![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজেকে জানার একটা মাধ্যম হচ্ছে লিখে যাওয়া।লেখালেখি করার অভ্যাস নেই বললেই চলে,মাঝে মাঝে "আউল ফাউল"লেখার চেষ্টা করি একটু.....
পুড়াইয়া দিলো শেষ পর্যন্ত! রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি জিগ্যেস করলাম।
সকালেই মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেলো এটা শুনে।ঘুম থেকে উঠা মাত্রই রাহাত এমন একটা খবর শোনাবে বুঝতে পারিনাই।শালারা আজকে ভোঁরে নাকি আতাহার ভাইদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে।অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছুই নাই।আতাহার ভাই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পরে উনার বাড়ি যে এরা পুড়িয়ে দিবে,তা আমি খুব ভালো করেই জানতাম।কিন্তু জিদ উঠছে অন্য কারনে।আতাহার ভাইয়ের বাবাকে বাড়ির ভিতরে আটকিয়ে তারা আগুন লাগিয়েছে।এলাকার কাউকে আগুন নিভাতে পর্যন্ত দেয় নাই এরা।আমি রাহাতকে জিগ্যেস করলাম,"চাচি আম্মা কই?উনি বাড়িতে ছিলেন না?"
-চাচিতো আগেই আতাহার ভাইয়ের বইনরে লইয়া গেরামের রইসুদ্দিনের বাড়িতে উঠসে।এখন শুনতাসি মা-মাইয়া দুই জনই বাড়ির সামনে গিয়া কানতাসে।একটু আগে আগুন নিভাইসে সবাই মিল্যা।চাচার শইল পুইরা এক্কেরে কয়লা.........
-আতাহার ভাই আসবে?কি মনে হয় তোর?
রাহাত মুখ শক্ত করে বললো,"ভাইয়ের দিল পাত্থরের লাহান শক্ত।রহমতউল্লার লাশ না ফালাইয়া উনি বাড়িত পা দিবো না.........
-কে কে ছিল ঐখানে?
-কেডা আবার?রহমতউল্লা আসিলো,তার চামচাগুলা গেসিলো,আর বাকি সবগুলা মিলিটারি ।ইস্কুলের থন মেজর সাবেও গেসিলো।এই মেজরের বাচ্চাই তো কইল "উসকো আন্দার ডালকেহি আগ জ্বালাদো"
-মেজরের বাচ্চা এই কথা কইসে?
-কইবোনা আবার!! একটু পরে তো আপনাগো বাড়িত আইবো।বড় হুজুর আইতে কইসে।
-দাদা আসতে বলছে এরে!!!!!!!আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম রাহাতকে
-কেন কইব না আইতে?বড় হুজুর তো পাকিস্তানের লাইগা জান দিয়া দিবো না?রাহাত গলা নামিয়ে বললো "ভাই আফনের দাদা হইসে গিয়া পাকিস্তানের চামুচ"
-ঠিক বলেছিস,বিড়বিড় করে বললাম আমি,"বুড়া আসলেই রাজাকার"............
সকালটাই শুরু হয়ে গেলো খারাপ খবর দিয়ে।আতাহার ভাইয়ের আব্বাকে আমি এই ৮ মাসে ভালো করেই চিনে ফেলেছিলাম।অসম্ভব ভালো দাবা খেলতে পারতেন তিনি।কাজটা তারা ভালো করেনাই।অবশ্য দেশে আসার পরে কোন কিছুতে ভালো কিছু হচ্ছে বলে দেখছিনা।এই পাকিস্তানিগুলাকে পিষে ফেলতে ইচ্ছা করছে কেন জানি।কিন্তু সেটা করা যাচ্ছেনা আমার বুড়া খাটাশ দাদার জন্য।তিনি পাকিস্তানের ক্যাবিনেট লেভেলের আমলা।তার নাতি মুক্তিযুদ্ধ করতে গেছে-এটা শুনলে তিনি মিলিটারিদের হুকুম দিয়ে ফেলতে পারেন যেন আমাকে দেখা মাত্রই মেরে ফেলা হয়!!ওহ গড!!!!!!!!!বাবা আমাকে কেন এই দেশে নিয়ে আসলো আল্লাহ মালুম।আমার দেশের জন্য আমি কিছু করতে পারছিনা কিন্তু আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে এইসব।ফাখ ম্যান.........
রাহাতকে জিগ্যেস করলাম,"শালারা আসবে কখন?"
-এইতো ভাই আইয়া পরবো এহনি।আমি কি যামুগা?
-যা।আর শোন,একটা কাজ কর।আমি রাহাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,"আতাহার ভাইয়ের কানে খবর পৌছা যে আমি দেখা করতে চাই।"
রাহাত আমার দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
হাত-মুখ ধুয়ে বের হতেই দেখি ২ টা জিপ নিয়ে মেজর আর চ্যালাগুলা গেটের বাইরে থেমেছে।শালাগুলার সামনে পরার ইচ্ছা নাই দেখে বাথরুমের দরজা ধরেই দাড়িয়ে থাকলাম।আগে ঢুকোক দাদার রুমে,দাদার পা চাটুক,এর মধ্যে আমি আমার নাস্তা সারি।ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি বাবা-মা দুই জনেই টেবিলে বসা।বাবা আমাকে দেখেই বলল,"Good morning,kiddo..How was the sleep?"
বাবার মুখের উপর কড়া কিছু বলা দরকার।আমি তাই বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,"মোটামুটি।তবে ভালো থাকার জন্য কি আমিও কারো বাড়ি পুড়িয়ে আসবো?"
বাবা হাত থেকে জুসের গ্লাস টা রেখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।বাবার চোখে আমি অসহায় একটা ছাপ দেখতে পারছি বাট আই ডোন্ট গিভ অ্যা শিট।আজকে আমাকে বলতেই হবে।
-তুমি জানো বাবা,আজকে ওরা আতাহার ভাইদের বাসা পুড়িয়ে দিয়েছে?
-সকালে শুনেছি।লিসেন,সান,এটা শুনে আমারও খারাপ লাগছে।
-"বাবা,টপিক চেঞ্জ করোনা।"আমি গলার আওয়াজ একটু নামিয়ে বললাম,"আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে দিচ্ছনা কেন?এলাকার সবাই বলছে আমাদের ফ্যামিলি নাকি রাজাকার ফ্যামিলি।লুক,তোমার বাবা কি করে আমি জানিনা বাট আমি এইরকম ট্রেইটর অপবাদ নিজের গায়ে লাগাতে পারবো না।হয় আবার ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাক করতে দাও আমাকে,নয়তো আমাকে আমার দেশের জন্য ফাইট করতে দাও।চয়েস ইস ইওরস......
-দেখো আপন,আমার আম্মু বলে উঠলো,"এই অবস্থাতে তো দেশ ছাড়ার প্রশ্নই আসেনা।আর আমরা সবাই দেশ কে ভালোবাসি।এখন দেশের জন্য যুদ্ধ না করেও তো দেশের জন্য অনেক কিছু করা যায়,তাইনা?আর কে কি বলল সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?তুমি জানো তুমি ট্রেইটর না,দ্যাটস ইট...
-মম প্লীজ,এইসব যুক্তি আর দিওনা,বলে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।নাস্তার মুড নষ্ট হয়ে গেছে আমার।আতাহার ভাই কি নাস্তা করেছেন?জানতে ইচ্ছা করছে খুব...
হটাত পিছন থেকে সার্ভেন্ট ডাক দিয়ে বলল,"ভাইসাব,বড় হুজুর আপনারে উনার ঘরে ডাকে।আপনারে এখনি যাইতে কইসে।" শিট ম্যান,এই বুড়া আমারে ডাকে কেন?আল্লাহ মালুম।রুমে ঢুকে দেখি দাদার সাথে ১ টা মেজর আর তিনটা লেফটেন্যান্ট বসা।দাদা আমাকে দেখে বলল,"হেই মেজর,দিস ইস মাই অনলি গ্র্যান্ডচাইল্ড,আপন।হি অ্যান্ড মাই সন কেম ফ্রম ক্যালিফোর্নিয়া আরলি ইন দিস ইয়ার টু সি প্যাকিস্তান।"কিছুক্ষণ হাসিমুখে কথাবার্তা আর নাস্তা করে বিদায় নিল এই বাস্টার্ডগুলা।যাওয়ার সময় আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছি,নিচে থেকে ডাক দিলো এক দাড়িওয়ালা,"স্যার ভালো আছেন?"
আমি পিছন ফিরে দেখলাম,কেউ নাই।তার মানে আমাকেই স্যার বলা হয়েছে!আমি বললাম,আছি কোনরকম।কিন্তু আপনাকে ঠিক......
-স্যার আমি রহমতউল্লা।মেজর সাহেবের সেবা করি।
আমার ক্যান লাল হয়ে গেলো এই কুত্তাটাকে দেখে।এইটাই তাহলে সেই পিস অফ শিট?একে তো এখনি খুন করতে ইচ্ছা করছে।
-"স্যার আপনারে গত সপ্তাহে দেখলাম বারেক মাস্টারের বাড়িতে যাইতে,ঐযে যার পোলা মুক্তি মুক্তি ভাব ধরতাসে,আতাহার কইরা নাম।আপনি কিন্তু ঐগুলার বাড়িতে যাইয়েন না।ওরা ভালা মানুষ না",এটা বলে সে জিপের দিকে চলে গেলো।আমার পিছনে এর মাঝে রাহাত এসে পড়েছে।আমার দিকে ফিসফিস করে বললো,"ভাইজান,এইডাই রহমতউল্লা।চিনসেন এইবার?"
-হুম চিনেছি।আমাকে মুক্তি চিনায় এই শালা।একেও আমি চিনাব।মুক্তি মানে কি একে আমি ঠিকই চিনাব।তারপর আমি পিছনে রাহাতের দিকে ফিরে বললাম,"আতাহার ভাইয়ের কাছে খবর দিয়েছিস?"
-ভাইয়ে তো নদীর অইফারে।আমি রইসুল রে কইসি,জোহর ওয়াক্তের আগেই ভাইয়ে জাইনা যাইব ইনশাল্লাহ।
-তাইলে রেডি থাক।বিকালে নদীর ঐপারে যাবো।ভাইয়ার সাথে দেখা করা জরুরি।
আতাহার ভাইয়ের সাথে আমার জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে পরিচয়।দেশে আসার পর যখন বিকালে হাটতে বের হতাম,আতাহার ভাইদের গ্রুপ তখন সকার খেলত।এই দেশে এরা সকারকে কোন কারন ছাড়াই ফুটবল বলে।আমি যখন এই কথা ভাইয়ের সামনে বলেছিলাম,সেদিন ভাই সবার সামনেই আমাকে বলেছিলেন,"যেটা পা দিয়ে খেলে সেটার নাম ফুটবল।তোমরা হাত দিয়ে রাগবি খেলার পরেও তাইলে সেটারে ফুটবল বল ক্যান?বুঝলা আপন,তোমাদের অ্যামেরিকা হইসে আসলে উল্টা দেশ।সেখানে সবই উল্টা।আমার ক্যান জানি মনে হয় তুমিও উল্টা।বুকে হাত দিয়া দেখত হার্টবিট কোনদিকে দিতাসে,ডানে না বামে?" আতাহার ভাইয়ের এই অপমান শোনার পরে আর সেদিন মাঠের সামনে দাড়াইনাই।তবে পরের দিন ভাইয়া আমাকে ঠিকই বুঝিয়ে শুনিয়ে রাগ কমান।দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত উনার সাথেফুট বল খেলার সুযোগ হতো।কিন্তু ২৫ মার্চের পরে আমাকে সহজে বাসা থেকে বের হতে দেয় না আমার দাদা।তাই বিকালে খেলার সুযোগও কম।অবশ্য মাঠে কেউ খেলতে যায় কিনা সেটাই বা কে জানে!!রাহাতের কাছেও আমি কোন উত্তর পাইনা।অবশ্য তখন রাহাতও আমার সাথে ভালো করে কথা বলতো না।এলাকার কেউই না।সবার চোখে এখন একটাই ভাষা-এদের পরিবার পাকিস্তানের দালাল......
এর এক-দেড় মাস পরেই আমার ভাগ্যে অনেক ভালো একটা সুযোগ আসে।একদিন দুপুর বেলায় রাহাত আমার রুমে আসে বলল,"ভাইজান একটু নিচে চলেন।আতাহার ভাইয়ে ডাক দিসে।"
-কি বলিস এইগুলা!উনি না মুক্তিযুদ্ধে গেছে?আমারে ডাক দিলো কেমনে?
-"ভাই গলা নামান।মাইনসে শুইনা লাইব" রাহাত ফিসফিস করে বলল।
-আচ্ছা চল।কিন্তু উনি কই?
-আসেন আমার লগে।মাঠের পিছে বইসা আসে ভাইয়ে...
মাঠের পিছনে যে ভাঙ্গা দেয়াল আছে তার পিছনে দেখি আতাহার ভাই বসে আছে।উনি আমাকে দেখেই বলল,"আপন,আমি তোমার সাথে যতোটুকু মিশেছি,আমার মনে হয় না তুমি পাকিস্তান সাপোর্ট করো।তবুও তোমার মুখেই শুনতে চাই,তুমি কোন পক্ষে?"
আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,"ভাই,আমার জন্ম এই দেশে না।কিন্তু আমার মনে হয় আমি আপনার চেয়ে কম ভালো বাসিনা এই দেশটা কে।"
-দেশ আগে না বাবা-মা?
প্রশ্নটা শুনে আমার খুব বলতে ইচ্ছা করলো যে আমার বাবা-মাই আমার কাছে সব।কিন্তু মুখ দিয়ে কেন জানি বের হয়ে গেলো,"দেশ"......
-ভালো,মনে আছে খেলার সময় তোমার সাথে যখন কথা হতো,তুমি বলেছিলে যে তুমি আর্মস চালাতে পারো ভালভাবে?
-হ্যা ভাই মনে আছে।আমরা যখন শিকারে যেতাম তখন তো ভালোই চালাতে পারতাম।
-"তাহলে আমার একটা কাজ করে দাও", বলেই তিনি তার পিছন থেকে গামছা দিয়ে মোড়ানো একটা স্টেনগান বের করে বললেন,"এইটা আমার লিডার আমাকে দিয়েছে কিন্তু এইটা দিয়ে ফায়ার করতে গেলেই কেমন জানি কট কট শব্দ করে আটকে যাচ্ছে।হেল্প করতে পারবে?
দুপুরের রোদটা কেন জানি আমার কাছে খুব তীব্র মনে হচ্ছিল সেদিন।জন্মের পর থেকে কতো রাইফেল ধরলাম,কতোগুলো দিয়ে শুটিং প্র্যাকটিস করেছি তার হিসেব আমি রাখিনাই।কিন্তু সেদিন একটা স্টেনগান হাতে নিয়ে আমার কেমন জানি ভয় করতে লাগলো।এই অস্ত্রটা কোন কম্পিটিশনে কেউ চালাবে না,এইটা দিয়ে রেইন ডিয়ার মারা হবেনা,এটার বুলেট দিয়ে মরবে বেজন্মা পাকিস্তানিগুলা!!!!!! আমি মাথা থেকে এসব দূর করে দেয়ালের পিছনে বসে ভালোমতো স্টেনটা চেক করলাম।দেখে মনে হচ্ছে এটার ট্রিগার চেম্বার বুলেট স্টকের সাথে বাড়ি খাচ্ছে।আমি আতাহার ভাইকে বললাম,"ভাই তেমন কোন সমস্যা না,তবে ঠিক করতে আমার একটা স্ক্রু ডাইভার আর রেঞ্জ লাগবে।" আতাহার ভাই রাহাতকে পাঠাল এলাকার গাড়ির ওয়ার্কশপ থেকে এগুলা নিয়ে আসতে।ততক্ষনে আমি আর ভাই ছাড়া সেখানে কেউ নাই।তখন ভাইয়া বলা শুরু করলো,"তোমাকে আমাদের সাথে নিলে ভালো হতো।ইউ হ্যাভ স্কিল।কিন্তু তোমার দাদা একটা সমস্যা।আর তুমি এখানে থেকে আমাদের অনেক কিছুই ইনফর্ম করতে পারবে।কারন তোমাদের বাড়িতে হাই অফিসিয়াল মানুষেরা আসবে শিওর।রাহাতকে দিয়ে খবর পাঠাতে পারবেনা?আর মাঝে মাঝে রাহাত কে নিয়ে বিকালে বের হবা।তোমাকে এলাকার কেউ সন্দেহ করবে না।তুমি এসে আমারে আর আমার সাথের সবাইরে টার্গেট প্র্যাকটিস করতে শিখাবা।দেশের জন্য কি এতোটুকু করতে পারবা না?"
কাধে এতোবড় একটা দায়িত্ব পেয়ে সেদিন বুকটা গর্বে ফুলে গিয়েছিলো।রাহাত রেঞ্জ আর স্ক্রু ডাইভার নিয়ে আসলে আমি আতাহার ভাইয়ের স্টেনটার প্রবলেম সারিয়ে ফেলেছিলাম।এর পর থেকেই প্রতি সপ্তাহে বিকালের দিকে স্কুল মাঠে খেলার নাম করে স্কুল রুমের ভিতরে আমি ভাইকে আর তার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের নিশানা সোজা করতে শিখাতাম।আমার খুব প্রাউড ফিল হতো কারন আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেতাম।
বিকালে হাটতে হাটতে নদীর কাছে এসে পরলাম।রাহাতের চেনা নৌকা ঠিক করাই ছিল।চারদিকে চেয়ে খালি ভেসে আসা লাশ খুজছি,কিন্তু আজকে চোখে কোন লাশ ধরা পড়লো না।কিন্তু নদীর পানি জানি কেমন রাগী রাগী চেহারাতে তাকিয়ে আছে।আমি তো খুন করে নদীতে লাশ ফেলছি না,আমার দিকে রাগ দেখানোর মানে কি!!!!নদীর পার হয়ে প্রাইমারি স্কুল বিল্ডিঙের পিছনে গিয়ে আমি আর রাহাত দেখলাম আতাহার ভাই সহ আরও ২ জন মানুষ বসে আছে।আতাহার ভাইকে কেন জানি আজকে খুব ছোট ছোট লাগছে।সান্ত্বনা টাইপের কিছু বলতে যাচ্ছি,এইসময় ভাই নিজেই বলে উঠলো,"কি খবর আপন,হটাত দেখা করতে চাইলা?"
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।তাই বলে ফেললাম,"ভাইয়া,রহমতউল্লাকে তো বেঁচে থাকতে দেয়া ঠিক হবেনা।এই স্কামগুলাই দেশের আসল শত্রু"
ভাই আমার দিকে চেয়ে বলল,"আমি জানি।কিন্তু রহমতউল্লার বাড়ি হাইস্কুল থেকে ১০ পা দুরেও না।তার সাথে ২ টা রাজাকার চেলা থাকে।তোমার কি বিন্দুমাত্র ধারনা আছে যে রহমতউল্লাকে মারা মাত্রই গুলির শব্দ পেয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের ঘিরে ফেলবে?"
আমি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,ভাই আমি এই জন্যই একটা কথা বলতে এসেছিলাম।দিনের বেলাতে তো এদের মারা রিস্কি।কিন্তু আপনি রাতের বেলাতে এদের ঘরে ঢুকে ঠিক সেভাবেই মারতে পারেন এদের যেভাবে তারা ঘর থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়।আমার বাবার একটা সাইলেন্সার ওয়ালা পিস্তল আছে।আজকে রাতে যদি আপনারা কয়েকজন মিলে একে মেরে ফেলতে চান,তাহলে আমি সেটা আপনাদের এক দিনের জন্য ম্যানেজ করে দিতে পারবো।তবে পিস্তল টা ফেরত দিতে হবে এই শর্তে আমি সেটা দিতে পারবো।"এক নিঃশ্বাসে কথাগুলা বলে আমি দম নিলাম............
ততক্ষনে আতাহার ভাই মনে হচ্ছে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।উনি জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,"আজকে সন্ধ্যার আজানের পরে তুমি পিস্তলটা সাইলেন্সার লাগিয়ে রাহাতের হাতে নিচে পাঠিও,আমি নিজে এসে নিয়ে যাবো।আজকেই রহমতউল্লাকে খুন করবো আমি,আমার দেশের জন্য"............
-"ঠিক আছে ভাই তাহলে আমি এখনই বাসায় যাচ্ছি,আপনি এশার আজানের সময় বাসার নিচে আসবেন।আর সাবধানে,কেউ যেন না দেখে" এই বলে আমি চলে আসলাম বাসার দিকে.........
সন্ধ্যার সময় আব্বু যখন নামাজ পড়তে গেলো,তখন আমি আব্বুর রুমে ঢুকলাম।আমাদের গানকেস তা আব্বুর আলমারির পিছনে।আলমারি খুলে আমার এটা বের করতে হবে।শিট ম্যান,আব্বু বুলেট কই রেখেছে!!!! খুজতে খুজতে বুলেট কেসটাও পেয়ে গেলাম,শার্টের নিচে পিস্তল লুকানোর সময় হাসি আসলো কেন জানি।টেক্সাসে যখন থাকতাম তখন আমার আলাদা শোল্ডার হোলস্টার ছিল।এইটা যদি আজকে থাকতো,তাহলে আর শার্টের নিচে পিস্তল লুকানোর দরকার পড়তো না।এখন এই ভারি স্মিথ এন্ড ওয়েসন নিয়ে আমার চলাফেরা দেখলে যে কারো সন্দেহ হবে,তাই বাথরুমে লুকিয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে মনে হয়...............
৪০ মিনিটের মতো যখন কেটে গেলো,তখন চুপচাপ আমি নিচে গেটের কাছে চলে গেলাম।রোডের উল্টাপাশে রেইনট্রি গাছের নিচে একটা ছায়া দেখে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম।গিয়ে দেখি আতাহার ভাই নিজেকে চাদর দিয়ে পুরো মুড়িয়ে নিয়েছে।"ভাই আপনাকে দেখে তো এমনিতেই হার্ট এটাক করে মারা যাবে ওরা,পিস্তলে দরকার আছে?" ভাই কিছু না বলে একটু হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু হাসতে পারলো না মনে হয়।অবশ্য এই মুহূর্তে আমি উনার মুখে হাসি আশাও করছিনা।সকালে যেই ছেলের বাবাকে খুন করা হয়েছে,সেই ছেলেটা বিকালের মধ্যেই কিভাবে মুক্তিযোদ্ধার দায়িত্ব পালনে চলে যায়,তা আমি আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষটা কে দেখে বুঝার ট্রাই করছি।কিন্তু পারবো বলে মনে হচ্ছেনা।এর মধ্যে আতাহার ভাই বলল,"তুমি ঘরে চলে যাও।কেউ দেখলে ঝামেলা হবে"।"ঠিক আছে ভাই,বেস্ট অফ লাক" এটুকু বলেই আমি বাসার দিকে পা বাড়ালাম।আজকে রাতে অনেক শান্তির ঘুম হবে আমার।তবে আমার কারনে আজকে তিন টা জানোয়ার আর ঘুমাতে পারবেনা-এটা ভেবে খুব আনন্দ হচ্ছে।বাংলাতে এটাকে কি বলে,পৈশাচিক আনন্দ?ডিকশনারি দেখতে হবে গিয়ে..................
পরদিন সকাল বেলায় আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল রাহাত আমার শরীর ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে।ঘুম থেকে উঠে মাথা কেমন জানি জ্যাম জ্যাম লাগছিল আর শালা রাহাত জানি হড়বড় করে কি বলছিল,অনেক কষ্টে যতোটুকু বুঝলাম তার সারমর্ম হলো,গতকাল এক পাকিস্তানি সুবেদার এক হিন্দু মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো রহমতউল্লার বাড়িতে,আতাহার ভাই আর তার সহযোগীরা যখন চুপে চুপে বাড়ির ভিতর ঢুকে,তখন এই দুই জানোয়ার মেয়েটাকে ধর্ষণ করতে ব্যস্ত।তাই তাদের মাথার পিছনে বুলেট ঢুকাতে ভাইয়ার নাকি কোন ঝামেলাই হয় নাই।ভাইয়া নাকি সাথের দুইটা রাজাকারকেও মেরে ফেলেছে।আমি খুশিতে লাফ দিবো কিনা বুঝতে পারছিনা।উনি ময়ে হয় পুড়া ম্যাগজিন খালি করে ফেলেছেন এই জানোয়ারগুলোর উপরে।ইয়েস.........এভাবেই প্রত্যেকটাকে খুন করা উচিত।আতাহার ভাইয়ের আম্মু নিশ্চয়ই এটা শুনে একটু শান্ত হতে পেরেছেন।এটা মাথায় আসা মাত্রই আমি রাহাতকে জিগ্যেস করলাম,"আতাহার ভাইয়ের আম্মা খবরটা পাইসে?"
-কি কন ভাই পুরা এলাকার সবাই জানে।মিলিটারির তো মনে হয় ডরে মুইত্তা দিতাসে।হালার বাড়ি থেইক্কা লাশ বাইর করার সময় শুনি কইতাসে-ক্যায়সে গোলি কিয়া?পাতা হি নেহি চালা..................
-এলাকার কি খবর?ভাইয়েরা বের হতে পারসে তো?
-"পারবো না আবার?আর যাওনের সময় আফনের আব্বার পিস্তল আমারে দিয়া গেসে।এই লন" বলে আমার হাতে পিস্তল টা ধরিয়ে দিলো।আরে!!!!!সাইলেন্সার টা কই?রাহাতকে জিগ্যেস করতেই সে বলল,"ভাই কইসে এইডার একটা অংশ পরে ফেরত দিবো।এহন খালি এইডাই দিসে আমারে।"বলে সে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।এখন আব্বুর রুমে যেতে হবে।যেখানকার জিনিস সেখানেই ফেরত যাক। আব্বুর রুমে ঢুকে দেখলাম রুমে কেউ নাই।তাই আলমারি খুলে পিস্তলটা গান কেসে রাখতে যাবো,এই সময় আব্বু রুমে ঢুকে পড়লো আর আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো আব্বুর।আমার হাতে পিস্তল দেখে আব্বু মনে হলো এক মুহূর্তেই সব বুঝে গেছে।আমার দিকে হিসহিস স্বরে বললো,"কালকে রাতের কাজটা তাহলে তুমি করেছো?"
আমার পা মনে হয় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে।এইভাবে ধরা পড়ে যাবো সেটা বুঝতে পারিনাই।কিন্তু এখন ভয় পেলে চলবেনা।তাই গলা একটু কঠিন করেই বললাম,"আমি কেন করবো?যার বাবা পুড়ে মরেছে,সেই গিয়ে কাজটা করে এসেছে।আমি খালি পিস্তলটা ধাঁর দিলাম শুধু।দুই একটা পাকিস্তানি মরলে তোমার আশা করি আপত্তি থাকার কথা না।"
-আপন তুমি অতিরিক্ত করে ফেলেছ।তারা যদি তোমাকে ধরতে আসে তখন কি করবে?আমরা কিন্তু তখন তোমাকে হেল্প করতে পারবো না।
-"স্টপ ইট ড্যাড" বলে চিৎকার করে উঠলাম আমি।"তিন বছর আগেও আমরা ট্রেসপাসিং করার জন্য দুই ডাকাতকে ঘরের সামনে শুট করেছিলাম ভুলে গেছো?আমাদের ঘরের সামনে ডাকাত আসলে তুমি শুট করতে পারো,আর আমার দেশের মানুষকে তারা কিল করছে আর আমরা বসে বসে দেখবো?এতোটা কাওয়ার্ড হলে কবে থেকে ড্যাড?"
আমার কথা শেষ করার সাথে সাথে বাম গালটা জ্বলে উঠলো কেন জানি।আব্বু এতো জোরে হাত চালিয়েছে যে আমি বুঝতেও পারিনাই যে আমাকে চড় মারা হয়ে গেছে।গাল ডলতে ডলতে আমি আব্বুকে বললাম,"যদি আমাকে সহ্য না হয় তাহলে বল।আমি যুদ্ধে জয়েন করবো গিয়ে।ল-মার্শালদের কাউণ্টিতে জন্মেছি আমি।আমার শিক্ষা আমাকে ট্রেইটর বানায়নি। আমার কথা শুনে আব্বু কিছু না বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।আমি পিস্তলটা হাতে নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে দাড়িয়ে থাকলাম।আব্বু যদি সত্যিই কোন স্টেপ নেয় তাহলে আমি এক মুহূর্তও ওয়েট করবো না।আপাতত পিস্তল টা জায়গামতো রেখে দিলাম,দরকার পরলে পুরা গানকেস একেবারে তুলে নিয়ে যাবো।এই অস্ত্র এখানে পড়ে থাকার চেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি দরকার।
দুই ঘণ্টা পরে,প্রায় সকাল ১১ টা বাজে তখন,আব্বু লিভিং রুমে গিয়ে ঘোষণা দিলেন এক সপ্তাহের মধ্যে নাকি আমরা অ্যামেরিকা ব্যাক করবো।আর দাদাও নাকি আমাদের সাথে অ্যামেরিকা যাবেন।শুনে আমার মেজাজটাই গরম হয়ে গেলো।আমাকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রাখার কি উদ্ভট চেষ্টা!!!!ফাইন......তোমরা যা খুশি ডিসিশন নিতে থাকো,কালকে রাতের মাঝেই আমি পালিয়ে যাবো।এইরকম অবস্থাতে আমার দেশ আগে,তোমরা না।এইরকম ভাবতে ভাবতে আমি সময় কাটানোর চেষ্টা করছি,এর মাঝে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হচ্ছে হচ্ছে ভাব।হটাত ইঞ্জিনের শব্দ পেয়ে চমকে উঠলাম,এখন আবার কে আসলো?জানালার কাছে সরে এসে দেখি বাসার বাইরে একটা মিলিটারি জিপ থেমেছে।সর্বনাশ!তারা জেনে গেলো নাকি?আমি পিছনের জানাল বেয়ে পালানোর জন্য সরতে গিয়েই দেখলাম সেদিনের সেই মেজর হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে নামছে।তার মানে কি আমাকে ধরতে আসেনাই?হটাত আতাহার ভাইয়ের নির্দেশ মাথায় ঢুকলো,উনি তো এদের কাছে কাছে থাকতে বলেছিলেন,ইনফরমেশন যোগার করতে বলেছিলেন।তাই বহুত কষ্টে মুখে সামান্য হাসি হাসি ভাব নিয়ে দাদার রুমের দিকে গেলাম।রুমে ঢুকা মাত্র মেজর আমাকে দেখে হাসি দিয়ে বলল,হাউ আর ইউ,বয়?"আমি সুন্দর করে জবাব দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম।এরপর দেখি এই মেজর আমাদের সবার পাসপোর্ট আর প্লেনের টিকিট টেবিলে রেখে বলল,"স্যার,ইয়ে রেহি আপলোগোকা প্লেন কা টিকিট।মাগার আপ পারসু হি চালে জানা চাতেহে?"
দাদা তখন বলল আমরা নাকি সবাই এই গণ্ডগোলের সুযোগে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে চাচ্ছি।তাই এতো তারাতারি করে চলে যাওয়া।এর মাঝে আবার দাদা দেখি সৌজন্য দেখিয়ে মেজরের জিপে ৫ কেস বিয়ার আর ২ কেস হুইস্কি উঠিয়ে দিতে বলল সারভেন্টকে।আজকে রাতের খাবার নাকি আমাদের এখান থেকেই যাবে।মেজর তো খুশিতে গদগদ হয়ে দাদার পা ছুঁয়ে সালাম করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো এবং যাওয়ার আগে বলে গেলো পরশু নাকি আমাদের এস্কর্ট করে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিবেন।এইসব দেখে ঘৃণায় আমি এই বুড়ার দিকে তাকাতে পারছিলাম না।এমন বেজন্মার ঘরে ক্যান জন্মালাম আমি সেটাই বুঝতে আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব...............
রাত ৯ টার দিকে আম্মু রুমে এসে বললো টেবিলে ডিনার দেয়া হয়েছে।আজকে আমার কিছুই খেতে ইচ্ছা করছিলো না।যেই বাসা থেকে পাকিস্তানি বাস্টার্ডদের জন্য খাবার পাঠানো হয়েছে একটু আগে,সেই বাসার খাবার মুখে দিতে রুচিতে বাধছে।আম্মুর দিকে আমি তাকিয়ে বললাম,"আম্মু আমি খাবো না"
-হোয়াই মাই সান,এনিথিং রং?
-আম্মু এই বাসা থেকে পাকিস্তানিদের জন্য খাবার পাঠিয়েছ,আবার তুমি আমাকে এই বাসার খাবার খেতে বল?কালকে সকালে পারলে টাকা দিও,আমি হোটেলে গিয়ে খাবো।
কথাগুলো মনে হয় একটু বেশি জোরেই বলে ফেলেছিলাম।কারন সামনে তাকিয়ে দেখলাম আব্বু আর দাদা দরজার সামনে দাঁড়ানো।দাদা তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,"আপন,একটু পরে তুমি আমার রুমে আসবে।ঠিক আছে?"বলেই তিনি রুমের সামনে থেকে চলে গেলেন।আব্বুও আম্মুকে বলল রুম থেকে চলে আসতে।আমার একা খুব জিদ উঠতে থাকলো এদের সবার উপর।উফ...এটা কোন রাজাকারদের মাঝে এসে পড়লাম!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
বুড়া খাটাশটার রুমের ভিতরে ঢুকে দেখি খাটাশটা দোল খাচ্ছে রকিং চেয়ারে।আমার পায়ের শব্দ পেয়ে তিনি চোখ খুলে বললেন,"তোমাকে ডেকেছি কয়েকটা কথা জানতে।তোমার কি মনে হয়,আমি ভালো না খারাপ?" প্রশ্ন শুনে আমার হাসি পেয়ে গেলো।আমি বললাম,"আপনি আপনার দেশে মানুষদের সাথে বেঈমানি করছেন।এখন আপনিই ভাবেন যে আপনি ভালো না খারাপ"..........
আমার উত্তর শুনেও উনার চেহারাতে তেমন কোন পরিবর্তন দেখলাম না।একমনে দোল খেতে খেতে হটাত তিনি আস্তে করে বললেন,"আজকে রাতে মিলিটারি ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনী আক্রমন চালাবেন।জানো এটা"? আমি পুরা শকড হয়ে গেলাম।আজকে রাতে মুক্তিবাহিনী আক্রমন করবে!!!!!!!!!!আমাকে তো রাহাত কিছুই জানাল না!আর এই খাটাশ জানলো কেমনে এই কথা?আমি উনার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে জিগ্যেস করলাম,"আপনি কোথা থেকে শুনলেন?"
-আমার শোনার কথা কারন পরিকল্পনা টা আমার।আজকে রাতে বিয়ার আর হুইস্কি সেজন্যই পাঠিয়েছি আমি।
ধীরে ধীরে আমার কাছে সব পরিস্কার হতে থাকলো।আসলে দাদা লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হেল্প করতে চাচ্ছেন!!
-কিন্তু এলাকার সবাই ভাবছে আপনি পাকিস্তানিদের সাহায্য করেন!!!!
-হ্যাঁ করিতো।কিরকম সাহায্য করি তা আজকে রাতেই বুঝবে।এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে,তুমি কি আজকে রাতে যুদ্ধে যেতে চাচ্ছ?
আমি বুঝতে পারলাম না দাদা আমাকে এই প্রশ্ন কেন করছেন।আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দাদা বুঝতে পেরে বললেন,"আচ্ছা আমি ভেঙ্গে বলছি।মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমন করার প্ল্যানটা আরও এক সপ্তাহ পরের।কিন্তু তুমি আতাহারকে দিয়ে এমন একটা বোকামি করিয়েছ যার জন্য প্ল্যানটা আজকে রাতের মধ্যেই কার্যকর করতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের।কিন্তু এখনো আমাদের সব ফাইটার এসে পৌছাতে পারেনাই।যেহেতু তুমি ভালো শুটার,তাই তুমি কি আজ রাতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবে?"
আমি কোন ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না বলার মতো।পিছনে পায়ের শব্দ শুনে দেখি দরজার কাছে আব্বু দাঁড়ানো।আব্বুর চোখেও নগ্ন উল্লাস।আমি তাই আব্বুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,"তুমিও যাচ্ছ নাকি?"
আমার আব্বু জবাব দিলো,"শুটিং শিখালাম আমি তোকে,আর আমার উপরেই বাটপারি,না?আজকে দেখবো কে কতোগুলা টার্গেট হিট করে।"বলেও আব্বু হেসে দিলো।আমারও অনেক হাসি পাচ্ছিল।আসলেই আমি গাধা।নয়তো সহজেই আমার বুঝা উচিত ছিল যে আব্বা আসলে আমাদের সাপোর্ট করছেন।আমি দাদার দিকে তাকালে তিনি বললেন,আজ রাত ঠিক সাড়ে তিনটার দিকে আক্রমন করবে আমাদের ছেলেগুলা।তাই তোমরা তোমাদের অস্ত্র নিয়ে বের হয়ে যাও এখন।বাড়ির বাইরে মনির দাঁড়ানো,তার সাথেই যেতে হবে তোমাদের।আমি এদিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করি।আমি আর রোখসানা মিলে সব গুছিয়ে ফেলছি।এখন যাও।হাতে সময় কম...............
আমি আর আব্বু রুমে ঢুকার পরে আলমারির কাছে গিয়ে আলমারিটা খুললো আব্বু।গানকেসে দুইটা রাইফেল রাখা।একটা M1 রাইফেল,আরেকটা উইনচেষ্টার কোম্পানির একটা বোল্ট অ্যাকশন মার্কসম্যান রাইফেল।রাইফেলটার গায়ে আমি আলতো করে হাত বুলালাম।এইটা দিয়ে গত ১০ বছরে কতো কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছি তা আর গুণে রাখিনাই........................
আব্বু তখন M1 টা হাতে নিয়ে বলল,"মাই সান,আজকে কিন্তু বুলস আইতে শুট করছ না তুমি।কোন ভুল করো না বাবা,কারন তোমার কিছু হলে তোমার আম্মুকে আমি কি জবাব দিবো,বল?প্রমিস করো,আজকে সাবধানে থাকবে?"
-ড্যাড,টেনশন করো না।আজকে আমরাও ফ্রিডম ফাইটার।আজকে কোন পিছুটান নিয়ে ভাবার টাইম নাই।উইশ মি লাক,ড্যাড......
রাত তিনটা বেজে আঠারো মিনিট।ঘড়ির লুমিনাস ডায়ালের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলাম আরেক বার।চাঁদটা এক ঘণ্টা আগেও মাথার উপরে ছিল।এখন সামান্য একটু চাঁদ,সেটাও পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে।সোয়া এগারোটা থেকে আমি এই তিন তালা বিল্ডিঙের ছাদে শুয়ে আছি রাইফেলের স্কোপে চোখ রেখে।দেড়শ মিটার দুরেই হাইস্কুল যেখানে মিলিটারি ক্যাম্প। ইনফ্রারেড স্কোপের কারনে পুরো জগতটাই আমার কাছে লাল হয়ে আছে।এই তিন ঘণ্টাতে একবারও নড়তে পারিনাই।স্কুলের মুখ বরাবর এই বিল্ডিংটা।স্কুলটাকে চারদিক দিয়ে এর মাঝেই মুক্তিবাহিনী ঘিরে ফেলেছে,নিঃশব্দে।আব্বু আর আতাহার ভাই এক সাথেই বট গাছের পিছনে লুকিয়ে আছে।চারদিকে সামান্য ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পর্যন্ত নেই আজকে।খালি সামান্য ঠাণ্ডা বাতাস আসছে উত্তর থেকে।আমি কেন জানি হটাত খুব কেঁপে উঠলাম।প্রচণ্ড শীত করছে কেন জানি।৯০ টা বুলেটের স্টক নিয়ে এসেছি আমি,জানিনা আজকে এর মাঝে কয়টা টার্গেট হিট করবে।আজকে আমার দায়িত্বটাই মনে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।স্কুলের ছাদে উঠে কোন মিলিটারি যেন প্রতিরক্ষার সুযোগ না পায়,সেটা দেখবো আমি আর মাত্র বার মিনিট পর থেকে।কিন্তু আমার আরও একটা কাজ আছে,আব্বুকে কভার দেয়া।আজকে আব্বুর যেন কিছুই না হয়,আমি হতে দিবোনা।দাঁতে দাঁত চেপে আমি ঠিক সাড়ে তিনটা বাজার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
স্কুল প্রাঙ্গনে তাবু খাটিয়ে যেই সৈন্যগুলো ঘুমাচ্ছিল,তাদের ঘুম গ্রেনেড গুলো ফাটার আগেই ভেঙ্গে যাবে বলে মনে হয়নি,তাদের ঘুম ভাঙ্গলই না আর।স্কোপে তাকিয়ে দেখতে পারলাম প্রায় এক সাথে তেরটির মতো গ্রেনেড ছুঁড়েছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা।তাঁবুগুলোর উপরে পড়ার দুই সেকেন্ডের মাঝেই প্রায় সবগুলো একসাথে বিস্ফোরিত হলো,তাবুর ভিতরে থাকা সৈন্যদের গা তখনই স্প্লিন্টারময় হয়ে গেলো।দশ সেকেন্ডের মাঝে পুরো এলাকা চিৎকার,আর্তনাদে ভরে গেছে ততক্ষনে। হুড়োহুড়ি করে পজিশন নেয়ার আগেই পাকিস্তানি বেশ কয়েকটা সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রান হারাল।এর মধ্যে আব্বু পাগলের মতো স্কুলের টিচার্স রুমের দিকে গুলি করছে।সেই দিকে কেউ আছে কিনা দেখতে পারলাম না তবে স্কোপে ধরা পড়লো দুইটা সৈন্য সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠার চেষ্টা করছে।বুঝলাম এখন আমার কাজ।জীবনে এই প্রথম আল্লাহর নাম নিয়ে রাইফেল টা একটু উচু করলাম।
সিঁড়ি দিয়ে দুই নাম্বার সৈনিকটা ছাদে উঠার আগেই দেখল প্রথম সৈনিকের বুকে যেন কেউ একটা অদৃশ্য লাত্থি মেরে দিলো।প্রথম সৈনিক ছাদের মধ্যে পরে যাওয়ার আগেই দ্বিতীয় সৈন্যর গলা বরাবর .305 ক্যালিবারের একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিলাম।ইয়েস.........পারফেক্ট হিট।আশেপাশের বিল্ডিংগুলাতে ততক্ষনে আলো জ্বলে উঠেছে।তাই আমার মাজল ফ্ল্যাশ ধরা পরবে না ভেবে আরেকটু রিলাক্সড হলাম।এইবার স্কুল কম্পাউন্ড এর দিকে রাইফেল নামালাম।বেশিরভাগ সেনাই মরে গেছে।কিন্তু স্কুলের গেটের পিছনে বালির বস্তা ফেলে বানানো বাঙ্কারের পিছনে এখনো ছয় সাত জন সৈন্য এখনো আছে।বালির বস্তাগুলোর কারনে মুক্তিযোদ্ধারা এখনো সামনে আগাতে পারছে না।এর মধ্যে দেখলাম মনিরকে গুলি করেছে তারা।বেচারা মনে হয় মারাই গেছে অথবা মারা যাচ্ছে।বালির বস্তার ঠিক ২ ইঞ্চি উপরে তাই আমি একের পর এক গুলি করতে থাকলাম যাতে তারা মাথা উচু করার সময় না পায়।এই ফাকে মুক্তিযোদ্ধারা স্কুলের ভিতরে ঢুকে পরেছে।এর মাঝেই আমি বালির বাস্তার উপর গুলি চালিয়ে যাচ্ছি,হটাত একটা গুলি লেগে গেলো ঠিক নিশানাতে..............................
আমি স্কোপে চোখ রেখে গুলি করে যাচ্ছি,ঠিক এই মুহূর্তে একজন মাথা উচু করলো।দৈবক্রমে আমি ঠিক সেই সময়ই ফায়ার ওপেন করেছি।আমি স্কোপে চোখ রেখে স্পষ্ট দেখতে পারলাম গুলিটা ঠিক ডান চোখের ভিতর দিয়ে চলে গেলো।"বুলস আই" বলেই আমি নজর দিলাম বালির বস্তা গুলোর দিকে।এর মাঝেই রাসেল ভাই এক হাতে দুইটা গ্রেনেডের পিন খুলে বাঙ্কারের দিকে থ্রো করলেন।তিন সেকেন্ড পরে কেন জানি মনে হল গ্রেনেড ফাটার শব্দে পাকিস্তানি কুত্তাগুলার চিৎকার ঢাকা পরে গেছে।ইয়েস!!!!!!!!!!!! করে দেখিয়েছি আমরা...................................................
পাঁচ মিনিটের মাঝেই পুরো এলাকাবাসী স্কুলের সামনের দিকে যেতে শুরু করলো।ততক্ষনে মুক্তিযোদ্ধাদের "জয় বাংলা" আমার কান পর্যন্ত এসে গেছে।আশ্চর্য!এই হাল্কা শীতের মধ্যেও আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে।এতো এক্সাইটমেন্ট আজ পর্যন্ত হয় নাই।কেন জানি মনে হচ্ছে দেশ টা স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে...............
এই লেখাটা পুরোটাই বানিয়ে লেখা।রাজাকারদের বিরুদ্ধে মনের ঝাল ঝাড়তে গিয়ে কিভাবে জানি লেখাটা নেমে গেছে।অতিরিক্ত মাসুদ রানা পড়ার কারনে মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান একটা বিষয়ের মাঝে আমি সামান্য থ্রিলার ভাব এনে ফেলার ধৃষ্টতা করেছি বলে ক্ষমা চাচ্ছি।
আমি যুদ্ধ দেখেছি আমার নানার ভাইয়ের চোখে,মুক্তিযোদ্ধা আত্মীয়দের চোখে......আমি বই পত্র পড়ে মুক্তিযুদ্ধ বুঝতে চাইনি।আমি জানি,আবেগ কখনো বইয়ের লেখা দিয়ে ফুটিয়ে তোলা যাবেনা।আমি মাঝে মাঝেই চিন্তা করি আর আফসোস করি কেন আমার জন্ম ৫০ বছর আগে হলো না?কেন আমি আমার দেশটাকে স্বাধীন করার যুদ্ধে যেতে পারলাম না?আফসোস করি কেন এখনো এই সাপগুলো জাতীয় পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ঘোরার সুযোগ পায়?কেন?
মুক্তিযোদ্ধারা নিজের বাবা-মা,ভাই-বোনের জীবনের বিনিময়ে আমাদের জন্য একটা দেশ কেড়ে এনেছে।ত্রিশ লক্ষ প্রানের ইস্পাতকঠিন গাথুনির উপর আমার এই দেশটা দাড়িয়ে আছে।এই গাথুনিকে দুর্বল করার সুযোগ কি আমরা দিতে পারি?দেশটাতো আমাদেরই।আমরা সবাই এর কাছে ঋণী।আমরা সবাই এর যোদ্ধা....................................
©somewhere in net ltd.