নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আসহাবে কাহাফ

কবি হাইড্রা

কবি হাইড্রা › বিস্তারিত পোস্টঃ

৭১ এর রত্না দিদি

১৪ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১২


' আমি রত্না দিদিকে নিয়ে যাচ্ছি।'
সবাই আমার এই কথাটা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।কেন তাকিয়ে আছে তার জন্য আপনাদের নিয়ে যাব ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে। রত্না দিদি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেওয়া ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালি আলাদা জাতি সত্তার নেশায় আন্দোলনকে বেগবান করতে থাকে ।অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্টী ইয়াহিয়া ও ভুট্রো খান একের পর এক বাঙ্গালি সত্তা বিলুপ্তি করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিদের জীবনে নেমে আসে কালো রাত। সেই দি রা্তের আধারে ইয়াহিয়া ও ভুট্রো খানের নির্দেশে পাকিস্তানির হানাদার বাহিনী বাঙ্গালি কে মেধা শূন্য করার নিমিত্তে বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় মেতে উঠেন। সেই বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় ছিলেন রত্না দিদির বাবা নিলয় সেন ওবং মা অরুনিমা সেন। নিলয় সেন তখনকার নাম করা একটি দৈনিক পত্রের সিনিয়র সাংবাদিক ছিলেন। তার হাতের লিখনী হয়ে সেইসময় পত্রিকায় উঠে আসত পূ্ব বাংলার নির্যাতিত সাধারন মানুষের বিভিন্ন ন্যায দাবি দাওয়া । অন্যদিকে রত্না দিদির মা অরুনিমা সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। যার কারনে পাকিস্তানিদের হত্যার তালিকায় তাদেরও নাম ছিল।যথারীতি সেই রাতে হানাদার বাহিনী রত্না দিদির বাসায় এসে বাবা মাকে হত্যা করে। শুধু তাই নই সেদিন পাকিস্তানি পশুরা কুমারী রত্না দিদিকে ধর্ষন করে বাইরে থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে যায়।
পরের দিন ২৬ শে মার্চ সকাল হওয়ার আগেই সারা দেশে বুদ্ধিজীবীদে্র হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘটনা অন্যদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনা । সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের সামনে ছাত্ররা সবাই ভিড় করা শুরু করে। উদ্দেশ্য স্বাধীনতার র্যালি বের করা কিন্তু রত্না দিদির আসতে দেরি হচ্ছিল। তাই হাবিব ভাই রত্নাদের বাসায় চলে যায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে হাবিব ভাই রত্না দিদিদের কাটাবনের বাসায় পৌছায়। বাসার সামনে পৌছে দেখতে পায় দরজা বাইরে থেকে আটকানো অথচ কোন তালা দেওয়া নেই। হাবিব ভাই দ্রুত দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। সামনে দিকে এগুতেই মেঝেতে রত্নার বাবা মায়ের রক্তার্ত লাশ দেখে সে চমকে যায়। রত্না দিদির সহ পাঠী হওায়ার কারনে এর আগেও হাবিব ভাই বহুবার এই বাড়িতে এসেছে তাই ঘটনা বুঝতে দেরি হল না। নিশ্চয় হানাদার বাহিনী গতরাতে এই বাড়িতেও হামলা করেছে।আর দেরি না করে হাবিব ভাই দ্রুত সোজা সিড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে যায়। সেখানেও রত্না দিদির কক্ষের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। দরজা খুলে হাবিব ভিতরে প্রবেশ করতেই ধর্ষিত রত্নার চিৎকার- ' না হাবিব না, তুমি চলে যাও। ওরা আমার সব শেষ করে দিয়েছে,তুমি আমার দিকে আর এক কদমও এগিয়ে আসবে না।' হাবিব রত্নার কোন কথা না শুনে তার দিকে এগিয়ে যায়। রত্নার দিকে আরেকটু এগিয়ে যেতেই বসা থেকে উঠে দৌড়ে পালিয়ে আত্নহত্যা করতে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু রত্নার শরীর এতটাই দুর্বল ছিল যে, দরজার সামনে যেতেই আবারও সে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। হাবিব এই মুহুরত্বে কি করবে ভেবে উঠতে পারে না। রত্না যে ধর্ষন হয়েছে একথা কাউকে বলা যাবে না, রত্না এতে করে সবার কাছে নিজেকে ছোট মনে করবে অন্যদিকে এখন রত্নার যা অবস্থা দূরে কোথাও নিয়ে তার চিকিৎসা করানোটাও সম্ভব না, তাই অনেক্ষন চিন্তা ভাবনা করার পর খুজে বের করল মারুফের কথা। মারুফ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। হাবিব আর মারুফ একই মেসে থাকে, তাই আর দেরি না করে মারুফ কে খুজে বের করে রত্নার বিষটা খুলে বলে। তারপর দুজনে মিলে সিদ্বার্ন্ত নিল যে, রত্না কে তাদের মেসে নিয়ে চিকিৎসা করাবে। অতঃপর তাই করা হল।
মারুফের দেওয়া প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে প্রায় রাত দশটার সময় রত্নার জ্ঞান ফিরে আসে। রত্না চোখ মেলে তাকাল, হাবিব আর মারুফ তার বিছানার পাশে বসে আছে। আচমকা শুয়া থেকে উঠে রত্না হাবিব কে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করে। হাবিব বুঝতে পারে রত্না তার মা-বাবা ও সম্ভ্রম হারানোর কথা মনে করে এমন করছে। তাই সে রত্না কে অভয় দিয়ে বলে-
তোর কিছু হয়নি পাগলি, দেখ- আমি আর মারুফ মিলে তোর চিকিৎসা করেছি। আর আমরাতো তোর বন্ধুই। তুই আর কান্না করিস না।
আমি তো জানি, আমি তোদের বন্ধু, আমি এটাও জানি এখন আমি একজন ধর্ষিতা। যার কোন সামাজিক মর্যাদা থাকে না, তোরা আমাকে কেন বাচালি? এই সমাজে ধর্ষিতার কে আছে। কে এই ধর্ষিতাকে নিয়ে ঘর করবে?
আমি ই করব! হ্যা, আমি তোকে ভালবাসি। তাই আমি জেনে শুনে ধর্ষিতা রত্নাকে বিয়ে করব।
কথাটা হাবিবের মুখ থেকে বের হওয়ার পর তিনজনই কিছুটা নিস্তব্ধ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে সম্পুর্ন কক্ষে নিরবতা নেমে আসে। বেশ কিছুক্ষন পর মারুফ নিরাবতা ভেঙ্গে দিয়ে বলল-
' শুন রত্না, আমি আর হাবিব ঠিক করেছি তোরা কিছুদিনের জন্য গ্রামে চলে যাবি। তোরা মানে তুই আর হাবিব। আর সেখানে তুই একজন মুসলিম মেয়ে হিসেবে হাবিবদের বাসায় থাকবি। কারন, হাবিবদের পরিবার পুরোটাই ধার্মিক এবং ইসলামিক মনা। সুতারাং তারা যেন কেউ জানতে না পারে যে হাবিব একটা হিন্দু মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে গেছে। আর যদি দেশের অবস্থা ভাল হয় তবে দুইজনই ঢাকা চলে আসবি।'
তারপর দিন ২৭ শে মার্চ রত্না আর হাবিব দুজনেই গ্রামের বাড়ি চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। হাবিব কিছুটা অনুমান করে , রত্না এখনও কিছুটা ভয় পাচ্ছে। সে রত্নাকে স্বাভাবিক করার জন্য প্রশ্ন করে-' আচ্ছা রত্না, তোকে মুসলিম কোন নামটা ধরে ডাকব?' রত্নার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, সোজা বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তখন হাবিব আবারও প্রশ্ন করল-
কি হল রত্না?কিছু বলছিস না যে।
কি বলব, আমার তো কপাল পুড়েছে। তুই আমাকে পোড়া কপালী ডাকলেই হবে।
বাহ! বেশ ধারুন তো, আমি তোকে কুসুম বলে ডাকব।
হাবিবের মুখে কথাটা শুনেও রত্না কোন পালটা জবাব দেয় না। রত্নার মনে একটাই প্রশ্ন বার বার ঘুর পাক খাচ্ছে। হাবিব তার অনেক দিনের পরিচিত পুরোনো বন্ধু অথচ তার মুখে কোনদিন এমন কিছুইতো শুনিনি যে সে আমাকে ভালবাসে কিংবা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তাহলে আজ কেন? আজ কি আমার দুরাবস্থা দেখে সে আমাকে করুনা করছে? একটু পরেই রত্না হাবিবের কাছে জানতে চাইল-
আচ্চা হাবিব, তোদের বাড়িতে আমার কথা কি বলবি তুই?
সেটা আমি ঠিক করে রেখছি! তুই বরং মুসলিম মেয়ের অভিনয়টা ভাল করে করিস। না হয় আমার রক্ষা নেই।
হাবিবের কথা শুনে রত্না আর কোন প্রশ্ন করে না। বাড়িতে পৌছানোর পর হাবিব সবার সাথে কুসুমের পরিচয় করিয়ে দেয়। এখানে রত্নাকে সবাই কুসুম হিসেবেই জানে এবং এটাও জানে যে কুসুমের বাবা মাকে ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে। দেশের অবস্থা ভাল না তাই এই মুহুরত্বে সহপাঠী কুসুম কে হাবিব তাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। এখানেই রত্না দিদির সাথে আমার পরিচয়। রত্না দিদি কুসুম হিসেবে হাবিবদের বাড়িতে থাকলেও হাবিব ভাই প্রতিদিন তাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসত।কারন, আমাদের বাড়িতে একটি তুলসী গাছ একটি পান ক্ষেত ছিল। তবে পান ক্ষেতের মাচার উপর দিয়ে দুই বাড়ির লোকজন সবাই সবাকে দেখতে পেত। আমি তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। একদিন খেয়াল করলাম আমাদের তুলসী গাছের সামনে একটা আস্ত ইট খাড়া করে মাটিতে পুতে দিল কুসুম আপু। এরপর তিনি তুলসী গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দুদের মত পূজা করছেন। এছাড়াও আপু মাঝে মাঝেই তুলসী গাছটার গোড়ায় পানি ঢালতেন। হাবিব ভাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেও কোন দিন কুসুম আপুকে এই কাজে সাহায্য করতেন না। একদিন আপু তুলসী গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পূজা করছিলেন। এমন সময় আমি গিয়ে তার পিছনে হাজির হই। আমি কুসুম আপুর কাছে দাড়িয়েছি দেখে, হাবিব ভাইও আমাদের কাছাকাছি চলে আসে। আপু বেশ মনযোগি হয়ে সুন্দর করে মন্ত্র পাঠ করছিলেন। আমি বুঝতে পারলাম এটা হিন্দুদের মন্ত্র। আপুর প্রার্থনা শেষ হলেই আমার দিকে তাকায়। আমি তখনি প্রশ্ন করলাম,
আপু, আপনি কি হিন্দু?
হ্যা, আমি হিন্দু।
কুসুম আপু এই কথাটা বলার সাথে সাথেই আমার পিছন থেকে হাবিব ভাই জোর গলায় ধমক দিয়ে বলে,-
এই গুলো কি বলছ তুমি? তোমার কি মাথা ঠিক আছে কুসুম?
হ্যা, আমার মাথা ঠিক আছে। আমি এই মাত্র প্রার্থনা শেষ করলাম, সুতারাং ইশ্বর তুল্য শিশুর সাথে আমি মিথ্যা বলতে পারব না। তাছাড়াও আমি এটা চাই যে, এই গ্রামে অন্তত একজন আমার সঠিক ইতিহাস টা জানুক।
আপুর কথা শুনে হাবিব ভাই কিছুটা শান্ত হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, আপু আর হাবিব ভাই একে অপরকে অনেক ভালবাসে। আমি আবারও আপুর কাছে জানতে চাইলাম,-
আপু, আপনি যদি হিন্দু হউন; আপনার নামটা কি?
আমার নাম রত্না দেবী সেন, তোমার নাম কি?
আমার নাম বাবুল সর্দার, আপু আমি তাহলে তোমাকে রত্না দিদি বলে ডাকব।
হ্যা,ঠিক আছে। তবে আমিও তোমাকেও বাবু বলে ডাকব।
সেদিনেই রত্না দিদি তাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো আমাকে বলে। এরপর থেকে দিদি যখনই আমা্দের বাড়িতে আসতেন সবসময় আমার সাথে কথা বলতেন।কথাবার্তায় দিদির সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল অত্যধিক। তাই খুব অল্প সময়ে হাবিব ভাইদের বাড়ির সবার মন জয় করে নেয়। দেখতে দেখতে প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেল। দেশটা যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই হাবিব ভাইয়ের মা-বাবা ও বাড়ির বড়রা ঠিক করেছে কুসুম আপুর সাথে হাবিব ভাইয়ের বিয়ে দিবে। দেশের যা অবস্থা কোনভাবেই ঘরে অবিবাহিত যুবতি মেয়ে রাখা যাবে না। বিয়ের কথা শুরু হলেই হাবিব ভাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়, সে এখন কি করবে? একদিকে বাবা মা জানে না কুসুম হিন্দু অন্যদিকে কুসুম কি আদৌ হাবিব ভাইকে বিয়ে করবে? এক সকালে হাবিব ভাই খুব ভোরে আমাদের বাড়িতে আসে। আমি যে রত্না দিদির সবচেয়ে প্রিয় হয়েগেছি সেটা ভাইয়া বুঝত। হাবিব ভাই আমার কাছে আসার কারন ছিল রত্না দিদির সাথে তার বিয়ে। যাইহোক, আমার কাজ পড়ল রত্না দিদির এই বিয়েতে কোন আপত্তি আছে কিনা জানা। আমি সেদিনই রত্না দিদির কাছে জানতে চাইলাম। রত্না দিদি আমাকে সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল,-
তুই কি বলিস? আমি কি তোর হাবিব ভাইকে বিয়ে করব?
হ্যা, আমি চাই তুমি হাবিব ভাইকে বিয়ে কর।
আমার কথা শুনে দিদি সেদিন খুব হেসেছিল। আমি রত্না দিদির এমন হাসি ইতিপূর্বে দেখিনি। অবশেষে বেশ ধুমধাম করে মুসলিম রীতি অনুযায়ী হাবিব ভাই আর রত্না দিদির বিয়েটা হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের পরও রত্না দিদি একদিনের জন্যও তুলসী গাছের সামনে প্রার্থনা করতে ভুলে নি। আমার খুব মনে আছে, দিনটি ছিল ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১। সন্ধ্যা বেলায় তুলসী গাছের সামনে দাঁড়িয়ে দিদি খুব কান্না করছিলেন। আমি কাছে যেতেই দিদি কান্না লুকানোর চেষ্টা করে। আমি জানতে চাইলাম, দিদি এত কান্না করছ কেন? পরে দিদির কাছ থেকে শুনি হাবিব ভাই যুদ্ধে যাবে তাই। দেশে তখন পুরোদমে যুদ্ধ শুরে হয়েগেছে। পাকিস্তানিরা এই দেশের নিরীহ মানুষকে কুকুরের মত গুলি করে মারছে। তবে কিছু জায়গায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হচ্ছে। পরের দিন জানতে পারলাম হাবিব ভাই দিদি কে মা বাবার কাছে রেখে যুদ্ধে চলে গেছে। সেদিনের পর থেকে আমি নিয়মিত হাবিব ভাইদের বাসায় গিয়ে রত্না দিদিকে সঙ্গ দিতাম। হাবিব ভাইয়ের মা বাবাও আমাকে খুব ভাল জানতেন। কিন্তু হাবিব ভাই যুদ্ধে যাওয়ার পর থেকে রত্না দিদির মুখে আমি কোনদিন আর হাসি দেখিনি। দিদির মলিন মুখ দেখে আমারও খুব একটা ভাল লাগত না। এরমধ্যে নভেম্বর মাসে এসে আমার মা বাবা সিদ্বার্ন্ত নিল আমাকে নিয়ে কলকাতা চলে যাবে। কারন , যেকোন মুহুর্ত্বে পাকিস্তানিরা আমাদের গ্রামেও হানা দিতে পারে। রত্না দিদি আর দেশ কে ছেড়ে আমিও চলে যাব শুনে রত্না দিদি আরও ভেঙ্গে পড়ে। কারন, হাবিব ভাই যুদ্ধে যাওয়ার পর আমিই রত্না দিদিকে সবছেয়ে বেশি সময় দিয়েছিলাম। অথচ সেই সময় আমারও আর কিছুই করার ছিল না। বাবা মায়ের কথা মতে আমরা সবাই প্রস্তুত। আমরা যেদিন কলকাতা চলে যাব সেদিন সকালে দিদি যথারীতি প্রার্থনা করতে আসলে আমিও তুলসী গাছটার কাছে যায়। এক সময় দিদি তার পুজা শেষ করে । আজ অবশ্যই দিদি একটু বেশি সময় ধরে পূজা করে। তাই আমি দিদি কে বললাম,
দিদি, আজ এত সময় ধরে কি প্রার্থনা করলে?
আমি ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম, আমার বাবুটা যেন যেখানেই যায় খুব ভাল থাকে।
দিদি, তোমাকে একটা কথা বলব?
হ্যা, বল।
আমাকে তুমি বিয়ে করে পেল, তাহলে বাবা মা আমাকে আর কলকাতা নিয়ে যেতে পারবে না। তাছাড়া , হাবিব ভাইতো যুদ্ধে গেছে, সে আর জীবিত ফিরে নাও আসতে পা্রে।
আমার মুখে প্রথমে বিয়ের কথাটা শুনে দিদির মুখটা ক্ষণিকের জন্য লাল বর্ণ ধারন করেন, কিন্তু পরক্ষণে আমার মুখে হাবিব ভাইয়ের না ফেরার কথা শুনে খুব জোড়ে আমার গালে একটা চড় দিয়ে বসে। আমি সাথে সাথেই মুখে হাত দিয়ে কান্না শুরু করি। তারপর দিদি আমাকে কাছে জড়িয়ে ধরে তার শাড়ির কোমরের ভাজ থেকে একটা পতকা বের করে দিল। আর বলল,-
ধর, এই নেয়। আমাদের জাতীয় পতাকা। যেখানে যাবি মনে রাখবি আমরা স্বাধীন ,আমাদের একটা স্বাধীন পতকা আছে। আর যদি কখনও এই দেশে ফিরে আসিছ, তাহলে পতাকাটা উড়িয়ে আসবি, এই পতকা আমাদের অহংকার।
আমি দিদির কথা শুনছিলাম, ঘরের ভিতর থেকে মায়ের ডাক শুনে দিদির কাছ থেকে বিধায় নেয়। পতকা টা লাল আর সবুজ কাপড় দিয়ে দিদি নিজের হাতে সেলাই করেছে। তাই আমিও খুব যত্ন করে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। সেদিনের পর থেকে আজকের পুর্বে দিদির সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি।
প্রায় ৪৫ বছর পর গতকাল দেশে এসেছি। ঠিক দেশে নয়, আমার সেই চিরচেনা গ্রামের বাড়িতে। যেখানে আমি কাটিয়েছি জীবনের প্রথম ১৩ টি বছর। কখন যে জীবনের ৫৮ টি বসন্ত কেটে গেল আজ অবধি টের পায়নি। কলকা্তা জীবনের দীর্ঘ ৪৫ বছরে আমার জীবনে কতটা পরিবর্তন হল তা বলে শেষ করার মত নয়। কলকাতার জহুরলাল নেহারু বিশ্ববিদ্যালয় থেলে অনার্স- মাষ্টার্স পাশ করে আবার সেখানেই শিক্ষাকতা শুরু করলাম। এই কলকাতা জীবনের মধ্যখানে আমার জীবন সঙ্গী হয়ে এল কলকাতার মেয়ে রোশন আরা , বংশধর হিসেবে এল মেয়ে নিশু ও ছেলে অয়ন। কিন্তু এর মধ্যে হারিয়ে পেলেছি আমার মা বাবা কে। সেই জীবনে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, আর কখনো বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতেও পারিনি। তবে আমার সেই রত্না দিদিকে আমি খুব অনুভব করতাম যখন জাতীয় দিবস গুলোতে দেখতাম বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা পতাকা উড়াচ্ছে। আমিও মাঝে মাঝে তাই রত্না দিদির দেওয়া সেই পতাকাটা বের করে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম আর ভাবতাম কবে আমার নিজের দেশে ফিরে যাব। গেল জানুয়ারী মাসে চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছি, তাই ভাবলাম নিজের দেশে একবার ঘুরে আসি। ছেলে মেয়েদের নিয়ে এখানে আসার পর দেখলাম অনেকেই আমাদের চিনতে পারছে না, তবে পরিচয় দেওয়ার পর সবাই খুব সাদরে গ্রহন করছে দেখে খুব ভাললাগছে। কিন্তু আমি যখন রত্না দিদির কথা জানতে চাইলাম কেউ কোন প্রকার খুজ দিতে পারল না। আর যখন বললাম কুসুম আপু তখন সবাই বলল সেই পাগলী মেয়েটা? আমি প্রথমেই একটু অবাক হয়! সেই পাগলী মেয়েটা মানে কী ? পরে এক প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারলাম। ১৯৭১ সালে আমাদের চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পরও যখন অনেকেই যুদ্ধ থেকে ফিরে এল কিংবা যারা জীবিত নেই অন্তত তাদের মৃত্যুর খবর এল অথচ হাবিব ভাই ফিরে আসছে না তখন রত্না দিদি এক প্রকারের খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে তুলসী গাছের প্রার্থানায় জড়িয়ে পড়ে। আর তখন সবাই বুঝতে পারে সেই কুসুম আসলে হিন্দু মেয়ে। হিন্দু মেয়ে হওয়ার অপরাধে সেই সময় সবাই মিলে রত্না দিদিকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়। সেই থেকে এই রেল ষ্টেশনে দিদি ঘুরাঘুরি করে আর মাঝে মাঝে বাবু বলে কাকে যেন ডাকে। আমি কথা গুলো শুনেই বুঝতে পারলাম, দিদি তো বাবু বলে আমাকেই ডাকত। আর দেরি না করে দ্রুত বের হয়ে পড়ি সাথে দিদির দেওয়া সেই পতকা। আমি যখন ষ্টেশনে পৌছায় দিদি তখনও মাথা নিচু করে মেঝেতে বসে আছে। আশে পাশে অনেক লোক অথচ এই মানুষটির দিকে তাকানোর মত কেউ নেই। আমি পতাকাটা রত্না দিদির চোখের সামনে মেলে ধরতেই দিদি আমার দিকে তাকল। আমিও দিদির দিকে তাকিয়ে বললাম, দিদি আমি তোমার বাবু। আমাকে জড়িয়ে ধরে দিদি বেশ কিছুক্ষন কান্না করল। আশে পাশের লোকজন আমাদের ঘিরে ধরেছে। আমাদের দেশের এমন হাজারও রত্না আছে, এমন হাজারও কুসুম আছে যাদের মা বাবা,ভাই বোন ও সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। অথচ তাদের গল্প গুলো রয়ে গেছে সবার আড়ালে আর সমাজের হাতে প্রতিদিন লুন্ঠিত হচ্ছে তাদের ভাগ্য। তাই আমি আমার রত্না দিদিকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
সমাপ্ত!

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২০

বিজন রয় বলেছেন: সুন্দর।
++++

২| ২৭ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৫৮

কবি হাইড্রা বলেছেন: ধন্যবাদ বিজয় দাদা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.