নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

পি এম বাহার আহমেদ

পি এম বাহার আহমেদ

সব সৃষ্টি সাহিত্যের অনুগত। আমরা এবং আমাদের সমাজ ও চার পাশের কর্ম বা ঘটনা প্রভৃতি এবং শৈল্পিক ও বাস্তবতা, সব কিছুই সাহিত্যের আদলে গড়ে উঠে। যেহেতু সাহিত্য সুন্দর ও শৃংখলাবদ্ধের শিকলে বাঁধা, ফলে মানুষের কর্ম বা আচরণ, সমাজ ও সমাজের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা সুন্দর ও ছন্দময় করে তুলতে অবশ্যি সাহিত্যের প্রয়োজন আছে। একথা সত্য, সমাজ প্রত্যেক মানুষের জীবন ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সাহিত্য নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ ও সমাজের নানাবিদ কর্ম ব্যবস্থাপনা।যে সমাজে কর্ম পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা যত উন্নত, সে সমাজ ও মানুষের জীবন প্রবাহ ততো উন্নত। ফলে ব্যক্তি ও সমাজ ‍নিয়েই জীবন প্রবাহের স্বার্থকতা। আর এ স্বার্থকতার পেচনে রয়েছে সাহিত্য।

পি এম বাহার আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিদ্রোহী কবিতায় মহাবিশ্ব ও ইসলামী দর্শন

১৯ শে মে, ২০১৪ রাত ১১:৪০

বিদ্রোহী কবিতায় মহাবিশ্ব ও ইসলামী দর্শন

পি এম বাহার আহ্মেদ



�আমি চির- বিদ্রোহী বীর�



বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির- উন্নত শির!�



ব্যক্তি যখন বস্তু থেকে অধিক প্রিয় ও মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায় এবং যদি সেটি হয় পৃথিবী থেকে হাজারগুণ বৃহৎ কোনো নক্ষত্রের তুলনা, সে দিক থেকে মহাজাগতিক সৃষ্টির মধ্যে একজন মানুষ কতটা অবদান ও মূল্যায়নের অধিকারী হতে পারে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চর্চাবোধ থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। সৃষ্টির একটি নক্ষত্রের যে বৈশিষ্ট্যগুলো মানব জ্ঞানে দর্শনশিল্পের মহা-নিদর্শন অথবা যতটা স্পর্শকাতর উপলব্ধির যোগান দেয়- �বিদ্রোহী�র প্রকাশনা আধুনিক সাহিত্যে নজরুল সম্পর্ক আধুনিক বিশ্বসাহিত্যকে আত্মবিস্ময়ী করে তুলেছে। এই কবিতা এবং সৃষ্টির উপকরণ ও শিল্পায়ন কেন্দ্রিক নজরুল�চর্চা আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে একজন অন্যতম যুগ �্রষ্টার অধিকার দাবি করে। যার সৃষ্টি ও শিল্পমননে দূরদর্শিতা আগামী হাজার বছরের বিশ্বকে এবং মানব জাতিকে সাহিত্যে, ধর্ম ও সংস্কৃতিবোধে এবং ব্যক্তি চরিত্রায়নে বিশ্ব ছাড়িয়ে মহাজগত বিজয়ের প্রেরণা দেয়।



নজরুল সাহিত্য ভাবনা এবং সৃষ্টি ও মনে বিকাশ ও প্রকাশনা এ�সব কোনো একক জাতি, গোষ্ঠী, বা দেশ কেন্দ্রিক নয়। তাই তিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের কবি নয়, বিশ্ব ও মহাবিশ্ব চেতনায় শৈল্পিক মননের কবি। ঈশ্বরে অসম বিশ্বাসী ইসলামের কবি।



প্রত্যেক কবির ব্যক্তি জীবন ও মূল্যবোধের কাছে তার জীবন যাত্রা সীমাবদ্ধ। কোনো একটি দেশ, জাতি বা গোষ্ঠী কেন্দ্রিক চর্চা করেন- এমন কবিদের সংখ্যা বেশি। যিনি দেশ নিয়ে ভাবেন, তিনি দেশের কবি। বিশ্ব নিয়ে ভাবেন-বিশ্বকবি এবং পরাবিশ্বকে নিয়ে ভাবেন তিনি পরাবিশ্বের কবি। এই সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষতঃ একজনই। তিনি নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবিতা নজরুলকে শুধু বিশ্ব নয়, পরাবিশ্বকেন্দ্রিক শিল্প ও মননের অধিকারী করে তুলেছে। বিজ্ঞান ও চর্চাকে বিশ্ব চেতনা ও সাহিত্যের আদলে প্রায়োগিক অর্থে- অর্থের যে প্রাঞ্জলতা পরিচয় দিয়েছে, যা দেশ, জাতি এবং বিশ্ব ছাড়িয়ে কবিত্বের উপলব্ধিবোধ ও চেতনা মহাবিশ্ব বা মহাজাগতিক অদৃশ্য ও রহস্যকে দৃশ্যমান করার চেষ্টারই শামিল। একটি কবিতায় নজরুল বলেন,



�আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু



এই �্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!�



(ধূমকেতু)



শুধু বাংলা বা বিশ্ব সাহিত্যে নয়, মহাজগত ও মহাকালের সৃষ্টির সামনে কবি মানুষ জাতিকে, শিরকে সমুন্নত রাখতে চেয়েছেন। মহাজাগতিক সকল সৃষ্টির নজরুল এত গভীর চিন্তা ও চর্চার উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন, যেখানে আবেগ অনুভূতির ও আক্ষেপের প্রকাশ দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। কবিতার রূপক অর্থে সব সৃষ্টিকে তাঁর দৃষ্টি ও দর্শনমননে দেখেছিলেন।



�আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি।�



(ধূমকেতু)



নজরুল সৃষ্টির গভীরে না গেলে তার কবিতায় মহাজগত ও সৃষ্টির ভাবনাকে মূল্যায়ন করা সাধারণ পাঠকের দ্বারা সম্ভব হবে না। যেখানে কবি চর্চায় মহাজাগতিক ভাবনা হাজার বছর পরও বিশ্ব সাহিত্যে অদৃশ্য ও রহস্য থেকে যাবে। তবু সব রহস্যকে উদ্ঘাটনের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।



সকল সৃষ্টি মানুষের জন্য। জগৎ-মহাজগৎ এবং তার অনুপম সৌন্দর্য্য মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ�কথা অস্বীকার করার কায়দা মানুষ জাতির নেই।



�আসমান ও জমিন সৃষ্টির মধ্যে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে-� (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-১৯০)



সৃষ্টি যদি মানুষের কল্যাণে হয়, চর্চা ও উপলব্ধি কেন হবে না? যেখানে অদৃশ্য ও বিচিত্র রহস্যের সমান্তরালে হাজারো বিশ্ব দোদুল্যমান। মানব সভ্যতা থেকে যদি কোনো স্যাটেলাইট বা মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা হয়, সেখানে প্রথম লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, মহাবিশ্বকে জানা ও চেনা এবং সৃষ্টির অদৃশ্য রহস্যকে দৃশ্যমান করা। এই রহস্যকে জানা ও চেনার তাগিদ যদি মানুষের কল্যাণে আসে তাহলে নজরুল সাহিত্যে মহাবিশ্বকে কিভাবে অস্বীকার করি?



�বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির�এই উক্তি থেকে আজকে উন্নত বিশ্বের মহাবিশ্ব জয়ের বা চাঁদ ও মঙ্গলে মানব সভ্যতার জ্ঞানের পতাকা উত্তোলনের অগ্রিম সংকেত লুকানো রয়েছে। আবার মহাশূন্য পেরিয়ে মহা-মানব মহাম্মদ (স.)-এর বিস্ময়ী অভিযাত্রার ইতিহাসও এখানে লুকিয়ে আছে।



�তাজি র্বোরাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার



হিম্মত-হরেষা হেঁকে চল!�



র্বোরাক্ শব্দটি আরবি অভিধান থেকে নেয়া হয়েছে। শব্দটি ধর্ম ও ইসলাম, মানব ও সভ্যতা, মহাবিশ্বের দৃশ্য-অদৃশ্যকে জানা-চেনা এবং প্রামাণিক ধারণা অর্জনে পথিকৃৎ।



দেড় হাজার বছর পূর্বে মহাজাগতিক সকল সৃষ্টিকে পদতলে ফেলে মানব সভ্যতার বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা ও সাধনার স্রষ্টা� মুখোমুখি সাক্ষাৎ লাভ করেন-মানব মুক্তির দূত মহাম্মদ। �্রষ্টার সাক্ষাতে অভিযাত্রী তার ঊর্ধ্ব-গগণ পাড়ি দেয়ার বাহন ছিলো র্বোরাক। র্বোরাক সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইলে বিদ্রোহী কবিতার আরো গভীরে যেতে হবে।



কেননা, বিদ্রোহী কবিতাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে কিছু ভুল বুঝাবুঝি রয়েছে। তার জন্য প্রধান কারণ যে পংক্তিগুলো,



� বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি�



চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি�



ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া



খোদার আসন �আরশ� ছেদিয়া,



উঠিয়াছি চির- বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!�



এ ধরনের বক্তব্যকেন্দ্রিক বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশনার তদানীন্তন সময়ে মুসলিম সমাজে বিতর্কের শীর্ষে উঠেন। অনেকের ধারণা আরশ ও ছেদিয়া দু�টি শব্দের সমন্বয়ক অর্থে মহান �্রষ্টা আল্লাহকে ছোট করা হয়েছে। এবং কবি নিজে �্রষ্টার ঊর্ধ্বে প্রকাশ দিয়েছেন।



বিদ্রোহী কবিতার কবি একজন, কিন্তু বক্তব্যের বক্তা একাধিক। কোথাও কোথাও কবি স্বয়ং নিজে বক্তার আসনে ছিলেন। কবি যে নিজে বক্তা তার দলিল কবিতায় উল্লেখ রয়েছে-



�আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের�



এখানে বঞ্চিত পথবাসী এবং (সকল অর্থে) গৃহহারা পথিকের পক্ষে বক্তব্য প্রকাশ দিয়েছে। অন্য বক্তা অনুল্লেখিত। যেমন-



�বল বীর�



বল উন্নত মম শির!�



কবিতার এ অংশে বক্তা স্বয়ং কবিকে নির্দেশ দিচ্ছেন কিছু বলার জন্য। কবিতার প্রথম বক্তা ও প্রথম দুটি চরণ রেফারেন্স অথবা কবির বক্তব্যকে শাণিত করার অর্থে একাধিক স্থানে ব্যবহার করা হয়েছে।



একজন মহা-মনীষী, দার্শনিক এবং বিশ্ব শান্তির দূত মহাম্মদ (স.) চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র, মহাবিশ্ব এবং মহাকাশ পাড়ি দিয়ে স্বয়ং তার �্রষ্টার সন্নিকটে সাক্ষাতে উপনীত হন। নজরুল কাব্যে �আরশ-ছেদিয়া� বলতে �আরশে মুয়াল্লা�য় উঠে �্রষ্টার এত কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন যেখানে আল্লাহ ও মোহাম্মদ-এর মধ্যে একটি নূরের পর্দা ব্যতীত কোনো দূরত্ব ছিল না। ইতিহাসে এই বিস্ময়কর ঘটনা মহাম্মদ (স.) নিজে তার অনুসারী বা সাহাবীদের কাছে এভাবেই ব্যক্ত করেন, ...উঠিয়াছি চির- বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!� বিদ্রোহী কবিতার সৃষ্টি ও শিল্পের গভীরে গেলে �্রষ্টার একত্ববাদ ও ধর্মীয় অনুভুতির অনেক যুক্তি খুঁজে পাই।



এ�মহাবিশ্বের তুলনায় পৃথিবী একটা শস্য কণা পর্যন্ত নয়। তবু প্রত্যহ পৃথিবী কেন্দ্রিক অসংখ্য ঘটনা ঘটে- যা সভ্যতার অন্তরালে মানুষ ও প্রাকৃতিক বিষয় বস্তুকে প্রভাবিত করছে। এ ধরনের সব ঘটনা মানুষের কর্মকাণ্ডের পরিণতি হয়ে দাঁড়ায়। কবি বলেন,



�মহা� প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস�



অথবা�



�আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,



আমি অবসান, নিশাবসান!�



মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হয় এবং মানুষ ধ্বংসের কারণ হয়। যে লোকালয় মানুষের অবস্থান ও জীবন যাত্রার গতি নির্দেশ করে, একদা সে লোকালয় ধ্বংসে পরিণত হয়। এবং সেটা আমি অর্থে মানুষের দ্বারা হয়। প্রাকৃতিক বস্তু বা প্রকৃতির আগ্রাসন শুধু নিয়তি নয়, মানুষের কর্মকাণ্ড প্রকৃতিকে আগ্রাসী হতে সাহায্য করে। বিশ্ব পরিবেশে অনাসৃষ্টির কারণে, সাইক্লোন-সিডর, নদী ও সমুদ্রে অস্বাভাবিক উত্তাল-তরঙ্গ এবং বন্যায় বয়ে আনা ধ্বংস, পরিবেশকে অবহেলার কারণে ঘটে থাকে। অগ্নি-অনলের ছড়িয়ে পড়া লেলিহান শিখা মানুষ জ্বালিয়ে-জ্বালাও পোড়াও অবস্থার সৃষ্টি করে। সেখানে কবি সত্য কথা বলেছেন,



�আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।�



অথবা



� আমি বসুধা-বক্ষে অগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানাল�



আগুনের উৎপাদক মানুষ এবং নিবারকও। তার জন্য প্রকৃতি বা �্রষ্টাকে দায়ী করা যাবে না। কবিতার পুরো অংশে সৃষ্টি-অনাসৃষ্টি, নির্যাতন-নিপীড়ন, মানুষ-মানুষের কর্ম ও জীবন, দৃশ্য-অদৃশ্য, দেশ-জাতি, বিশ্ব-মহাবিশ্ব সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। সেখানে আলোচক কবি নিজে। বিদ্রোহী কবিতায় প্রত্যেক চরণ একেকটি ঘটনা বা প্রেক্ষাপট হয়ে উঠেছে।



পৃথিবীতে সকল মানুষ নিষ্পাপ এবং সুখ ও সমৃদ্ধির সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে জন্মায়। তাহলে মানুষ কেন দুঃখী হয়! কেন ব্যথায় ব্যথিত হয়! এর উত্তর বিদ্রোহী কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে। তাই মানুষের প্রতি মানুষের নির্যাতন-নিপীড়ন, খুন-জখম এ�রূপ বেসামাল কর্মতৎপরতা দেখে কবি শুধু প্রতিবাদী হয়ে উঠেননি- কখনো বিচলিতও হয়েছেন। এক্ষেত্রে তার জীবন ও সাহিত্য ছিল প্রতিবাদমুখর। যেখানে প্রতিবাদ ক্ষমতা ছিল না, সেখানে কবি তীব্র আক্ষেপের বাণী করেছেন। অন্য একটি কবিতায় কবি বলেন,



�ওদের কল্লা দেখে আল্লা ডরায়, হল্লা শুধু হল্লা।�



অথবা



এক মুর্গির জোর গায়ে নেই, ধরতে আসেন তুর্কি তাজী,�



(কামাল পাশা)



বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম�ইসলামের কবি। সাম্য ও মৈত্রীর কবি। পৃথিবীর সব মানুষকে তিনি কবিতায় মৈত্রীর একক সম্মেলনে জড়ো করার চেষ্টা করেছেন। সব ধর্মে-বর্ণে মানুষদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে অসুরপনাদের হাত থেকে বিশ্ব, মাটি ও মানুষদের রক্ষার তাগিদে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি এক দৃষ্টিতে সকল ধর্ম ও ধর্মানুভূতিকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন, আবার ইসলামের বিপ্লবী সৈনিক হয়ে �্রষ্টা ও একত্ববাদে পরম বিশ্বাসী ছিলেন। তাই �্রষ্টার একত্ববাদকে এ�ভাবে- কবিতায় প্রকাশ দেন,



�আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।



আমি মানব দানব দেবতার ভয়,



বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,



জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য�



জগদীশ্বর ঈশ্বর বা সৃষ্টি কুলের মহান �্রষ্টা মখলুকাতের সকল সৃষ্টির মধ্যে পুরুষকে সর্বোচ্চ সম্মান, জ্ঞান ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছেন। কবিতায় �্রষ্টা সেই পুরুষ থেকে উত্তম বলে নিজকে প্রকাশ দিয়েছেন। সেই আল্লাহ অমর ও অক্ষয়। তার মৃত্যু নেই এবং ক্ষয়ও নেই। তিনি মহাশক্তিমান। যে কারণে দুনিয়ার সকল মানব-দানব অথবা যাকে মানুষ দেবতা ভাবে, সেই দেবতার অন্তরের ভয় একমাত্র আল্লাহ। সেই ঈশ্বরকে জয় করা খুব সহজ কথা নয়। জয় করতে হলে অবশ্যই তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বিশ্বের সব কিছু সহজে সম্ভব হলেও �্রষ্টাকে জয় করা খুব সহজ নয়। বিদ্রোহী নজরুলের কাব্যের আঁধারে পরতে পরতে ��্রষ্টা সত্য� লুকিয়ে আছে। কিন্তু কবিতায় বক্তা, বক্তব্য ও বক্তব্যের উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে না পেরে �বিদ্রোহী� কবিতার মত তার অনেক কবিতায় আমরা �্রষ্টা ও একত্ববাদের পরিচয় খুঁজে পাইনা। এ�টি নিশ্চয় কবির নয়, পাঠক ও বিশ্লেষক্দের অজ্ঞতা দায়ী। কবিতায় বলা হয়েছে,



�আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস



আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ�



কবি আবার বলেন,



�আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,



আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি



আমি উন্মন মন উদাসীর�



কবিতায় এই দু�টি অংশে আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমতঃ বেদুঈন এবং তার ব্যক্তি সত্তায় বিশ্বাস প্রবণতা এবং দ্বিতীয়তঃ নারী এবং তার প্রেম-অনুভূতি। কিন্তু এই কথাগুলো কবির নিজস্ব নয়। আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষের জীবন-কর্ম ও বিশ্বাসকে তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। এ�ধরনের বৈশিষ্ট্য কেন্দ্রিক রচনা হয়েছে বিদ্রোহী কবিতা।



নজরুল সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু বলার আগে তার কবিতাকে ভালো করে বুঝতে হবে। আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থে শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ ও তার উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে হবে। না জেনে বুঝে কারো সম্পর্কে মন্তব্য করা যেমন ঠিক না, তেমনি ব্যক্তি বা সৃষ্টির আগ্ফের না জেনে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা বাহুল্য। নজরুল কাব্যে এখনো অসংখ্য গোপনীয়তা রয়েছে, যা সঠিক চর্চার মাধ্যমে দৃশ্যমান করা সম্ভব।



আমরা নজরুল কাব্য সামগ্রীর সমাবেশে অনেকাংশে কবি-ভাষণকে নির্ণয় করতে ব্যর্থ হই। যে কারণে অন্যের ভাষণকে স্বয়ং কবির নিজস্ব ভেবে নজরুল ইসলাম এবং কবিতায় তার ধর্ম-বিশ্বাসকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে থাকি। এ ধরনের ভুল থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি উদাহরণ রি�ফার যায়, কবিতায় বলা হয়,







�ঐ বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত,



মম অগ্নি-দাহনে জ্বলে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ!



আমি জানি জানি ঐ �্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,



তাই বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি!�



(ধূমকেতু)



এখানে কবি একজন �্রষ্টাবিমুখ ও একত্মবাদে অবিশ্বাসী ব্যক্তির ধ্যান-ধারণা এবং উপলব্ধিকে উল্লেখ করেছেন। কবি নিজে নয়, বরং এমন এক ব্যক্তিকে কবিতায় বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দেন, যিনি জীবনের পরতে পরতে নির্যাতিত- নিপীড়িত এবং ব্যথার দাহনে প্রজ্জ্বলিত হয়েছেন। এ�ভাবে জীবনের সবকিছু যখন ব্যর্থ- তখন �্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকূলকে অস্বীকার করতে শুরু করেন। �্রষ্টা ও ধর্মের বিধি-নিষেধ অমান্য করে অহেতুক মন্তব্য করেন। এই বক্তা ও বক্তব্যের জন্য কবি দায়ী নন। বরং �্রষ্টায় অবিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের ধ্যান-ধারণা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো কবিতায় স্থান পেয়েছে।



বিদ্রোহী-তে �্রষ্টাপোলব্ধির ব্যাপক নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু পাঠক সমাজে কোনো অজানা কারণে সেসব শনাক্ত করা যেন দুরূহ হয়ে পড়েছে। তাই নজরুল ও বিদ্রোহী-তে ভুল ব্যাখ্যার প্রচলন হয়ে আসছে। আশ্চর্য কথা হচ্ছে, এই কবিতায় ধর্ম-তত্ত্ব ও ইসলাম সম্পর্কে সন্দিহান সাধারণ পাঠক; এমনকি খোদ্ নজরুল ইন্সটিটিউট্। প্রমাণ হচ্ছে, �অগ্নি-বীণা� কাব্যগ্রন্থ। নজরুল ইন্সটিটিউট্ থেকে প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি-২০০৭ �চতুর্থ মুদ্রণ� এর-বইটিতে �দ্বিতীয় মুদ্রকের প্রসঙ্গ কথা� শিরোনামে ভূমিকা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, �বিদ্রোহী� ব্যতিরেকে অগ্নি-বাণী�য় ইসলামের অতীতে বা সমকালীন ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ব্যবহার করা হয়েছে �শাত-ইল-আরব�, �কামাল পাশা�, �খেয়াপারের তরুণী�, �কোরবানী�, �মর্হরম�, প্রভৃতি কবিতায়�। এখানে �বিদ্রোহী ব্যতিরেকে� বলতে বুঝানো হয়েছে যে উল্লেখিত কবিতাগুলো-য় ইস্লামের ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকলেও বিদ্রোহী-তে নেই। খোদ্ নজরুল ইন্সটিটিউট্ থেকে এ�ধরণের বক্তব্য অনাশা-হতাশা ও বাক্রুদ্ধকর বটে। কেননা, বিদ্রোহী কবিতা শুরু হয় ইস্লামের ইতিহাসে �মিরাজ্� তথা মহাম্মদের স. �্রষ্টা-সাক্ষাতের ঘটনা কেন্দ্রিক এবং শেষ করা হয়েছে



একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দিয়ে।



�আমি চির- বিদ্রোহী বীর�



বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!�



মেহাম্মদ (স.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর মূর্তিপূজক, একত্ববাদে অবিশ্বাসী, সকল অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে, প্রতিরোধে বিদ্রোহ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বর্গীয় বাণী প্রচার করেছেন। সে কথাও এখানে আলোচনায় এসেছে।



ব্যক্তি জীবন ও সাহিত্য চর্চা এক কথা নয়। আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে দু�টিই প্রবাহমান। তবে চর্চার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও ব্যক্তি ও জীবন যাত্রার প্রভাব সাহিত্যকে প্রভাবিত করতে পারে। নজরুল জীবনাদর্শে যতটা প্রতিবাদী ছিলেন, সাহিত্যে তার আকাশ ছাড়িয়ে গেছেন। নিশ্চয় এই বিদ্রোহী মনস্ক শিল্পের সূচনাতে জীবন ও জীবন যাত্রার আকস্মিক প্রভাব উঠে এসেছে। কবি প্রমাণ করেছেন, শুধু মানবের জীবন মানে� যুদ্ধ নয়, শিল্প সাহিত্যও যুদ্ধ। যদি সেটা আমরা বুঝতে পারি...।



লেখক : কবি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.