নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রভ৭১

একজন মানুষ।

প্রভ৭১ › বিস্তারিত পোস্টঃ

এ শহরে নেশাগ্রস্তের মতো কবি হতে এসেছিলাম

২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৪:৫৬

আল মাহমুদ



পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে আমি একটা টিনের সুটকেস নিয়ে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামলাম। সম্ভবত সেটা ছিল শীতকাল। সন্দেহ নেই আমি কবি হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এ প্রাচীন মোগলাই শহরে পা রেখেছিলাম।



চারদিকে ঘোড়ার গাড়ির ডাকাডাকি-হৈহুল্লোড়ের মধ্যে আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ভেবে নিলাম আমার গন্তব্যের কথা। আমি যাব ২৮১ নবাবপুর, একেবারে ধোলাইখালের পাশে যেখানে নবাবপুর গিয়ে একটি পুলের মাথায় শেষ হয়েছে এর পাশের একটি হোটেলে। পুলটা পেরোলেই জনসন রোডের শুরু। ডান দিকে কোর্ট হাউস স্ট্রিট, বাঁ দিকে মুকুল সিনেমা, খ্রিস্টানদের গির্জা এবং একটু এগিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক। যে পার্কে সিপাহি বিদ্রোহের সময় কয়েকজন বিদ্রোহী সিপাহিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।



আমি একজন পথচারীকে নবাবপুর রোডেটা কোথায়, কোন দিকে গেলে নবাবপুরে পৌঁছতে পারব জিজ্ঞেস করলাম। এর আগেও আমি দু’একবার ঢাকায় এসেছিলাম। এসেছিলাম আমার খালার বাসায় উঠতে গিয়ে সে বার নবাবপুর রোডের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক খালা ১২ নম্বর ইসলামপুর রোডে থাকতেন। তার স্বামী ছিলেন শিক্ষক। এ কারণে আমি নবাবপুর রোডটা চিনি না এমন তো নয়। কিন্তু ফুলবাড়িয়া স্টেশন পেরিয়ে কিভাবে নবাবপুর রোডে পৌঁছব সেটাও আমি ভালো করে জানতাম না।



পথচারী আমাকে বলল- ওই তো সামনে নবাবপুর রোডের মাথা। ডান দিকে গিয়ে নবাবপুর চলে যান। আমি সুটকেসটি হাতে তুলে হাঁটতে শুরু করলাম। সুটকেসটি আমার হালকাই ছিল। কিছু কবিতার জীর্ণ খাতা, একটি বই আর কিছু কাপড়। সে সময় আমি সবে হাফপ্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরতে শুরু করেছি। আমার পরনে ছিল কুমিল্লার খদ্দরের মোটা হলুদ পাঞ্জাবি। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল।



আমার কাছে মূল্যবান কোনো কিছুই ছিল না। অল্প কিছু টাকা ছিল। যা কষ্টে সংগ্রহ করে আমি বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলাম। তবে একটি দামী জিনিস আমার সাথে ছিল। সেটা হলো কলম- লাইফটাইম। আমার শরীরে মধ্যে ঝোলানো কাপড়-চোপড়, সুটকেস, জামা ও জুতো সব কিছুর মধ্যে অধিক মূল্যবান।



একটু হেঁটে গিয়ে আমি নবাবপুরে পড়লাম। এর চেয়ে প্রশস্ত রাস্তা ঢাকায় আর ছিল না। একটু এগোতেই দেখি ভিস্তিওয়ালারা তাদের চামড়ার মশক বহন করে রাস্তা ধুয়ে দিচ্ছে। তাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি। গাড়োয়ানরা খোশ মেজাজে ঘোড়ার সাথে কথা বলতে বলতে ঘন্টি বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় বেরিয়েছে সালোয়ার-কামিজ পরা অনেক মেয়ে। কারো হাতে চায়ের কাপ, কারো হাতে সিগারেটের প্যাকেট বা পানের মোড়ক নিয়ে তারা আশপাশের বাড়িগুলোতে ঢুকছে। সারাটা রাস্তায় একটা অতিশয় প্রভাত বেলার গন্ধ ছড়ানো। গন্ধটা বিরিয়ানি, মুরগি পোলাও, তেহারি, নেহারির সাথে ঘোড়ার গায়ের গন্ধ এবং গরুর সদ্য রাঁধা গোশতের ঘ্রাণে সংমিশ্রিত। সবটাই যে নবাবপুরের গন্ধ এটা কিন্তু ঠিক নয়। নবাবপুর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঠাটারিবাজার এবং আরো কয়েকটি রাস্তার আশপাশের নাস্তা রন্ধনশালার উপচেপড়া গন্ধ নাকে টের পাচ্ছিলাম। এই গন্ধ আমি যেখানে যাব সে রথখোলা পর্যন্ত প্রসারিত। তারপরই বাতাস অন্যরকম। কারণ ধোলাইখাল পর্যন্ত নবাবপুরের যে আমেজ তা পুলটা পেরোলেই আর থাকছে না। আমি রথখোলার মোড়ে গিয়ে সুটকেসটা একবার নিচে নামিয়ে একটা সিগারেট ধরাবার চিন্তা করলাম। এখানে অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি যে আমি খুব অল্প বয়সেই ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। যে অভ্যাস সত্তরে এসেও ছাড়তে পারিনি। কিংবা ছাড়িনি। ছাড়িনি এ কারণে যে আমার বুকে কোনো কফ-কাশি, হাঁপানির মতো দুরারোগ্য ব্যাধি আমাকে কখনো অবশ করেনি। আর এখন তো জীবনের শেষ মাথায় এসে যখন আমার প্রভু আল্লাহর নামে সপ্তাহের একদিন বৃহস্পতিবার জিকির শুরু করি তখন এ বিশ্বাস কেমনভাবে যেন হয়েছে যে আমার বুকটা আর গোলযোগপূর্ণ বোধ হবে না। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু সংস্কার থাকে। অদৃশ্যের ওপর যুক্তিহীন ভরসা থাকে। আমারও আছে। কত দেখলাম, কত পড়লাম, কত কিছু ঘাঁটলাম আর বেছে নিলাম নিজের দুর্ভোগ। কিন্তু প্রায় অন্তিমে এসে এখন এমন বহু বিষয়ে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছি যা দেখা যায় না। হাত বাড়ালে ধরা যায় না। কিন্তু আমার কাছে চিন্তিতভাবে তা বিদ্যমান।



কেউ যদি বলে আমি কুসংস্কারে বিশ্বাসী, বলতে পারে। আমি আমার অভিজ্ঞতার অন্ধকার অঞ্চল পার হতে হতে আলোর মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি। এই আলোর ঝলকানিতে এখন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আলোর ভেতরে আলো দেখতে পাচ্ছি। এ অবস্থাটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমার কবিত্ব শক্তি আমার প্রভু যেটুকু অনুমোদন করেছেন তা দুঃসাহসীর মতন বলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এই রচনা শুরু করলাম। সাধ্যমতো সত্য-মিথ্যা-স্বপ্ন-দৃশ্য-অদৃশ্য সব লিখে যাওয়ার বাসনা রাখি। আমি বলছি না আমার জীবনের এ অংশ আমি যা বলব এর সবটুকু সত্য। আমি স্বপ্ন জগতের মানুষ, আমার কাছে নিরেট সত্য দাবি করা নির্দয়তা ছাড়া কিছু নয়। আমি বলব আমার কাহিনী। বলব আমি এভাবে জীবন কাটিয়েছি। কেউ বিশ্বাস করার ইচ্ছে থাকলে তিনি করবেন। কেউ মিথ্যার অভিযোগ উত্থাপন করলে আমি বলব যে কবির চেয়ে সত্যবাদী সমাজে খুব বেশি জন্মায় না।



আমি টিনের সুটকেসটার উপর রথখোলার মোড়ে যেখানে দুধ বিক্রেতাদের সারি জমে উঠেছে এর এক প্রান্তে চুপচাপ বসে পড়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার শখের সিগারেট বার্কলে। সাধারণত এটি খাওয়ার মতন পয়সা আমার থাকত না। সিজারই টানতাম। কিন্তু আমার এ মহানগরীতে কবি হওয়ার বাসনা নিয়ে নতুন অতিথি। সে জন্য দু’একটি বার্কলে সিগারেট অন্য প্যাকেটে ঢুকিয়ে এসেছিলাম। আরামে সুখটান মারছি।



একজনকে, আমার সমবয়সি হবে এক তরুণকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ঐ তো সমজিদ। আমি ২৮১ নং বাড়িতে যাব। ছেলেটি চমকে উঠল। বুড়ির হোটেলে?



আমি বুঝতে পারলাম ছেলেটি আমার গন্তব্য সম্পর্কে নির্ভুল কৌতূহল প্রকাশ করছে। হ্যাঁ ভাই।



কার কাছে যাব!



কবি লুৎফর রহমানের কাছে।



তাড়াতাড়ি যান। একটু পরেই উনি তো অফিসে চলে যাবেন। আমি দেখে এসেছি উনি নিচে খেতে বসেছেন।



আমি কালবিলম্ব না করে সিগারেটে দু’তিনটা সুখটান মেরে সুটকেস নিয়ে দ্রুত পা ফেলে মসজিদের পাশের গলি দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।



বাঁ দিকে তাকাতেই বুড়ির খোয়া ওঠা অতিশয় প্রাচীন দোতলা ইমারত। আমি ঢুকেই দেখলাম লুৎফর রহমান, একদা যিনি আমার দাদার বাড়ির গৃহশিক্ষক ছিলেন এবং দীর্ঘকাল কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে বেয়ারার চাকরি করে কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখে সামান্য পরিচিতি অর্জন করেছিলেন সেই প্রসন্ন মুখচ্ছবি লুৎফর কাকু।



আমাকে দেখে খুবই যে বিম্মিত হয়েছেন এমনভাব তার চেহারায় ফুটে উঠল না।



এই তো সকালের গাড়িতে।



তিনি আমার কথায় আমার হাত থেকে সুটকেসটি নিয়ে যেখানে চাটাই বিছিয়ে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছিল এর পাশে রেখে বললেন, আগে নাস্তা করে নাও। উপরে গিয়ে কথাবার্তা হবে। তিনি মোটা বিশাল আকৃতির এক বৃদ্ধা মহিলার দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে খেতে দিতে বললেন। বৃদ্ধা আমাকে এ সকালবেলাতেই গরম ভাত এবং কাঁচকি মেশানো আলুর ভাজি প্লেটে ভরে দিয়ে ঠেলে সামনে রাখতে গিয়ে বললেন, কোত্থেকে? শাহবাজপুর থেকে? শাহবাজপুর আমার শ্বশুরবাড়ি।



মুখে প্রসন্ন হাসি।



আমি বললাম, না নানী। আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বুড়ি আর কথা বাড়ালেন না।



আমি সকালবেলার গরম প্রাতরাশ পেট ভরে খেয়ে নিলাম। তারপর ধুয়েমুছে কুলকুচা করে সুটকেসটি নিয়ে উপরে চলে এলাম। লুৎফর কাকু তখন অফিসে যাওয়ার জন্য পাঞ্জাবি পরে নিয়েছে আমাকে পাশের খালি সিটটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে বসো। কেন এসেছ?



একটা কাজের জন্য।



তোমার বাপ-মা জানেন?



আপনার কাছে আসব এ কথা বলে চলে এসেছি।



তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। তারপর অত্যন্ত মৃদু শব্দে বললেন, গতকাল কাফেলায় তোমার একটি গল্প ছাপা হয়েছে- ‘জীবন’। ভালো লেখা। ডাকে পাঠিয়েছিলে? আমি নেড়ে সম্মতি জানালাম।



তিনি কাগজের ভাঁজ থেকে সাপ্তাহিক কাফেলার একটি সংখ্যা আমার হাতে দিয়ে বললেন, সুন্দর করে ছেপেছে। এখন কাফেলা দেখছেন কবি ওয়াছেকপুরী, আবদুর রশিদ ওয়াছেকপুরী। তার কবিতা তো নিশ্চয় দেখে থাকবে। ইচ্ছে করলে আমি অফিস থেকে না ফেরা পর্যন্ত তুমি একবার ইসলামপুর থেকে ঘুরে আসতে পারো। ২৫ নম্বর ইসলামপুরের দোতলায় কাফেলা অফিস। গেলেই তাকে পাবে। শোনো, তোমার অনেকগুলো কবিতা কলকাতার কাগজে ছাপা হয়েছে। নতুন সাহিত্য, চতুরঙ্গ ইত্যাদিতে।



কাফেলা থেকে রাস্তায় নেমে আমার মনে হলো ঢাকা শহর থেকে সুন্দর শহর আর বুঝি জগতে নেই। আমি এর আগেও ঢাকায় এসেছি। কিন্তু এবারের আসাটা ফিরে যাওয়ার জন্য নয়। যতটুকু মন পড়ে, ঋতুটা ছিল বসন্তের আমেজে ভরপুর। মীতের প্রকোপ শেষ না হলেও রাস্তার আশপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের উপরিভাগটা সহসা যেন লাল ফুলে ভরে গেছে। আমি ওই কাফেলার রাস্তা ধরেই ওয়াইজঘাটের দিকে হাঁটা দিলাম। ওয়াইজঘাটের অলিগলি পার হয়ে উপস্থিত হলাম বার্কলেন বাঁধের ওপর। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার তীরে। তো বাঁ হাতি রাস্তা ধরে চলতে চলতে এসে উপস্থিত হলাম সদরঘাট। সেখানে বিশাল কামানটি দর্শনীয় বস্তু হিসেবে পাথরের মঞ্চের ওপর বসানো ছিল। অনেকে বলতেন কালো খাঁ কামান। কামানটির নাম ছিল বিবি মরিয়ম। মনে হয় কোনো যুদ্ধের সময় কামানটি বুড়িগঙ্গার তীরচ্যুত হয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। কামানটিতে গ্রাম থেকে আসা হিন্দু বধূরা সিঁদুর দিয়ে পূজা করত। হয়তো তারা এটাকে তাদের শিবলিঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করত। আমি কামানটির ওপর হাত দিয়ে এর বিশাল আকার ও লৌহ গহ্বর দেখে নিলাম। এ কামানটিকে নিয়ে আমার একটি কবিতাও আছে। কবিতাটির নাম ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’। আমি যখন ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ লিখি তখন কামানটি সদরঘাটে ছিল না। তুলে আনা হয়েছিল গুলিস্তান মোড়ে। সেটা অনেক পরের কথা।



আমি যখনকার কথা বলছি তখন গুলিস্তান অঞ্চলটির আশপাশে খানাখন্দ, কচুঘেঁচু এবং অনাবাদি খালি জমি পড়ে ছিল। এর মধ্যে বিটুনিয়া বলে একটি সিনেমা হলের কথা মনে পড়ে। এই সিনেমা হলে ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। দর্শক ছিল ইংরেজরা। পাকিস্তান হওয়ার পর এ হলটি ইংরেজি শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাভোগী একটি শ্রেণীর বিদেশী সিনেমা দেখার হল রূপে বিবেচিত হচ্ছিল।



আবার কামানের কথায় ফিরে আসি। কামানটি ছিল অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ প্রতœ সম্পদ। এটি নিয়ে তখন ঢাকার পৌর কর্তৃপক্ষ কিংবা যারা প্রতœ সম্পদের রক্ষক তারা মনে হয় এর সঠিক স্থান নির্ণয় করতে পারছিলেন না। এখানে-ওখানে ঘুরেফিরে বিবি মরিয়ম এখন ওসমানী উদ্যানের গৌরব বৃদ্ধি করছে।



যা হোক আমি সদরঘাটে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে যাওয়ার সময় অবাার মজলিশ ভাইয়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, আরে আপনি এসেছেন। দেখুন কীর্তিবাসের প্যাকেট এসে গেছে। তিনি একটি প্যাকেট থোকে গাঢ় নীল রঙের প্রচ্ছদের ওপর লাইনো টাইপে কীর্তিবাস লেস পত্রিকাটি আমার হাতে দিলেন। পত্রিকার খোঁজে এর মধ্যে মজলিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত পত্রিকাটি দেখে আমার মন ভরে গেল। কাগজ দেখেই এই পত্রিকাটিতে লেখা পাঠাব বলে মনস্থির করে ফেললাম।



আমি যখন কাগজটি দেখছি, তখন আমার পেছনে পিঠের সাথে প্রায় বুক লাগিয়ে আরো একজন কীর্তিবাসের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিল। আমি মুখ ফিরিয়ে যুবকটিকে দেখলাম। আমি মুখ ফেরাতেই সে বলল, আমার নাম দেবব্রত চৌধুরী। তখন আমি আমার নিজের পরিচয় দিতে বাধ্য হলাম। বললাম, আল মাহমুদ।



হ্যাঁ কলকাতার কাগজে আপনার কবিতা আমি দেখেছি। আপনার বাড়ি তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আমি হবিগঞ্জের লোক। আমিও কবিতা লিখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।



ওই নামে কারো কবিতা কোনো পত্রিকায় পড়িনি। হয়তো তিনি ঢাকার পত্র-পত্রিকায় লেখেন। আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। আমি মজলিশ ভাইকে কীর্তিবাসের দাম পরিশোধ করা মাত্র তিনি আরো একটি প্যাকেট থেকে খুব সুন্দর সাদা আর্ট পেপারের প্রচছদওয়ালা একটি পত্রিকা আমার হাতে দিলেন। পত্রিকাটির নাম ময়ূখ। এটিও কবিতা পত্রিকা। আমি এবং দেবব্রত দু’জনে খুব উৎসুক হয়ে পত্রিকাটি দেখলাম। সম্পাদক জগদীন্দ্র মন্ডল। পাতা উল্টিয়েই দেখলাম, এতে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা দিয়ে শুরু। দারুণ আকৃষ্ট হলাম ময়ূখ পত্রিকাটির প্রতি। আমি ও দেবব্রত হাঁটতে হাঁটতে সদরঘাটের মোড় পার হয়ে ধোলাইখালের ব্রিজের ওপর এসে দাঁড়ালাম। দেবব্রতকে বললাম, আমি এখানে এই মসজিদের পাশে থাকি।



এটা তো নবাবপুর রোডে পড়ে। নম্বর কত?



আমি বললাম ২৮১।



ঠিকানাটি একটি কাগজে টুকে নিল দেবব্রত চৌধুরী এবং একটু অবজ্ঞার দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, তাহলে আমি আসি।



দেবু চলে গেলে আমি ভেতরে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, চার-পাঁচ জন লোককে বুড়ি খাওয়াচ্ছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই বলল, ওই মিয়া, জলদি আহো।



এ কথায় আমি দ্রুত উপরে উঠে গিয়ে পরনের পাজামা ও শার্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে নিলাম এবং নিচে এসে কুয়ার পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে গেলাম।



ততক্ষণে সবাই প্রায় উঠে গিয়েছিল। বুড়ি আমার দিকে একটা টিনের থালা এগিয়ে দিল এবং একটি বড় টিনের চামচ দিয়ে ঝাঁকা থেকে ভাত তুলে পাতে ঢেলে দিল। দেখলাম, এক টুকরা মাছ ও আলুসহ ঝোলভরা একটা বাটি আমার সামনে। আমি ঢেলে নিয়ে খেতে শুরু করলে কোত্থেকে একটা লম্বামতো ফর্সা লোক এসে দাঁড়াল। বুড়ি ওই লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বাক্স থেকে মুঠ করে কী যেন বের করে তাকে দিল। আমার মনে হয় পয়সা-কড়ি হবে। আমি আপন মনে খাচ্ছিলাম। আর আড় চোখে লোকটাকে দেখছিলাম। বেশ ছিমছাম স্বাস্থ্য এবং বেশ একটু লম্বাও বটে। চোখ দু’টি রক্তবর্ণ। ফিরে যাওয়ার সময় বুড়ি বলল, খাবি?



না।



লোকটা বেরিয়ে গেল



আমি এবার বুড়ির দিকে তাকালাম।



আমার ছেলে।



আমি কোনো কথা না বলে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই বুড়ি বলল, শীতের লেপকাঁথা আনছ?



আমি হাসলাম। আনিনি, তবে একটা ব্যবস্থা তো হবে। লুৎফর কাকু আসুক।



ওমা একেবারে মুক্ত সুরত! লুৎফর মিয়া তো কইল বড় ঘরের ছেলে।



আমি একটু লজ্জা পেয়ে কেটে পড়লাম। উপরে এসে খাটে শুয়ে পড়লাম। ঘুমটুম কিছু হলো না। মন পড়ে আছে কীর্ত্তিবাস ও ময়ূখের দিকে। পত্রিকা দুটো খুলে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে খুঁটিয়ে পড়লাম। যেন এক অনাবিষ্কৃত নতুন জগতে প্রবেশ করেছি। যেখানে পৌঁছতে না পারলে আর শান্তি নেই।



কিভাবে একজন মানুষ বালক বয়সেই কিংবা বয়োসন্ধিকালে কবি হয়ে ওঠে তা আমার এই নেশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। মনে হচ্ছে, কবিতা ছাড়া আমার আর কোনো পাঠ্য নেই। আর কিছু করতে যেন মনের কোনো সায় নেই। তাছাড়া সবচেয়ে বড় যে দুর্ভাগ্য ওই বয়সে আমার মনে যে বাসা বেঁধেছিল আমার যেন কারো প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই। এমনকি আমার নিজের প্রতিও কোনো দায়িত্ব অনুভূতি নেই। যদি থাকত তাহলে এই শীতের সময় বাড়ি থেকে লেপ-তোষক নিয়ে আসতাম। হায় আল্লাহ্ আমার একটি বালিশও ছিল না। আমি এসে পড়েছি প্রাচীন একটি মোগলাই শহরে। যে শহর সহসা-এর সামন্ততান্ত্রিক খোলস ফাটিয়ে এক দশকের মধ্যেই বেরিয়ে আসবে। হয়ে উঠবে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং ধর্মসহ যুদ্ধের জন্য ব্যাকুল।





দৈনিক ইত্তেফাকের সৌজন্যে।



মন্তব্য ৩৪ টি রেটিং +১৯/-০

মন্তব্য (৩৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৫:১৭

সৈয়দ নাসির আহমেদ বলেছেন: আল মাহমুদের যে কোন লেখা-ই বরাবরই ইতিহাসের বুক চিরে বের হয়ে আসে ,
এই কবি এখনও বাংলা কবিতার ভাবীদ্রষ্টা হয়ে বেঁচে আছেন। তিনি তার কাল ও সমকালকে ধরে আছেন বলেই তিনি আধুনিক।
সব শেষে বলতে চাই, আল মাহমুদ সৃষ্টি এবং স্রষ্টার আলো-আঁধারটা
ভালো করে বুঝেন বলেই তিনি সবসময় নতুন।
তিনি দীর্ণ করে বেরিয়ে আসেন সমকালে-ভবিতব্যে। তার শব্দরা বাকলফাটা বিচির মতো ছড়িয়ে পড়ে, এক অনন্ত বীজগান নিয়ে।
আল মাহমুদের লেখা পাঠ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য
আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।

২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৬:৩৩

প্রভ৭১ বলেছেন: ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ।

২| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৫:৪৩

রশীদ খাঁন বলেছেন: প্রিয় পোষ্ট

২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৬:৩৩

প্রভ৭১ বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৬:১৯

সিফাতরক্‌স বলেছেন: লেখাটি পড়তে পড়তে জেন সেই সময়ে হাড়িয়ে গিয়েছিলাম ।

২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৬:৩৪

প্রভ৭১ বলেছেন: আমিও।

৪| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৭:৫৪

নাজিম উদদীন বলেছেন: পত্রিকায় পড়ছি।

সেই মাহমুদ এখন কি হয়ে গেল!

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৩৫

প্রভ৭১ বলেছেন: হয়ে গেল!

৫| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৮:৩৯

শূন্য আরণ্যক বলেছেন: সেই সময়ে ফিরে গেলাম

"আলুভাজির সাথে কাচকি মাছ"

শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৩৫

প্রভ৭১ বলেছেন: ধন্যবাদ।

৬| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৯:০০

তনুজা বলেছেন: সব থেকে প্রিয় কবি, তাই পোস্ট প্রিয়তে তুলেছি আগেই
ধন্যবাদ আপনাকে

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৩৬

প্রভ৭১ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকেও

৭| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৯:০৯

আলী আরাফাত শান্ত বলেছেন: +

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৩৯

প্রভ৭১ বলেছেন: ধন্যবাদ।

৮| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ১০:১৪

মোতাব্বির কাগু বলেছেন: +

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৩৯

প্রভ৭১ বলেছেন: ধন্যবাদ।

৯| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ১০:৫৯

তায়েফ আহমাদ বলেছেন: আল মাহমুদ!
অন্য রকম!

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৪০

প্রভ৭১ বলেছেন: অন্য রকম!

১০| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ১১:৪২

লাবণ্য প্রভা গল্পকার বলেছেন:
আল মাহমুদ
যিনি আদিঅন্ত কবি
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ


২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৪১

প্রভ৭১ বলেছেন: ধন্যবাদ খালামণি।

১১| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ১১:৫৮

মোঃ খায়রুল ইসলাম বলেছেন: ভাল লাগল ।

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৪১

প্রভ৭১ বলেছেন: ধন্যবাদ।

১২| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:২৩

সেলটিক সাগর বলেছেন:
আল মাহমুদকে কি মুক্তিযোদ্ধা কবি বলা যায় ? - আরিফ জেবতিক
=====================================

কারো চরিত্র চিত্রন আমার উদ্দেশ্য নয় । আল মাহমুদকে আমি খুবই শক্তিমান কবি হিসেবে মানি , তার রাজনৈতিক দূ:খজনক বিবর্তন সত্ত্বেও যে কয়জন কবি আমাদের সময়কে প্রতিনিধিত্ব করবেন , তাদের মাঝে আল মাহমুদের নাম প্রথম সারিতেই রাখতে হবে । যদিও তার ইদানিংকার মোনাজাত জাতীয় কবিতা পাঠক হিসেবে আমার পছন্দের তালিকায় নেই , তারা সাম্প্রতিক কবিতার বইটি আমি ফেলে দিয়েছি , তবু তার আগের লেখাগুলোর কারনেই তার অবস্থান আমার মনে অনেক উচ্চ আসনে রয়েছে ।

আল মাহমুদের কাব্য বিচারের সাধ বা সাধ্য কোনটাই আমার নেই । আমি শুধু তার মুগ্ধ পাঠক ।

কিন্তু জটিলতা সৃষ্ঠি হয় যখন তার রাজনৈতিক অবস্থানটি আলাদা ভাবে আমাদের বিচার্য হয়ে ওঠে । সেই জায়গায় আল মাহমুদ আমার প্রতিপক্ষ দলে অবস্থান করেন ।

তাই যখন আমার প্রতিপক্ষ দল গর্বের সাথে বলে - দেশের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কবি তাদের শিবিরে অবস্থান করেন , তখন আমি হতাশ হয়ে পড়ি । শামসুর রাহমান কেন নিজের গ্রামে বসে ''স্বাধীনতা তুমি '' কবিতাটি ছদ্মনামে লিখে সেটা স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠিয়ে দায় সারলেন , তিনি কেন আল মাহমুদের মতো সশস্ত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন না , সেটা নিয়ে আফসোস করতে থাকি ।
কিন্তু বহুদিন ধরেই আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না আল মাহমুদ কোন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন । হাসান মোরশেদের '' ঘাটানো দরকার'' মন্তব্যটি আবার আমাকে খুঁচিয়ে তুলে ।

গত কয়দিন ধরে কিছু বই ঘাটাঘাটি করছিলাম ।কিন্তু কোথাও এই বিষয়ে কিছু পেলাম না ।

আজ এক কাজিনের বই আলমারিতে অন্য একটি বই খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেলাম স্বয়ং আলমাহমুদের আত্মজীবনী । বইটির নাম ''বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ ।" প্রকাশক : একুশে বাংলা ।

আসুন , সেখান থেকে কিছু অংশ পড়া যাক :

৭১ সালে ভারত পাড়ি দেয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে কবি জানাচ্ছেন :

'' আমার ভগ্নিপতি পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি হোসেন তৌফিক ইমাম সেখান থেকে সপরিবারে আরগতালায় পৌছেছেন । ....জেনে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম । এ পরিস্থিতিতে নারায়ণপুরে আমি নিরাপদ ছিলাম না । মনে মনে দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার একটা আকাঙ্খাও জেগে উঠেছিল ।''

যাক , না না বিপর্যয় পেরিয়ে আল মাহমুদ অবশেষে কলকাতা পৌছান ।

তিনি সেখানে তৌফিক ইমামের বাসাতেই আশ্রয় নেন ।
তবে মুক্ত পরিবেশেও কবিকে বেশি সাহসী বলে মনে হচ্ছে না , কারন তিনি বলছেন :

"এখানে এসে উডস্ট্রিট থেকে আমি একদম বেরুতাম না । কারন অতি কৈশোরে আমার খানিকটা জানা থাকলেও ওই সময়ে তা আগের মতো থাকার কথা নয় । আমি ভয় পেতাম ঠিকমতো বাসায় এসে পৌছতে পারব না । "

অর্থাৎ কবি আসলে নিজের বাসায় ফেরার ব্যাপারেই বেশি কাতর ছিলেন দেখা যাচ্ছে ।

যদিও পরের প্যারায় উনি জানাচ্ছেন :

"আমি নয়মাস কলকাতায় অবস্থানকালে আমার প্রধান নেশাই ছিল কলকাতাকে জানা । এ ব্যাপারে যারা আমাকে সাহায করেছিলেন কলকাতার ওপর বই লিখেছেন সেই পুর্ণেন্দু পত্রী এবং কবিতা সিংঞের মেয়ে রাজেশ্বরী রায় চৌধুরী ।"

অর্থাৎ , কবি নয়মাস কলকাতাতেই ছিলেন এবং পূর্ণেন্দু পত্রী আর রাজেশ্বরী রায়ের সাথে কলকাতাকে জানতেই তার সময়টি ব্যয় হয়েছে । দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতাকে জানাটা যদি কবির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় , তাহলে তাকে আর যাই হোক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিয়ে ফেলাটা মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয় ।

তারপর কবি বিভিন্ন বর্ণনায় জানাচ্ছেন , তাকে পেয়ে কলকাতার কবিকূল কেমন খুশী হয়েছিলেন । এই পর্যায়ে আমাদের গৌরবান্বিত হওয়ার অনেক তথ্যই আছে ।

কিন্তু যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এতো কথা ,সেখানে কবির ভুমিকা কী ?

"ততদিনে আমার ভগ্নীপতি প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহন করেছেন । আমি তখনো তার সঙ্গেই আছি । এর মধ্যে আমার দায়িত্ব বেড়ে গেল । "

কী সেই দায়িত্ব , সেটা জানতে হলে পড়তে হবে পরের লাইনটি ।

" বিভিন্ন পত্রিকায় আমার সমর্থন একটু -আধটু সমর্থনসূচক প্রতিবেদন ছাপা হতে শুরু হয়েছে ।"

অর্থাৎ , কবি তখন আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়ে সেই পত্রিকার কাটিং জোগাড় করে চলছেন ।
তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সাথে তার সংযুক্তি কোথায় ?

আছে এর পরের লাইনে । উনি জানাচ্ছেন ,

" তা ছাড়া আট নম্বর থিয়েটার রোডে মুক্তিযুদ্ধের মূল অফিসের স্টাফ হিসেবে আমার নাম থাকায় আমি একটি পরিচয়পত্র পেয়ে গেলাম । এটা ছিল আমার জন্য একান্ত জরুরী । কারন তখন কলকাতায় চলাফেরা করার জন্য এই পরিচয়পত্রটি থাকা দরকার ছিল । "

এই পরিচয়পত্রটি নিয়ে উনি কী করেছেন ?

" আমাকে কেউ কোন নির্দিষ্ট দায়িত্ব না দিলেও আমি কলকাতার লেখক , শিল্পী , ও সাহিত্যিকদের মধ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন যোগানোর কাজ করে চলছিলাম ।"

কলকাতার লেখক , শিল্পী , ও সাহিত্যিকগন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কেউ ছিলেন বলে জানা যায় নি কোনদিনই , তখনকার সময় বিবেচনা করলে ভারতবাসী কারো পক্ষেই এই বিরোধিতা করার কোন কারনই নেই । তাছাড়া কোথাও সেই ধরনের মটিভেশনে আল মাহমুদ কিছু করেছেন বলে নিজেও দাবী করেন নি , বরং বিভিন্ন জায়গায় কবি সাহিত্যিকদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর অনেক বর্ণনা আছে । বলা বাহুল্য সেগুলো নিছকই কবি সাহিত্যিকদের চিরন্তন আড্ডাবাজী , সেখানে মুক্তিযুদ্ধের কোন বিষয়ই নেই ।

শামসুর রাহমান যখন অবরুদ্ধ দেশে থেকেও ছদ্মনামে স্বাধীনতার কবিতা লিখে স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠাচ্ছেন , অসংখ্য সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মী যখন স্বাধীন বাংলা বেতারকে মুখর করে রেখেছেন , কবি আলমাহমুদ তখন স্বাধীন বাংলা বেতারে কী করছেন , দেখা যাক :

"এ সময় আমি মাঝে মধ্যে বালুহাককাক লেনের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিসে হাজিরা দিতে যেতাম । কিন্তু রেডিওতে অংশগহন করিনি । কারন আমার পরিবার-পরিজন তখনো বাংলাদেশে অনিশ্চিত অবস্থঅয় কাল কাটাচ্ছিল এবং পরিবার পরিজনের কোন খবরই আমার জানা ছিল না । "

কবি আল মাহমুদের সাহস বোঝা যায় এখানে ।

কবি কি তখন কিছু লিখছেন না ? লিখছেন ।
তিনি জানাচ্ছেন , আনন্দবাজার রবিবাসরীয় বিভাগে তখন তিনি ''প্রকৃতি '' কবিতাটি লিখেছেন । প্রকৃতি কবিতাটি আমার পঠিত বলে স্মরণ আসছে না , তাই মন্তব্য করছি না , তবে কবিতার নাম দেখে সেটিকে যুদ্ধের সাথে সংশ্রব আছে , এমন কোন কবিতা বলে মনে হচ্ছে না ।

এসময় কবি কলকাতা থেকে তার কাব্যগ্রন্থ বের করার চেষ্টা করেন এবং সফল হোন । সেটি '' আল মাহমুদের কবিতা '' শিরোনামে অরুণা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় । সেখানে যুদ্ধের কোন কবিতা ছিল বলে কবি দাবী করেন নি ।

বরং তিনি এক বস্তিবাসী যুবতীর ঘরে নিরীহ রাত যাপন করেছেন বলেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন , তাছাড়া পূর্বে উল্লেখিত রাজেশ্বরী রায় চৌধুরীর সাথে তার ঘনিষ্ট ঘুরাফেরা কানাঘুষার জন্ম দেয় বলেও ইঙিত পাই আমরা ।

কবি তখন নিজেকে নিয়েই মগন ছিলেন ।

"এ সময় আমার মানসিকতায় একটু শৈথিল্য দেখা দিয়েছিল ,কেমন যেন গা ছাড়া ভাব । আমি মনে প্রানে আল্লাহর কাছে যৌন সংযম প্রার্থনা করতাম ।"

কারন , কবির সনেটন নিয়ে একটি মিনিবুক প্রকাশিত হয়েছিল , সোনালি কাবিনের সেই কবিতাগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী তাদের ব্লাউজের ভেতর রাখত বলে কবি খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন ।

কবির এই ঘুরাফেরা যে অনেকেরই পছন্দ হয় নি , সেটা বুঝা যায় যখন কবি আরো জানান :

" এর মধ্য একদিন হঠাৎ একটি পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ ছাপা হলো । তারা লিখেছেন , আমি নাকি ভিআইপিদের মতো পোশাক পরে কফি হাউসে ঘুরে বেড়াই ।"

কবি অবশ্য এগুলোকে নকশালপন্থী লেখকদের ষড়যন্ত্র বলে দাবী করেছেন তার বইয়ে ।

শেষ কথা :

কবির আত্মজীবনী পড়ার পরে আর অন্যান্য বইয়ের রেফারেন্স টানার দরকার মনে করছি না ।
৭১ সালে কবি কী করেছেন , কী করেন নি , সেটা উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার ।

কিন্তু সার্বিক বিচার করে মনে হচ্ছে কবি আল মাহমুদ আসলে প্রভাবশালী ভগ্নীপতির ছত্রছায়ায় কলকাতার জীবনে খুবই আরামে ছিলেন । ভগ্নিপতি তাকে একটি আইডি কার্ড ধরিয়ে দিয়েছিলেন , মুক্তিযুদ্ধের সাথে এটাই কবির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের বড় পরিচয় ।
দেখা যাচ্ছে , আত্মীয় স্বজন মামা চাচার জোরের বিষয়টা বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার সাথে একই সময়েই জন্ম নিয়েছিল ।

কবি আল মাহমুদকে যদি মুক্তিযোদ্ধা কবি বলা হয় , তাহলে জামাতিদের " মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ"কেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন হিসেবে মেনে নিতে হবে , এটাই আমার মনে হচ্ছে ।

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৪২

প্রভ৭১ বলেছেন: ধন্যবাদ।

১৩| ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:২৭

সেলটিক সাগর বলেছেন:
১৩ নং প্লাস।

আরিফ ভাইয়ের পোস্টের উৎস-

http://www.sachalayatan.com/arifjebtik/17812

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৪৩

প্রভ৭১ বলেছেন: হুম

১৪| ২৭ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৯:০০

প্রণব আচার্য্য বলেছেন: ওয়েলডান@সেলটিক সাগর



১৫| ২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৩:৪৩

প্রভ৭১ বলেছেন: প্রণব

১৬| ০২ রা মে, ২০০৯ বিকাল ৩:০৩

প্রচ্ছদ বলেছেন: Click This Link

১৭| ০৩ রা মে, ২০০৯ সকাল ৮:০৪

তরু বলেছেন: ভালো লাগলো।

১৮| ১৩ ই মে, ২০০৯ রাত ১:৩৯

নৃপ অনুপ বলেছেন: ঘুম থেকে জেগে দেখি আবারও জ্বলছি আমি;
স্বপ্নের ভিতর কতবার গুম খুন হই, কতবার পোস্টমর্টেম...

এ রকম পোস্ট দিতে পারলে, মন্দ কি?

মঙ্গলার্থে...

১৯| ২২ শে মে, ২০০৯ ভোর ৫:৫৬

ইমন সরওয়ার বলেছেন: আল মাহমুদ কি মুক্তিযোদ্ধা কবি? এধরণের অবান্তর কথা - এ জন্য যে একজন কবি যুদ্ধে গেলেন কি গেলেন না (অস্ত্র হাতে) সেটা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। তিনি একটি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধেকে সমর্থন করেন কি না অথবা সে সময় করেছিলেন কিনা সেটা জিজ্ঞাস্য হতে পারে। এটা আমরা জানি যে তৎকালিন ৭ কোটি বাঙালি অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশ নেয়নি। তাই বলে তাদের দেশপ্রেম ছিল না বলা যাবে না। (গুটিকয়েক রাজাকারদের কথা আলাদা। পৃথিবীর সব দেশেই কিছু কিছু গাদ্দার, থাকবেই। সবাই তো আর ভালো মানুষ হয় না।)
এখানে আলোচ্য বিষয় হতে পারে আল মাহমুদ এ সময়ের কত বড় কবি। পঞ্চাশ থেকে এ পর্যন্ত আল মাহমুদ তার কাব্য প্রতিভা নিয়ে কতটা সচল।
পুন:নবার আল মাহমুদ পাঠের সুযোগ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

২০| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৪৩

রুহী বলেছেন: অনেক সুন্দর করে লিখেছেন।আারো লেখা চাই।আল মাহমুদ সময়ের সাহসী কবি।ভালো থাকবেন।

২১| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ভোর ৪:২০

নিরব পাঠক বলেছেন: দিদি

নমষ্কার। গেওর্গে আব্বাস ভাই কৈ গেল? সাথে মাশূক ভাই ও নাই।

একটু কি বলবেন?????

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.