিনি নূপুর বাজে।
--
ওমর আলী আশরাফ
email : [email protected]
©somewhere in net ltd.
১|
১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:১২
সনেট কবি বলেছেন: ভাল লিখেছেন।
আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।