নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার নাম- রাজীব নূর খান। ভালো লাগে পড়তে- লিখতে আর বুদ্ধিমান লোকদের সাথে আড্ডা দিতে। কোনো কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই। নিজের দেশটাকে অত্যাধিক ভালোবাসি। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষদের শ্রদ্ধা করি।

রাজীব নুর

আমি একজন ভাল মানুষ বলেই নিজেকে দাবী করি। কারো দ্বিমত থাকলে সেটা তার সমস্যা।

রাজীব নুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধাবমান কালো চোখে আলো নাচে

০৫ ই জুন, ২০২০ রাত ১:৪২




ভূমিকা
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হল রহস্য ও সম্ভাবনার বিশাল সাগর। আমরা যারা এ যুগে জন্মেছি তারা খুবই ভাগ্যবান। ভাগ্যবান নানা কারনে। তার মধ্যে একটা বড় কারণ হলো এই যে, মানুষ এত হাজার হাজার বছর ধরে সভ্য হয়ে উঠেছে, এত কথা জেনেছ, এত রকম কলকব্জা আবিষ্কার করেছে তার সব আজ আমাদের হাতের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। জীবন হয়ে গেছে সহজ এবং আনন্দময়। মানুষ বিশ্ব বিধানের অন্তগত এক মহা জীবনের অংশ, মনুষ্যত্ব ও ভালবাসার তাই কোনো ক্ষয় নেই, মনুষ্যধর্ম ঠিক মতো বিকশিত হলে ধূলিময় পৃথিবীতেই স্বর্গরাজ্য আনা সম্ভব।
সভ্যতার সূচনাপর্ব থেকেই মানুষ জানতে চেয়েছে তার সৃষ্টির আদি রহস্য। মহাভারতের আদিপর্বের সৃষ্টিবর্ণন অংশের- সৃষ্টি তত্ত্ব থেকে যে ধারণা পাই তা কিছুটা আধুনিক বিজ্ঞানের সমার্থক বলেই বোধ হয়। আধুনিক বিজ্ঞান বলে- আদিতে বস্তুপুঞ্জ একত্রিত হয়ে একটি পিণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল। উক্ত পিণ্ডের বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে বর্তমান মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল। বহুকাল আগেই ধর্ম অনুসারে মানুষের মধ্যে কতগুলো জাতের উদ্ভব ঘটেছে—মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি। ধর্ম দিয়ে বিভক্ত হয়েছে মানুষ।রাজনীতির চক্রে আমাদের ভাগ করা হয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। আরও পরে মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা এই বাংলাদেশ পেলাম, শুরু হলো নতুন যাত্রা। দেশ পেলাম কিন্তু বিভেদ গেল না।
ইতিহাস সত্যিই বড় বিচিত্র। ভারত কেন ভাঙ্গলো? আমাদের ভারত থেকে আলাদা হওয়ার কারণটা কী ছিলো? ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যাগুলোর মূল নিহিত ১৯৪৭ সালের দেশভাগে। এই উপন্যাসে আমি, দেশ ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, আন্দোলন, আবিস্কার, রাজনীতি, প্রেম, মানব জীবন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে টুকরো টুকরো কিছু বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে।



মানুষের জীবন আসলেই খুব দুর্বোধ্য।
সত্য তো সত্যই, সোজাবাঁকা, সাদাকালো যেমন হোক তার স্বরূপ। সত্যকে সত্য বলেই প্রকাশের একটা তাগিদ বা তাড়না থাকা উচিত। জন্ম-প্রক্রিয়ায় যে লক্ষ-কোটি স্পার্ম আপনাকে পরাজিত করতে পারতো,তাদেরকে পরাস্ত করে আপনার জন্ম । সুতরাং পৃথিবীতে আপনার আসার নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। নিশ্চয়ই আপনার জীবনের কোন উদ্দেশ্য আছে!একদিন শিশুটি জন্মগ্রহণ করে একা,ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করে চারপাশ জুড়ে মা-বাবা,ভাই-বোন,আত্মীয়স্বজন,সীমাহীন ভালোবাসা নিয়ে পরম মমতায় ছোট্ট শিশুটিকে সারাক্ষণ আগলে রাখেন,শিশুটি বড় হয় আদরে,আনন্দে,স্বপ্নরা জাল বুনে প্রতিনিয়ত। একদিন দিনের শেষে মানুষ বুঝতে পারে-মানুষ একা,একদম একা। অথচ মাঝের পরিজন-পারিপার্শ্বের সাহচর্যময় মধুর সময়গুলো সত্যিই মানুষের জীবন চক্রের এক মহা মূল্যবান অধ্যায়। শেষ বয়সে মানুষ বাস করতে চায় অতীতের সুখচিন্তায়,ভবিষ্যতের কল্পনায়। বর্তমানে কেউ বাস করতে চায় না।

শশীভূষন প্রতিদিন রাতে ঘুমোবার আগে এক ঘন্টা নিয়ম করে ডায়েরী লিখেন। তিনি ডায়েরীতে প্রতিদিনকার ঘটনা লিখেন না। নিজের মতন করে লিখেন, অতীত দিনের দুঃখ-কষ্ট এবং আনন্দের কথা। শশীভূষনের একমাত্র মেয়ে অলকা স্কলারশীপ পেয়ে মাইক্রোবায়োলজি পড়তে আমেরিকা গিয়েছে। অলকা নিয়মিত তার বাবার খোঁজ খবর রাখছে চিঠির মাধ্যমে। শশীভূষন মনে করেন তার স্ত্রী অপলা বেঁচে থাকলে অলকার মতন এত নজদারী করতো না। মাঝে মাঝে তার খুব রাগ হয় মেয়ের উপর। অলকা বলে দিয়েছে, শশীভুষন যেন রাত এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম না এলেও যেন চোখ বন্ধ করে ভেড়া গুনেন। শশীভূষন ভেড়া না গুনে এলোমেলো কথা ডায়েরীতে লিখতে বসেন। একটানা লিখতে পারেন না চোখের সমস্যার কারনে, কোমরে বেশ ব্যথা। ডায়েরী লেখা বন্ধ রেখে একটু পরপর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখেন। অতোতের টুকরো টূকরো নানান রকম কথা তার মনে পড়ে।

শশীভূষনের জন্ম ভারতের আসাম রাজ্যে। সেই সময় আসামে অনেক চা বাগান ছিল। আসামের চা বাগান গুলোতে তার অনেক স্মৃতি জড়িত। তখন চা বাগানের পাশ দিয়ে সব সময় হাতী চলাচল করত। কতদিন সে নিজে একাই হাতীর পিঠে চড়েছেন। দেশ ভাগের পর অধুনা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হোন। দেশ বিভাগের পর লাখ লাখ উদ্বাস্তু মানুষ যখন দেশ ছাড়ছিল, তখন হেলিকপ্টার থেকে তা দেখে জিন্নাহ কপাল চাপড়ে বলেছিলেন, এ তিনি কী করলেন! আসাম বাংলাদেশের একেবারেই সীমান্তঘেঁষা এলাকা। আসামের বেশীর ভাগ মানুষই হিন্দু ধর্মের। সেই সময় আসামে জাতি, ধৰ্ম, বৰ্ণ নির্বিশেষে 'বিহু' নামে উৎসব পালন করতো। আসামের বাঙালি বিদ্বেষী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬০ সালে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর আসাম রাজ্যের অর্থনৈতিক সমস্যা প্রকট হতে শুরু করেছিল। পূর্ববাংলাকে দুর্বল অংশে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত দেশভাগে সম্পন্ন করেছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা। দেশ ভাগের অনেক আগে থেকেই অবিভক্ত বাংলা থেকে দলে দলে বাঙ্গালিরা আসামে যায়; সেখানে চাষবাস শুরু করে, ক্রমশ ব্যবসা আর চাকরিতে তারা অগ্রসর হয়ে ওঠে। ইংরেজ বিদায় নেয়ায় দেশভাগে আসামে বাঙালিরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। ১৮২৬ সালে প্রথম বার্মিজ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে আসাম প্রথম ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়।



শশীভূষন তার ডায়েরীতে লিখতে শুরু করলেন-
‘জাতিসত্তার প্রধান উপাদান ভাষা।
দেশবিভাগ ছিলো এমন একটি পরিণতি, যা ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছিলো অধিকাংশ মানুষকে। একই আকাশ, একই বাতাস, দু’বাংলার মানুষের ভাষাও এক। রাজনৈতিক নিপীড়নের স্বীকার হয়ে জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিরূপায় হয়ে অনেক সময় মানুষ যুগ যুগ ধরে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দেশ ভাগের সময়ে সে দেশের বড় বড় হিন্দু জমিদারেরা লক্ষ লক্ষ বর্গ একর জমি ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। তখন সেই জমির অধিকার পান দরিদ্র মুসলিম চাষিরা। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে কোনও আইন বা আন্দোলন ছাড়াই ভূমি সংস্কার হয়ে যায়। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশদের শাসনের সূত্রপাত হয় ১৭৫৭ সালে। এরপর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নানা ষড়যন্ত্র ও কৌশলে ব্রিটিশরা তাদের আধিপত্য ধরে রাখে।‘

...শশীভূষন লেখা বন্ধ করে আবার ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ালেন। কিছুক্ষন আকাশ দেখবেন বলে। আকশের দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভীষন ভালো লাগে। তার বন্ধু তাকে প্রায়ই বলতেন- সময় পেলেই আকাশ দেখবি। শশীভূষন আকাশ দেখতে থাকুক, আমরা কিছুক্ষনের জন্য অন্য দিকে নজর দেই।



১৯২৭ সাল।
বাইগার নদী এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম আছে। পুরো গ্রাম জুড়ে সুন্দর ঝকঝকে সকাল। চারিদিকে স্বচ্ছ রোদ। রোদের তাপ নেই। গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজ একটা ছোট্র ছেলে প্রথম ক্লাশ করতে এসেছে। বালকের পূর্বপুরুষদেরই গড়ে তোলা গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল। হাসি খুশি প্রানবন্ত বালকটির বয়স ছয়-সাত বছর হবে। বাবা মা আদর করে বালকটিকে খোকা বলে ডাকেন। খোকাকে স্কুলে নিয়ে এসেছে- তার বড় বোন ফাতেমা বেগম। খোকাটি হাসি মুখে ক্লাশে রুমে ঢুকে প্রথম বেঞ্চে বসল কোনো রকম সংকোচ ছাড়াই। অন্য ছেলেদের মতন সে কোনো কান্নাকাটি করল না। এই সাহসী বালকের মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। স্কুল ছুটির পর খোকা একাএকা হেঁটে বাসায় ফিরল। প্রায় সোয়া কিলোমিটার দূরত্ব। তার মেজ বোন আছিয়া বেগম ভাইকে আনতে স্কুলে যেতে চেয়েছিল- কিন্তু খোকা চিৎকার করে বলেছে- আমি একাই আসতে পারব- এতটুকু পথ। প্রতিদিন বিকেলে খোকা খুব ফুটবল খেলতেন, দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন বোনদের নিয়ে। পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি ছিল গভীর মমতা। মাছরাঙা ঢুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে তাও তিনি খেয়াল করতেন খালের পাড়ে বসে বসে। খোকার মনটা ছিল আকাশের মতো উদার। তখনকার দিনে স্কুলে তার অনেক গরিব বন্ধু ছিল যারা ভালো করে পেটপুরে খেতে পারতো না খোকা ওই শিশুদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। মাকে বলে দুধ ভাত খেতে দিতেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় খোকা স্কুলের শিক্ষক বসুরঞ্জন সেনগুপ্তের বাসায় প্রাইভেট পড়তেন। একদিন সকালে তাঁর বাড়ি থেকে পড়া শেষ করে আসার পথে এক খালি গা বালককে দেখলেন। জিজ্ঞেস করলে ছেলেটি বললো, এই শীতে তার গায়ে দেয়ার মতো কিছু নেই। সঙ্গে সঙ্গে খোকা গায়ের গেঞ্জি খুলে ওই ছেলেকে দিয়ে দেন। বাড়ি ফিরে আসেন চাদর গায়ে, আদুল গায়ে। বালকের কষ্ট সেদিন খোকা সহ্য করতে পারেননি। বয়স যখন চৌদ্দ, তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি হঠাৎ চক্ষুরোগে আক্রানত্ম হন। অনেক চিকিৎসা চলে। কিন্তু অসুখ সারে না। এ কারণে তাঁর লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর পর আবার সুস্থ হয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
এই খোকা ১৯৩৮ সনে আঠারো বছর বয়সে ফজিলাতুন্নেসা নামক এক তরুনীকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। পরে যথা সময়ে এই বালকের আরও কাহিনী বলা হবে।



এখন, শশীভূষনের মেয়ে অলকা'র কাছে যাওয়া যাক। অলকা থাকে আমেরিকার ফারগো নামক শহরে। খুবই ছোট শহর। ফারগো শহরটি ছবির মতন সুন্দর। শীতের সময় প্রচণ্ড শীত পড়ে। এলিন নামের এক বৃদ্ধার কাছ থেকে অলকা দুই রুমের একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। অলকা'র ঘরটি ছোট কিন্তু ঘুব সাজানো গুছানো। অলকা অনেক কষ্টে এই শহরকে আপন ভাবতে শিখেছে। তবে এ শহরে একাএকা ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে না। অলকারর পাশের ফ্ল্যাটে থাকে মেরি নামের একটি মেয়ে। মেরি ফারগো শহরে এসেছে চীন থেকে। অলকার সাথে সে মাইক্রোবায়োলজিতে পড়ছে। মেরি খুব মিশুক, আন্তরিক এবং হাসিখুশি টাইপ মেয়ে। সবচেয়ে বড় কথা মেরির সাহস অত্যাধিক। সেদিন ক্লাশ শেষে মেরি জোর করে অলকাকে নিয়ে গেল পার্কে। পার্কে হাঁটতে আসা এক বুড়ো মেরির বুকে হাত দেয়। অলকা প্রচন্ড অবাক হয়ে বুড়োর দিকে তাকিয়ে রইল। বুড়োর এমন ভাব করল- এটা কোনো ব্যাপার না। মেরি রেগে গিয়ে বুড়োকে দিল পেটের মধ্যে এক লাথথি। বুড়ো ছিটকে পড়ল ঘাসের উপর। মেরি বলল- আংকেল এক পা তো কবরে- একটু সাবধান হোন।



শশীভূষন ব্যালকনি থেকে এসে আবার লিখতে বসেছেন। বয়স হয়ে গেছে। লেখা ছাড়া তার আর কোনো কাজও নেই। এবার সে খুব দ্রুত লিখছেন। তার কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে- তার হাতে সময় বেশী নেই। বুকের মধ্যে অনেক কথা জমা হয়ে আছে। সে জানে তার লেখা কেউ পড়বে না এবং কোথাও ছাপা হবে না। এই জন্য সে অনেক নিশ্চিন্ত। যা খুশি তাই লেখা যাচ্ছে। কিন্তু সম্পূর্ণ লেখাটা শেষ না করে মরে গেলে, সে মরেও শান্তি পাবে না। চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে শশীভূষন লিখতে শুরু করলেন- ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে ভূমি সংস্কারের অধীনে জমিদার ব্যবস্থা রদ করা হয়। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী সহ পূর্ব বাংলার নেতারা উপলব্ধি করেন যে, বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম অধ্যুষিত এই জনপদের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য দরকার পুর্নাঙ্গ স্বাধীনতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে কলকাতার যেই সুশীল সমাজ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে ছিলেন এই বলে যে 'বঙ্গ ভাগ হয়ে যাচ্ছে'; সেই সুশীলরাই আবার ১৯৪৭ সালে বঙ্গকে ভেঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতমাতার সাথে অন্তর্ভুক্তির দাবী জানাতে থাকে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ না হলে বংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে আবির্ভূত হবার প্রশ্ন আসতো না। আমরা হয়তো আজও অখণ্ড ভারতের অধীনে থাকতাম। শশীভূষন লেখা বন্ধ করে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেছেন। বয়স হয়ে গেলে মানুষ অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েও ভাবতে খুব পছন্দ করে।



পত্রিকা হাতে নিয়ে ওমর আলী সকালবেলা বারান্দায় বসেছে। সে এখন আরাম করে পত্রিকা পড়বে এবং মগ ভর্তি করে চা খাবেন। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ওমর আলীর স্ত্রীর নাম সরলা বিবি। সরলা বিবি তার স্বামীর উপর মহা বিরক্ত। সরলা বিবি মনে করেন- তার স্বামীর মতন অলস মানুষ এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। শুধু অলস হলেও চলতো- সাংঘাতিক বোকা। সবাই জানে বোকাটাইপ পুরুষ নির্বোধ শ্রেনীর হয়। সরলা বিবির বিশাল ব্যবসা। ভারত থেকে কাসার থালা, প্লেট, মগ এনে এখানে বিক্রি করেন। তেরটা বেবী টেক্সী আছে, ভাড়া খাটে। এবং শাড়ি কাপড়ের ব্যবসা আছে। সব তার একা সামলাতে হয়। একবার সরলা ওমর আলীকে পঞ্চাশটা শাড়ি দিয়ে লক্ষ্মীবাজার আর ইসলামপুর পাঠিয়ে ছিলেন দুইজন বেপারীকে দেওয়ার জন্য। ওমর আলী বাসায় ফিরে কিছুই বলতে পারলেন না- শাড়ি কোথায় ? কাকে দিয়েছে? ওমর আলী সব ভুলে যান। শুধু ভুলেন না অতীত দিনের সৃতি। তার আছে সোনালী অতীত। সরলা বিবি এখন নিজেই সব ব্যবসা দেখাশোনা করেন। আর ওমর আলী বাসায় বসে বই-খবরের কাগজ পড়েন আর রেডিও শুনেন। এখানে একটা কথা বলে রাখতে চাই- দেশ ভাগের কারনে ওমর আলী তার পরিবারকে নিয়ে আসাম থেকে এই দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়। তখন তার বড় মেয়ে বানু’র বয়স দশ বছর আর ছোট কন্যা পুষ্প’র বয়স তিন মাস।


ওমর আলীর হাতে দৈনিক আজাদ পত্রিকা। পত্রিকার একটি খবরের দিকে তার চোখ আটকে গেল। সে তার স্ত্রীকে বলল- তাড়াতাড়ি এক কাপ চা নিয়ে এসে আমার পাশে বসো। ওমর আলী চা শেষ করে- তার স্ত্রীকে পত্রিকা পড়ে শোনাচ্ছন। সেই নিউজের কিছু অংশ আমি হুবহু তুলে দিলাম- "এই বিস্তৃত ভূখন্ডে (বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল) প্রায় ৭ কোটি ৩০ লক্ষ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। হিন্দী ভাষীর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি নয়। পূর্ববঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলার বিভিন্ন জেলায় উচ্চারণের কিছু প্রভেদ আছে বটে, কিন্তু লেখ্য বাঙ্গলার রূপ সর্বত্র একই। সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভারতের সব প্রদেশীক সাহিত্যের মধ্যে শ্রষ্ট বাংলা ভাষার বিধিক ভাব প্রকাশোপযোগী শব্দের সংখ্যা বেশি। অতএব বাংলা সবদিক দিয়াই ভারতের রাস্ট্রভাষা হইবার দাবি করিতে পারে। রাষ্ট্রভাষার আসনের উপর বাংলা ভাষার দাবি সম্বন্ধে আর একটি কথাও বিশেষভাবে জোর দিয়া বলা যাইতে পারে।‘’



ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি নয়াবস্তি এলাকায়, ছোট একটা বাচ্চা উঠানে একাএকা আপন মনে খেলছে। বাচ্চাটি নতুন হাঁটা শিখেছে। দু' পা হেঁটেই পরে যাচ্ছে আবার উঠে দাড়াচ্ছে- আবার পড়ে যাচ্ছে। উঠা আর পড়ে যাওয়ার খেলা খেলে শিশুটি বেশ মজা পাচ্ছে। এই বাচ্চাটির ডাক নাম পুতুল। দেশ ভাগের দুই বছর আগে পুতুলের জন্ম। তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে পুতুল তৃতীয়। তাদের বাবা ইস্কান্দর মজুমদার একজন ব্যবসায়ী। ইস্কান্দর মজুমদার ১৯১৯ সালে ফেনী থেকে জলপাইগুড়ি যান। পুতুলের স্কুল জীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুরের মিশন স্কুলে। এরপর দিনাজপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই অস্টম শ্রেনী পাশ করেন ।
১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে পুতুলের বিয়ে হয়- কমল নামের এক হাসি খুশি তরুনের সাথে। পুতুলের বয়স তখন সতের বছর বয়স। জিয়াউর রহমানের ডাক নাম কমল। জিয়া তখন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডিএফআই এর অফিসার হিসাবে তখন দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর পিতা কলকাতা শহরে এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে অতিবাহিত হয়। জিয়াউর রহমান পশ্চিম জার্মানি থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে দেশে ফিরে আসার পর তাকে (তদানীন্তন মেজর) অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয়-অধিনায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। স্বভাবতই জনসাধারণের কাছে জিয়াউর রহমান নামটি অপরিচিত ছিল। কিন্তু তিনি একজন তাৎক্ষণিক জাতীয় ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হলেন যখন তিনি ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। তাঁর ঘোষণাটি ছিল: ‘‘আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক, এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
‘‘আমি আরও ঘোষণা করছি, আমরা ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও বৈধ সরকার গঠন করেছি। এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন এবং শাসনতন্ত্র মেনে চলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ সরকার সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বের প্রত্যাশী এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য চেষ্টা করবে। আমি সকল সরকারের কাছে আবেদন করছি তারা যেন বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের নিজ নিজ দেশে জনমত গড়ে তোলেন।
‘‘শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে গঠিত সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌম ও বৈধ সরকার এবং এই সরকার পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতি লাভের অধিকার সংরক্ষণ করে।’’

(এখানে একটা কথা উল্লেখ করতে চাই, বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে যোগ দেবার পর থেকে মোট চার বার বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতার হন। সর্বশেষ তিনি ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে তার ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।)






১৯৪৭ সালটা সমস্ত বাঙ্গালীর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতীয় উপমহাদেশ ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত, বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) সিলন (বর্তমান শ্রীলংকা) এবং পাকিস্তান (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ) এই চারটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশবিভাগের বছর শেখ মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময়ে কলকাতায় ভয়ানক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। এসময় মুজিব মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।

কন্যার নাম নূরী। তিন বছর বয়স। সে নতুন হাঁটতে শিখেছে। ঘরে থাকতে চায় না। সারা উঠান হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে হামাগুড়ি দেয়। তার মা তাকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারে না। কোলে নিলেও জোর করে নেমে যায়। এক শীতের সকালে নূরী প্রতিদিনকার মতোন উঠানে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। আপন মনে খেলা করছিল। মা রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। নূরী একা একা খেলতে-খেলতে হঠাত পা পিছলে পুকুরে পরে যায়। ছোট্র নুরী পুকুরে পড়ে গিয়ে পারে উঠে আসার জন্য দাপাদাপি করে। দাপাদাপি করতে করতে নূরী মাঝপুকুরে চলে যায়। রান্না ঘর থেকে নূরীর মা দেখতে পান উঠানে নুরী নেই। অথচ মাত্র’ই তো ছিলো। কই গেলো নূরী। রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসেন নূরীর মা। এসে দেখেন তার মেয়ে মাঝপুকুরে ভেসে আছেন। সাথে সাথে তিনি পুকুরে ঝাঁপ দেন। এবং নূরীকে বুকে টেনে নেন। মরতে মরতে অল্পের জন্য বেঁচে যায় নূরী। নুরীর জন্ম হয়েছিল পৃথিবীতে পিছিয়ে পড়া এবং আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগা নারীদের পথ দেখাতে। আসুন এই নূরী সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।

দেশভাগের সময় সাপ্তাহিক ‘বেগম পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়।
বেগম পত্রিকা’র হাত ধরেই এদেশে প্রথম ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয়। ঈদ সংখ্যা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হতো। ‘বেগম’ পত্রিকাটি বহু নারীকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছে। নারীকে সবল ও সাহসী করার লক্ষ্যে বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। নূরজাহান বেগমের পিতা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, ছিলেন ‘বেগম’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র মেয়ে নূরজাহান বেগম। ডাক নাম নূরী। ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ‘বেগম’ পত্রিকার নূরজাহান বেগম। নূরজাহান বেগমের শৈশব কাটে গ্রামের বাড়িতে মা, মামা,দাদী,নানীর সঙ্গে। বেগম পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই যখন নূরজাহান বেগম বিএ শ্রেণীতে পড়তেন। ‘বেগম’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। পিতা এবং কন্যা সমাজে নারীদের অগ্রগতি যেভাবে চিন্তা করতেন,ঠিক সে বিষয়গুলো বেগম পত্রিকায় প্রতিফলিত হতো। পাশাপাশি নারীদের গৃহকর্মের কথা,ছবি এবং তাদের নানা সমস্যার কথা প্রকাশিত হতো। নারীদের ছবি আঁকতে, লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন নূরজাহান বেগম। বেগম পত্রিকা শুধু নারীদের উদ্দেশ্য করেই গোড়াপত্তন হলেও এর পাঠক শুধু নারীরাই ছিলেন না। ধীরে ধীরে এই পত্রিকা পুরুষদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। নূরজাহান বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) কে। প্রায় ৬৩ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকা। যদিও অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল পত্রিকাটা নিয়ে কিন্তু বেগম-এর উদ্দেশ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। নারী জাগরণ, নতুন নারী লেখক সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীকে উৎসাহী করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বেগম-এর প্রথম দিকে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাঁরা লেখা, ছবি সংগ্রহ করেতেন। আজ নারীরা নিজেই লেখা পাঠিয়ে দেন। ('ধাবমান কালো চোখে আলো নাচে' উপন্যাসে এই রকম অনেক জ্ঞানী গুনীদের কথা আসবে।)

ইদানিং রাতে শশীভূষনের একেবারেই ঘুম আসে না। স্ত্রীও বেঁচে নেই যে রাত জেগে গল্প করবেন। অপলা’র এত তাড়াতাড়ি মরে যাওয়া ঠিক হয়নি। তার স্ত্রী অপলা ছিল তার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু। যে বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। ইচ্ছা করলে কান্নাও করা যায়। এখন সে বড্ড একা। একমাত্র মেয়ে অলকা সেও লেখা পড়তে করতে চলে গেলো দেশের বাইরে। এখন মধ্যে রাত্রে চা খেতে ইচ্ছা করলেও বানিয়ে দেবার কেউ নেই। তিনি চা বানাতে পারেন না। অনেক বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। দিনের বেলা এদিক সেদিক যাওয়া যায়। এ পাড়ায় একটা লাইব্রেরী আছে, সেখানে বই নিয়ে বসলে সময় কিভাবে চলে যায় টের পাওয়া যায় না। রাতটা পার করাই বড্ড মুশকিল। রাতের বেলা কোথাও যাওয়া যায় না। সময় তো পার করতে হবে তাই শশীভূষন ক্লান্তিহীন ভাবে তার ডায়েরীতে লিখে চলেছেন- ‘ভারতের মানুষ সহজেই বুক বাজিয়ে বলতে পারতেন তাঁদের ইতিহাসও মিশর, ইউনান আর চীনের সভ্যতার মতোই হাজার হাজার বছরের পুরনো। সমস্ত পৃথিবী জুড়েই দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে মানুষ। তাদের একটি দল হচ্ছে শাসক শ্রেণী, অন্যটি শোষিত শ্রেণী। পৃথিবীর আদিতে এই সব শ্রেণী বিভাজ্যতা ছিল না। কারণ তখন রাজা প্রজার ভেদ বুঝতে পারতো না মানুষ। পশ্চিমা দেশগুলো সভ্যতার সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। অন্ত পাঁচহাজার বছর আগে থেকে শুরু করতে পেরেছিল তারা। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করতে যাওয়া বাঙালি ১৯৪৭ সালে কাজে পরিণত করার মতো পরস্পরবিরোধী কাজে লিপ্ত হতে পেরেছিল। আগেরবার বৃটিশ রাজ সেটা করতে চেয়ে এদের বিরোধিতায় সেটা পারেনি পরের বার বৃটিশদের হাতে-পায়ে ধরে সেটা করে এরা। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন নিপীড়িত মেজরিটি বাঙ্গালীদের একটু সুবিধা দিতে চেয়ে বঙ্গভঙ্গ করেন। কিন্তু সংখ্যালঘু বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে দারুণ আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনে কিছু জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা যে ছিলেন না তা নয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে দিল্লীর দরবারে এটা বাতিল ঘোষিত হয়। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলি জনসংখ্যায় ভারসাম্য ছিল ঠিকই, কিন্তু লেখাপড়ায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এরা মুসলমানদের চাইতে কয়েক যোজন এগিয়ে ছিল যা একশ' বছরের মধ্যেও অক্ষুণ্ণ থাকতো। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন অবসান করে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগ হয়ে ১৪ আগষ্ট পাকিস্থান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও ১৫ আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভ।‘

শশীভূষনের লেখা থামালেন। এখন তার মধ্যে কবিতা লেখার ভাব এসেছে।কলেজে পড়ার সময় তিনি প্রচুর কবিতা লিখতেন।পত্রিকাতে তার কবিতা ছাপানো হতো।তার কবিতার মুগ্ধ পাঠক ছিলেন অপলা, তার স্ত্রী। অবশ্য সেসব কবিতা তিনি জমা করে রাখেন নি। যদি কবিতা গুলো জমা করে রাখতেন তাহলে হাজার খানেক কবিতা হতো।শশীভূষন ব্যলকনিতে গিয়ে কিছুক্ষন রাতের আকশের দিকে তাকালেন তারপর তিনি কবিতা লিখতে শুরু করলেন।

‘’অদৃশ্য কুয়াশায় দেখা যায় না ইষ্টিশন মাস্টারের ঘর
ওয়েটিং রুমে বসে চোখে ভাসে তোমার কপালের টিপ
তুমি তো জানো- আমি আমার ইচ্ছা মতো লিখি
যেখানে ইচ্ছা কমা বসাই, , যেখানে ইচ্ছা দাড়ি দেই ।।
বাড়িয়ে রাখো তোমার হাত- সময় মতো ধরে নিবো । ‘’

এতটুকু লিখে কবিতা আর এগোয় না। শিশীভূষন মাথা চুলকায়। না নতুন কোনো শাব্দ আসছে না। অথচ তিনি নিজের কাছে জিদ ধরে বসে আছেন কবিতাটা শেষ না করে ঘুমাতে যাবেন না।

জওহরলাল নেহরু কে কারাবাস করতে হয় দীর্ঘদিন। কারাবাসের দিনগুলো তাঁর নিজের জন্য খুব কষ্টের এবং বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল ঠিকই, তবে ওই অসহ বন্দী জীবনে থেকেই তিনি রচনা করেন গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বই। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ ওই তিন দারুণ গ্রন্থেরই একটি। আহমদনগর দুর্গের কারাশিবিরে বন্দি জীবনযাপনকালীন সময়ে লেখা এই গ্রন্থ ইতিহাসচর্চার পৃথিবীতে নতুনরকম আলোকপাত করে। আত্নজীবনীর মতো নিঃসঙ্কোচে কথনে পূর্ণ এই বই কথা সাহিত্যের মতো আকর্ষণীয় ও স্বাদু। বইটি দিনলিপি আকারে রচিত, যে দিনলিপিগুলি ধারণ করে আছে জওহরলালের ভারতচিন্তা ও ইতিহাস ভাবনা। শুধু ইতিহাস রচনাতেই লেখক সীমাবদ্ধ থাকেননি, নিজের ব্যক্তিগত জীবনকেও নানা আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। স্ত্রী কমলা ও প্রিয় কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর বর্ণনা উঠে এসেছে বারংবার, স্ত্রীর অসুস্থতা ও মৃত্যুর সময়গুলোর দিনলিপি বর্ণনা করেছেন নিপুণতার সাথে। মহাভারত, গীতা ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের নানা দিক উল্লেখিত হয়েছে বইটিতে। বইয়ের শেষ দিকে আলোচিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতবর্ষের রাজনীতি ক্ষেত্রে তার প্রভাব। বইটি শুরু হয়েছে তাঁর কারাজীবন ও ব্যক্তিজীবন দিয়ে। জওহরলাল নেহরু অসাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন, তাই কোন দল, মত বা ধর্মের প্রতি পক্ষপাত, অনুরাগ বা বিরাগ দেখা যায়নি তাঁর রচনায়, সূক্ষ্ম তুলাদণ্ডে ভালো মন্দের বিচার করেছেন তিনি। এমনকি নিজ মতাদর্শের বিরোধী কাউকে, যেমন: মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কারো সম্পর্কেই বিষোদগার বা ব্যক্তি আক্রমণ করেননি তিনি। এতটাই সততার পরিচয় দিয়েছেন যে তিনি রচনায় মহাত্মা গান্ধীর কিছু নীতির সমালোচনা করতেও কুণ্ঠিত হননি!

ওমর আলীর হাতে পন্ডিত নেহেরু ‘ডিস্কভারি অব ইন্ডিয়া' বইটি। তিনি ৩১৪ পৃষ্ঠাটি খুব মন দিয়ে পড়ছেন। ৩১৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, ''অন্যান্য অঞ্চলে বৃটিশ শাসন ছড়িয়ে পড়ার আগে বাঙালিরা একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করে পঞ্চাশ বছর ধরে। এ কারণেই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষাংশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বৃটিশ ভারতে ঔদ্ধত্যব্যঞ্জক ও প্রধান ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। সে সময় বাংলা শুধু বৃটিশ শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল না, এদের মধ্য থেকেই প্রথম ইংরেজি শিক্ষিত দলটি বের হয় এবং বৃটিশ ছত্রছায়ায় ভারতের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা বৃটিশ শাসনকে মেনে নেয়, বশ্যতা স্বীকার করে এবং এতে অভ্যস্ত হয় ভারতের বাকি অংশের অনেক পূর্বেই।''

ওমর আলী মনে করেন, ভারতকে বুঝতে হলে এই বইটি অবর্শ পাঠ করতে হবে। ইতিহাস ব্যাপারটা যে এতো চমৎকারভাবে, ব্যতিক্রমী দৃষ্টিতে উপস্থাপন করা যায় তা এ বইটি না পড়লে জানা হতো না। ওমর আলী হচ্ছেন আমার নানা। তিনি খুবই সহজ সরল একজন মানুষ। আমৃত্যু নানান বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করে গেছেন। আমার যখন দুই বছর বয়স, তখন নানা মারা যান। মা’র কাছ থেকে নানার অনেক গল্প শুনেছি। সেই গল্পের কিছু কিছু অংশ এই উপন্যাসে আসবে।

জওহরলাল নেহ্‌রু সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। গঙ্গা নদীর তীরে এলাহাবাদ শহরে জওহরলাল নেহেরু জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৯ সালে। গান্ধীর দর্শন ও নেতৃত্ব জওহরলাল নেহেরুকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। মহাত্মা গান্ধীর প্রভাবে নেহেরু পরিবার তাদের ভোগ-বিলাসের জীবন ত্যাগ করেন। তখন থেকে নেহেরু খাদির তৈরি কাপড় পড়তেন। ব্যক্তিজীবনে রূচিবান পুরুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন জওহরলাল নেহ্‌রু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আদর্শবাদী, পন্ডিত এবং কূটনীতিবিদ নেহেরু। তিনি মোট পাঁচবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। বৃটিশ সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদান করায় তিনি বহুবার কারারুদ্ধ হন এবং প্রায় ১৭ বছর জেল খাটেন। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে তিনি প্রথম সে-দেশের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। ১৯৬৪ সালের ২৭ মে ভারতের এই মহান নেতা তার নিজ কার্যালয়ে মৃত্যু বরণ করেন। জওহরলাল নেহেরু ও তার দুই বোন বিজয়া লক্ষ্মী ও কৃষ্ণা "আনন্দ ভবন" নামক বিশাল বাড়িতে পশ্চাত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হযে উঠেন। তৎকালীন ভারতের সব থেকে আধুনিক স্কুলে পড়ার পর প্রায় ১৫ বছর বয়সে নেহেরু ইংল্যান্ডের হ্যারোতে চলে যান। এরপর তিনি কেমব্রীজেই ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন। ইংল্যান্ডে পড়ার সময় নেহেরু ভারতীয় ছাত্র সংসদের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।

তাঁর শাসনামলে ভারতে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়। এই সময়ে একটি ভারত-পাকিস্তান ও একটি ভারত-চীন যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ভারত-পাকিস্তানের শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি করেন। লেখক হিসেবেও নেহরু বিশেষ দক্ষ ছিলেন। জওহরলাল নেহেরুও একজন রাজনীতিবীদ সুতরাং তার পক্ষে বিপক্ষে মন্তব্য থাকবে, কেউ শ্রদ্ধা আবার কেউ নিন্দাও জানাবে তাকে এটা অস্বাভাবিক নয়। জওহরলাল নেহ্‌রু'র সাথে বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ এর সাথে খুব মিল আছে, বলুন তো দেখি আমি কার কথা বলছি?

সকাল ৭ টা। হাজী শারাফত আলীর ছেলে মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। তার ভাই বোনদের কথা মনে পড়লেই তিনি আকাশের দিকে তাকান। ছোটবেলা থেকেই তিনি জানেন- তার বাবা-মা, ভাই বোন ওই আকাশেই থাকেন। তার পরিবারের সবাই তাকে আদর করে চেগা মিয়া বলে ডাকতেন। বাবা-মা মরে যাবার পর চেগা মিয়া চাচা ইবরাহিম এর কাছে চলে যান। চেগা মিয়া অসহযোগ আন্দোলন করে প্রায় এক বছর জেল খাটলেন। ১৯২৫ সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন মহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। স্ত্রীর সাথে চেগা মিয়ার দিনের পর দিন দেখা হয়, কথা হয় না। আসলে যারা মানুষকে ভালোবাসেন তারা নিজের ঘর সংসারের কথা খুব একটা মনে পড়ে না। দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তারা নিজেদের উৎসর্গ করে দেন।

চেগা মিয়া তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি যেখানেই যেতেন- একদল মানুষ তাকে সব সময় ঘিরে থাকত। ঘিরে থাকা মানুষ গুলো চেগা মিয়াকে অসম্ভব ভালোবাসেন। সবাই ভালোবেসে চেগা মিয়াকে ডাকত- লাল মাওলানা নামে। অনেকে লাল মাওলানার কাছ থেকে পানি পড়া নিতে আসতো। চেগা মিয়া অর্থাৎ লাল মাওলানা এক আকাশ আগ্রহ নিয়ে কিছুক্ষন বিড়বিড় করে পানিতে ফু দিতেন। সেই পানি পড়া খেয়ে নাকি অনেকেই উপকার পেতেন। দূরদুরান্ত থেকে গ্রামের সহজ সরল মানুষ তার কাছে পানি পড়া নিতে আসেন। তার সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি আর সূফি চেহারার কারনে- খুব সহজেই তিনি মানুষের মনে স্থান পেতেন। একদিন এক স্কুল শিক্ষক তার কাছে এসে বললেন- আপনি একজন অদ্ভুত মানুষ! এই সমাজে আপনার মতো মানুষ আমাদের খুব বেশি দরকার। মাওলানা শিক্ষককে বললেন, পৃথিবীর মজলুম মানুষ সবাই এক, তারা যেখানেই বাস করুক। শিক্ষক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি মনে করি একজন মুজিব আর একজন ভাসানীর মাঝে বড় পার্থক্য রয়েছে, আপনার রাজনৈতিক গ্রুমিংটা হয়েছে অনেকটাই একক ভাবে, আসামের জঙ্গলে। একারণে একদিকে আপনি চীনের লাল মাওলানা, অন্যদিকে আপনি মুরিদদের পানি পড়াও দিচ্ছেন, এমন জটিলভাবে চলেছে আপনার রাজনৈতিক দর্শন।

১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে লাল মাওলানা কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। তারপর থেকে তার নাম রাখা হয় 'মাওলানা ভাসানী'। কিন্তু বাঙ্গালীদের কাছে তিনি 'মজলুম জননেতা' নামে বেশি পরিচিত। মজলুম নেতার পুরো নাম আবদুল হামিদ খান ভাসানী। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এর ভাষণ শুনে ভাসানী রাজনীতিতে অণুপ্রাণিত হন। 'বাঙ্গাল খেদাও' আন্দোলনে বাঙ্গালীদের সাহায্য করার জন্য তিনি বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান এবং গ্রেফতার হোন। গ্রেফতার হওয়ার পর অনেক শিক্ষিত বাঙ্গালীকে বলতে শোনা গেছে- ভাসানী রাজনীতি বহুলাংশেই উদ্ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিমুলক। কিছু দুষ্টলোক সব জাগায়ই থাকে। তাদের কাজই হচ্ছে সংঘাত তৈরি করা।

বাঙ্গালীদের অপমান করে এক প্রকার গলা ধাক্কা দিয়ে আসাম থেকে বের করে দিচ্ছে- এই ব্যাপারটা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না, তাই তিনি মাও সে তুং থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রসিডেন্ট সহ অনেক কাছে চিঠি লিখে সহযোগিতা চাইলেন। দুঃখজনক ব্যাপার হলো কেউই তখন সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন না।

আসামের কারাগারে ভাসানী সাহেবকে দেখতে যান ওমর আলী। কিন্তু ওমর আলীকে ভাসানীর সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। ওমর আলী করুন গলায় ডিউটি অফিসারকে বললেন, আমার স্ত্রী সরলা বিবির দুই ভরি গহনা আপনি নিয়ে যান- তবু ভাসানীর সাথে একবার দেখা করতে দেন। ডিউটি অফিসার নারায়ন চন্দ্র দুই ভরি গহনা রেখে দিয়ে ওমর আলীকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। আর বললেন, ভাগো হিয়াসে। তোম বাঙ্গালী হো। ওমর আলী তখনও জানতেন না, চিরদিনের জন্য আসাম ছেড়ে চলে যাবেন এই শর্তে ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে মাওলানা ভাসানীকে মুক্তি দেয়া হবে।
ওমর আলীর মনে করেন ভাসানী সাহেব একজন শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী। বিতর্কের উর্ধে একজন মানুষ। যিনি দেশের স্বার্থে কাজ করবেন। তাই তাকে প্রতিটা বাঙ্গালী এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে মনে রাখবে চিরজীবন। ক্ষমতাবিমুখ রাজনীতির এক মহান পুরুষ ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তার সমতুল্য আর কে আছে? ওমর আলী চোখের পানি মুছে মনে মনে এক মহান সত্য ভাবলেন- মওলানা ভাসানীকে বাদ দিয়ে ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়।

ওমর আলী আগামীকাল সকালে স্ত্রীকে নিয়ে আসাম ছেড়ে চলে যাবেন। স্ত্রীর গর্ভে তার প্রথম সন্তান। আসাম ছেড়ে চলে যেতে দুঃখে তার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। এখানে তিনি এবং তার স্ত্রী সরলা ভালোই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশের হর্তা-কর্তারা নির্বোধ হলে দুঃখের আর শেষ থাকে না। আজ ওমর আলীর ভাসানীর একটা কথা খুব বেশি মনে পড়ছে- আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।





১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রচন্ড শীতে এক বালক রাস্তা দিয়ে একাএকা হাঁটছে। বালক জানে না তার বাবা কে, মা কে ? ক্ষুধা পেলে একটা খাবার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কেউ কেউ তাকে- ফেলে দেওয়া খাবার খেতে দেয়। বালকটি মানুষের নষ্ট করা খাবার এক আকাশ আনন্দ নিয়ে রাস্তার পাশে বসে খায়। খাওয়ার সময় বালকটিকে অনেক আনন্দিত দেখা যায়। বালকটির কোনো নাম নেই। যে বালকের বাপ মায়ের ঠিক নাই- ঘটা করে কে আবার সেই বালকের নাম রাখবে? তাই আমি লেখার খাতিরে বালকটিকে একটি নাম দিলাম, টারজান। টারজান নাম দেওয়ার পেছনে কারন হলো- সে খুব সহজেই যে কোনো গাছে লাফ দিয়ে উঠতে পারে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে যেতে পারে। এই কাজটি করতে তার কোনো ভয় হয় না। দেশ ভাগ হয়ে গেল, ইংরেজরা বিদায় নিলো- টারজান তার কিছুই জানল না, বুঝল না। টারজান এর সব চিন্তা- শুধু তিনবেলা খাবার সংগ্রহে। ইদানিং টারজানের সাথে একটা কালো রঙের কুকুর যুক্ত হয়েছে। ছোট বাচ্চা একটা কুকুর। টারজান বাচ্চা কুকুরটার নাম রেখেছে কাল্লু। কুকুরটা দেখতে কুচকুচে কালো রঙের, তাই নাম রাখা হয়েছে কাল্লু। কাল্লু সারাদিন টারজানের পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করে। কাল্লুর উপর মায়া পড়ে গেছে টারজানের। টারজান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে- কাল্লুকে সে পালবে। অনেক বড় করবে। এই কাল্লু একটু বড় হওয়ার পর- সহজ সরল মানুষ 'ওমর আলী' নামে একজনকে কামড় দেয়, টারজান এবং কাল্লুর কাহিনী পরে বিস্তারিত বলা হবে।

সারাদিন একটানা দুশ্চিন্তায় মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষসমূহে এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ জমা হয়। শুধু দুশ্চিন্তা নয়, নিত্যদিনের যে কাজগুলো মানুষকে করতে হয় তা সুন্দরভাবে সমাধা করতে বহু কিছু চিন্তা করতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয়। রাতের বেলায় সুনিদ্রার তাৎপর্য নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে।... টাইমস অব ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনে মানুষের মস্তিস্ক নিয়ে একটা আর্টিকেল ছাপিয়েছে। অলকা খুব মন দিয়ে আর্টিকেলটি দুইবার পড়ল । এই ধরনের আর্টিকেল তার বাবা শশীভূষন খুব পছন্দ করেন। যে কোনো বিষয়ের উপর বই পড়তে শশীভূষন অনেক আনন্দ পান। নতুন নতুন বিষয় জেনে শশীভুষন প্রচন্ড অবাক হোন। অলকার ধারনা তার বাবা পৃথিবীর এমন কোনো বিষয় নেই- যা তিনি জানেন না। দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনটি সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। উদার মতাদর্শ নিয়ে ১৮৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকার সদর দফতর ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে। বৃটিশ শাসনামলে ১৮৩৮ সালের ৩ নভেম্বর বোম্বাই টাইমস হিসেবে প্রথমে এই পত্রিকা আত্বপ্রকাশ করে। প্রথমে প্রতি শনি ও বুধবার অর্ধ সাপ্তাহিক হিসেবে বের হতো। রায় বাহাদুর নারায়ণ দিনান্ত বেলকার পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা। তখন বৃটেনের সংবাদ বেশি গুরুত্ব পেতো। ১৮৬১ সালে বোম্বে টাইমস থেকে পরিবর্তন হয়ে নামকরণ করা হয় ইন্ডিয়ান টাইমস। ভারত স্বাধীনতার পর পত্রিকাটির মালিকানা লাভ করে ডালিয়াস শিল্পগোষ্ঠী। পরে এটি জৈন গ্রুপ মালিকানা লাভ করে। পরবর্তীতে এরপর নামকরণ করা হয় টাইমস অব ইন্ডিয়া। সহজ ও সাবলীল শব্দচয়ন ও অনলাইন সংস্করণে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল সংবাদের কারণে ভারতের উচ্চ ও মধ্য শিক্ষিত ইংরেজি জানা ব্যক্তিদের মাঝে পত্রিকাটির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।

জার্মানির একটি ছোট শহর ‘উলমে’ এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে একজন মহান বিজ্ঞানীর জন্ম হয়। বিজ্ঞানীর নাম আইনইস্টান। সহজ সরল একজন মানুষ। তার বিরুদ্ধে স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে মাঝে মাঝেই অভিযোগ আসত পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া ছেলে, অমনোযোগী, আনমনা। ক্লাসের কেউ তার সঙ্গী ছিল না। সকলের শেষে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসতেন। তাঁর পিতা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। মাঝে মাঝেই ছেলেকে নানা খেলনা এনে দিতেন। শিশু আইনস্টাইন এর বিচিত্র চরিত্রকে সেইদিন উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি তার অভিভাবক, তার শিক্ষকদের। দর্শনের বই তাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করত। পনেরো বছর বয়সের মধ্যে তিনি কান্ট, স্পিনোজা, ইউক্লিড, নিউটনের রচনা পড়ে শেষ করে ফেললেন। বিজ্ঞান, দর্শনের সাথে পড়তেন গ্যেটে, শিলার, শেক্সপিয়ার। অবসর সময়ে বেহালায় বিটোফোন, মোতসার্টের সুর তুলতেন। এই মহান বিজ্ঞানী বাইশ বছর বয়সে মিলেভা নামের এক হাসিখুশি তরুনীকে বিয়ে করে ফেলেন। একদিন গভীর রাতে মিলেভা ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার স্বামী পাশে নেই। মিলেভা বিছানা থেকে নেমে দেখেন- তার স্বামী ব্যালকনিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। মিলেভা এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে আস্তে করে স্বামীর পিঠে হাত রাখেন। স্বামী ফিস ফিস করে বললেন- ‘আমি এই বিশ্বপ্রকৃতির স্থান ও সময় নিয়ে গবেষণা করছি।’

আইনস্টাইনের এই গবেষণায় ছিল না কোনো ল্যাবরেটরি, ছিল না কোনো যন্ত্রপাতি। তার একমাত্র অবলম্বন ছিল খাতা-কলম আর তার অসাধারণ চিন্তাশক্তি। অবশেষে শেষ হলো তার গবেষণা। তখন তার বয়স মাত্র ২৬ বছর। একদিন ত্রিশ পাতার একটি প্রবন্ধ নিয়ে হাজির হলেন বার্লিনের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক পত্রিকা Annalen der physik-এর অফিসে।

আইনস্টাইন নিজের সম্পর্কে নিজেই বলেছেন,, ‘আমি খুব সুখী। কারণ, কারও কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। আমার টাকার প্রয়োজন নেই। পদক, খেতাব, উপাধি—আমার কাছে এসবের কোনো মানেই নেই। আমি প্রশংসার জন্যও লালায়িত নই। আমার নিজের কাজ ছাড়া একটি মাত্র বিষয় আমাকে আনন্দ দেয়, তা হচ্ছে আমার বেহালা।’



১৮৭৬ সালে করাচিতে এক দুষ্ট বালকের জন্ম হয়। এবং ৭৬ বছর বয়সে দীর্ঘদিন যক্ষা রোগে ভূগে- দেশ ভাগের পরের বছর মারা যান। এই দুষ্ট বালক’ই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। নাম তার মুহাম্মদ আলি জিন্না। পাকিস্তানের লোকজন তাকে কায়েদে আযম বা মহান নেতা হিসেবে সম্মান করে। তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করে মাথায় সব সময় টুপি পড়ে থাকতেন, পরে এই টুপি জিন্না টুপি নামে পরিচিতি পায়। পাকিস্তানের জাতির পিতা ‘কায়েদে আযম’ এর প্রতি দেশটির জনগণের রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা। দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালত, হাসপাতাল, স্কুল কলেজ সবখানেই পাওয়া যাবে তার ছবি। মুসলিম দেশ হলেও এতে কোন কার্পণ্য রাখেনি পাকিস্তানিরা।

লন্ডন থেকে লেখাপড়া শেষ করে জিন্না সাহেব বোম্বেতে এসে আইনপেশা শুরু করেন। সে সময় সারা বোম্বেতে তিনি একাই ছিলেন- মুসলিম ব্যারিস্টার। তার ভাগ্য ভালো ছিল। ১৯০৭ সালের মধ্যে তিনি একজন দক্ষ আইনজীবি হিসেবে খ্যাতি পেয়ে যান। অনেকেই মনে করেন- খ্যাতি পাওয়ার প্রধান কারণ হলো- নিজের উপর তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। একবার ইংলন্ডে আইন পড়াকালীন সময়ে তিনি মনস্থিরও করে ফেলেছিলেন রসকষহীন আইন পাঠ ছেড়ে একটি শেক্সপেরিয়ান নাট্যদলের সাথে যুক্ত হয়ে নাট্যমঞ্চে অভিনয় শুরু করবেন।

মুলত ১৮৯৬ সালে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে মুহাম্মদ আলী জিন্নার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তিনি জন্ম দিয়েছিলেন দ্বিজাতি তত্ত্বের, যে তত্ত্ব কেবল ধর্মকে সম্বল করে হাজার মাইলের ব্যবধানে জন্ম দিয়েছিল একটি রাষ্ট্রের। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজের রাজনৈতিক জীবনে কখনোই এক চিন্তাচেতনা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাননি। ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে পরিপূর্ণ সফল মানুষ কোনোভাবেই বলা যায় না। তিনি সাংসারিক জীবনে সাফল্যের মুখ দেখেননি। ভালোবেসে বিয়ে করে তিনি তাঁর স্ত্রীকে অবহেলা করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী একপর্যায়ে তাঁর থেকে আলাদা হয়ে যান। রোগে ভুগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন অপরিণত বয়সে। সেই স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানও যে বাবার দৃঢ় অনুসারী ছিল। এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

প্রথমবার মাত্র ১৫ বছর বয়সে জিন্নাহ বিয়ে করেছিলেন মায়ের চাপে পড়ে। কনের নাম ছিল এমি বাঈ। পরে ১৯১৮ সালে তিনি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন পার্সি সম্প্রদায়ের মেয়ে রতন বাঈকে। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়ার ‘ক্ষোভে’ তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক রাখেননি। মায়ের কনের সঙ্গে তিনি থাকেন নি, মৃত্যুর সময়ও তাঁর গর্ভধারিণী মা জিন্নাহকে পাশে পাননি। জিন্নাহ সাহেব অবশ্যই শিয়া মুসলমান ঘরে জন্ম নেন। এবং কোনোদিন কোনো ধর্ম পালন করেননি। তার স্ত্রীও মুসলমান ছিলেন না। তিনি নামাজ পড়তেন না। মদ ও শুয়োরের মাংস নিয়মিত খেতেন। কিন্তু মাথায় থাকত তার প্রিয় টুপি।

জিন্না সাহেবের ছোট বোন ফাতেমা জিন্না- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দন্ত চিকিৎসায় ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি তার বড় ভাই মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর সহকর্মী ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। ফাতেমা জিন্নাহ ১৯২৩ সালে বোম্বেতে একটি ডেন্টাল ক্লিনিক চালু করেন। আজও পাকিস্তানে তাকে ভাইয়ের সহকর্মী হিসেবে তাকে সম্মান করা হয়। ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।
(ফাতেমা জিন্নাহ তার ভাই মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর উপর একটি অসমাপ্ত জীবনী লিখেছেন। এটি ১৯৮৭ সালে কায়েদে আজম একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।)

১৯৪৭ সালে মুসলমানরা পেয়েছে পাকিস্তান আর হিন্দুরা পেয়েছে ইন্ডিয়া। স্বাধীনতা সহজে পাওয়া যায়, কিন্তু শাসন পরিচালনা করা, গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রবর্তন করার জন্য প্রয়োজন হয় জ্ঞানের এবং এই জ্ঞান সহজ লভ্য নয়। এক একজন মানুষ এক একরকম ভাবে। তবে প্রত্যেকেই, মনে হয়, একটা জায়গায় একই রকম ভাবে। তা হল, দেশভাগ না হলেই ভাল হত। জিন্নাহ যে উপমহাদেশের রাজনীতিতে ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছেন, তার একটা বড় কারণ তার রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিটাই ছিল দুর্বল। নিজে ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষিত অসাম্প্রদায়িকমনা মানুষ। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন এবং সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির অনুসারী ছিলেন। জিন্না দক্ষিন এশিয়ার সম্ভবত সব থেকে জটিল রাজনৈতিক চরিত্র।

মানুষকে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, দেশ, জাতীয়তা, লিঙ্গ, ভাষা ইত্যাদি অনেক কিছু দিয়ে বিভাজিত করা যায়। ধুর্ত কিছু মানুষ এই বিভাজন থেকে সবসময়ই ফায়দা লুটার চেষ্টা করে। সময়-সুযোগে পুরুষ-নারী, জমিদার-প্রজা,আসামি-বাঙালি, ইরাকি-কুর্দি সব ধর্মের-দেশের-লিঙ্গের-জাতির-গোত্রের-ভাষার একদল মানুষ অপর একদল মানুষের কাছে নির্যাতিত হচ্ছে বা নির্যাতন করছে। এভাবে মানুষকে যতদিন না স্বার্থের কারণে বিভাজন বন্ধ হচ্ছে, যতদিন না আইনে-শাসনে-রাজনীতিতে-অর্থনীতিতে-সামাজিকতায় মানবিক পরিচয়টি প্রাথমিক বিবেচ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এ ধরনের হানাহানি বন্ধ করা যাবে না।

১৯৪৮এ মহম্মদ আলি জিন্না ঢাকার মাটিতে দাঁড়িয়েই, বাঙ্গালির ভাষা পরিচয় ও সাংস্কৃতিক অভিমানকে কিছুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে ঘোষণা করে দিলেন ‘উর্দু এবং শুধু মাত্র উর্দুই’ হবে পাকিস্তানের একমাত্র সরকারী ভাষা। বলা বাহুল্য ঐদিনই মহম্মদ আলি জিন্না তার সাধের পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ ও একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখার বীজ পুঁতে দিলেন। তাই ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিলো বাঙালিকে। বাংলা ভাষার জন্য ঝরেছিল বুকের তাজা রক্ত। অথচ সেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধাচরণকারী জিন্নাহ’র কবরেই টগবগ করছে বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলা। সেই সব দুঃখ দিনের কথা একটু একটু করে বলা হবে।


'...শুন্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর,
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর ।
তোমরা আমায় চিনোনি ... '

পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল তার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন তিনি কবিতা লেখার বিনিময়ে কোন অর্থ নিবেন না। সব কথা রাখা যায় না, একসময় টাকার অভাবে কবিতা দিয়েই জীবন নির্বাহ করতে হলো তাকে। কবিতার জন্য পেয়েছিলেন বৃটিশ সরকারের দেয়া নাইট উপাধি। বৃটিশদের নাইট উপাধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পেয়েছিলেন, যদিও পরে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এই নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। তবে এই দুজনের মিলও আছে। মিলটা কবিতা দিয়ে রাষ্ট্রে প্রভাব ফেলায়। ইকবালের লেখার দ্বারা খুব প্রভাবিত আরও দুজন মানুষ ছিলেন। একজন পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

শশীভূষন অবাক! সত্যি সত্যি দেশটা ভাগ হয়ে গেল। তার বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে। তার মেয়ে অলকা লেখাপড়া শেষ করে আমেরিকা থেকে কবে ফিরবে কে জানে! দেশ ভাগ হয়ে ভালো হলো কি মন্দ হলো তিনি কিছুই ঠাওর করতে পারছেন না। দেশভাগ কি জরুরি ছিল? আর সেই চিন্তা তিনি এই বয়সে করতে চান না। তিনি জানেন, বিপুল সমুদ্রের মধ্যে নেমে পড়লে পথভ্রান্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা। তবুও ব্রিটিশ আসার আগে হিন্দু মুসলিম তো একই দেশে ছিল পাশাপাশি । ধর্মীয় ব্যাপারটা এত প্রকট হয়ে দেখা দেয় নি। পলাশীর যুদ্ধে মুসলিম নবাবের হয়ে হিন্দুরাই তো মরণপণ লড়েছিল। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? জিন্নার দাবি অনুসারে মুসলিমরা যদি একটি পৃথক জাতি হয়, তা হলে ভারত আসলে কী? দেশভাগের পর যা রইল, তা কি একটি জাতি নয়? আমরা কি অনেকগুলি গোষ্ঠীর একটি সমষ্টি? নাকি জিন্নার কথামতো, অনেকগুলি জাতির সহাবস্থান মাত্র?

আসলে ব্রিটিশ শাসক হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কে ব্যবহার করেছে নিজের সুবিধা মত। মুসলিমরা শিক্ষায় ও চাকুরিতে পিছিয়ে পড়েছে , দোষ হয়েছে হিন্দুদের। সেই অবস্থা কাজে লাগিয়েছে শাসক। মুসলিম কৃষকেরা ব্রিটিশ করের বোঝা বয়েছে; দোষ হয়েছে হিন্দু জমিদারদের। ব্রিটিশ শাসক সেটাকেও কাজে লাগিয়েছেন নিপুনভাবে। কার লাভ কার ক্ষতি কে তার বিচার করে? একটি দেশ ভেঙে তিনটি দেশ। সন্ত্রাস, দারিদ্র, রাজনৈতিক ওলট- পালট, দুর্নীতি কি... নেই ! দেশভাগে যা হওয়ার কথা ছিল, হল ঠিক তার উলটো। দুই জাতির মধ্যে বিদ্বেষ দূর করার চাইতে বরং হিন্দু, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি পরিচয় আরও উসকে দিল।

অলকা তার বাবাকে চিঠি লিখেছে। ডাকপিয়ন সকালে চিঠি দিয়ে গেছে। অলকা'র চিঠি পেলেই শশীভূষনের মনটা খুশিতে ভরে যায়। তিনি ডাকপিয়নকে বখশিস দেন। তিনি দিনের মধ্যে অনেকবার করে মেয়ের চিঠি পড়েন। অলকা চিঠিতে তার বাবাকে লিখেছে-

প্রিয় বাবা আমার,
কিছু ঘটে গেলে তা সহজ ভাবেই মেনে নেয়াই ভালো। গতমাসে তোমার চিঠি পড়ে মনটা ভীষন খারাপ হয়েছে। দেশভাগ ব্যাপারটা কেন তুমি মেনে নিতে পারছো না? কেন এক আকাশ সৃতি বুকে ধরে রেখে কষ্ট পাচ্ছো? তুমি দেশভাগ নিয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছো। তাই বলি- আমার মতে দেশভাগের মূল কারণ ছিল ধর্ম। হিন্দু ও মুসলমান কোনকালেই মিলেমিশে থাকেনি। তারা দুই পৃথক জাতির মতই ছিল। ইংরেজদের কোনো দোষ নেই। তারা যেমনভাবে হিন্দু আর মুসলমানকে দেখেছিল, তেমনভাবেই তারা ইতিহাস লিখেছে।

বাবা ভুলে গেলে চলবে না, মুঘল আমলে সামান্য কারণে দাঙ্গা হত। যদিও তখন দাঙ্গা গুলো একতরফা হত। হিন্দুদের বিরুদ্ধে। কারণ তখন মুসলিম আমল। ১৭২০ সালে কাশ্মিরে এক মুসলমানের প্রতিহিংসাবশত দাঙ্গা হয়। ১৭২৯ সালে দিল্লিতে এক মুসলমানের হত্যাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা হয়। ১৭৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে আসামে মুসলিমরা হিন্দুদের মহরমের সময় তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলে, হিন্দুরা অসম্মত হয়- পরিনামে দাঙ্গা। ১৭৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেড়ার জেলায় মুসলিমরা হিন্দু ধর্মীয় উত্সবে সশস্ত্র হামলা করে। ১৮০৯ সালে বারানসিতে হিন্দুরা একটা বাড়ি বানাচ্ছিল মসজিদ আর বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের মাঝে- তাই নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয়। ১৮৭৪ সালে বোম্বেতে এক পার্সি প্রফেটদের উপর এক বই লিখে, সেই বই নিয়ে দাঙ্গা।

তারপর, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুসলিমদের জমানা গেছে। তাই এবার দাঙ্গা গুলোর চরিত্র কিছুটা বদলেছে। এবার একতরফা হিন্দুরা মার খেল না। তারা পাল্টা মার দিতে শিখলো। ১৮৮৯ সালে দিল্লিতে এক হিন্দুর ধর্মান্তরকরণ নিয়ে দাঙ্গা বাঁধে তখন ১৮৯১ সালে কলকাতায় মসজিদ বানানো নিয়ে দাঙ্গা লাগে। ওই একই বছরে পলাকাদে হিন্দু ধর্মীয় মিছিলের উপর মুসলিম আক্রমন হয়। ১৮৯২ সালে প্রভাসপাতনে মহরম নিয়ে হিন্দুরা দাঙ্গা লাগায়। ১৮৯৫ সালে পোরবন্দর-এ হিন্দুর ঘরের পাশ দিয়ে মুসলিম ধর্মীয় মিছিল বেরোলে হিন্দুরা আক্রমন করে। এইরকম হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে বহু দাঙ্গা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বাবা, আমি আমেরিকা আসার দুই বছর পর লাখ লাখ মানুষ ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় নিহত হয়। এদের ঘৃণা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে মুসলিম প্রধান এলাকায় হিন্দুদের দেখামাত্র হত্যা করা হতো আর হিন্দু প্রধান এলাকায় মুসলমানদের দেখামাত্র হত্যা করা হতো।

ইংরেজরা এইসব দাঙ্গা দেখে হিন্দু আর মুসলিমদের দুই পৃথক জাতি ভেবে নিল। ভাবাটাই কি স্বাভাবিক নয় বাবা? এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের আর্থিক ক্ষতি হলে তারা ভারত স্বাধীন করার কথা ভাবতে থাকে। এতে ব্রিটিশদের দোষ কোথায়? অতএব দেশভাগের জন্য দায়ী সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ আর সাম্প্রদায়িকতা। ইংরেজরা কোনভাবেই দায়ী নয়। দেশভাগের প্রধান কারণ যে ধর্ম সেটা অনেকে মানতে চায় না। একবার ভেবে দেখো বাবা, কাদের স্বার্থে ব্রিটিশরা দেশভাগ করলো? দেশভাগের সময় কিন্তু কোনো হিন্দু বাধা দেয় নি বরং গান্ধীজি বাধা দিয়েছিলেন বলে নাথুরাম গডসে তাকে গুলি করেছিলেন। এর থেকে কি প্রমান হয়? হিন্দুদেরও দেশভাগে মৌন সম্মতি ছিল। এই রকম বহু উদাহরণ আছে। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়াতে এখন যদি দাঙ্গা হাঙ্গামা কমে।


বাবা তুমি জানতে চেয়েছিলে- ইংরেজরা কাশ্মিরের সমাধান কেন করে যাননি সে বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। সেই বিষয়ে পরের চিঠিতে বিস্তারিত জানাবো। এখন আমি বের হবো। ফ্রিজে কিছু নেই। বাজার করবো।
তুমি ভালো থেকো। মন খারাপ করে থেকো না।

বাবা ওমর আলীর চাচার কি কোনো খোজ পেয়েছো?

বিঃ দ্রঃ আমি তোমার কাছে নেই। তাই নিজের যত্ন নিও। সময় মতো খেও, ঘুমিয়েও। আর তোমার ডায়েরী লেখা শেষ হলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। হাতী ঘোড়া কি লিখেছো- আমি পড়তে চাই। আচ্ছা, বাবা একটা কথা বলি? না থাক বলব না। আচ্ছা, বলেই ফেলি- বাবা আমি কি নিজের পছন্দ করা কাউকে বিয়ে করতে পারি? ভয় পেও না, আমার পছন্দের কেউ নেই। কথাটা এমনিই বললাম। হা হা হা

মেয়ের লেখা চিঠি শেষ করে শশীভূষনের একটা কথাই বার বার মনে হচ্ছে- ইস! দেশটা যদি ভাগ না হতো, তবে কতই না ভালো হতো। আমার সবাই এক সাথে থাকতাম। ইস, কতই না ভালো হতো।



তোমার আদরের কন্যা অলকা



এই পৃথিবীর একটা দায়-দায়িত্ব আছে, মানুষের উপর আবার মানুষের একটা দায়-দায়িত্ব আছে পৃথিবীর উপর। যে যার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে- প্রকৃতি রেগে যায়। প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। প্রকৃতি খুব নির্মম প্রতিশোধ নেয়। অনেকে প্রকৃতিকে নিয়তি বলেন আবার কেউ কেউ ঈশ্বর বলেন। আসলে, যে যেটা ভেবে শান্তি পায়। ১৯৪৩ সালে এই বাংলায় 'প্রকৃতি' একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেল। সরকারি হিসেবে ১৫ লক্ষ। তখন, কলকাতা বিহার উড়িষ্যা তখন বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্গত। দুর্ভিক্ষের সে দিনগুলোতে মানুষ কচুঘেঁচু, পাতা-লতা এমনকি দূর্বাঘাস খেয়েও বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। গ্রাম-বাংলার মানুষের খবর-বার্তা পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম বলতে ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে জানানো, মানুষের বলাবলি, আলোচনা, ভালো-মন্দ মন্তব্য ইত্যাদি ছাড়া তেমন আর কোনো বাহন ছিল না। ধারনা করা হয়- এই ৪৩ এর দূর্ভিক্ষের সময় জন্ম হয় টারজানের।

কী বিচিত্র মানুষের জীবন! সূর্য অস্তমিত। ব্যাঙের নিরবচ্ছিন্ন ডাক, পাখির নিরন্তর কুলায় ফিরে যাওয়া। টারজানের যখন সাত বছর বয়স তখন ওমর আলীর সাথে তার দেখা হয় বিক্রমপুরের। ওমর আলী মুন্সিগঞ্জ বাজারে শাড়ি, লুঙ্গি আর গামছা বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন-কুচকুচে কালো রঙের একটি কুকুরের সাথে এক বালক খেলছে। দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে ওমর আলীর খুব'ই ভালো লাগল। তার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তারও একটি কুকুর ছিল। কালো রঙের কুকুর। কুকুরটির নাম তিনি রেখেছিলেন- পালোয়ান। ওমর আলী টারজানের কাছে গিয়ে বলল- এই খোকা তোমার এই কুকুরের নাম কি? খোকা উত্তরে বলল- আমার নাম টারজান আর আমার কুকুরের নাম- কাল্লু। আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে- আমাকে আর কাল্লুকে কিছু খাওয়াবেন? ওমর আলী বললেন অবশ্যই খাওয়াবো। চলো।

তারা তিনজন একটি রাস্তার পাশে খাবারের দোকানে বসলো। ওমর আলী নিজে কাল্লুকে রুটি ছিড়ে ছিড়ে খাওয়ালেন। আর টারজান খুব দ্রুত সাতটা আটার রুটি শেষ করে দিল পাতলা ডাল দিয়ে। টারজানের খাওয়া দেখে ওমর আলীর খুব মায়া লাগল। আহা বেচারা খুব ক্ষুধার্থ। খাওয়া শেষে ওমর আলী টারজানের জীবন বৃত্তান্ত সব শুনলো। তার বাবা মা নেই এবং সে রাস্তায় রাস্তায় থাকে শুনে ওমর আলীর চোখে পানি চলে এলো। তিনি এক আকাশ আগ্রহ নিয়ে টারজানকে তার বাসায় নিয়ে এলেন। সালো কালো কুকুর কাল্লু। বাসায় এনে তিনি ভয়াবহ এক বিপদে পড়লেন। ওমর আলীর স্ত্রী সরলা বিবি কিছুতেই কাল্লুকে বাড়িতে রাখতে রাজী হলেন না। তার বক্তব্য টারজান থাকতে পারে কিন্তু কুকুরটি না। তিনি কুকুর খুব ভয় পান। বিশেষ করে কালো কুকুর। ওমর আলী সরলা বিবিকে খুব আকুতি মিনতি করে বুঝাতে চেষ্টা করছেন। দূরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে টারজান। তার পায়ের কাছে কালো রঙের কুকুরটি লুটোপুটি খাচ্ছে অজানা এক আনন্দে। ঠিক এই সময় ওমর আলীর ছোট মেয়ে পুষ্প এসে তার মা সরলা বিবিকে অনুরোধ করে এবং তিনি মেয়ের কথায় সায় দেন তারপর থেকে টারজান ও কাল্লু এই বাড়িতেই থেকে আয়। এই ওমর আলী ও সরলা বিবির বাড়িতে টারজানের নতুন জীবন শুরু হলো।


ওমর আলী নিয়ম করে টারজানকে সকাল-সন্ধ্যা পড়াতে বসান। লেখাপড়ায় টারজানের খুব আগ্রহ। সে দ্রুত স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ শিখে ফেলল। টারজানের প্রতিভায় ওমর আলী মুগ্ধ। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওমর আলী টারজানকে গল্প শোনায়। এতে লেখা-পড়ায় আগ্রহ বাড়ে। ওমর আলী গল্প শুরু করলেই পুষ্প এসে বাবার পাশে বসে খুব মন দিয়ে গল্প শোনে। পুষ্প আর টারজানের পাশে কাল্লুও এসে বসে। তারা তিনজনই মুগ্ধ হয়ে ওমর আলীর গল্প শুনে।
ওমর আলীর গল্প গুলো এই রকম- একবার এক বাদশা একজন অপরাধী কয়েদীকে হত্যা করার হুকুম দিলেন। বেচারা নিরুপায় হয়ে বাদশাহকে গালি দিতে শুরু করল এবং অশ্লীল ভাষায় যাচ্ছেতাই বকতে লাগল।
লোকে বলে থাকেঃ মানুষের মনে যখন বেঁচে থাকার আশা থাকে না তখন তার মনে যা কিছু থাকে তা বলতে দ্বিধাবোধ করে না।
বাদশাহ তাঁর এক মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ লোকটা এমন জোরে জোরে কি বলছে?
মন্ত্রীমহোদয় খুব দয়ালূ ও মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বললেনঃ লোকটা বলছে, যারা রাগ দমন করে এবং লোকদেরকে ক্ষমা করে, সেইসব লোকদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।
একথা শুনে বাদশার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেগ হলো এবং তার প্রাণদন্ড মওকুফ করে দিলেন। আর একজন মন্ত্রী যিনি প্রথমোক্ত মন্ত্রীর বিরোধী ছিলেন, প্রতিবাদ করে বললেনঃ আমাদের মত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের পক্ষে পবিত্র রাজদরবারে সত্য বৈ মিথ্যা বলা সমীচীন নয়। অপরাধী বাদশা নামদারকে গালি দিচ্ছে এবং এমন সব অকথ্য কথা বলছে, যা কাউকে বলা যায় না।
মহান বাদশা সে কথায় কান দিলেন না; বরং বিরক্ত হয়ে বললেনঃ যে সত্য কথা তুমি বলেছ, তার চেয়ে ওর মিথ্যা কথা আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে, কেননা, ওর উদ্দেশ্য মহৎ। অর্থাৎ, একটা মূল্যবান জীবন রক্ষা করে তাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া।
জ্ঞানী লোকেরা বলে গেছেনঃ অশান্তি উতপাদনকারী সত্য কথার চেয়ে শান্তিকামী মিথ্যা কথা ঢের ভালো।


ওমর আলী টারজান এবং পুষ্পকে গল্প বলতে থাকুন, এই ফাঁকে আমরা ফারগো শহর থেকে ঘুরে আসি। সেখানে শশীভূষন এর মেয়ে অলকা থাকে। এবং সে মাইক্রোবায়োলজি'তে লেখাপড়া করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে অলকা এক মগ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। কফি খেতে খেতে সারাদিনের কাজ কর্ম মাথায় সাজিয়ে নেয়। আজ তার তিনটা ক্লাশ আছে। আর এক বছর পর তার লেখা পড়ার পাঠ শেষ হয়ে যাবে। মাইক্রোবায়োলজিতে পড়াশোনা করার কারণে পেশাগত জীবনের জন্য তার চাকরির অনেক দরজা খোলা। পৃথিবীর যে কোনো দেশে খুব সহজেই সে একটা চাকরি পেয়ে যাবে। ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ'তে। কিন্তু তার নিজ দেশে তার কোনো চাকরি নেই। মাত্র দেশ ভাগ হলো। দেশের মানুষ গুলো ছন্নছাড়া অবস্থায় আছে। অলকা তার চিন্তা ভাবনা গুলো তার বাবার সাথেও শেয়ার করতে পারে না। তার পাশের রুমে থাকা চীন দেশের মেয়ে মেরি'র সাথেও আলোচনা করতে পারে না। আর এই মেয়ের সাথে আলাপ করলেও সে কিছু বুঝবে না। আর এলিন নামের বৃদ্ধা যার কাছ থেকে সে এই রুম ভাড়া নিয়েছে- সে দেখা হলেই নানান গল্প ফাঁদে। এলিন প্রথমেই জানতে চান- লেখাপড়া কেমন হচ্ছে? তোমার কোনো প্রেমিক নেই কেন? দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছো কেন? তারপর বৃদ্ধা এলিন তার ছোটবেলার গল্প শুরু করেন। এলিন কিছুতেই বুঝতে চায় না- অলকার সময় তিনি নষ্ট করছেন। সারাদিন ক্লাশ শেষ করে, বাজার করে তার নিজের রান্না নিজেকেই করতে হয়। আসলে আমেরিকায় বুড়ো বুড়ি গুলো খুব অসহায় এবং নিঃসঙ্গ। বুড়ির ছেলে মেয়েরাও কোনো খোঁজ খবর নেয় না।

অলকার কফি শেষ। এখন সে তার বাবা'র কাছে চিঠি লিখবে। মাসে অন্ততপক্ষে তিনটা চিঠি না পেলে শশীভূষন খুব মন খারাপ করেন। দেশটা ভাগ হওয়াতে বাবা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছেন। অলকা খুব সাবধানে বুদ্ধি দিয়ে চিঠি লিখে। যেন চিঠি পড়ে বাবার অস্থিরতা কমে যায়।

প্রিয় বাবা,
সময় তার সমকালকে কখনো কখনো মহাকালের সঙ্গে মুহূর্তে যুক্ত করে নেয়। কিছু কিছু মানুষের কোন দেশ নেই। তারা বড্ড দুর্ভাগা, কোথাও তাদের জায়গা নেই। সব যুগেই এই রকম মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ তারা পুরো পৃথিবীটাকেই নিজের দেশ ভাবলে পারে। তাতে কষ্টটা কিছুটা লাঘব হওয়ার কথা। ভুল তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে ভাগ হয়েছিলো ভারত-পাকিস্তান। ধর্ম দিয়ে দেশ ভাগের নজির বোধহয় আর একটিও নেই পৃথিবীর মানচিত্রে। তুমি হিন্দু আর আমি মুসলমান, আমরা একে অপরের শত্রু এমন করে বিভাজনের যে রেখা টেনে দেওয়া হয়েছিলো ১৯৪৭ এ, আজো ডিএনএর মতো আমরা বয়ে চলছি তা। তার দৃষ্টান্ত যারা সংখ্যায় নিতান্তই কম তাদেরকে ভিটেছাড়া করা, ঘর বাড়িতে আগুন দেওয়া। কয়জন-ই বা পারে সেই ডিএনএকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতো পরিবর্তন করে নতুন বৈশিষ্ট্যের আনায়ন করতে?

বাবা, উপমহাদেশের মানচিত্রে এক ঐতিহাসিক ঘটনা- ভারতবর্ষের বিভাজন। কেবলই মানচিত্রের বিভাজন নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো কোটি মানুষের ভাগ্য সম্পদ সঞ্চয় ও প্রণয়ের নানান ঘটনা। উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ যখন তার তাঁবু গুটিয়ে নিতে বাধ্য হল, তখনই তাদের মধ্যে এক বড় সংশয় ছিল যে, এ মানুষেরা যদি আগামীতে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মিলিতভাবে বেড়ে ওঠে তাহলে পৃথিবীর নানা সাম্রাজ্যের শক্তি হুমকির সম্মুখীন হবে। এ সংশয় থেকে শীর্ষস্থানীয় হিন্দু-মুসলিম নেতাদের নিয়ে ভারত বিভাজনের চক্রান্ত করে ইংরেজ।

বাবা, আমার এক শিক্ষক ক্লাশে দেশভাগ নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন। তিনি বললেন, আমি মনে করি দেশ ভাগ একটি দুঃখজনক ঘটনা। দেশ ভাগের সময় শেরেবাংলা, সোহওয়ার্দী কাউকে বাঙালি মুসলমানদের প্রতিদিধিত্ব করতে রাখা হয়নি, চালাকি করে রাখা হয়েছিলো যোগ্রেন্দ্র নাথ মন্ডল নামের এক অযোগ্য বাঙালিকে। দ্বি-জাতি তত্ত্বের আসরে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পূর্বসুরি যোগেন্দ্র মন্ডল কেন? এসব হচ্ছে ধর্মের নামে রাজনীতির ভেল্কিবাজী। ১৮৭০ থেকে ১৮৯৩ সাল যে দাঙ্গা গুলো হয়েছে তার প্রত্যক্ষ কারণ হচ্ছে গরু। সে কালে হিন্দু পঞ্জিকার হিসাব আর মুসলিম হিজরি হিসাবের একটি দিনের মিল হয়ে যায় তা হল দুর্গাপূজা ও ঈদুল আজহার। মুসলিম সংস্কৃতি অনুযায়ী সেই দিন গরু কুরবানি করে থাকে কিন্তু হিন্দুরা গরু কুরবানিতে বল পুর্বক বাধা প্রদান করল। আরহিন্দুরা দুর্গাপূজা তো করবেই। বরঞ্চ প্রতিমা বিসর্জনেরর দিন ঢাকঢোল পিটিয়েবাজনা বাজিয়ে মসজিদের সামনে দিয়ে মিছিল করে যাবে।

বাবা, এর আগের চিঠি'তেও দেশভাগ নিয়ে আমার মন্তব্য তোমাকে জানিয়েছি। এবারও কিছু লিখলাম। এই চিঠি আমাকে এইখানেই শেষ করতে হচ্ছে। আমাকে এখুনি বের হতে হবে। আমি বেশ ভালো আছি। সময় মতো খাওয়া দাওয়া করছি। আর পড়াশোনাও খুব চলছে। বরাবরের মতো আমি খুব ভালো রেজাল্ট করবো এই ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, বাবা। তুমি ভালো ভাবে থেকো। নিজের দিকে লক্ষ্য রেখো। রাত জেগে বই পড়ো না। লেখালেখি করো না। ঘুমের দরকার আছে।

বিঃ দ্রঃ তোমার বন্ধু ওমর আলী চাচার খবর কি? তার কি কোনো খোঁজ পেয়েছো? দেশভাগ হলে একটা মানুষ হারিয়ে যাবে এটা কোনো কাজের কথা না। তার কোনো খোঁজ খবর পেলে আমাকে অবশ্যই জানাবে। আমি নিজেও চাচার খোঁজ করছি। দেখি, তুমি না আমি কে ওমর আলী চাচাকে খুঁজে বের করতে পারে।


তোমার আদরের কন্যা অলকা


শীতের শেষে সমস্ত গাছের পাতা ঝরে পড়ে। তখন পাতা ছাড়া গাছ একদম রুগ্ন মনে হয়। শুকনো পাতা দিয়ে মাটির পথ ঢেকে যায়। সেই পথ দিয়ে কোনো পথিক হেটে গেলে কড়কড় মড়মড় শব্দ হয়। বাতাসে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পাতা গুলো উড়ে যায়। কেউ কেউ এই সমস্ত শুকনো পাতা গুলো ঝুড়ি ভরে বাড়ি নিয়ে যায়। রান্নার কাজে লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করে। এদিকে সমস্ত গাছের পাতা ঝরে পড়ার কারনে গাছ গুলো দরিদ্র বলে মনে হয়। কিন্তু গাছ গুলো বেশি দিন দরিদ্র থাকে না। সমস্ত পাতা ঝরে যাওয়ার পরই আবার নতুন করে নতুন পাতা গজায়। কচি সবুজ পাতা দেখতে কি যে সুন্দর লাগে ওমর আলীর। তার ধারনা সবুজ রঙে চোখের আরাম হয়। তিনি চোখের আরামের জন্য লম্বা সময় ধরে কচি সবুজ পাতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মানুষ দেখলে ভাববে লোকটি বুঝি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

এই যে ১৪ ও ১৫ই আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রদ্বয়ের জন্ম হলো। পাঞ্জাব বিভক্ত হল, বঙ্গদেশ বিভক্ত হইল, আসাম বিভক্ত হল। লক্ষ লোকের কাফেলা বাস্তভিটা ত্যাগ করে ভিনদেশ পানে যাত্রা করলো। যাত্রাপথে কেউ প্রাণ হারাল, কেউ স্বদেশেই পলকের মধ্যে বিদেশী হল ও অনেকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায় ভূষিত হলো, কেউ মুহূর্তের মধ্যে কাঙ্গাল ভিক্ষুকেও পরিণত হলো, কেউ গৃহহারা ও বাস্তহারা হলো। সমৃদ্ধশালী অতীত যেন অট্টহাসি হাসতে লাগল। একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া নিদারুন মর্মব্যথা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়।
ওমর আলী এবং শশীভূষন স্বচক্ষে দেখেছেন এবং ব্যথায় জর্জরিত হয়েছেন, কিন্তু প্রতিকার করার ক্ষমতা ছিল না; বিষাক্ত পারিপার্শ্বিকতা অসহায় করে রেখেছিল- মনুষ্যত্ববোধ, বিবেক, শিক্ষাদীক্ষা বিফল ছিল। নারকীয় আচার বাহবা পেল, যেন পশুত্ব প্রদর্শনই ছিল বীরত্ব।
মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয় যার ফলে পাকিস্তানের মানচিত্রে দুটি পৃথক অঞ্চল অনিবার্য হয়ে ওঠে যার একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান।

ওমর আলী এবং শশীভূষণ রেডিও'তে স্পষ্ট শুনেছেন, ২৪ এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন- "বাংলা ভাগ হবেনা। বাংলা পাকিস্তানের সাথেও যাবেনা, ইন্ডিয়ার সাথেও যাবেনা। পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা ও আসাম মিলে একটি পুর্নাঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।" হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপলব্ধি করেন যে যদি বাংলাকে পুনরায় ভাগ করা হয়, অধিকাংশ শিল্প কারখানা, শিল্প নগরী কলকাতা চলে যাবে পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের দখলে। ফলশ্রুতিতে, পুর্ব বাংলা অর্থনীতিতে চরম ভাবে পিছিয়ে পরবে। তাই সমগ্র পূর্ব বাংলা, আসাম, পশ্চিম বঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্নিয়া জেলা সহ অধিকাংশ অঞ্চল হত এই অবিভক্ত বাংলার অন্তর্গত। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের এই বক্তব্য শুনে দুই বন্ধু খুব খুশি হয়েছিলেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগের সভাপতি, মৌলানা আকরাম খাঁ, জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলার মুসলমানদের লাশের ওপর দিয়েই কেবল বাংলা বিভাগ করা সম্ভব।

দেশভাগের অনেক আগেই শশীভূষণ এবং ওমর আলী এই দুইজনের মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। তখন তারা আসাম থাকতেন। আসামে প্রায় সারা বছর'ই বিভিন্ন উৎসব আর মেলা হতো। ১৯৫০ সালে ভূমি সংস্কারের অধীনে জমিদার ব্যবস্থা রদ করা হয় তখন তারা আসামের একটা স্কুলে একসাথে লেখা পড়া করতেন। দেশ ভাগ হলো আর দুইজন দু'দিকে ছিটকে পড়লো।

দেশ ভাগের কয়েকদিন আগে শশীভূষনের সাথে ওমর আলীর ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ হলো। শিল্প সাহিত্যে তাদের দুইজনের জ্ঞান অনেক। দুইজন দুই ধর্মের। ওমর আলী বলেন, সারা পৃথিবীতে অশান্তির মূল কারন হলো ধর্ম। ধর্ম না থাকলে পৃথিবীতে এত মারামারি কাটাকাটি হতো না। কিন্তু এই কথা মানতে রাজি হলেন না শশীভূষন। সেদিন তারা রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে ধর্ম নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক করলেন। তাদের আলোচনার চুম্বক অংশ নিচে দেয়া হলো-

ধর্ম নিয়ে শশীভূষনের বক্তব্য হলো- জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত, এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। কোনো ধর্ম সত্য না মিথ্যা তা প্রমান করার জন্য আমাদেরকে সেই ধর্মের গ্রন্থগুলোর দিকে ফিরে যেতে হবে। যেহেতু সব ধর্মের মানুষই দাবী করে তাদের ধর্মগ্রন্থ তাদের ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে, কাজেই সেই ধর্মের গ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই এমন কিছু দিয়ে দেবেন যার দ্বারা মানুষ বুঝতে পারবে যে ঐ ধর্মটা সন্দেহাতীতভাবে সত্য। ধর্মীয় কিচ্ছা কাহিনীতে বহু গোজামিল বা উদ্ভটত্ব থাকলেও মানুষ সেটা থেকেই জীবনের মূল্য খুজতে চেষ্টা করে। নাস্তিকতা শুধু যে একটি অযৌক্তিক ও অন্ধ-বিশ্বাস তা-ই নয়, সেই সাথে সবচেয়ে অমানবিক ও বিপদজনক বিশ্বাস। কারণ নাস্তিকরা হিটলার ও স্ট্যালিনের মতো গণহত্যাকারি ও তাদের ভিকটিমদের ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞানের প্রধান রহস্যগুলোর সমাধান হয়ে যাওয়ার পরেও মানবজীবনের কিছু প্রশ্ন অজানাই থেকে যাবে। ধর্ম যদি মানব প্রগতির বাধা হতো, তাহলে আজ বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি হতো না। ধর্মীয় সংকীর্ণতা মানুষকে ছোট করে। ধর্মীয় রাজনীতি মানুষকে অসহিষ্ণু ও হিংস্র করে তোলে।

ধর্ম মানুষকে পুণ্যবান ও ধার্মিক করে। উদার ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয় ধর্ম। ধর্ম পালন মানুষকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করে। মানুষ ও মানবতার প্রকৃত শান্তি ও সার্বিক মুক্তি ধর্ম পালনের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। বিদায় হজ্বের ভাষণে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলে গেছেন ‘হে মানবমন্ডলী! সাবধান, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সমুদ্র হোক বা সংসার, যে ধর্মের নৌকা প্রস্তুত করে সে ঠিকই পার হয়ে যায়।

ধর্ম নিয়ে ওমর আলীর বক্তব্য- আমি কে, জীবনের উদ্দেশ্য কি এই প্রশ্নগুলি সবার মনেই থাকবে। ঐতিহাসিক ভাবেই এই প্রশ্নের সন্ধানে লোকে গীতা, কোরান বা আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক দর্শনের মধ্যে এসবের উত্তর সন্ধান করবে। যেমন আমি করি। কিন্ত আমি হিন্দু বা আমি মুসলমান এই ধরনের কৃত্রিম পরিচয় কপ্পুরের মতন উবে যাবে।
ধর্ম মানুষের তৈরী সামাজিক ব্যবস্থা। আস্তিকতা হচ্ছে মনের বিকৃত অবস্থা। পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মগুলোতে মানুষের যুক্তিবোধ (Rationality) ও বিবেকবোধ (Conscience) ছোটবেলা থেকেই নষ্ট করে দেয়া হয়। নাস্তিকতা মানুষের মনের স্বাভাবিক অবস্থা । আস্তিকতা হচ্ছে মনের বিকৃত অবস্থা। মানুষের অসহায়্ত্ব থেকেই ঈশ্বর ধারণার উৎপত্তি।আদি কালে আগুনকে মানুষ ভয় পেত কারণ তা নিয়ণ্ত্রণ করার সাধ্য মানুষের ছিলনা। সে কারণে তখন আগুনকে পূজা করতো।
মানুষ যখনই জীবনের অর্থ খুজতে গীতা, বাইবেল অথবা কোরানের মধ্যে ঢুকবে তখনই সে দিক ভ্রান্ত হয়ে পড়বে, পড়তে বাধ্য আর তখনই তার ধর্ম পরিচয় আবার চাগাল দিয়ে উঠবে।
মুক্তির জন্য মানুষকে নিজেরই চেষ্টা করতে হবে। কোনো দৈব সাহায্য সে পাবে না। প্রার্থনা একটা অন্তঃসার শূন্য ব্যাপার। উপাসনা নিরর্থক। ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন’ এই তত্ত্বটির মধ্যে রয়েছে ধর্মের সবচেয়ে বড় ফাঁকি।



সেদিন দুই বন্ধু দীর্ঘক্ষন আলোচনা করেও কোনো সমাধানে আসতে পারেনি। এই সমস্যা কোনোদিন সমাধান হবার নয়। যুগ যুগ ধরে নানান তর্ক বিতর্ক চলবেই। নাস্তিক-আস্তিক সবাই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আসলে, সব ধর্মই কি মূলত এক নয়? যারা ধর্ম নিয়ে ঝগড়া ফ্যাসাদ করেন তারা কেন শুধু মানব ধর্ম পালন করেন না? মানবতা কি আপেক্ষিক? ধর্ম এমনেই এক অদ্ভুদ জিনিস, যে হাজার মাইল দুরের ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির মানুষ একীভূত করলেও পাশের বাসার একই ভাষাভাষি, সংস্কৃতির মানুষকে এক করতে পারে না। সেই ধর্মই যখন মানবতার বানী শোনায়, তখন অবাকই হতে হয়। পৃথিবীতে প্রবর্তিত সব ধর্মের একটি অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবকল্যাণ। মানুষ ও মানবতার অকল্যাণ কোনো ধর্মেরই লক্ষ্য বা মূলনীতি হতে পারে না। দুঃখের কথা হচ্ছে নারীকে সব ধর্মেই অবমাননা করা হয়েছে। তবুও নারী পুরুশের চেয়ে অনেক বেশি ধর্মপরায়ণ।

মূলত পৃথিবীতে বুদ্ধ ধর্ম হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে জ্ঞানীদের জন্য । যাদের পূর্ণ জ্ঞান আছে তারাই বুঝতে পারবে বুদ্ধের অমৃত বাণী। পৃথিবী কিংবা পৃথিবীর বাইরে এমন কোন ব্যক্তি কিংবা মহাপুরুষ নাই যে বুদ্ধের বাণী গুলাকে মিথ্যা প্রমাণ করবে। সকল ধর্মেই কিন্তু মানবতার কথা বলে। যদি সব ধর্ম একসাথে বিবেচনা করেন তাহলে একটি মাত্র ধর্মের উদয় হবে এবং সেটিই হল মানব ধর্ম। মানব কুলে জন্মেছি বলেই আমরা মানব। ইতিহাস বলে এই পৃথিবীতে একমাত্র বুদ্ধ ধর্মেই বুদ্ধ তাঁর মৈত্রী প্রেমে সবাইকে আবদ্ধ করে জয় করেছিলেন রাজ সিংহাসন ত্যাগ করে তাও আবার বিনা যুদ্ধে। বুদ্ধ নিজে আঘাত সহ্য করেছেন কিন্তু কখনো অপরকে আঘাত করেন নাই। বুদ্ধের কাছে মৈত্রী প্রেম ছিল সবার জন্য এক সমান। সে প্রাণী হোক কিংবা মানুষ। তাইতো বুদ্ধ বলেছেন, “জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়” শান্তি শুধু মাত্র তো আর মুখে বললে হবে না, শান্তি আসতে হবে মনের ভিতর হতে। ধর্ম পালন হৃদয়ের ব্যাপার, বিশ্বাস ও ভক্তির বিষয়; এতে যেন জোর-জবরদস্তি না থাকে। ভালো কাজ সবসময় কর। বারবার কর। মনকে সবসময় ভালো কাজে নিমগ্ন রাখো। সদাচরণই স্বর্গসুখের পথ।

পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ কিবা খ্রিষ্টান। সব ধর্মেই বলা হয়েছে নারী শ্রেষ্ঠ, নারী অতুলনীয়, চির মহান। মুসলিম ধর্ম মহান করেছে নারীকে, স্বর্গ পায়ের তলে দিয়ে। হিন্দু ধর্ম মর্যাদা দিয়েছে, স্বরস্বতী, লক্ষীকে দেবী সাজিয়ে। বৌদ্ধ ধর্মের শাশ্বত প্রেমের বাণীর কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে নারী। খ্রিষ্টান ধর্মেও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণায়, পরিচয় পেয়েছে যিশুর মাতা মেরী। সকল ধর্মেই দিয়েছে নারীর সম্মান, যদিও আমরা দেই ধর্মের দোহাই।


ওমর আলীর জ্বর এসেছে। তাই টারজান গিয়েছে বাজার করতে। এর আগেও টারজান বেশ কয়েকবার বাজার করেছে। বাজার করতে তার ভালোই লাগে। ওমর আলী বলেছেন, তার জ্বর ভালো হলে পুষ্প আর তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে ধানমন্ডিতে। সেখানে নাকি অনেক গাছপালা আছে বড় বড় পুকুর আছে। বিশাল বিশাল ধানক্ষেত। আসে পাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই।

আজাদ পত্রিকাটা হঠাত বন্ধ হয়ে গেল। ওমর আলী নিয়মিত এই পত্রিকাটা পড়তেন। ‘সাধু সাবধান’ শিরোনামে সম্পাদকীয় টা পড়ে তিনি বেশ মজা পেয়েছেন। দুঃখজনক ব্যাপার হলো 'সাধু সাবধান'' নামে কলামটি লেখার কারনেই পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। আজাদ মূলত মুসলিম লীগ ভাবধারার পত্রিকা। আজাদ বন্ধ হয়ে যাবার পর ভাসানীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’। ওমর আলী বুঝতে পারেন, এটি কট্টর মুসলিম লীগবিরোধী পত্রিকা এবং পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী পত্রিকা হবে।

ওমর আলী ঠিক করেছেন, আজ সারা দিন শুয়ে শুয়ে বই পড়বেন। হাতের কাছে তার চারটি বই আছে। যে কোনো একটি বই তিন আজ পড়বেন। বুকের কাছে বই নিয়ে তিনি ভাবছেন- দেশ ভাগ হলো ধর্মের ভিত্তিতে। একভাগে পড়লো মুসলিমরা ও অন্যভাগে পড়লো হিন্দু ধর্ম অনুসারীরা। মুসলিম রাজ্যে আবার দুটো ভাগ পশ্চিম আর পূর্ব। পশ্চিম আর পূর্বের প্রজাদের মাঝে সাংস্কৃতি -ঐতিয্যে ও জীবনযাত্রায় আবার ব্যাপক তফাত। দেশভাগ মানুষকে ছিন্নমূল ও যাযাবর করে দিয়েছে। একাধিকবার ঠাঁই বদল করতে হয়েছে মানুষকে। আদিবাসী ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, হাজং, কোচ, ডালু, হদি, বানাই প্রভৃতি আদিবাসীদের কয়েক দফা প্রাণরক্ষার জন্য জন্মভূমি ছাড়তে হচ্ছে। ওমর আলী জানেন এক সময় এই দেশভাগ নিয়ে জাদুঘর, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র তৈরি করা নতুন প্রজন্মের জন্য। কিছু হৃদয়বান মানুষ অবশ্যই দেশ ভাগের দুঃখ কষ্ট ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য লিখে রাখবেন। তিনি নিজেও কিছু লিখবেন কিনা মনস্থির করতে পারছেন না।

বাজারের পথ টারজানের চেনা। তবু সে যতবার বাজারে যায় ভিন্ন পথ দিয়ে যায়। নতুন একটা রাস্তা তার চেনা হয়ে যায়। যেন সে এই রাস্তাটা আগে ছিল না, এটা তার আবিস্কার। তবে সব রাস্তা কেমন খালি খালি। শুধু মাত্র বাজারে আর বৈশাখী মেলায় কিছু লোকজন লেখা যায়। ওমর আলী তাকে বলেছে- এই শহরে অনেক লোক বাস করে, প্রায় সাড়ে তিন লাখ। গ্রাম থেকে অনেক ছেলে শুধু মাত্র লেখা পড়া করার জন্য ঢাকা কলেজে পড়তে আসে। তারা হোস্টেলে। টারজানের খুব ইচ্ছা ঢাকা কলেজে পড়ার। ওমর আলী বলেছেন, খুব মন দিয়ে লেখা পরা করলে শুধু ঢাকা কলেজ না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। এই জন্য টারজান খুব মন দিয়ে পড়ছে। যদিও ক্লাশে সে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছাত্র। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে খুব ভালোবাসেন।

পুষ্প টারজানের বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিল- ''অতি ক্ষুদ্র জিনিসটা, বহন করে মানুষটা।'' কিন্তু গত দিন ধরে ভেবেও ধাঁধার উত্তর টা খুঁজে বের করতে পারেনি। কি এমন জিনিস যা একটা মানুষকে বহন করতে পারে? অতীত দিনের সৃতি? নাকি উকুন? বাজার শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে পুষ্পের সাথে টারজানের দেখা হয়। পুষ্প'ই প্রথমে দেখে টারজানকে।
প্রশ্ন করলো পুষ্প কি মাছ কিনলে আজ?
ট্যাংরা মাছ।
ট্যাংরা মাছ কি তোমার প্রিয় মাছ?
না, আমার প্রিয় মাছ চিংড়ি। কিন্তু আজ বাজারে চিংড়ি মাছ উঠেনি। তবে, ওমর চাচা গতকাল বলেছিলেন, ট্যাংরা মাছ খেতে ইচ্ছে করছে। চাচীও বললেন, ট্যাংরা মাছের কথা।
পুষ্প বলল- এই মাছ কিভাবে রান্না করে জানো?
টারজান বলল, জানি না। আমি শুধু খেতে জানি।
পুষ্প বলল- এই মাছ আমি না খেলেও রান্নার নিয়ম জানি। প্রথমে মাছ কেটে পরিষ্কার করে ধুয়ে পানি ঝরাতে হবে। চুলায় ফ্রাইপ্যানে তেল দিতে হয়। তেল গরম হলে পেঁয়াজবাটা, রসুনবাটা, হলুদগুঁড়া, মরিচগুঁড়া, লবণ ও সামান্য পানি দিয়ে ভালো করে কষে নিতে হয়। কষানো হলে তাতে মাছ ও আলু কুচি দিতে হয়। একটু নেড়ে এক কাপ পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। মাছ ও আলু সেদ্ধ হলে ধনেপাতা ও কাঁচা মরিচ দিতে হবে। তারপর গরম ভাতের সঙ্গে গপ-গপ করে খেতে হয়। টারজান অবাক হয়ে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে আছে!

সরলা বিবির কাপড়ের ব্যবসা ইদানিং মন্দা যাচ্ছে। আসামে তার পিতলের থালা বাসন আরও অনেক নিত্য ব্যবহার্য জিনিস ভালোই চলছি। সেখান থেকে চলে আসতে তারা বাধ্য হলেন। বাকিটা জীবন এখানেই থাকতে হবে। আর কি কখনও আসাম যেতে পারবেন? গতমাসে কলতাবাজার এলাকায় তিন কাঠা জমি কিনেছেন। ওমর আলী সংসারী মানুষ না। যা করার তাকেই করতে হবে। এ ব্যাপারটা তিনি ওমর আলীকে বিয়ে করার তিন মাস পর বুঝতে পারেন। কিন্তু তিনি ওমর আলীকে খুব ভালোবাসেন। সেদিন কোথা যেন টারজান নামের একটা ছেলেকে ধরে এনেছে। ছেলেটাকে তিন-রাত পড়াচ্ছেন। নিজের মেয়ে পুষ্প যে পাড়া বেড়ানি হয়েছে সেদিকে লক্ষ নেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের পেঁয়াজ কেটে দেয়। কুয়া থেকে পানি তুলে দেয়। উঠান ঝাড়ু দিয়ে দেয়। ছোট বাচ্চাদের গোছল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়। সরলা বিবির আফসোস মেয়েটা তার মতো হয়নি। তার বাবার স্বভাব পেয়েছে।

সেদিন ওমর আলী বলছিল- বাংলা ভাষায় নাকি আর কথা বলা যাবে না। উর্দুতে কথা বলতে হবে। পাকিস্তানের হর্তা-কর্তা নাকি তাই'ই চায়। বিষয়টা সরলা বিবির মোটেও ভালো লাগেনি। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়াটা তার একেবারেই অপছন্দ। এর আগে জোর জবস্তি দেশ ভাগ করা হলো। এখন বলছে উর্দু হবে আসল ভাষা। দেশ ভাগ করা হয়েছে, তিনি চুপ করে ছিলেন। কিন্তু কেউ যদি তার মুখের ভাষা কেড়ে নেয়- তাহলে তিনি চুপ করে বসে থাকবেন না। তার যা আছে তিনি তাই নিয়ে প্রতিবাদ করবে।


এক বিদেশি জাহাজ মধুমতি নদীতে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। সেই ডুবে যাওয়া জাহাজ দেখার জন্য শশীভূষন ছুটে চলেছে- মধুমতি নদীতে। জাহাজ এর নাম স্টিব অস্টিন। শশীভূষন মধুমতি'র জাহাজটির সামনে যেতেই- এক পুলিশ অফিসার বলল- না, জাহাজের কাছে যাওয়া যাবে না। নো, নেভার।
নৌকার মাঝি বলল- আপনাকে আগেই বলেছিলাম- ওই জাহাজের সামনে যাওয়া নিষেধ আছে। পুলিশটি সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে। শশীভূষন মাঝিকে সাহস দিয়ে চলে এলেন একদম জাহাজের সামনে। লাফ দিয়ে জাহাজে উঠে পড়লেন। ঠিক তখন পুলিশ অফিসারটি নরম গলায় শশীভূষনকে বললেন, এসেই যখন পড়েছেন, আমার সাথে চারটে ডাল ভাত খান, খুব খুশি হবো। মেন্যু অতি সামান্য। ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে করলা ভাজি, আর ডাল। হঠাত শশীভূষনের মনে হলো- পুলিশ অফিসারটি চাচ্ছে- সে যেন এই ডুবে যাওয়া জাহাজটির সাথে তলিয়ে যায়।
শশীভূষন ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন- পুলিশ অফিসারটি তার পূর্ব পরিচিত। অফিসারটি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে- ধরুন, আমার হাত ধরুন, নয়তো আপনি ডুবে যাবেন। সময় খুব কম। শশীভূষন এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে পুলিশ অফিসারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠিক তখন কে যেন তার কানে ফিসফিস করে বলল- ''প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা''।

ঘুম ভেঙ্গে গেল শশীভূষনের। সারা শরীর ঘামে ভেজা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন ভোর চারটা। আমেরিকাতে এখন মনে হয় বিকেল। অলকা মনে হয় ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। শশীভূষন ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন, আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। ভোরের আকাশ দেখা- দারুন একটা ব্যাপার। সকালের আলো না ফুটতেই তিনি হাঁটতে বের হলেন।
এই শহরে তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। থ্রি কমরেডস- এর মতন বন্ধু শশীভূষনের একজনও নেই। নেই বলা ঠিক না, একজন ছিল- ওমর আলী। তিনি পূর্ব থেকে পশ্চিমে এলেন আর ওমর আলী পশ্চিম থেকে পূর্বে এলেন।এই ভোরে একা একা হাঁটতে তার ভালোই লাগছে। আজ তার ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। কোথাও বসে খুব আড্ডা দিতে ইচ্ছা করছে।
পুরো শহরটাকে একটা সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ মনে করে- তিনি শুধু এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় হাঁটতেই থাকলেন। নানান রকম চিন্তা-ভাবনা করতে করতে- তার চায়ের পিপাসা পেয়ে গেল। এখনও কোনো চায়ের দোকান খোলেনি।

গতকাল রাতে শশীভূষন তার ডায়েরীতে লিখেছেন- কেন প্রতি বছর খরা বা বন্যা হয়?
দরিদ্র দেশের মানুষ জানেই না কিভাবে নদীকে ব্যবহার করতে হয়। পানি তো সম্পদ। কিন্তু এই সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে না। আগামী শতাব্দীর মাঝামাঝি মানুষের অস্তিত্বে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। মানুষের হাতে খুব বেশি সময় নেই। তবু মানুষ গাছ লাগাচ্ছে না। বরং বন জঙ্গল উজার করছে। পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের এক নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু লোভী মানুষ পৃথিবীর কাছ থেকে শুধু লুটপাট আর তছনছ করেছে। তৈরি করেছে শুধু জটিলতা। পৃথিবীর সব দেশের মানুষ সবাই এক হয়ে যদি পৃথিবীর কথা ভাবতো- পৃথিবী ছোট্র একটা গ্রহ, তার অফুরন্ত সম্পদ নেই। যা আছে, যতটুকু আছে তার যত্ন নেওয়া দরকার।
এক দেশের প্রতি আরেক দেশের যেন উদাসীনতা না থাকে। আমেরিকায় ভূমিকম্প হলে চীন যেন চুপ করে না থাকে। ইথিওপিয়ায় দুর্ভিক্ষ হলে তার ক্ষুধা যেন স্পর্শ করে অস্টেলিয়াকে। মধ্যপ্রাচ্যে মহামারী হলে তা যেন উদ্বিগ্ন করে সুইজারল্যান্ডকে। পৃথিবীর ক্ষমতায় থাকা মানুষ গুলো যদি এক টেবিলে বসে সিদ্বান্ত নিতো আমরা আর যুদ্ধ করব না। পারমানবিক বোমা বানাবো না। নতুন নতুন অস্ত্র বানাবো না। যেসব অস্ত্র আছে, সেগুলো আটলান্টিক মহাসাগরে ফেলে দিব।


এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রানী মানুষ। আবার এই গ্রহের সবচেয়ে দুষ্টলোকও মানুষ। একবার অন্ততপক্ষে মানুষের ভাবা উচিত- সে কেন পৃথিবীতে এসেছে? সে কেন আরেকজনের শান্তি নষ্ট করবে? এই পৃথিবীতে একজন মানুষ কেন আসে? শুধু লেখা পড়া করে চাকরি করার জন্য? বিয়ে করে বাচ্চা উৎপাদন করার জন্য? যে নৌকা চালায়, সে কি সারা জীবন শুধু নৌকা’ই চালাবে? তারপর মরে যাবে? যে সরকারি অফিসে দশটা পাঁচটা কাজ করে, সারা জীবন এই কাজ করেই মরে যাবে? অথবা যে ব্যবসা করে, সারা জীবন ব্যবসা করেই, অনেক টাকা কামিয়ে মরে যাবে? এ জন্যই তারা পৃথিবীতে এসেছে? কোথায় যেন পড়েছিলাম- যারা শুধু মাত্র চাকরির জন্য লেখা পড়া করে তারা দেশের মেরুদন্ড টাই নড়বড়ে করে দেয়। আমরা এই পৃথিবীতে এসেছে- আমাদের অনেক দায়-দায়িত্ব আছে। আমরা পৃথিবীর কাছে ঋণী। এই ঋণ শোধ করার জন্য আমাদের সবার কিছু না কিছু করা উচিত। সবাই যদি একটু একটু করে কিছু করি- তাহলে এই পৃথিবী ঝকমক করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক আকাশ আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। আপনার যদি টাকা পয়সা না থাকে, অন্ততপক্ষে একটা গাছ লাগান রাস্তার পাশে। যত্ন দিয়ে গাছটা বড় করতে সহায়তা করুন। একসময় এই গাছ আপনাকে অনাবিল আনন্দ দিবে-শান্তি দিবে।

আমি জানি আমাদের সমাজে 'বদ' লোক দিয়ে ভরা। একজন আরেকজনের যে বেশি 'বদ'। বিরাট বদ। এই বদ লোক গুলোকে ভালো করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের'ই। তারা কেন এবং কিভাবে বদ হলো একবার ভেবে দেখুন। সবচেয়ে বড় আশার কথা হলো- আমাদের দেশের বেশীর ভাগ লোকই ভালো। বিশ্বাস করুন একজন সহজ সরল ভালো মানুষ। তারা একে অন্যের বিপদে এগিয়ে যায়। এই যে কিছু দিন আগে পানি বন্ধি মানূষের জন্য তারা যে যা পেরেছে ত্রান নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। তাদের সাধ্যমত করতে চেষ্টা করেছে। কারো রক্তের প্রয়োজন হলে- গভীর রাতে ছুটে যায় হাসপাতালে। তবে বেশ কিছু বদ লোকের কাজ কর্মে আমি প্রচন্ড হতাশ।
সারাদিন চাকরি আর ব্যবসা। টাকা-টাকা করলে হবে? যদি পৃথিবীই না টিকে থাকে তাহলে টাকা দিয়ে কি হবে? আপনার একর-একর জায়গা জমি দিয়ে কি হবে? ভেবে ভেবে বের করুন কারা পৃথিবীর ক্ষতি করছে। পৃথিবী ক্ষয় করছে। তাদেরকে বাঁধা দিতে হবে। বুঝাতে হবে। আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের এমন এক পর্যায়ে আছি যা আরেকটু বেশি হলে সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপদ। এই নিয়ে কাউকে কোনোদিন ভাবতে দেখলাম না। অথচ তার জ্ঞান বুদ্ধি আছে। যদি মানুষ সাবধান না হয়- তাহলে ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস সব শেষ করে দিবে একদিন। সেই সময় খুব কাছেই। মনে রাখতে হবে- মানুষের কোনো গন্তব্য নেই, শুধু গতি আছে। সে কোথায় চলেছে তা সে নিজেই জানে না। এক সময় আকাশে অনেক চিল দেখা যেত। দোকান থেকে খাবার আনার সময় প্রায়'ই ছোঁ মেরে নিয়ে যেত। আজকাল আর দেখা যায় না। তার মানে চিল বসতে পারে এমন সব গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। পাখি কমেছে। জীবজন্তু কমেছে। সামনে আমাদের ভয়াবহ দুঃসময়।
যদি এমন হতো, ভেবে দেখুন- পৃথিবীতে কোনো দুষ্টলোক নেই। কোনো অস্ত্র নেই। সবাই সবাইকে ভালোবাসে। হিংসা নেই, বিদ্বেষ নেই, লোভ নেই। একজনের সমস্যায় অন্যজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাকে সাহায্য করার জন্য। দেশে কোনো খাদ্যাভাব নেই। কৃষক ফসল ফলাচ্ছে। মানুষ গাছ লাগিয়ে লাগিয়ে পুরো পৃথিবীটা সবুজ বানিয়ে ফেলেছে। নদী ভর্তি মাছ। জেলেরা ঝাল ফেললেই মাছ আর মাছ। দেশে কোনো চোর নেই, ছিনতাইকারী নেই। কেউ ঘুষ খায় না। দুর্নীতিবাজ লোকরা সবাই সৎ হয়ে গেছে।
এই দেশে কিছু লোকের এত পরিমান টাকা আছে যে, তারা ইচ্ছা করলে দশটা গ্রামের রাস্তা পাকা করে দিতে পারে। প্রাইমারী স্কুল গুলো বিল্ডিং করে দিতে পারে। কাল্ভাট করে দিতে পারে। আর্সেনিক মুক্ত পানির ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তাদের টাকা আছে কিন্তু তারা কেন এই কাজ গুলো করে না? মৃত্যুর পর তো তারা টাকা কবরে নিয়ে যাবে না। এই জন্য'ই বলেছি সবার আগে পৃথিবীকে ভালোবাসতে হবে। পৃথিবীর মানুষকে ভালোবাসতে হবে। একটা বিশ্ব সম্মেলন করে সারা পৃথিবীর সব মানুষ মিলে এই পৃথিবী নামক গ্রহটাকে সুন্দর করে সাজানো সম্ভব।

পৃথিবী আপনাকে ততটুকুই দিবে, আপনি পৃথিবীকে যতটুকু দিবেন। ভেরি সিম্পল ইকুয়েশন। কাজেই, ডু সামথিং ব্যাটার, ডু সামথিং ডিফারেন্ট।
শশীভূষন বাজারের কাছে এসে একটা চায়ের দোকান খোলা পেলেন। চায়ের দোকানে বসলেন। বয়স হওয়ার কারনে তিনি আর আগের মতো হাঁটতে পারেন না। অনেক লোক চায়ের জন্য বসে আছে। কেতলিতে চায়ের পানি গরম হচ্ছে। ধুতি পরা এক শিক্ষিক লোক শশীভূষনকে দেখে নমস্কার দিলেন। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর হঠাত করে বলতে শুরু করলেন- শেখ মুজিব নামে এক যুবক রাজনীতি শুরু করেছে। সে অনেক দূর যাবেন এই আমি বলে রাখলাম। তার সাথে আরও আছেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ.কে রফিকুল হোসেন।

১০
ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন দেখে অলকার ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম ভাঙ্গার পর কি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে সে বিশেষ কিছুই মনে করতে পারছে না। একটু একটু আবছা যা মনে পড়ছে তা হলো- অন্ধকার রাস্তা। অনেক গুলো কুচকুচে কালো সাপ। আর বুকে ভয় ধরা কেমন বিকট শব্দ। বিছানায় সে উঠে বসল। সাইট টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে পানি খেল। তারপর হাতে নিল রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার বই। আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো। এপাশ-ওপাশ করছিল। ঘুম আসছিল না। ইদানিং তার এই সমস্যা হয়েছে- ঘুম আসে না। ঘুম নিয়ে আগে তার কোনো সমস্যাই ছিল না। অলকা কবিতার বই খুলে বসল। সে খুব মন দিয়ে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা পড়ে। কেন সে নিজের লেখাপড়া বাদ দিয়ে আজকাল কবিতা পড়ছে সে জানে না। তবে তার পড়তে ভালোই লাগছে। তার ধারনা রবার্ট ফ্রস্ট হচ্ছে বিশ্বের এক নম্বর কবি। তার কবিতা গুলি এক একটা মহাকাব্য। ছোট্ট পরিসরে, কিছু সহজ সরল কথায় তিনি অনেক কিছু বলে ফেলতে পারেন। পৃথিবীর তাবৎ মানুষ যেদিকে হেঁটেছে সেদিকে তিনি কখনোই পা বাড়াননি, মাড়াননি পূর্ব-চিন্তানির্ভর অমৌলিক শিল্পপ্রয়াসীদের পথও। তাঁর পথ সবসময়ই স্বতন্ত্র ও পরিচ্ছন্ন। মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে জীবনসংগ্রামের নেমে পড়েছিলেন ফ্রস্ট। নিরলস দিনমজুর খেটেছেন। জুতার দোকানের সামান্য বেতনের কর্মচারী থেকে শুরু করে কারখানার শ্রমিক, পত্রিকায় রিপোর্টিং এবং পশমের ববিন বোঝাই গাড়ি-ঠেলার কাজসহ বহুবিধ কায়িক শ্রমবিসর্জনের মাধ্যমে পরিবারে অর্থের যোগান দিয়েছেন। কাজের ফাঁকে চালিয়েছেন কাব্যচর্চা। হতাশায় ভেঙে পড়েনি কখনো। রবার্ট ফ্রস্টের জীবন ও সাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনের বেশ কিছু অধ্যায়ের মিল খুঁজে পাওয়া যায়, পাওয়া যায় অমিলও। এই মুহূর্তে অলকা তার প্রিয় কবিতাটা পড়ছে-
The Road Not Taken
Two roads diverged in a yellow wood,
And sorry I could not travel both
And be one traveler, long I stood
And looked down one as far as I could
To where it bent in the undergrowth;

কবি মহাশয় দুইটি রাস্তাকে কল্পনা করেছেন। যে রাস্তাটি হলুদ বনের ভিতর দিয়ে গিয়েছে। একি সাথে আবার আফসোসও করেছেন– তিনি দুইটি পথ একসাথে ভ্রমণ করতে পারবেন না। কবি দাডিয়ে দেখেছেন, যে রাস্তাদুটো কতদূর নিচে গেছে নেমে গেছে। আসলে, কবিতায় রাস্তা বোঝালেও রূপক অর্থে এখানে, জীবনের লক্ষ্য বুঝিয়েছেন।মানব জীবনের দ্বিধা, দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে যায়, একবার যেখান থেকে চলে যাওয়া হয় সেখানে আর ফিরে আসা অনেক সময় সম্ভব হয় না। আর জীবন চলার পথ অনেক। কিন্তু যে পথে মানুষ খুব কম হেটেছে, অথবা অল্প মানুষ হেটেছে এমন পথ পছন্দ করার মধ্যেই সমস্ত পার্থক্য বিদ্যমান। এটাই মানুষের মধ্যে পার্থক্য গড়ে তোলে।
আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। অলকা ফস্ট সাহেবকে রেখে এক মগ কফি বানিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। আমেরিকান বুড়ো বুড়িরা হাঁটতে বের হয়েছে। তের তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে উত্তর এর দিকটা দেখতে বেশ লাগে। এখনও কর্ম ব্যস্ততা শুরু হয়নি। অলকার বন্ধু মেরি আসার কথা সকাল আট টায়। যে কোনো সময় মেরি এসে ডাকতে শুরু করবে। মেরি তাকে নিয়ে কোথায় যেন যাবে। মেরি মেয়েটাকে অলকার মাঝে মাঝে হিংসা করতে ইচ্ছা করে। মেয়েটা এই স্বাধীনচেতা দেশে আরও বেশি স্বাধীন। যখন যা মন চায় তাইই করছে। সপ্তাহে দুইদিন ডেট করছে রজার নামে একটি ছেলের সাথে। রজার বয়সে মেরির থেকে দুই বছরের ছোট। রজারের আগে মেরির সাথে জন নামে আরেকটা ছেলের সাথে দীর্ঘদিন সম্পর্ক ছিল। আমেরিকাতে ডেট মানেই শারীরিক সম্পর্ক। এই ব্যাপারটা ভাবতেই তার ভীষন লজ্জা হয়। সে ভেবে পায় না এটা কিভাবে সম্ভব? কোনো একটা রেস্টুরেন্টে দু’জন মিলে খাবে। তার পর ছেলে অথবা মেয়ের ফ্ল্যাটে সারারাত একসাথে থাকা। অলকা একবার মেরিকে প্রশ্ন করেছিল- নর-নারীর সাথে কি শুধু শারীরিক সম্পর্কই হয়, আত্মার সম্পর্ক হয় না? মেরি উত্তরে বলেছিল- শারীরিক সম্পর্কে যে সুখ আত্মার সম্পর্কে সে সুখ নেই। যতদিন শরীরের যৌবন থাকবে ততদিন যৌনতা উপভোগ করে যাওয়া উচিত। আত্মার সম্পর্ক হয় মা বাবা ভাই বোনদের সাথে- বেড পার্টনারের সাথে নয়।

যখন খুব অস্থির লাগে অলকার- তখন তার ইচ্ছা করে কোনো চলন্ত জাহাজে উঠে পড়তে। মাসের পর মাস জাহাজ সমুদ্রে ভাসবে। সে ভেসে বেড়াবে এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে। এক একটা বন্দর এর সকাল নিশ্চয় এক একরকম! তার ভাগ্যটাই মন্দ। জাহাজ তার এত ভালো লাগে কিন্তু সে কখনও জাহাজে উঠেনি। পাঁচ বছর আগে হলে সে জাহাজে করে আমেরিকা আসতে পারতো। উড়োজাহাজ আবিস্কার হওয়ার কারনে সে আমেরিকাতে জাহাজে করে আসা হলো না। প্লেনের চেয়ে জাহাজ অনেক বেশি আনন্দময়। প্লেনে মাত্র কয়েক ঘন্টা আর জাহাজে মাসের পর মাস। জাহাজ চলছে তো চলছেই। মধ্যরাত্রে যখন চাঁদের আলো সমুদ্রের গায়ে পড়ে তখনকার পরিবেশটা কত না সুন্দর হয়! কোনো কবি কি সেই পরিবেশেরে বর্ণনা দিতে পারবে? বারবার সে তার প্রাপ্ত আনন্দ গুলো থেকে বঞ্চিত হয়। এই জন্য তার মন সামান্য খারাপ হলো। একদিন হয়তো কেউ একজন তার অতি সামান্য একটা ইচ্ছাও হাসি মুখে পালন করবে।
গত সপ্তাহে বাবার চিঠি আসেনি। মনে হয়, দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। গত মাসে চিঠিতে বাবা লিখেছিলেন- এবার ভাষা নিয়ে বড় ধরনের একটা গন্ডগোল হবে। যে সপ্তাহে অলকা বাবার চিঠি পায় না, সে সপ্তাহে উইকএন্ড গুলো তার ভালো কাটে না। তার উইকএন্ড মানে মুভি দেখা, বাজার করা, কাপড় ধোয়া, রান্না করা এবং মহা কবি রবার্ট ফস্ট।


১১
ইউরোপে যখন ১৯১৪ সালে বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়, তার চব্বিশ বছর পর মোয়াজ্জেম হোসেনের জন্ম হয়। বাবা মা'র একমাত্র সন্তান সে। দাই জরিনা খাতুন বললেন একেবারে রাজপুত্র হয়েছে। মোয়াজ্জেম হোসেনের বাবা ছিলেন বিক্রমপুরের জমিদার। খুব নাম ডাক ছিল তার। নিজস্ব ঘোড়ার গাড়িতে চলাচল করতেন। ইংরেজরাও তাকে খুব সমীহ করতেন। অস্টিন নামের জাহাজে করে তিনি কলকাতা যেতেন বছরে চার বার। জমিদারের ছেলে বলে কখনও স্কুলে যেত না মোয়াজ্জেম। শিক্ষকরা তাকে বাসায় এসে লেখাপড়া করাতেন। এটাই তখনকার দিনের নিয়ম ছিল। চাষাভূষাদের ছেলেদের সাথে তো জমিদারের ছেলে লেখাপড়া করতে পারে না। খুব ভালো ঘোড়া চালাতেন মোয়াজ্জেম। পদ্মা নদীতে সাঁতার কাটতেন। দেখতে শুনতে এবং স্বভাব চরিত্রে খুব নাম ডাক ছিল। তার যখন সতের বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর মোয়াজ্জেম হোসেন একখানা ডায়েরী পান। তার বাবা নিয়মিত ডায়েরী লিখতেন। হাতের লেখা খুব সুন্দর। বসন্তের এক বিকেলে মোয়াজ্জেম বাবার লেখা ডায়েরী পড়তে শুরু করেন।
জানুয়ারীঃ
''যুদ্ধ ব্যাপারটাকেই আমি ঘৃণা করি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নব্বই লাখ যোদ্ধা মারা গেল, সাথে সাধারন মানূষ মরলো প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ আর আহত হলো কোটি মানুষের উপরে। যুদ্ধ চললো টানা চার বছর। তাতে কার কি লাভ হলো? অস্ট্রিয়ার যুবরাজ 'আর্কডিউক'কে হত্যা না করলে এই যুদ্ধ হতো না। মানুষ শুধু মানুষকে মারার জন্য যে পরিমান অর্থ এবং সময় ব্যায় করে এর পাঁচ ভাগও যদি শিক্ষা ও খাদ্যের জন্য ব্যায় করতো তাহলে পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যেতো।

ফেব্রুয়ারীঃ
কলকাতা যাচ্ছি জাহাজে করে। কেবিনে বসে এরিখ মারিয়া রেমার্ক এর 'অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন' বইটি মাত্র পড়া শেষ করলাম। লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নিজের চোখে দেখা যুদ্ধের কথাই তিনি তার বইতে লিখেছেন। (বইয়ের শেষ পাতার প্রতিটি লাইন তার ডায়েরীতে লিখে রাখা)। ‘অসম্ভব শান্ত একটা দিন। ঝকঝকে নীল আকাশ, মাঝে মাঝে সাদার ছোপ। বাতাস বইছে মৃদুমৃদু। ঘাসের ডগার শিশির বিন্দু এখনো শুকোয়নি। লাল লাল ফুলগুলোর ওপর ছুটোছুটি করছে দুটো রঙিন প্রজাপতি। নির্মল বাতাস, বারুদের গন্ধ নেই, গোলার গর্জন নেই। চারদিকে এমন নিঃশব্দ যে একটা মাত্র লাইনে শেষ হয়েছে আর্মি রিপোর্ট : ‘পশ্চিম রণাঙ্গন সম্পূর্ণ শান্ত’। গাছটার নিচে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পল, যেন ঘুমিয়ে আছে। ওকে যখন ওলটানো হলো, দেখা গেল মুখে তখন ও হাসি লেগে আছে এক টুকরো। যেন কোন কষ্ট'ই পায়নি ও। যেন জেনেই গিয়েছে, সব শেষ হতে চলেছে। প্রজাপতি দুটো উড়েই চলেছে ফুলে ফুলে।’
কী অসাধারণ আর আর কাব্যিক উপসংহার। সেটা শুধু রেমার্কের কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব।
বাবার কথা ভাবতে ভাবতে মোয়াজ্জেম ডায়েরী বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকালেন।

আঠারো বছর বয়সে বালাসুর গ্রামের খায়রুনকে বিয়ে করেন মোয়াজ্জেম হোসেন। খায়রুনের বাবাও ছিলেন জমিদার। বিয়ের সময় খায়রুনের বয়স ছিল তের বছর। তার মতো সুন্দরী অত্র অঞ্চলে আর নেই। কোলকাতার এক জমিদার তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তের বছর থেকেই খায়রুন প্রতি বছর একটি করে সন্তান জন্ম দিতে লাগলেন। মোয়াজ্জেম আর খারুনের মোট সন্তানের সংখ্যা তের। বর্তমানে দশ জন বেঁচে আছেন। পাঁচটি মেয়ে, পাঁচটি ছেলে। বাকি তিন জন কলেরা রোগে মারা যায়। টানা তের বছর গর্ভধারন করে খায়রুনের শরীর ভেঙ্গে গেছে। খায়রুন এত গুলো ছেলে মেয়ে নিয়ে মাথা নষ্ট হবার যোগাড়। দাসদাসী থাকলেও খায়রুন নিজের হাতে বাচ্চাদের খাওয়ান, গোসল করান, কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ান। বাচ্চাদের দাসীদের হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। এদিকে মোয়াজ্জেম পড়ে থাকেন কোলকাতা। কোলকাতায় বিশাল এক দোতলা বাড়ি আছে তাদের। নিউজ প্রিন্ট কাগজের ব্যবসা শুরু করেছেন মোয়াজ্জেম। ব্যবসার বুদ্ধি মোয়াজ্জেমের একেবারেই নেই। বরং ধারধেনা আরও বেড়ে গেল। তার শরীরের জমিদারের রক্ত বলেই ফুটানি একটুও কমলো না। লোক পাঠিয়ে কোলকাতা থেকে জর্দা আনান, কাপড় আয়রন করিয়ে আনান। তার বিলাসিতা এত পরিমানে ছিল যে গ্রামের লোকজন তাকে নওসা মিয়া বলে ডাকতেন। বাসায় নাপিত এসে ছেলে মেয়েদের চুল কেটে দিতে যেত, বিনিময়ে আনাজপাতি দিয়ে দেয়া হতো। বাচ্চাদের চুল কাটানোটা দেখার মতো একটা দৃশ ছিল। দশ জন লাইন ধরে এক কাতারে বসতো। নাপিত একজন একজন করে চুল কেটে যেত। আর দূরে আরাম কেদারায় বসে মোয়াজ্জেম সাহেব ডিরেকশন দিয়ে যেতেন। জেলেদের জালে বড় মাছ ধরা পড়লেই মোয়াজ্জেম সাহেব অনেক দাম দিয়ে কিনে নিতেন।

এদিকে মোয়াজ্জেম জমিদারির আয় উন্নতি কিছুই বাড়াতে পারলেন না। বরং জমির পর জমি বিক্রি করতে লাগলেন। বাঈজী নাচাতেন। জমিদাররা কুঠিতে বাঈজী নাচাবেন এটা স্বাভাবিক। মোয়াজ্জেম দুই হাতে টাকা উড়াতেন। কথিত আছে মোয়াজ্জেম বিয়ের পর প্রজাদের উপর অত্যাচার জুলুম শুরু করেন। নিরীহ প্রজারা কিছুতেই প্রতিরোধ করতে পারল না, শুধু অভিশাপ দিয়ে গেল। এই অভিশাপে পয়ত্রিশ বছর বয়সে মোয়াজ্জেন হঠাৎ করে অন্ধ হয়ে যান। কোলকাতা গিয়ে ডক্তার দেখালেন কিন্তু কাজ হলো না। তিনি সারা জীবনের জন্য অন্ধ হয়ে গেলেন। মোয়াজ্জেম অন্ধ হয়ে যাওয়াতে তার ছেলেদের জন্য ভালো হলো। তারা লেখা পড়া বন্ধ করে দিল। শুধু বড় ছেলে মেহের আলী লেখা পড়া চালিয়ে যেতে লাগলেন।

তার পাঁচ মেয়ে খুব সুন্দরী বলে ঢাকার নামকরা সব ব্যবসায়ীদের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। আর মোয়াজ্জেম হোসেনের অন্ধত্বের সুযোগ নিয়ে তার পাঁচ ছেলে- টাকার দরকার হলেই জমি বিক্রি করা শুরু করল। এমনকি মোয়াজ্জেম হোসেনের এক ছেলে যার নাম সোনা মিয়া সে বন্ধুদের সাথে ছাগল চুরী করতে গিয়ে ধরা পড়লো। তারপর থেকে সোনামিয়া পলাতক। এই খবর নওসা মিয়া অর্থ্যাত মোয়াজ্জেম হোসেনের কানে গেল। তিনি ঘোষনা করলেন- যে সোনা মিয়াকে ধরে আনবে তাকে তিন শতাংশ জমি দেয়া হবে। এবং সোনা মিয়াকে তিনি নিজের হাতে খুন করবেন। সোনা মিয়া নিখোঁজ হয়ে গেল। তার খোজ আর কখনও পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বলেন- সোনা মিয়া কোলকাতা চলে গেছে। আবার কেউ বলেন জাহাজের খালাসির কাজ নিয়েছে।
সোনা মিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত পরে বলা হবে। শুধু এতটুকু বলে রাখি- সোনা মিয়া খালাসির কাজ নিয়ে আমেরিকা চলে যায়। সেখানে অলকা নামে একটি মেয়ের সাথে তার দেখা হয়। অলকার বাবার নাম শশীভূষন।

অন্ধ হওয়ার পর মোয়াজ্জেম হোসেন আর ঘরের বাইরে যান না। সারাদিন শুয়ে বসে থাকেন। কানের কাছে থাকে দুই ব্যাটারির একটা রেডিও। তার চাকর নিখিল বসে থাকে পায়ের কাছে। নওসা মিয়ার সব ছেলে মেয়েই বাবাকে খুব ভয় পায়। যেমন ভয় পায়, তেমন সম্মানও করে। মানুষটা অন্ধ হয়ে যাবার পর- অনেকেই তার কাছে আর আসেন না। কিন্তু খায়রুন যেন আরও বেশি ভালবাসতে শুরু করলেন মোয়াজ্জেম হোসেনকে। মানূষটা খায়রুন এর হাতের রান্না ছাড়া অন্য কারো হাতের রান্না খেতে পারেন না। দিনের বেশির ভাগ সময়ই খারুনের কাটে রান্না ঘরে। জমিদারি নেই কিন্তু জমিদারি স্বভাবটা রয়ে গেছে- নওসা মিয়া সাত রকম তরকারি ছাড়া ভাত খেতে বসেন না। নওসা মিয়ার খাওয়াটা দেখার মতোন একটা ব্যাপার। বিশাল এক পিতলের থালার মধ্যে তিন চামচ ভাত নেন আর পিতলের থালার চারপাশে ছোট ছোট সাত পিতলের বাটিতে থাকে তরকারি। নওসা মিয়া চোখে না দেখলে কি হবে- গুনতে তো পারেন। যদি কখন সাত বাটি তরকারি থেকে এক বাটি তরকারি কম হয়- খুব রেগে যান, রেগে গিয়ে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করেন। এদিকে সংসারের অবস্থা তেমন ভালো না। জমির পরিমান কমে গেছে। বর্গা দিয়ে খুব অল্পই টাকা আয় হয়।

খায়রুন আর মোয়াজ্জেম হোসেনের বড় সন্তান মেহের হোসেন সংসারের হাল ধরে। বিএ পাশ করে মেহের হোসেন ব্যবসায় নামে। সে দুই তলা একটা লঞ্চ কিনে। লঞ্চের নাম মালঞ্চ। মালঞ্চ সদরঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে সারা পদ্মানদী ঘুরে বেড়ায়। মেহের আলী মাসে দুইবার গ্রামে গিয়ে মায়ের হাতে সংসার খরচের টাকা দিয়ে আসে। লঞ্চের কেবিনে থাকতে মেহের আলীর ভালো লাগে না তাই সে শহরে এক রুম ভাড়া নিয়েছে। যখন সে ঢাকার গিলগা এলাকায় সরলা বিবি' আর ওমর আলীর ঘর ভাড়া নিতে যায়- সহজ-সরল, ব্যাক্তিত্ববান আর রুপবান মেহের হোসেনকে দেখেই তারা মুগ্ধ হয়ে যান।

মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পরে ওমর আলী আর সরলা বিবির একমাত্র মেয়ে পুষ্পের সাথেই মেহের হোসেনের বিয়ে হয়।

১২
মানুষ পৃখিবীতে আসে একা। আবার যখন চলে যায় তখনো একা। যৌবনে চারপাশে মানুষের ভিড় থাকে। কর্মব্যস্ত হয়ে যায় মানুষ। কিন্তু বৃদ্ধ বয়েসে মানুষ এতো একাবোধ করে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। চারপাশে সবকিছু থাকতেও সে যেনো একা কোনো নির্জন দ্বীপের অধিবাসী। বৃদ্ধ বয়স বড় নিঃসঙ্গ জীবন। এই সময় সব থাকতেও কিছু থাকে না। মনে হয় গতিশীল পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই বেমানান। মানুষ সঙ্গ প্রিয়। কিন্ত মৃত্যু সবার জীবনে আসবে। মানুষ মরে গেলেও স্মৃতি রেখে যায়। শশীভূষনের আজ সময় কাটে শুধু ডায়েরী লিখে। বুড়ো বয়সে শুধু কথা বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বুড়োদের কথা কেউ শুনতে চায় না। কোটি কোটি কথা জমা হয়ে আছে। ডায়েরীটা লেখা শেষ তিনি তার মেয়ে অলকার কাছে ডায়েরীটা পাঠাবেন।

একটি দেশ ভেঙে তিনটি দেশ। সন্ত্রাস, দারিদ্র, রাজনৈতিক ওলট পালট, দুর্নীতি কি... নেই! ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস- ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ! এক হিসেবে ধর্ম তো আফিম। হিন্দু ও মুসলমান কোনকালেই মিলেমিশে থাকেনি। দেশভাগের জন্য দায়ী সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ আর সাম্প্রদায়িকতা। দেশ ভাগের পর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে জন্মেছে সীমানা বিরোধ ও পারস্পরিক অবিশ্বাস। অন্তত দশ লাখ মানুষ নিজের জন্ম স্থান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের আজও মনে হয় কেন হল দেশভাগ ? দেশভাগের ইতিহাস পালটানো যাবে না, কিন্তু ঘৃণার এই দেয়ালটা ভাঙা যাবে তো? ব্রিটিশ আসার আগে হিন্দু মুসলিম তো একই দেশে ছিল পাশাপাশি । জিন্নার দেশপ্রীতি অথবা দেশপ্রেমের উদাহরণ কেউ দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। এই ভৌগোলিক বিভাজন কোটি-কোটি মানুষকে শুধু ভিটেমাটি ত্যাগেই বাধ্য করেনি, প্রাণ কেড়েছে, নিঃস্ব করেছে এবং অভিবাসী দেশে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছে। আর বিভাজনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো পাঞ্জাব আর বাংলা। দেশভাগের পরবর্তী নয় মাসের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি হিন্দু, শিখ ও মুসলমান জীবন বাঁচানোর জন্যে তাদের পিতৃভিটের মায়া ছেড়ে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে। যারা জেদি মাছির মতো ভিটেমাটি আঁকড়ে থেকেছে, তারা পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে। ধন-সম্পদ-ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ন করলে চলবে না। মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে তাঁর মূল্যবোধ দিয়ে। তাই মূল্যবোধ বজায় রাখতে হবে।

দেশভাগের সময় কিন্তু কোনো হিন্দু বাধা দেয় নি বরং গান্ধীজি বাধা দিয়েছিলেন বলে নাথুরাম গডসে তাকে গুলি করেছিলেন। এর থেকে কি প্রমান হয় ? হিন্দুদেরও দেশভাগে মৌন সম্মতি ছিল। তাই নয় কি ? ভাগ তো হলো, কিন্তু তাতে জাতি সমস্যার সমাধান হলো কি? হলো না। রাশিয়ায় বিপ্লব হয়েছে, চীনে বিপ্লব হয়েছে, ভারতবর্ষে কেন হলো না? তার একটা কারণ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। ওই ব্যবহারে দেশভাগ সম্ভব হয়েছে। দেশভাগে লাভ যে হয়নি, তা নয়। হয়েছে। তবে সেটা সুবিধাভোগীদের, মেহনতিদের ভাগ্যে বাঞ্চনাই সত্য হয়ে রয়েছে। এপারে যেমন, ওপারেও তেমনই। ব্যক্তিগত যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে দেশভাগের প্রভাব পড়েছিলো উপমহাদেশের বিভক্ত মানবমণ্ডলীর মানসে, রাজনীতি, অর্থনীতি, এবং জীবন সংগ্রামে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে। দেড় কোটি মানুষ হেঁটে দেশান্তরিত হয়। এর মধ্যে হিন্দু ও শিখরা ভারতে আর মুসলিমরা পাকিস্তানে চলে যায়। ভারতবর্ষ তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ; আর সে জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম নয়, ভাষা। মানুষ যেখানে জন্মায় এবং বড় হয় তার মনটা সেখানেই থাকে।

দেশভাগের চূড়ান্ত ঘোষণায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি এবং ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন একবারও পাকিস্তানের নাম মুখে নেননি। দেশভাগে পূর্ব ভারতের উদ্বাস্তু বাঙালিদের কথা কিছু বলা হয়, কিন্তু উদ্বাস্তু বিহারিদের কথা বলা হয় না। দেশভাগ নিয়ে উপমহাদেশের মানুষের ভাবনা আজও চলমান। কেন দেশভাগ হলো, কিভাবে হলো- এ নিয়ে আলোচনা, বিতর্কের শেষ নেই। কোন মানুষের জীবনেই তার রাজনৈতিক দর্শন স্থিতিশীল না। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তা বিবর্তিত হতে থাকে। এই বিবর্তনের মূলে থাকে অর্জিত জ্ঞানের সাথে বাস্তবতার পার্থক্য। দেশভাগ ইংরেজদের কৌশল নাকি তত্কালীন নেতাদের লোভের ফল—এই বিতর্ক কি কোনো দিন শেষ হবে না? জন্য দায়ী কে? কংগ্রেস বলবে দায়ী হচ্ছে মুসলিম লীগ, মুসলিম লীগ দোষ চাপাবে কংগ্রেসের কাঁধে। পারস্পরিক এই দোষারোপের ভেতর সত্য যে নেই তা অবশ্যই নয়; দায়ী দুই পক্ষই, কম আর বেশি। উভয়েই ছিল অনমনীয়, ফলে ভাগ না হলে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে—এমন আশঙ্কা অমূলক ছিল না। কিন্তু মূল অপরাধ গান্ধী যাকে তৃতীয় পক্ষ বলতেন সেই ব্রিটিশেরই, অন্য কারো নয়। আসল ঘটনাটা তারাই ঘটিয়েছে, ‘জাতীয়তাবাদী’ দুই পক্ষকে এমনভাবে ক্রমাগত উসকানি দিয়েছে যে ওই দুই পক্ষ পরস্পরের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে এবং দেশভাগ অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

দেশভাগের পর থেকেই মানূষ অস্থির সময় পার করছে। কেউ কারোর সাথে মিল হয়ে থাকতে চায় না। সব কিছুর পেছনে স্বার্থ খোঁজা মানুষের স্বভাব হয়ে গেছে। আসলে দেশভাগ হলো বাঙালির আদি পাপ। এই পাপ আমাদের যেকোনও উপায়ে মোচন করতে হবে। সম্পর্ক সবসময় বর্তমানের ওপর নির্ভর করে। অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। ইতিহাস বহমান নদীর মতো। গতি কখন কোথায় নিয়ে যাবে, কেউ জানে না।

১৩
সবাই জানে টারজান খুব দুষ্ট ছেলে। তবে এ এলাকায় টারজানের কোনো বদনাম নেই। গত বছর বর্ষার সময় এক মস্ত সাপ স্বপ্নাদের রান্না ঘরের পেছন থেকে বের হয়ে এসেছিল। অনেক চিৎকার আর দৌড় ঝাঁপ শুনে টারজান ছুটে গিয়েছিল স্বপ্নাদের বাড়িতে। সবাই উঠোনে দাঁড়িয়ে সাপটিকে দেখছিল। আর ভয়ে কাঁপছিল। সাপটা বিশাল ফণা তুলে দুলছিল উঠোনের মধ্যিখানে। এসব টারজানের কাছে দুধভাত। কত সাপ মেরেছে সে। যদি বুদ্ধি থাকতো তাহলে সাপেরা টারজানের বিরুদ্ধে মামলা করতো। মুহূর্তের মধ্যে সে একটা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল কেউটে সাপটাকে। একটাও লাঠির বাড়ি মাটিতে পড়েনি। সাপের সারা শরীর থেতলে দিল সে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার এই বাহাদুরি দেখার জন্য স্বপ্না বাসায় ছিলনা তখন।

স্বপ্নাকে সে পুকুরে গোছল করতে দেখছিল। স্বপ্না দেখতে ভারী সুন্দর। দু'টা চোখ ভরতি ভীষন মায়া। এসব আগে সে কখনও দেখেনি। দুপুরবেলা সে উঠেছিল আমগাছে কাকের বাসা খুঁজতে। অনেকদিন ধরে তার কাক পোষার শখ। টারজান গাছে চড়তে খুব পারে। এই জন্যই কি তার নাম টারজান? অসংখ্যবার সে বোলতা, মৌমাছি আর ভীমরুলের হুল খেয়েছে। একবার তো একটা একফুট লম্বা বিছা কামড়ে ছিল। বিছার ব্যথায় মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্য এই সাংঘাতিক ব্যথা সে নিরবে সহ্য করেছিল। পাড়ার রফিক মাস্টার তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার ডাক্তার পর্যন্ত তাকে অবশ করার ইনজেকশন দেওয়ার সময় বলেছিলেন, এ ছেলেটির ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা সাংঘাতিক। এসব কেসে ব্যথায় অনেকে মারা পর্যন্ত যায়। টারজান মরেনি। বরং তার মনে হয়েছে, সে এর চেয়ে আরও বেশি ব্যথা অনায়াসে সহ্য করতে পারে। মানুষ ব্যথাকে খুব ভয় পায়। টারজান পায় না। বরং ব্যথাকে তার কখনও কখনও বন্ধুর মতো মনে হয়।

আম গাছটা বড্ড পুরানো। তাছাড়া গতকাল বৃষ্টি হওয়াতে বেশ পিচ্ছল। টারজান এই গাছে কয়েকদিন আগে একটা সাপও দেখেছিল মগডাল থেকে নিচে নেমে যেতে। কে জানে হয়তো সাপটা এখনও হয়তো শীতের এই দুপুরে মগডালে বসে ঘুমাচ্ছে। টারজান কোনো কিছুতেই ভয় পায় না। সে সাপের মতো বেয়ে গাছটাতে উঠে গেল। এবং একটা কাকের বাসা পেয়ে গেল। বাসায় কেউ নেই তবে তিনিটি ডিম পড়ে আছে। ডিম ফুটে কবে বাচ্চা বের হবে কে জানে! অনেকেই বলে কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। কিন্তু এগুলো কিছুতেই কোকিলের ডিম নয়। ডিম গুলো দেখে তার ভীষন আনন্দ হলো আর ঠিক তখনই নীচের পুকুরে সে স্বপ্নাকে দেখতে পেলো। পুকুরে ডুব দিচ্ছে। মাথা ভরতি চুল লেপটে আছে চোখে-মুখে আর পিঠে। সারা ভেজা শরীরে লেপটে আছে ভেজা জামা। জামা ভেদ করে ফুটে উঠেছে দু'টি স্তন। দেখতে নেই। এসব দেখতে নেই। বড় লজ্জার কথা। তবু যে বারবার চোখ সেদিকেই চলে যাচ্ছে! পাপ হচ্ছে। সে মনে মনে দুইবার প্রভুর উদ্যেশে বলল- ক্ষমা করো, ক্ষমা করো। দুইবার ক্ষমা চাওয়ার পরও তার চোখে যেন বারবার স্বপ্নার দিকে চলে যাচ্ছে।

ডুব দিয়ে আবার সাঁতার কেটে সামনের দিকে যাচ্ছে। টারজানও ভালো সাঁতার জানে। ছলাৎ ছালাৎ করে দুইহাত আর পা দিয়ে সাঁতার কেটে সামনে এগিয়ে যায়। আমগাছের মগডালে বসে সে স্বপ্নাকে চোরের মতো দেখছিল। স্বপ্না পুকুর ঘাটের সিড়িতে বসে গামছা দিয়ে মাথা মুছছে। এক আকাশ মুগ্ধ চোখে সে দেখে যাচ্ছে। স্বপ্নার বয়স ষোল। তার চেয়ে এক বছরের বড় হয়তো। ক্লাশ নাইনে পড়ে। কেউ তাকে এসব দেখতে বলেনি, তবু সে জানে এসব দেখা ঠিক নয়। দোষ হয়, পাপ হয়। টারজান অনেকবার দেখেছে স্বপ্না তার বন্ধুদের সাথে দড়ি লাফায়, এক্কা দোক্কা খেলে, দুই বেনী দুলাতে দুলাতে স্কুলে যায়। কতবার তাদের বাড়ি এসে পুষ্প'র সাথে কেরাম খেলেছে। তখনও সে এত মন দিয়ে স্বপ্নাকে দেখেনি। সেই শুকনো মেয়েটিকে আজ কেমন রাজকন্যার মতো দেখাচ্ছে। অবশ্য রাজকন্যা বললে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। রাজকন্যাদের তো দুধে আলতায় গায়ের রঙ হয় বলে সে শুনেছে। দুধে আলতায় রঙটা যে কেমন তা অবশ্য টারজানের জানা নেই। তবে স্বপ্নার চুল অবশ্যই রাজকন্যাদের মতোন। রাজকন্যাদের আরও অনেক কিছু কি কি যেন থাকে। না, স্বপ্না মোটেই রাজকন্যাদের মতোন নয়। তবে সে আজ পাপ করেছে লুকিয়ে লুকিয়ে স্বপ্নাকে দেখে। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন তো? সে প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর সাথে অনেক কথা বলে। টারজান বুঝতে পারে আল্লাহ তার কথা শুনছে। সে যখনই আল্লাহর সাথে কথা বলে তখনই চারপাশে কেমন একটা বেলী ফুলের সৌরব ছড়িয়ে পরে। আল্লার কাছে সে যা চায় আল্লাহ তাকে তাই'ই দেন। না, সব দেন না। মনে হয় ভুলে যান। অর্ধেক দেন। বাকি অর্ধেক দিতে ভুলে যান বোধহয়। টারজান জানে না তার বাবা কে, মা কে। মনে মনে সে আল্লাহর কাছে একজন বাবা মা চেয়েছিল- আল্লাহ তাকে ওমর আলী আর সরলা বিবিকে দিয়েছেন। সাথে ছোট বোন পুষ্পকেও দিয়েছেন। এক মুহূর্তের জন্যও তার কখনও মনে হয় না- ওমর আলী, সরলা বিবি তার বাবা মা নন। এবং পুষ্প তার বোন নয়। তাদের সাথে যদি টারজানের দেখা না হতো তাহলে আজ সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো ফকিরের মতো। সে ঠিক করেছে তাদের ছেড়ে সে কোনোদিন যাবে না। নো নেভার।

টারজান আজকাল অনেক কিছু বুঝে। ওমর আলী তাকে সব সহজ করে পানির মতো বুঝিয়ে দেন। দেশভাগ কেন হলো তা আগে টারজান বুঝতো না, এখন বুঝে। বাংলা ভাষা নিয়েও কি যেন একটা সমস্যা হয়েছে। অনেকেই বলাবলি করছিল। সে তার স্কুলের নারায়ন স্যারের কাছ থেকে শুনেছে। যদি বাংলা ভাষায় কথা বলতে দেয়া না হয় তাহলে টারজান খুব বিপদে পরে যাবে। কারন সে বাংলা ভাষা ছাড়া আর অন্য কোনো ভাষা জানে না। নারায়ন স্যার বলেছেন- ''পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজে বাংলা ভাষার ওপর আক্রমন চালাচ্ছে। দেশভাগ নিয়ে কর দাঙ্গা হাঙ্গামা হলো এখন আবার ভাষা নিয়ে দাঙ্গাও শুরু হয়েছে। খাজা নাজিমুদ্দিন দাঙ্গা থামানোর জন্য বাংলা সমর্থকদের সব দাবী-দাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওমর আলীর কাছ থেকে টারজান জেনেছে, শেখ মুজিব নামে এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে সার্থক করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি কারাগার থেকে বের হোন এবং তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। টারজান বিশ্বাস করে আল্লাহ সব কিছু ঠিক করে দিবেন।

নানান সাত পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে টারজান আম গাছের মগডাল থেকে ধুম করে পুকুরে পড়ে গেল। স্বপ্না প্রচন্ড ভয় পেয়ে টারজানের দিকে তাকালো। টারজান ভালো সাঁতার জানে বলে নিজেকে সামলে নিল। তবে তার নিজেকে সামলে নিতে বেশ বেগ পেতে হলো। সে মনে মনে ভাবছে ভালো বাহাদুরি দেখানো হলো স্বপ্নাকে। স্বপ্না বলল- এই ভূত, তুই কোথা থেকে ধুম করে পড়লি জলে? ভেজা গায়ে টারজান উঠে এলো। তার নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে। খুব অপমান বোধও হচ্ছে। মনে মনে বলল- স্বপ্না তোমার জন্যই লাফ দিলাম, আর তুমি'ই আমাকে ভূত বললে?
টারজান বলল- এ এলাকায় আমার মতো আর কেউ আছে- সাপ মারতে পারে, যে কোনো গাছে মুহূর্তের মধ্যে উঠে যেতে পারে? আমার মতো করে এত জোরে ছুটতে পারে? পারে কেউ আমার মতো করে বিছার কামড় সহ্য করতে?

টারজান বাসায় ফিরল চুপি চুপি। কেউ তাকে দেখতে পেলো না। ওমর আলী দুপুরে খেয়ে ঘুমাচ্ছেন আর সরলা বিবি গিয়েছেন বেপারিদের কাছে টাকা আনতে। আর পুষ্প এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। সে দুপুরে আরাম করে খেয়ে স্বপ্নার কথা ভাবতে বসলো। আজ থেকে স্বপ্না কি তাকে অবহেলা করবে? রোগা পটকা একটা মেয়ে। সামনের পাটির একটা দাঁত আবার উঁচু। টারজান খুব টের পায় লেখা পড়া ভালোভাবে করতে পারলে কেউ আর তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। কিন্তু তার যে মোটেও পড়তে বসতে ইচ্ছা করে না। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রান ভরে আল্লাহকে ডাকলো। হে আল্লাহ আজ আম গাছে উঠে স্বপ্নাকে গোছল করতে দেখে কি খুব পাপ করে ফেললাম? ক্ষমা করে দিও আল্লাহ। তোমাকে বলছি- আমার কিন্তু আপন এই দুনিয়াতে কেউ নেই। আমি কি খুব খারাপ? আজ যদি পুকুরে ডুবে মরে যেতাম তাহলে কি ভালো হতো?

এই কিশোর আল্লাহর সাথে সাথে কথা বলতে বলতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। এবং ঘুমের মধ্যে স্বপ্নাকে স্বপ্নে দেখল। এই কিশোর টারজান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করে। যথাসময়ে এই বীরযোদ্ধার আরও গল্প বলা হবে।

১৪
কেউ কি কোথাও আছো? থাকলে কথা বলো, আমার সাথে কথা বলো। কে আছো ওই মহাশূন্যে? ঈশ্বর বা সর্বময় সর্বশক্তিমান কেউ- আমার দিকে তাকাও। অন্তত একটু আভাস দাও আমায়। তুমি যে আছো, আমায় বুঝতে দাও। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। শুধু একটিবার, মাত্র একটিবার চুপি চুপি আমায় দেখা দাও। আমি একা, বড় একা। খুব নিঃসঙ্গ একজন। মৃত্যুর আগে একটিবার তোমার অস্তিত্বের উৎস আমাকে উপলব্দি করতে দাও ....
শীতের মধ্যরাত। চারপাশে ঘুমন্ত নগরী। শশীভূষন কুয়াশা মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের গোপন কথাগুলি বলছে। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস।

যুবক বয়সে একবার শশীভূষন তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে আত্মাহত্যা করতে চেয়েছিল। তখন তার মেয়ে অলকার বয়স মাত্র চার বছর। সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করবার জন্য তিনহাত দড়ি নিয়ে একটা তেতুল গাছের শক্ত মজবুত ডালে উঠে বসে ছিল। শশীভূষনের পড়নে ছিল একটা সবুজ ফতুয়া, ধুতি আর কাঁধে গামছা। ধুতিটা বেশ ময়লা এবং পুরোনো। কিছুক্ষন পর তো সে মরেই যাবে তাই গাছের ডালে বসে আরাম করে একটার পর একটা বিড়ি খাচ্ছে। চারদিক খুব বেশি নির্জন এবং অন্ধকার। তার মনে হচ্ছে মৃত্যু মানেই অপার শান্তি। আর বেঁচে থাকা মানেই অপার দুশ্চিন্তা। কেন যে সে আরও আগে মরেনি এই ভেবে তার রাগ লাগছে এখন। বেঁচে থাকতে কত কি যে লাগে তার ইয়ত্তা নেই। চাকরি করো, বাজার করো, সামাজিকতা রক্ষা করো, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসো, বউ বাচ্চাকে নিয়ে বেড়াতে বের হও। বউ এর হাজারটা চাহিদা পূরন করো। পূজোয় নতুন জামা কিনো, নানান জনের কটু কথা সহ্য করতে হয়। কাজেই বেঁচে থাকলে নানান বায়নাক্কা সহ্য করতে হয়। মরে যাও, সব সমস্যার সমাধান।

তার বউ লতা বড্ড দজ্জাল মেয়ে। একটা দিন শান্তি দেয় না। শিব ঠাকুর মেয়েদের শরীরের শক্তি দেয় না কিন্তু গলায় খুব জোর দেয় পুরুষের শান্তি নষ্ট করার জন্যে। আর গলার জোর শশীভূষনের একেবারেই নেই। ঝগড়ার সময় শশীভূষন কিছুক্ষন বলে ক্ষান্ত দেয় কিন্তু লতার গলা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। তার ইচ্ছা মাঝে মাঝে করে লতার গলা টিপে ধরতে। সে ভদ্রলোক না হলে কবেই লতাকে গলা টিপে মেরে ফেলতো। শশীভূষন শুনেছে তার শ্বাশুড়িও নাকি এমন দজ্জাল ছিল, খুব চিৎকার চেচামেচি করতো। যখন সামনে কাউকে পেত না, তখন জানালা খুলে রাস্তার মানূষদের সাথে গলাবাজি করতো। দিনের পর দিন কটু বাক্য শুনতে শুনতে শশীভুষনের বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সহ্যের বাইরে চলে গেছে। এই সমাজে লতার মতোন কিছু নারী আছে তাদের কথা তীরের মতো এসে বুকে বিঁধে। তারপর সারা শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। শশীভূষন বিড়িটা ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে আরেকটা বিড়ি ধরালো। বিড়ি খেতে আজ বেশ লাগছে। আজ মরে যাবে বলে পুরো এক পেকেট কিনেছে। সাথে একটা ম্যাচ বাক্স।

গাজীপুরের এই জংলে একসময় অনেক শেয়াল দেখা যেত। হরিণও নাকি ছিল। এখন এসব কিছুই নেই। থাকলে ভালো হতো তাহলে তাকে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হতো না। শেয়াল আর নেকড়ে তাকে খুবলে খুবলে খেত। এই জঙ্গলটা আর আগের মতো নেই। যে যার ইচ্ছে মতো গাছ কেটে নিচ্ছে। জঙ্গলটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে। শশীভূষন মাথা বাঁকা করে আকাশের দিকে তাকালো। আজ কি চাঁদ উঠবে না? এই ঘুটঘুইটা অন্ধকারের তাকে ফাঁস নিতে হবে? বিড়ি খেতে তার অভ্যাস নেই। খুব কাশি আসছে। বার কয়েক কেশে নিল সে। বেসুরে গলায় দুই লাইন গান গাইল- 'আক্কলে খাইছে মাটি, বাপে-পুতে কামলা খাটি''। কিছুক্ষন পর সে মরে যাবে, জীবনটা চলে যাবে। আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে সে তার স্ত্রী লতার কথা ভাবলো। তার মৃত্যুর পর এত তেজ দেখাবে কার কাছে মাগী? মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদবে, কাঁদুক কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাক। তাই তো শশীভুষন চায়। তবে তার বাচ্চা মেয়েটার জন্য বুকটা খুব টনটন করবে। মাত্র চার বছর বয়সে সে তার বাবাকে হারাবে। রাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমায় অলকা। থাক, মায়া বাড়িয়ে আর লাভ নাই। লতাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য অন্য আর কোনো পথ নেই।

ঠিক এই সময়ে এই পথ ধরে এক সাধু যাচ্ছিল। শশীভূষনকে দেখে বলল- কে বাবা তুমি? এত রাতে গাছে উঠে বসে আছো? হাতে আবার দড়ি? ঘটনা কি?
শশীভূষন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিশ্চিন্তে মরতে এসেছিল, মরতে গিয়েও ঝামেলা হচ্ছে। পোড়া কপাল আমার! আজকাল আর নিরিবিলি জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠিক মরার সময় উটকো এক সাধু এসে হাজির। কি মতলব কে জানে! শশীভূষন বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে সাধুর দিকে তাকালো। অন্ধকারে সাধুর হাবভাব কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। সাধু আবার প্রশ্ন করলো- মরতে চাইলে তো মরার অনেক পথ আছে। গলায় দড়ি দিয়ে কেন? ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দাও, দুর্গাপুরের পাহাড় থেকে লাফিয়ে নিচে পড়তে পারো অথবা এক বোতল ফিনাইল খেয়ে নাও। শুধু শুধু গাছটাকে কষ্ট দিবে কেন বাবা? তারপর মানূষ এসে এই নিঃষ্পাপ গাছটাকে অভিশাপ দিবে। শশীভূষন মনে মনে ভাবল, সাধুটিকি তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। এখন হয়তো তাকে কোনো উপদেশ-টুপদেশ দিবে। সাধুর উপদেশে কাজ হবে না। আজ তাকে মরতেই হবে। লতা মাগীকে শিক্ষা দিতে হবে।

শশীভূষন হাতের বিড়িটা সাধুর পায়ের কাছে ফেলে বলল, কোথা থেকে আসলেন? বিড়ি টিড়ির বদ অভ্যাস আছে?
সাধু বলল, আমাদের কোনো কিছুতেই মানা থাকতে নেই।
খাবেন নাকি একটা?
সাধুটি হাত বাড়ালো। শশীভূশন বিড়ি আর ম্যাচ বাক্স এগিয়ে দিল।
সাধু বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে বিড়বিড় করে যেন কি বলল।
শশীভূষন মনে মনে ভাবলো বিড়ির মতো জিনিস আর হয় না। মুহূর্তের মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়। দু'জন অপরিচিত লোককে বন্ধু বানিয়ে দেয়।
সাধু বিড়িটি শেষ করে শশীভূষনের দিকে তাকিয়ে বলল- তুমি কেন মরতে এসেছে?
দুনিয়াজুড়ে মানুষের দুঃখের শেষ আছে?
তোমার দুঃখটা কি?
আমার বঊ আমাকে বড় কটু কথা কয়।
তুমি কেমন পুরুষ মানুষ হে, বউ এর কারনে মরতে এসেছো! বউ কেন তোমাকে আজেবাজে কথা বলে? সাধু সামান্য হেসে বলল, বউ এর রাগটাই দেখলে ভালোবাসাটা দেখলে না। আচ্ছা, তুমি মরলে তোমার বউ এর লাভটা কি?
তুমি তাকে চিনো না সাধু বাবা। সে বড় কঠিন নারী। মুখে একটুও মধু নেই। সারা শরীরে আছে বিষ।
সে কি তোমাকে কখনও দুই একটা মধুর কথা বলেনি? আরে বাছা রেগে গেলে সকলেই দুই একটা বেফাঁস কথা বলে, তাতে দোষের কিছু নেই।
শশীভূষন সামান্য রাগ দেখিয়ে বলল- আমি মরে মাগীকে একটা শিক্ষা দিব। মাগি মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদবে। তাতেই আমার বড় সুখ হবে।
সাধু বলল, তার মানে সে কেঁদে সুখ পায় আর তুমি কাঁদিয়ে? মাথা গরম করো না। তোমার বউ তোমাকে ভালোবাসে। দেখে গিয়ে এতক্ষনে তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছে।
শশীভূষন বলল, সাধু বাবা তুমি আমার মত ঘুরাবার চেষ্টা করো না। আজ আমাকে মরতেই হবে।
সাধু বলল- মরাটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। বেঁচে থাকাটাই আসল।


১৫
মুসলিম শাসনামলেই বাঙ্গালা এবং বাঙ্গালীর সুনির্দিষ্ট অস্তিত্ব আত্মপ্রকাশ করে। পৃথিবীর মানুষের কাছে দেশ হিসাবে একটা পরিচয় থাকতে হয়। যদি আপনার দেশগত পরিচয় না থাকে তাহলে আপনি হয়ে যাবেন রিফিউজি। ধর্ম আগে না জাতিসত্ত্বা আগে? মানুষ যেখানে জন্মায় এবং বড় হয় তার মনটা সেখানেই থাকে। বাঙ্গালির ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয় এবং তা নিয়ে ফুটানি করার তেমন কোনও কারণ নেই। সারাদেশে ধর্মীয় উগ্রতা বিদ্যমান। কিছু ধার্মিকেরা ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে প্রতিনিয়ত। কেউ সুযোগ পেলে চুরি করে, কেউ ধর্ষণ করে, কেউ লুটকরাজ করে আরও কত কী! বাঙ্গালীদের শান্তি নেই। দেশ ভাগের পর থেকে একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে।

ভাষার জন্য কোনো আন্দোলন না করেও আবদুল জব্বার ভাষা শহীদের মর্যাদা পান। তার গল্পটা এই রকম-
ময়মনসিংহের পাচুয়া গ্রামে দরিদ্র পরিবারে সহজ সরল এক বালকের জন্ম হয়। বালকের নাম রাখা হয়- আবদুল জব্বার। সালটা ১৯১৯। জব্বার'রা মোট তিন ভাই। তাদের পিতার নাম হাসান আলীও মাতার নাম সাফাতুন নেছা। দরিদ্র পরিবারে তিনবেলা খেয়ে না খেয়ে বড় হতে থাকে জব্বার। জব্বার প্রাইমারী স্কুলে ভরতি হয়। লেখাপড়া তার ভালো লাগে না। জব্বারের মনে হলো লেখা পড়া দরিদ্রদের জন্য না। যারা তিনবেলা পেট ভরে খেতে পায় লেখা পড়া তাদের জন্য। বাবা হাসান আলীকে জব্বার কৃষি কাজে সহযোগিতা করে। কিন্তু তিনবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পায় না। এভাবে লক্ষ কোটি অভাবী বাঙ্গালী পরিবারের মতো জব্বারদের দিন গুলো কাটছিল অভাব অনটনে।।

পনের বছর বয়সে নিজের খেয়াল খুশিতে এবং পরিবর্তনের আশায় এইহজ সরল বালক আবদুল জব্বার গৃহ ত্যাগ করে। ট্রেনে করে নারায়নগঞ্জ চলে যায়। জীবনে প্রথম তার ট্রেনে চরা এবং নিজ গ্রামের বাইরে আসা। ভাগ্য ভালো জব্বার নারায়ণগঞ্জ এসে শ্রমিকের কাজ পেয়ে যায়। প্রায় এক বছর খুব মন দিয়ে জাহাজ ঘাটায় শ্রমিকের কাজ করে। খুব অল্প সময়ে ভালো কাজ করে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এক ইংরেজের নেক নজরে আসে জব্বার। সেখান থেকে ইংরেজ সাহেবের সাথে সু সম্পর্ক গড়ে উঠে। ইংরেজ সাহেব তাকে এক চাকরি দিয়ে বার্মা পাঠিয়ে দেয়। সেখানেও জব্বার যথেষ্ঠ পরিশ্রম করে সবার মন জয় করে নেয়। কর্মের খাতিরে তাকে ইংরেজীতে কথা বলা শিখতে হয়। অনায়াসে সে ইংরেজীতে কথা বলে ব্যবসায়ীদের সাথে।

একরাতে জব্বার তার বাবা মাকে স্বপ্নে দেখে। হঠাত সে বাবা মাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। পরের দিন সকালে সে সিদ্ধান্ত নেয় আর এক মুহূর্তও বার্মা থাকবে না। একটানা জব্বার দশ বছর চাকরি করে দেশে ফিরে আসে। তার বাবা মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বহু বছর পর গ্রামে ফিরে এসে জব্বারের দিনকাল বেশ ভালো কাটছিল। কাজ পাগল মানুষ জব্বার। দেশে ফিরেও সে বসে থাকার লোক নয়। নিজের জমানো টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। মুদি দোকানের ব্যবসা। তার আয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেশ ভালোই চলছে তাদের জীবন।

জব্বার সিদ্দান্ত নিল- বিয়ে করবে। সে তার বাবা মাকে জানালো। জব্বার তার বন্ধুর বোন আমেনা খাতুন নামে এক কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করেন। আমেনা খাতুনের বয়স তখন এগারো। তাদের পাশের গ্রামেই থাকে আমেনা। বিয়ের এক বছর পরেই তাদের ঘরে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পুত্রের নাম রাখা হয়-নুরুল ইসলাম বাদল। সুন্দর হাসি খূশি পরিবার। প্রতিদিন রাতে জব্বার তার একমাত্র পুত্রকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। এবং মনে মনে ভাবে জীবনটা মন্দ নয়।

জব্বারের পুত্র বাদল এর বয়স যখন পাঁচ বা ছয় মাস তখন জব্বার তার ক্যান্সার আক্রান্ত শ্বাশুড়িকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে আসেন। সময়টা ১৯৫২ সাল, একুশে ফেব্রুয়ারী। ঢাকা মেডিকেল এলাকায় সব দোকান পাট বন্ধ। চারদিকে থমথমে অবস্থা। জব্বার জানতো না ঢাকার পরিস্থিতি অনেক খারাপ। খুব আন্দোলন করছে ছাত্ররা। সকাল থেকেই ছাত্ররা খুব আন্দোলন করছে। পুলিশ তাদের লাঠি হাতে ধাওয়া দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে ছাত্র জনতা সোচ্চার এবং শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত ঢাকার রাজপথ। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি দেখে জব্বার ঘাবড়ে গেল। সে গ্রামে থাকে তাই কি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছিল সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। আন্দোলনের দিকে জব্বার মন না দিয়ে সে খুব দৌড়ঝাঁপ করে জব্বার তার শ্বাশুড়িকে হাসপাতালে ভরতি করতে সক্ষম হয়। তার চিন্তা একটাই যতদ্রুত সমম্ভব শ্বাশুড়িত চিকিৎসা শেষে করে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। এই আন্দোলনরত ঢাকা শহর তার মোটেও ভালো লাগছে না।

আন্দোলন নিজ চোখে দেখার জন্য আবদুল জব্বার ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। তখন দুপুর তিনটা। সকাল থেকে পুলিশের সাথে ছাত্রদের ধাওয়া পালটা ধাওয়া চলছিল। অবাক হলেও সত্য পুলিশ ছাত্রদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারছিল না। একসময় পুলিশ এলোমেলো গুলি শুরু করে। একটা গুলি এসে লাগে জব্বারের বুকে। জব্বারকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে আরও দুইজন মারা যায়। তাদের নাম আবুল বরকত ও রফিকউদ্দিন আহমদ। হাসপাতালে নেওয়ার বেশ কিছুক্ষন পর জব্বার মারা যায়।

ছাত্ররা আবদুল জব্বার, আবুল বরকত এবং রফিকউদ্দিন আহমদের লাশ দেখে ক্ষেপে উঠে। শেষে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ এর সাথে গ্রাম থেকে আসা সহজ সরল মানুষ আবদুল জব্বারকেও ভাষা শহীদ এর মর্যাদা দেওয়া হয়। এই ঘটনার দুই বছর পর আবদুল জব্বারের স্ত্রী আমেনাকে বিয়ে করে জব্বারের আপন ছোট ভাই। তারপর আমেনা আরও দুইজন সন্তান জন্ম দেয়।


সহায়ক গ্রন্থঃ
সমরেশ বসুর ‘সওদাগর
’রমেশচন্দ্র সেনের ‘পুব থেকে পশ্চিমে’,
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘বারো ঘর এক উঠান’,
প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকো’,
মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’,
হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’,
মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই জুন, ২০২০ সকাল ৭:০৩

ইসিয়াক বলেছেন: বাহ! অন্য রকমপোস্ট।
আমার খুব ভালো লাগলো।
অসাধারণ।
এরকম লেখা আরো চাই।

০৫ ই জুন, ২০২০ দুপুর ১:০০

রাজীব নুর বলেছেন: ওকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.